[লীলাবতীর মৃত্যু নিয়ে লেখন হুমায়ুন আহমেদের একটি লেখা আছে। প্রকাশিত লেখা। লেখাটি পড়ে মনে হলো, মিসির আলি কি কখনো হুমায়ূন আহমেদের কোনো সমস্যা সমাধান করেছেন ? সেই চিন্তা থেকেই লেখাটি লেখা। হুমায়ূন আহমেদের অন্নান্য ক্যারেক্টার এর মতো -মিসির আলিও আমার অনেক প্রিয় একটি ক্যারেক্টার। হুমায়ুন আহমেদ চলে যাওয়ার পরে অনেক ভেবেছি, মিসির আলি কে নিয়ে লেখার, সাহস হয় নি।আমি মনে করি হিমু, মিসির আলি অথবা শুভ্রর মধ্যেই হুমায়ূন আহমেদ লুকিয়ে আছেন, আমার খুঁজতে অসুবিধা কোথায় ? মিসির আলীর ছবিটি বিং দিয়ে তৈরী , লেখাটি আমার নিজের। ]
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছে। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু আকাশের মেঘগুলো এখনো ঘন কালো — যেন কোনো অদৃশ্য যন্ত্রণার ছায়া। ঠান্ডা বাতাস বইছে। মিসির আলী তাঁর রুমের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলেন। জানালার ধারে রাখা পুরনো কাঠের চেয়ারটিতে আধখোলা অবস্থায় পড়ে আছে “নীল প্রজাপতি”- লেখক হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে সফল উপন্যাস।
নীল প্রজাপতি- বইটি প্রকাশের পর থেকেই পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সমালোচকরা এটিকে বাংলা সাহিত্যের একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু তারপর থেকে লেখক আর কোনো লেখা প্রকাশ করেননি।
মনে হচ্ছে যেন লেখক হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন।
এই বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের একটি লেখা মিসির আলি অবশ্য পড়েছেন।
লেখাটির নাম লেখক বনধ।
লেখক হুমায়ূন আহমেদ লেখক বনধ সম্পর্কে লিখেছেন : “রাইটার্স ব্লক ব্যাপারটা সম্পর্কে একটু ব্যাখ্যা করে বলি। এটা এক ধরনের অসুখ। সাধারণ পর্যায়ে অসুখের লক্ষণ হচ্ছে–লিখতে ইচ্ছা না হওয়া। মাথায় গল্প আছে, কিন্তু লিখতে ইচ্ছা করছে না। সাধারণ এই অসুখ সর্দিজ্বরের মতো কোনোরকম চিকিৎসা ছাড়াই আরাম হয়। এই অসুখ সাতদিনের মধ্যেই সারে। এই রোগে রোগী (অর্থাৎ লেখক) মারাও যান। নোবেল পুরস্কার পাওয়া জাপানি ঔপন্যাসিক কাওয়াবাতা হারিকিরি করে মারা গিয়েছিলেন। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে অনেকেই লিখতে না পারার কষ্টের কথা বলেছেন। যে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না।”
হুমায়ূন আহমেদ কি তবে রাইটার্স ব্লক অসুখে ভুগছেন ?
মিসির আলি জানালার কাচে আঙুল বুলালেন। বৃষ্টির ফোঁটা এখনো গড়িয়ে পড়ছে। তিনি ভাবছিলেন মানুষের মনের জটিলতা নিয়ে। কীভাবে হুমায়ুন আহমদের মতো একজন সফল লেখক, হঠাৎ করে লেখা বন্ধ করে দিতে পারেন ? কী সেই অদৃশ্য শক্তি যা তার সৃজনশীলতাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে ? ?
“স্যার, চা দিয়ে যাই?” — রহমত এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে।
মিসির আলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।
“হ্যাঁ, দাও। আর শোনো, হুমায়ূন আহমেদ এলে সরাসরি পাঠিয়ে দিও। আজ উনি প্রথমবার আসছেন। উনাকে যেন অপেক্ষা না করতে হয়।”
রহমত চলে যাওয়ার পর মিসির আলি নীল প্রজাপতি বইটি খুললেন ।
প্রথম পাতায় লেখা — “যাঁরা নীরবতার ভাষা বোঝে , তাঁদের জন্য।” উৎসর্গ বাক্যটি পড়ে তিনি একটু হাসলেন। মানুষের মন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি জেনেছেন, নীরবতারও একটা ভাষা আছে। প্রতিটি নীরবতার পিছনে লুকিয়ে থাকে এক গভীর কারণ। সমস্যা সমাধানে — সেই ভাষা বোঝার চেষ্টা করতে হয়।
ঘরের দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটা তিনটে বাজার শব্দ করলো।
দরজায় নক করার শব্দ হলো।
লেখক হুমায়ূন আহমেদ ঘরে ঢুকলেন ।
লেখকের চেহারায় একটা গভীর ক্লান্তি স্পষ্ট। চোখের নিচে কালি, চুলগুলো অগোছালো। পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। চোখে মুখে এক না বলা অস্থিরতা — যেন নিজের সাথেই লড়াই করছেন প্রতি মুহূর্তে।
“আসুন হুমায়ূন সাহেব, বসুন।” — মিসির আলি নরম সুরে বললেন, সামনের সোফার দিকে ইশারা করে।
হুমায়ূন আহমেদ বসলেন। তাঁর চোখ পড়লো টেবিলের উপর রাখা “নীল প্রজাপতি” বইটির দিকে। একটু যেন চমকে উঠলেন। চোখে-মুখে এক অস্বস্তিকর ভাব ফুটে উঠলো।
“আপনার বইটা পড়ছিলাম। চমৎকার লিখেছেন। বিশেষ করে গণিতের অধ্যাপকের চরিত্রটি। একজন যুক্তিবাদী মানুষ যুক্তিকে আশ্রয় করে কিভাবে এগিয়ে যায় সেটি খুব সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।”
“ধন্যবাদ।” — হুমায়ূন আহমেদ এর বেশি কিছু বললেন না। তাঁর চোখে একটা অস্থির দৃষ্টি।
“কতদিন হলো লেখেন না?” -চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মিসির আলি
প্রশ্ন করলেন ।
“প্রায় দেড় বছর।” — হুমায়ূন আহমেদ যেন নিজের কানেই বিশ্বাস করতে পারছেন না।
মিসির আলি স্থির দৃষ্টিতে হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এই দৃষ্টি কঠোর নয়, বরং করুণায় ভরা।
এমন দৃষ্টি যা মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করে, কিন্তু সেখানে কোনো আঘাত করে না।
“আপনি জানেন হুমায়ূন সাহেব, আমি লেখকদের খুব শ্রদ্ধা করি। কারণ তারা যা করেন, তা অসাধারণ। তারা মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করতে পারেন। আমি মিসির আলী যা করি যুক্তি দিয়ে করি , তারা তা করেন অনুভূতি দিয়ে । কারণ তারা মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করতে পারেন।
তারা যন্ত্রণাকে রূপ দিতে পারেন, শূন্যতাকে শব্দে বাঁধতে পারেন।”
লেখক হুমায়ূন আহমেদ একটু অস্বস্তি নিয়ে বললেন, “কিন্তু আমি তো আর লিখি না। আমি… আমি সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি।”
“হ্যাঁ, এই কারণেই তো আমার কাছে এসেছেন ? তাই না?”
হুমায়ুন আহমেদ মাথা নাড়লেন। তাঁর চোখে জমে উঠলো অসহায়ত্বের ছায়া।
“আমি লিখতে পারি না। বসি, কলম হাতে নিই, কাগজ সামনে রাখি। কিন্তু একটা শব্দও বের হয় না। মনে হয় আমার ভেতরের সব শব্দ যেন কেউ নিঃশব্দে চুরি করে নিয়ে গেছে। যে শব্দগুলো আগে ট্রেনের মতো মাথায় ঝিক ঝিক করতো, এখন আর করে না।”
রহমত আবার চা নিয়ে এলো। বাইরে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আকাশের রং বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
মিসির আলি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “আপনার শেষ বইটা, ‘নীল প্রজাপতি’ — এর মূল চরিত্র একজন গণিতের অধ্যাপক । সে একজন গণিতজ্ঞ, যে বিশ্বাস করে সব কিছুর পিছনেই একটা যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা আছে। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি আচরণ — সব কিছুর পিছনে একটা গাণিতিক সমীকরণ খুঁজে পায় সে। কিন্তু তার জীবনে এমন কিছু ঘটে যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তার জীবনের একটা ঘটনা , যা সব হিসাব-নিকাশের বাইরে।”
“হ্যাঁ।” — হুমায়ূন আহমেদের চোখে একটা আলো জ্বলে উঠলো যেন।
“আপনি কি জানেন, এই চরিত্রটা অনেকটা আপনার মতো?”
“আমার মতো?”
“হ্যাঁ। আপনিও তো যুক্তি দিয়ে লেখেন। আপনার প্রতিটি গল্পের প্লট খুব পরিকল্পিত। চরিত্রগুলো স্পষ্ট। ঘটনার প্রতিটি মোড় আগে থেকে ভেবে রাখা। আপনি যেন একজন আর্কিটেক্ট , যিনি প্রতিটি ইট কোথায় বসবে, আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন। কিন্তু ‘নীল প্রজাপতি’তে আপনি প্রথমবার আবেগকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। অবশ্য খুব সুক্ষভাবে। সাধারণ মানুষের চোখ এড়িয়ে যাবার কথা।”
হুমায়ূন আহমেদ চুপ করে রইলেন। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই দিনগুলো। যখন তিনি ‘নীল প্রজাপতি’ লিখছিলেন। যখন তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা তাঁর লেখক জীবনকে পাল্টে দিয়েছিল।
“আমাকে বলুনতো হুমায়ুন সাহেব, বই লেখার সময়ই আপনার জীবনে কি বিশেষ কিছু ঘটেছিল?”
হুমায়ূন আহমেদ চমকে উঠলেন।
“আপনি কী করে জানলেন?”
“আমি জানি না। আন্দাজ করছি। কারণ আপনার আগের লেখাগুলো পড়ে মনে হয়েছে, আপনি একজন পরিকল্পনা প্রিয় লেখক। আপনার লেখাগুলো যেন একটা সুনির্দিষ্ট গণিতের সমাধানের মতো। কিন্তু ‘নীল প্রজাপতি’তে আপনি নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। লিখেছেন মন থেকে, পরিকল্পনা করে নয়। সেখানে একটা ব্যথার ছোঁয়া আছে, যা আপনার আগের লেখায় ছিল না।”
বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানালায় টুপটাপ শব্দ।
রুমের আবছা আলোয় হুমায়ূন আহমেদের আহমেদকে আরো বিষন্ন লাগছিলো।
তিনি উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালেন। যেখানে কিছুক্ষণ আগে মিসির আলি দাঁড়িয়েছিলেন।
“আমার মেয়েটা … লীলাবতী চলে গেছে-নীল প্রজাপতি’ লেখার সময়। হঠাৎ করে। কোনো কারণ না জানিয়ে।” — হুমায়ূন আহমেদের কণ্ঠে একটা অস্পষ্ট কাঁপুনি।
মিসির আলি চুপ করে শুনতে লাগলেন। কখনো কখনো চুপ থাকলে অনেক কিছুর অর্থ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
“আমি বুঝতে পারিনি কেন। লীলাবতীর মৃত্যু -আমি মেনে নিতে পারি নি। । আমি সব সময় মনে প্রাণে মেয়েটির কথা ভাবতাম। লীলাবতীর সেই ছোট ছোট হাতের স্পর্শ পেতে চাইতাম। প্রতিবার যখন কলম হাতে নিই, তখন শুধু একটাই শব্দ মনে আসে — লীলাবতী । আর তারপরেই সব শব্দ হারিয়ে যায়।”
মিসির আলি আরো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এই নীরবতার মধ্যে যেন তার কানে ভেসে এলো একটি ছোট্ট শিশুর কান্নার শব্দ। প্রতিটি মৃত্যু একটি গল্প রেখে যায়। কিন্তু যখন সেই মৃত্যু একটি নবজাতকের হয়, তখন সেই গল্প হয়ে ওঠে অন্যরকম ।
“সেই দিন থেকে আমি আর লিখতে পারি না। বসি, কলম হাতে নিই। কিন্তু মনে হয় আমার সব শব্দ যেন লীলাবতীর সাথে সঙ্গে চলে গেছে।”
মিসির আলী উঠে গিয়ে হুমায়ুন আহমেদের পাশে দাঁড়ালেন।
“কিন্তু আপনি তো লিখেছিলেন। ‘শূন্যতার সীমানা’ — এই বইটা তো লিখেছেন লীলাবতী চলে যাওয়ার পরে, যদিও গল্পটি প্রকাশ হয়নি, আমাকে পাণ্ডুলিপি দিয়েছেন বলে জেনেছি ।”
“হ্যাঁ। কারণ তখন আমার মনে হয়েছিল, হয়তো লেখার মধ্য দিয়ে আমি এই ব্যথাটাকে বোঝাতে পারব। যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারব কেন এই চলে যাওয়া । কিন্তু লিখতে লিখতে বুঝলাম, কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তারপর থেকে আর লেখা আসে না ।”
“কারণ আপনি এখনো যুক্তি খুঁজছেন। কিন্তু মৃত্যুর কোনো যুক্তি নেই হুমায়ূন সাহেব। বিশেষ করে যখন সেই মৃত্যু একটি শিশুর।”
হুমায়ুন আহমেদ অস্পষ্টভাবে বললেন, “আমার স্ত্রী বলে, আমি নাকি নিজেকে বন্দি করে রেখেছি। সে বলে, লীলাবতী চলে গেছে, কিন্তু আমি তাকে ধরে রাখতে চাইছি। কিন্তু আপনি বুঝবেন মিসির আলি সাহেব , একজন বাবা কীভাবে তার মেয়েকে ভুলে যায়? কীভাবে সে তার স্মৃতিকে মুছে ফেলে?”
মিসির আলি ধীরে ধীরে বললেন, “ভোলার কথা কেউ বলছে না । কিন্তু আপনি কি জানেন, স্মৃতি ধরে রাখার দুটো উপায় আছে? একটা হলো তাকে আঁকড়ে ধরে থাকা, যা আপনি করছেন। আর একটা হলো তাকে রূপ দেওয়া, যা একজন লেখক করে।”
“বুঝতে পারছি না আপনার কথা ।”
“আপনার অনেক লেখায় আপনি যুক্তি দিয়ে গল্প বলতেন। ‘শূন্যতার সীমানা’য় আপনি প্রথমবার আবেগ দিয়ে লিখলেন। লিখতে গিয়ে আবেগের মধ্যে হারিয়ে গেছেন। আপনার ব্যথা এত গভীর যে তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না।”
“কী করব ? কীভাবে বেরিয়ে আসব?”
“লিখুন। কিন্তু এবার শুধু যুক্তি দিয়ে নয়, শুধু আবেগ দিয়েও নয়। দুটোর মিশ্রণে। লীলাবতীর স্মৃতিকে শব্দে বাঁধুন। তার জীবনকে অমর করে রাখুন আপনার লেখায়। একজন বাবার ব্যথাকে এমনভাবে লিখুন যেন পৃথিবীর সব বাবা তাতে নিজেকে খুঁজে পায়।”
হুমায়ূন আহমেদ অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “জানেন মিসির আলি সাহেব , লীলাবতীর জন্মের পর প্রথম যেদিন তাকে কোলে নিলাম, সেদিন তার চোখে যে দৃষ্টি দেখেছিলাম… মনে হয়েছিল যেন সে আমাকে চিনতে পারছে। তার ছোট্ট হাতটা আমার আঙুল চেপে ধরেছিল। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, পৃথিবীর সব লেখা বুঝি অর্থহীন। কোনো শব্দই বোধহয় এই অনুভূতিকে ধরে রাখার জন্য এনাফ না ।”
মিসির আলি একটু এগিয়ে এলেন। “কিন্তু আপনি তো সেই চেষ্টা এখনো করে যাচ্ছেন যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন,একটাই প্রশ্নের উত্তর — কেন কিছু জিনিস এমন অসময়ে চলে যায়?”
“হ্যাঁ। কিন্তু কোনো সূত্রই তো সেই উত্তর দিতে পারেনি।”
“হয়তো উত্তর পাওয়াটাই জরুরি নয় । হয়তো প্রশ্ন করাটাই যথেষ্ট। আর সেই প্রশ্নগুলোকে সাজিয়ে আপনার লেখায় রূপ দিন । যাতে অন্য কেউ যখন এই একই যন্ত্রণা নিয়ে একা বসে থাকবে, তখন আপনার লেখায় নিজেকে খুঁজে পাবে।”
বাইরে সন্ধ্যা নামছে। মিসির আলি দেখলেন ঘরের আবছা আলোয় লেখন হুমায়ূন আহমেদের মুখে একটা নতুন অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো।
“জানেন , আমি একটা স্বপ্ন দেখি। প্রায়ই। দেখি লীলাবতী বড় হয়ে গেছে। স্কুলে যাচ্ছে। আমি তার হাত ধরে হাঁটছি। সে আমাকে নানা প্রশ্ন করছে। আমি উত্তর দিচ্ছি। তারপর হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়… আর মনে হয়, এই স্বপ্নটাও যেন একটা অসম্পূর্ণ গল্প।”
মিসির আলি একটু ভাবলেন।
“আপনি কি জানেন , প্রতিটি মৃত্যু একটি অসম্পূর্ণ গল্প রেখে যায়? বিশেষ করে যখন সেই মৃত্যু একটি শিশুর, তখন সেই অসম্পূর্ণতা আরও বেশি করে ফিল হয়।”
“তাই তো আমি আর লিখতে পারি না । কারণ প্রতিটি গল্পই এখন আমার কাছে অসম্পূর্ণ মনে হয়। মনে হয় শুরু আছে ,শেষ নেই। “
“কিন্তু তাই বলে কি লেখা বন্ধ করে দেওয়া সমাধান? আপনি একজন লেখক। আপনার কাজ হলো এই অসম্পূর্ণতাকে শব্দে বাঁধা। এমনভাবে বাঁধা যাতে অন্য কোনো বাবা-মা যখন তাদের সন্তান হারাবে, তখন আপনার লেখায় সান্ত্বনা খুঁজে পাবে।”
হুমায়ূন আহমেদ চোখ মুছলেন।
“আপনি কি বলতে চাইছেন, আমার এই ব্যথাকে লেখায় নিয়ে আসতে ?”
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন।
“হ্যাঁ, ঠিক তাই। আপনি আগে যুক্তি দিয়ে লিখতেন। এখন আপনাকে দুটোর সমন্বয় করতে হবে। আবেগ এবং যুক্তি দুটোই। আপনাকে এমনভাবে লিখতে হবে যে তা সার্বজনীন হয়ে উঠবে। ।”
হুমায়ূন আহমেদ সোফায় গিয়ে বসলেন । আকাশে তখন সন্ধ্যা নামছে।
“কিন্তু কীভাবে শুরু করব ?”
“যেখান থেকে আপনার ব্যথাটা শুরু হয়েছিল। সেই সময় থেকে । যখন লীলাবতীর সংবাদ আপনি জানলেন । তার প্রথম কান্না, তার ছোট্ট হাতের স্পর্শ, তার মুখ — সব লিখুন। তারপর লিখুন তার মৃত্যুর কথা । কিন্তু এবার শুধু একজন বাবার দৃষ্টি দিয়ে নয়, একজন লেখকের দৃষ্টি দিয়ে।”
“আমি… আমি চেষ্টা করব মিসির আলি সাহেব ।”
“করুন। আর মনে রাখবেন, আপনার লেখার মধ্য দিয়ে লীলাবতী বেঁচে থাকবে চিরকাল। প্রতিটি পাঠকের হৃদয়ে।”
হুমায়ূন আহমেদ উঠে দাঁড়ালেন।
“আজ আসি ।”
“আসুন। আর হ্যাঁ, যখন লিখা শুরু করবেন, আমাকে জানাবেন।”
হুমায়ূন আহমেদ চলে যাওয়ার পর মিসির আলি আবার “নীল প্রজাপতি “ হাতে নিলেন।
কেন জানি তার মনে হলো , লেখক হুমায়ুন আহমেদ আবার লিখবেন।
এই ঘটনার প্রায় ২ সপ্তাহ পরের ঘটনা ।
মিসির আলীর টেবিলে একটা খাম। উপরে লেখা “মিসির আলি সাহেব , এটা আমার নতুন বই।” খামের ভেতরে একটা পাণ্ডুলিপি।
মিসির আলি প্রথম পৃষ্ঠা খুললেন। উৎসর্গ পাতায় লেখা:
“লীলাবতীর জন্য,
যে আমাকে শেখালো
যে জীবন যত ছোট হোক
তার আলো অনন্ত…”
“স্যার, হুমায়ূন আহমেদ এসেছেন।” — রহমত দরজায় দাঁড়িয়ে।
“নিয়ে এস ভিতরে।”
মিসির আলি সরাসরি হুমায়ূন আহমেদের চোখের দিকে তাকালেন।
এবার তার চেহারায় সেই পুরনো ক্লান্তি নেই। চোখে একটা স্থির দৃষ্টি।
“বসুন হুমায়ূন আহমেদ সাহেব। আপনার বই পড়ছিলাম।”
“কেমন লাগছে?”
“ভালো”
“জানেন এই বইটা লেখার পর থেকে আমি আর স্বপ্নে লীলাবতীকে বড় হতে দেখি না। এখন দেখি, সে ঠিক যেমন ছিল — একটা শিশু। আর সেই স্বপ্নে আর কোনো অসম্পূর্ণতা নেই।”
“কারণ আপনি তার গল্পটা সম্পূর্ণ করেছেন। আপনি বুঝেছেন যে জীবনের মূল্য তার দৈর্ঘ্যে নয়, তার অর্থে।”
লেখন হুমায়ূন আহমেদ একটু হাসলেন। “হ্যাঁ। আমার স্ত্রী ও তাই বলে।”
মিসির আলী পাণ্ডুলিপির শেষ পৃষ্ঠা খুললেন। পড়লেন শেষ লাইনগুলো:
“তোমার জীবন মাত্র ক্ষনিকের । লীলাবতী তুমি আমাকে শিখিয়ে গেছো যে, জীবনের পরিমাপ সময় দিয়ে হয় না, ভালোবাসা দিয়ে হয়। আর সেই ভালোবাসা অনন্ত…”
“এবার কী নিয়ে লিখবেন হুমায়ুন সাহেব ?”
“জানি না । তবে লিখবো এটুকু জানি।”
হুমায়ূন আহমেদ উঠে দাঁড়ালেন।
“আজ আসি । বাইরে স্ত্রী অপেক্ষা করছে। আমরা আজ লীলাবতীর কাছে যাব।”
মিসির আলি জানালা দিয়ে দেখলেন হুমায়ূন আহমেদ হেঁটে যাচ্ছেন।
রাইটার্স ব্লক কাটিয়ে উঠা লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
মাসনুন আহমেদ
১১ জানুয়ারী ২০২৪
রাত : ১০.৩০ মিনিট
(লেখা যদি ভালো লাগে জানাবেন)