বৃত্তভরাট
‘সাইফা, একটা গান শোনাও’।
‘কোন গানটি শুনতে চাও? তোমার কোন পছন্দ আছে?’
‘এই মুহূর্তে আমার পছন্দের কথা তোমাকে বলতে ইচ্ছে করছে না।’
পুরাতন দিনের অদ্ভুত একটা সুর ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরে। আমি বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আজকাল নাকি আর কেউ এসব গান শোনে না। সাইফা তবু আমার জন্য এসব পুরাতন দিনের গান বাছাই করে। আর আমিও শুনি। শুধু শুনি না। তন্ময় হয়ে শুনি। সাইফা তাই বলে আমি নাকি একটু অন্যরকম। আমারও তাই মনে হয়।
অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে
কই তাহার মত
তুমি আমার কথা শুনে হাসো না তো
ধরারও ধুলিতে যে ফাগুন আসে
কই তাহার মত
তুমি আমার কাছে কভু আসো না তো।
শুধু সুরটুকু না, গানের কথাগুলোও কত মধুর। মনটা হালকা হয়। প্রশান্তিতে চোখ বুজে আসে আমার। বুকের মধ্যে দম লাগা ভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যায়।
আমি চোখ বুজে ডাকি, ‘সাইফা’।
‘বল’। সাইফা খুব মোলায়েম কন্ঠে উত্তর দেয়।
‘তুমি কি করে বোঝ আমি এমন মিষ্টি একটা গান শুনতে চেয়েছিলাম। তোমার গান নির্বাচন সব সময় আমাকে মুগ্ধ করে। শুধু মুগ্ধ করে না, অবাকও করে।’
‘তোমাকে আগেও অনেকবার বলেছি, তোমার অনুভূতি-ভাব বোঝার পূর্ণ সক্ষমতা দিয়ে আমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছ্।ে তোমার শারীরিক মানসিক সব ধরনের স্পেসিফিকেশন নিয়মিত আপডেট হয় আমার মেমোরি সেলে।’
‘তবু আমার বিশ^াস হয় না। তুমি বলছ তুমি আমার শরীর ও মনের সব অবস্থা সম্পর্কে জান! আমি একটু পরীক্ষা করে দেখতে পারি।’
‘হ্যা, পার। কিন্তু তুমি আগেও আমার পরীক্ষা নিয়েছ। যাকে বলে হাতে কলমে পরীক্ষা।’
‘হুম। অগ্নিপরীক্ষা তো নেইনি।’
‘তুমি জান আমি অগ্নি নিরোধী তন্তু দ্বারা তৈরি। আমি কখনও আগুনে পুড়ব না।’
‘হা হা হা।’ অতি উচ্চমানের প্রোগ্রামেও তাহলে ত্রæটি থাকে। যেমন অনেক ভাল মানুষেরও কিছু না কিছু দোষ থাকে। আমি ভাবি।
‘আচ্ছা, আজ তবে তোমার একটু অন্যরকম একটা পরীক্ষা নেয়।’
আমার কেন জানি ছেলেমানুষি করতে ইচ্ছে করছে। তাও আবার একটা প্রোগ্রামড যন্ত্রের সাথে। আমি ঠিক আছি তো। একদম ঠিক যে নেই সেটা আমি জানি। কারন এরকম ছেলেমানুষি আমি মাঝে মাঝে করি। আগে করতাম না। মা মারা যাবার পর থেকে করি। করি না বলে বলতে হয় করতে উচ্ছে করে। সমস্ত জগত হাতের মুঠোয় থাকার পরও যখন তার থাকা না থাকার কোন মানে খুজে পাওয়া যায় না, তখন বুঝি এরকম হয়। সমস্তটাকেই কেমন অর্থহীন ছেলেমানুষি বাব হয়।
আমি গলায় একটু জোর এনে টেনে টেনে বলি, ‘সাইফা, বল, এই মুহূর্তে আমার কেমন লাগছে- সুখী না অসুখী’।
‘তোমার শরীরের তাপমাত্রা ৯৯.৬৩। ১০০ ছুই ছুই। বøাড প্রেশার ৯০/১৩৫। নিউরনে কম্পন মাত্রা...।’
‘তার মানে ব্যাপারটা জটিল তুমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছ না। ’ আমি সাইফাকে থামিয়ে দিই। এত গানিতিক হিসাব দেওয়ার মানে হচ্ছে সে ঠিক বুঝতে পারছে না। সাইফা সবসময় এসব ব্যাপারে একদম ঠিক অবস্থা বলতে পারে। এর আগেও অনেক পরীক্ষা করেছি আমি। ফলাফল বলা যায় নিখুত, ৯৯.৯৯%। মা যেদিন মারা গেল বা মেওে ফেলা হল, সেদিন থেকে আমাকে বুঝতে সাইফার কষ্ট হয়।
জগতে সব কিছু বোধ হয় প্রোগ্রাম করা যায়, শুধু মা হারানো আহত হৃদয়ের বেদনানুভব ছাড়া।
বিপ বিপ শব্দ বের হয় সাইফার মাইক্রোস্পিচ প্যানেল থেকে। সাইফা একটা যন্ত্র। যন্ত্র বলে মুখেব ভাব বোঝার উপায় নেই। তবু আমি বুঝতে পারি সাইফার ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। তার ইলেকট্রনিক সংকেতগুলো মিলছে না। কোথায় বাধা পেয়ে গুলিয়ে যাচ্ছে তার বায়ো-রোবোটিক মস্তিক্ষের নিউরনের ইলেকট্রিক অনুরনণ।
আমি ওকে বুঝিয়ে বলি, ‘মানুষের এই ধরনের অনুভূতি হয়। তুমি যতই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অসাধারন সংস্করন হও, যন্ত্র হয়ে এটা কখনও ধরতে পারবা না।’
‘তোমার এই অনুভ’তির কি কোনও নাম আছে।’ সাইফা কুন্ঠিত কন্ঠে আমাকে জিঞ্জাসা করে।
‘নাই। কোন শব্দ দিয়ে এটাকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব না। শুধু আমি এটা অনুভব করছি, পৃথিবীতে আর কেউ ঠিক এরকম অনুভব করবে না। কখনও না। তবু বোঝার জন্য উদাহারণ দেওয়া যেতে পারে, ধর যখন একটা মানুষের সব আছে, তবু সে শূন্য অনুভব করে। তার মনে হয় তার কি যেন কিছু নেই। কিন্তু বুঝতে পারে না কি নেই। কারন তার সব আছে। অন্তত তোমার মত যন্ত্রের যান্ত্রিক হিসাবে।’
‘তবু একটা নাম দেয়া যায় না।’
‘যায়। মেলানকলি। এটা দিয়ে অনুভুতিটাকে নির্দেশ করা যাবে বটে, পুরোটা বোঝা যাবে না।’
‘অদ্ভূত,তাই না। বৃত্তের মধ্যে সম্পূর্ণটা ভরাট,তবু ভিতরে শূন্য জায়গা আছে। এটা তো গানিতিকভাবে অসম্ভব।’
‘আমরা মানুষ, বৃত্ত না। মানুষ সব সময় বৃত্তের বাইরে।’
‘আচ্ছা, তোমার সব থাকার পরেও তোমার মনে হয় কিছু নেই। তোমার কি মনে হয়, তোমার কি নেই?’
‘মা। আমার মা নেই।’ আমি ডুকরে কেঁদে উঠি। বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠে।
সাইফা সব বোঝে। কিন্তু বুকের ভেতরের দহন থেকে যে কান্না উথলে আসে, তা বোঝে না।
‘গানটি কি পাল্টে দেব।’ অনুচ্ছ কন্ঠ দিয়ে ভলিউম কমিয়ে সাইফা বলে।
‘না। যতক্ষন না আমি ঘুমিয়ে পড়ি, তুমি এই গানটাই শোনাতে থাক।’ আমি বালিশে মুখ গুজে শুয়ে থাকি।
আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। যখন ঘুম থেকে উঠি, টের পাই মাথাটা ধরে আছে। বুকের মধ্যে হাস ফাস করছে। দম লাগা ভাবটা আবার ফিরে এসেছে। একটা স্বপ্ন দেখেছি ঘুমের মধ্যে। খুবই সাদামাটা স্বপ্ন। যেটা আমি প্রায়ই দেখি। দেখি একটা বৃত্ত। বিশাল সাদা পাতার ওপর আকা একটা বৃত্ত। একটা বড় পেন্সিল। কেউ একজন সেই পেন্সিল দিয়ে খসখস করে বৃত্তটি ভরাট করার চেষ্টা করছে। মানুষটিকে আমি চিনতে পারি না। অস্পষ্ট মুখায়ব। হঠাৎ হঠাৎ আমার বাবার মত মুখটা মনে হয়। মানুষটার রক্তশুণ্য চোখদুটো আমার দিকে চেয়ে থাকে। বৃত্তটি যত ভরাট হয় আমার তত কষ্ট হয়। একসময় আমি জেগে ওঠি। প্রতিবার একরকম ভাবে। দমবন্ধ হওয়া একটা অনুভূতি নিয়ে। স্বপ্নের মাথামুন্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারি না। কারন আমি বাবাকে অনেকদিন দেখি নাই।
সকালে রোদ উঠেছে মিষ্টি রোদ। আমি বাসা থেকে বের হয়। রাস্তায় পাাশের বাড়িগুলোর মায়াবী ছায়া পড়েছে। আমার মনে হয় ছায়াগলো দুলছে।