পোস্টস

প্রবন্ধ

ভালোর প্রত্যাশা

২৩ জুন ২০২৪

সাজ্জাদুল করিম

ভালোর প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাদের জন্মগত ব্যাপার। আমরা সর্বদা ভালোটিই চাই। আমার শরীর ভালো হোক, স্বাস্থ্য ভালো থাকুক, আমি যেন দেখতে ভালো হই, আমার খাবার ভালো হোক, পোশাক-পরিচ্ছদ ভালো হোক, বাসস্থানটি ভালো হোক, একটি ভালো ক্যারিয়ার আমার হোক, আমার একজন ভালো জীবনসঙ্গী হোক, সন্তানরা ভালো হোক, পরিবার ভালো থাকুক ইত্যাদির প্রত্যাশা আমাদের চিরন্তন। এসব চাওয়া অমূলক বা অযৌক্তিকও নয় এবং এই প্রত্যাশাগুলো করাই উচিত। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিসত্তাটি ভালো হোক বা ব্যক্তি আমি ভালো হই সেটি আমরা কয়জন চাই? আমি ভালো মানুষ হই এরকম স্বপ্ন আমরা কি দেখি? অথচ এই স্বপ্নটিই সর্বাগ্রে দেখা উচিত। 

 

আমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে চায়, তার সন্তান খারাপ হোক, দুষ্ট হোক, প্রতারক হোক, সন্ত্রাসী হোক, অত্যাচারী হোক, দুর্নীতি পরায়ণ হোক, অমানুষ হোক? না, আমার কেউই এমনটি চাইনা। এমনকি সমাজের সবচেয়ে খারাপ মানুষটিও চায়না যে তার সন্তান খারাপ হোক। কিন্তু কেন যেন নিজের ব্যাপারে বা নিজের ব্যক্তিসত্তায় ভালোর এই প্রত্যাশাটি আমরা করতে চাই না। কেন যেন আমরা ভালো মানুষটি হতে চাই না। ধরুন, আম গাছের একটি চারা লাগালাম। চারাটি লাগানোর পরে আমরা কী প্রত্যাশা করি? আমরা প্রত্যাশা করি- চারাটি ধীরে ধীরে বড় হবে, সুবিস্তৃত হবে, পত্র-পল্লবে সুশোভিত হবে, সুবিশাল বৃক্ষে পরিণত হবে, সুমিষ্ট আম দেবে এরকমই তো? হ্যাঁ, ঠিক তাই। স্বভাবত আমরা এমনটিই চাইবো। এখন প্রশ্ন হলো, সুমিষ্ট আম পেতে আমরা সর্বপ্রথম কোন কাজটি করি? আমরা কিন্তু সবার আগে একটি ভালো, পোকামুক্ত, নীরোগ, সুস্থ বীজ বাছাই করি। অসুস্থ বা পোকাযুক্ত, দুর্বল বীজ থেকে কী ভালো চারা বা ভালো ফল আশা করা যায়? অথচ আমরা নিজেরা ভালো না হয়েও আমাদের সন্তানদের থেকে ভালোর সর্বোচ্চ প্রত্যাশাটুকু করি। যে প্রত্যাশাটি আমরা আমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে করি বা যে স্বপ্নটি আমরা আমাদের সন্তানদেরকে নিয়ে দেখি, সেই একই প্রত্যাশা আমরা আমাদের নিজেদের বেলায় করি না বা সেই একই স্বপ্ন আমরা আমাদের ব্যক্তিসত্তায় দেখি না। এ কেমন দ্বিচারিতা? 

 

একইভাবে আমরা উন্নত (ভালো) জাতি হওয়ার স্বপ্ন দেখি। উন্নত দেশগুলোকে অনুকরণ করি। তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, চাল-চলন, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার ইত্যাদি অনুকরণ করে আমরা আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে চাই। আর এক্ষেত্রে আমরা শুধুমাত্র আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অবকাঠামোগত অগ্রগতি, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এগুলোকেই সূচক হিসেবে মনে করি বা প্রাধান্য দেই। কিন্তু উন্নত জাতি হতে হলে কী শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অবকাঠামোগত অগ্রগতি বা বস্তুগত উন্নতিই যথেষ্ট? নাকি সর্বাগ্রে প্রয়োজন উন্নত মানুষ? যাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেছেন ‘সোনার মানুষ’ হিসেবে।

 

জাতি বলতে আমরা কী বুঝি বা জাতি কী নিয়ে গঠিত? যেমন বাঙালি জাতি বলতে আমরা কি বাংলার রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, দালান-কোঠা, মিল-কারখানা ইত্যাদি বুঝি নাকি বাংলার মানুষকে বুঝি? হ্যাঁ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন এবং অপরিহার্য কিন্তু তারও আগে প্রয়োজন মানুষের উন্নয়ন। মানুষের উন্নয়ন মানে- মানবিক উন্নয়ন, মনুষ্যত্বের উন্নয়ন, মানব সত্তার উন্নয়ন। যে কারণে মানুষকে মানুষ বলা হয় সেই কারণগুলো পরিচর্যার মাধ্যমে উৎকর্ষ সাধন করা এবং মানুষের ভেতরের পশুত্বের বিনাশ ও মনুষ্যত্বের বিকাশের মাধ্যমে উন্নত মানুষে পরিণত হতে পারলে তবেই না উন্নত জাতি হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। তবেই না আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সত্যিকারার্থেই ফলপ্রসূ হবে।অন্যথায় ১ বাদ দিয়ে শুধু ০ দিয়ে যত বড় সংখ্যাই (০০০০০০০০০০০) গঠন করি না কেন তার যেমন মূল্য নেই ঠিক তেমনি উন্নত জীবনবোধ ও নৈতিকতা সমৃদ্ধ এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শ মানুষ তৈরি না করে শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বস্তুগত উৎকর্ষ সাধন বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে উন্নত জাতি বা দেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখাও আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।