বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম, নাম পাথরঘাট। এখানেই থাকতেন রফিক মিয়া, এক দুঃখী বৃদ্ধ কৃষক। তার ছিল ছোট্ট একটি খড়ের ঘর আর একটুকরো বন্ধ্যা জমি। তার একমাত্র সঙ্গী ছিল একটি বলদ, যার নাম ছিল কালু। কালু ছিল তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ তাকে কতবার বলেছে, "এই বলদ বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় করো," কিন্তু রফিক মিয়া কখনো রাজি হননি।
জীবনযুদ্ধের শুরু
রফিক মিয়ার স্ত্রী মারা গিয়েছিল বছর কয়েক আগে, সন্তান বলতে কেউ ছিল না। একমাত্র কালুই ছিল তার সঙ্গী। প্রতিদিন ভোরে তিনি কালুকে নিয়ে জমিতে যেতেন। ফসল ফলানোর চেষ্টা করতেন, কিন্তু মাটি এতটাই শক্ত ছিল যে কিছুই ভালোভাবে হত না। বর্ষার সময় মাটি কাদায় পরিণত হতো, আর শীতকালে হয়ে যেত পাথরের মতো শক্ত।
গ্রামে ধনী কৃষকদের জমি উর্বর ছিল। তাদের সেচের জন্য পুকুর ছিল, আর সার কেনার মতো টাকা ছিল। কিন্তু রফিক মিয়ার কাছে এসব কিছুই ছিল না। নিজের পরিশ্রম আর কালুর সাহায্যে তিনি যা করতে পারতেন, তাই করতেন।
ভাতের অভাব
দিন যত এগোচ্ছিল, রফিক মিয়ার আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছিল। কখনো কখনো তাকে দু-তিন দিন না খেয়ে থাকতে হতো। গ্রামের বাজারে চাল-ডাল কিনতে যাওয়ার মতো পয়সা তার থাকত না। কিন্তু কালুকে কখনো না খাইয়ে রাখেননি। নিজের ক্ষুধার কষ্ট ভুলে, যা কিছু সামান্য খাবার জোগাড় করতেন, তা কালুর মুখে তুলে দিতেন।
একদিন গ্রামে এক ধনী ব্যবসায়ী এলেন। তিনি বললেন, "রফিক চাচা, তোমার বলদটা বেশ শক্তিশালী। আমি এটা কিনতে চাই। তোমাকে ভালো দাম দেব।" রফিক মিয়া ধীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন, "কালু আমার ছেলে। আমি তাকে বিক্রি করতে পারব না। টাকা দিয়ে যদি মনের শান্তি না পাই, তবে সে টাকার দাম কী?"
কালুর অসুস্থতা
শীতকাল পড়তে শুরু করেছিল। একদিন সকালে জমিতে কাজ করার সময় রফিক মিয়া দেখলেন, কালু হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়ছে। তার শরীর কাঁপছে, আর চোখে জল। রফিক মিয়া তাকে ঘরে নিয়ে এলেন। কিন্তু তার কাছে ওষুধ কেনার মতো টাকা ছিল না। গ্রামের পশুচিকিৎসককে ডাকার জন্য পাশের বাড়ির কাছ থেকে ধার চাইলেন, কিন্তু কেউ টাকা দিতে রাজি হলো না।
সারারাত রফিক মিয়া কালুর পাশে বসে রইলেন। নিজের ছেঁড়া চাদরটি গায়ে জড়িয়ে দিলেন। কালু যেন বোঝাতে চাইছিল, "তুমি যা করছ, তা আমার জন্য যথেষ্ট।" কিন্তু পরের দিন সকালে কালু চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ল।
নিঃসঙ্গ জীবন
কালুর মৃত্যুতে রফিক মিয়া ভেঙে পড়লেন। জমিতে আর কাজ করতে পারতেন না। নিজের কষ্টের সাথিকে হারিয়ে তিনি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলেন। গ্রামের লোকেরা মাঝে মাঝে তাকে খাবার দিত, কিন্তু তার মনের দুঃখ কেউ ঘোচাতে পারত না।
মৃত্যুর পরে
এক শীতের সকালে, রফিক মিয়াকে তার ঘরের সামনে নিথর অবস্থায় পাওয়া গেল। তিনি নিঃশব্দে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। গ্রামের লোকেরা তাকে তার প্রিয় বলদ কালুর পাশে কবর দিল।
গ্রামীণ রূপকথা
রফিক মিয়া আর কালুর এই করুণ গল্প গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। তাদের বন্ধুত্ব, ত্যাগ, আর ভালোবাসার গল্প সবার মনে দাগ কেটে গেল। আজও পাথরঘাট গ্রামের লোকেরা বলে, রাতে জমির পাশে কেউ গেলে রফিক মিয়া আর কালুর ছায়া একসাথে কাজ করতে দেখা যায়। যেন তারা কখনো একে অপরকে ছেড়ে যেতে চায় না।
সমাপ্তি।