(১)
মধ্যপাড়ার ঠিক মাঝ বরাবর আর সব বাড়ি থেকে তফাতে দাঁড়িয়ে দুইটি বাড়ি, অনেকটা যমজের মতো শরীরে শরীর লাগিয়ে। দুটোই পাকিস্তান আমলের লালরঙ্গা ইটে গড়া। পার্থক্য এই যে একটা নিয়মিত যত্নে রাজকীয় সুন্দরীর মতো পুরাতনের আভিজাত্য নিয়ে বাঁকা চোখে ঠায় দাঁড়িয়ে আর অন্যটায় বহুদিন সংস্কারের ছোঁয়া নেই! অযত্নে পলেস্তারা খসে পড়েছে সবখানে। ফার্নের জঙ্গলের গভীরতা এতোটাই বেশি যে অনেক দূর থেকে দেখলে মনে হয়, বাড়িটার রং আসলে বোধহয় সবুজ! তবে ফাঁকে ফাঁকে কিছু শতবর্ষী ইট দাঁত বের করে জানান দেয় তার ভিত্তির সংবাদ।বাড়ি দুটোর যমজাকৃতির পিছনে আছে এক চমকপ্রদ ইতিহাস। সিকান্দার শাহ আর বেণুবিহারী ছিল মধ্যপাড়া গ্রামের দুই হতভাগ্য যুবক, বয়স প্রায় কাছাকাছি। বেণুবিহারীর জন্মভাগ্য ভালো ছিল না। তার মা ভাগ্যলক্ষ্মী গর্ভকালে বহু পুজা-মানত করেছিলো অনাগত সন্তানের শুভ আগমনের আশায়। তবু কোন অজানা পাপে বেণুবিহারীর মাতৃগর্ভ থেকে ভূলোকে আগমন মসৃণ হলেও, দেখা গেলো ডান হাতটা নেই। গর্ভে তার ডানহাত বিকাশই হয়নি। মধ্যপাড়া গ্রামের মানুষ জনের কাছে এ এক নতুন ঘটনা। মানুষের হাত ভেঙ্গে যেতে পারে, কেটে যেতে পারে অথবা কেউ কেটে দিতেও পারে, তাই বলে জন্ম থেকেই থাকবেনা। এরকম হয় নাকি! নিশ্চয়ই কোন শাপগ্রস্ত অপদেবতা জন্ম নিয়েছে!সময়টা ১৯২০ এর দশক ছিল, তাই এমন ভাবাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্ত মানুষের মনে বেণুবিহারীকে নিয়ে যে ভয় তৈরি হয়েছিলো তা আর কমেনি বরং অনাকাঙ্ক্ষিত একটা অস্বস্তি কাজ করতো। পালদের বাঁশবাগানে যখন চাঁদ উঠতো মধ্যরাতে, বেণুবিহারী একা বসে বাম হাতে বাঁশি বাজাতো। বাঁশের পাতায় চাঁদের আলো কেটে গলে পড়তো আর একটা ভয় ভেসে বেড়াতো গ্রামের রাস্তায়, চাটাইয়ের বেড়ার ফাঁকে। রাতে ঘুম ভেঙ্গে পোষা মুরগিগুলো পোকার কামড়ে কক কক করে ডেকে উঠলেও, ভয়ে কেঁপে উঠতো অনেকেই! সে অনেক কাল আগের কথা। পাশের বাড়িটা সিকান্দার শাহর। বাড়ির ছোট ছেলে হওয়ার সুবাদে একটু বেশিই সাহসী ছিল সিকান্দার। যৌবনকালটা পৃথিবী দেখবে বলে পথে নেমেছিলো। পড়াশুনা বেশিদূর না আগালেও যেটুকু করেছিল তা দিয়েই অনেক কিছু জেনে ফেলেছিলো সে। প্রবীণেরা বলেন সেকালে নাকি পড়ার খুব মান ছিল! সেকালের ফাইভপাশের সাথে একালের মেট্রিকয়ালা লাগুক তো দেখি! যাই হোক নাম এক হলেও ভ্রমণভাগ্য সিকান্দারের মতো সুপ্রসন্ন ছিল না! সাহেবদের শহর দেখার খেয়ালে কোলকাতার ট্রেনে উঠে পড়ল একদিন। ট্রেনটা শিয়ালদার কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ লাইন থেকে ফস্কে গেলো! সিকান্দারের ডান পাটা লোহার দরজায় আটকে এমনভাবে দুমড়ে মুচড়ে গেলো, কেটে ফেলা ছাড়া উপায় থাকলো না। সিকান্দার অবশ্য বলেছিলো, স্বয়ং ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় নাকি কোলকাতার হাসপাতালে তার অপারেশন করেছিলেন! গ্রামের লোকের তাতে কোন কিছু এসে যেতোনা, যেই অপারেশন করুক, পাতো কাটতে হয়েছে! তবু সিকান্দার বুক ভরেই গল্পটা শোনাতো। এতেও সমস্যার কিছু ছিল না, যতদিন না সে আবিষ্কার করলো তার অপর দুই ভাই বাবাকে ভুলভাল বুঝিয়ে জায়গা জিরাত সব নিজেদের নামে করে নিয়েছে! অবশ্য তখন আর কিছু করার ছিল না। পঙ্গু মানুষ, কীই বা করার ক্ষমতা ছিল তার। একবুক হতাশা নিয়ে সেইদিন চাঁদরাতে বাঁশবনের দিকে তাকে হেঁটে যেতে দেখেছিলো সবাই। সমালোচকেরা বলে সে নাকি গলায় দিতে দড়ি দিতে বের হয়েছিলো; কিন্তু তার কোনোই প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। যে কারণেই গিয়ে থাকুক, শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছিল সে। হয়ত চাঁদনী রাতে কারো সাথে দেখা হয়েছিল তার! লোকে বলে তাকে বেণুই বাঁচিয়েছিল সেদিন! কিছুদিন পর সবাই দেখলো সিকান্দার আর বেণুবিহারী খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত একই রকমের দুঃখ মানুষকে খুব কাছে টেনে নিয়ে আসে। তারা বাঁশবনে ঘুরে বেড়াতো নিজেদের মতো। মাঝে মাঝে এক গঞ্জ থেকে আরেক গঞ্জে যেতো। এটুকুই মানুষের চোখে পড়েছিলো, এর চেয়ে বেশি কিছু আসলে সত্যও নয় আবার মিথ্যাও নয়; কেউতো দেখেনি। ১৭৮৫ সালের দিকে এই বুড়ো বাঁশবনের গহীনে আশ্রয় নিয়েছিলো ফকির আন্দোলনের বিদ্রোহীরা। লালমুখো গোরারা তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছিল দিল্লী থেকে ঢাকা। আর এই মধ্যপাড়াটা সেই তখন থেকেই হদ্দ অজ পাড়াগাঁ! এদিক ফকিরদের লুকানোর জন্য বেশ নিরাপদ ছিল। সবাই বলে এখানে নাকি তাদের লুকানো ধন রত্ন রাখা ছিল! ফকির সন্ন্যাসীর জিনিসে কি না কি তাবিজ কবজ করা থাকে, এই ভয়ে গ্রামের লোকেরা কয়েক পুরুষ ধরেই ঢুকতোনা এদিকটায়! কিন্তু বেণুবিহারী আর সিকান্দারের ভয় ছিলোনা! কথায় আছে না, ন্যাংটোর নেই বাটপারের ভয়! যাদের সব গিয়েছে কপালের ফেড়ে তাদের ভয় করে কি লাভ। তারা আসলেও গুপ্তধন জোগাড় করে ফেলেছিলো কিনা, তা কেওই জানতোনা, কিন্তু বিশ্বাস করতো। নাহলে দেশভাগের আগে যারা কপর্দকশূন্য ছিলো, আইয়ুব শাহীর আমলে আঙুল ফুলে এতো ধনী কীভাবে হলো! যেভাবেই হোক দুইবন্ধু সত্তর সালে মধ্যপাড়ার সবচেয়ে ধনীলোক বনে গিয়েছিলো! লোকে ঠাট্টা করে বলত-“যমজ রাজা!” যমজ রাজারা কোন এক অজানা কারণে বাঁশবনটাও কিনে নিয়েছিলো সব শরীকদের কাছে থেকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে। লোকে অবশ্য তাতেও অন্য মানে খুঁজেছিল, কিন্তু লোকের কথায় কান দিয়ে আমাদের কাজ নেই।
(২)
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের পর যখন তাবৎ বিশ্ব মিডিয়ায় civil war in Pakistan শিরোনামে খবর আসতে শুরু করেছিলো, তখনো প্রথম দুইমাস মধ্যপাড়ায় যুদ্ধের আগুনের আঁচ পৌঁছায়নি। মাঝে মাঝে বীভৎস গর্জনে কিছু যুদ্ধবিমান আকাশের এই মাথা থেকে ওই মাথা থেকে উড়ে যেতে দেখেছিলো এখানকার লোকেরা। তবে বাতাসে ভেসে উড়ে আসছিল ভয়াবহতার টুকরো টুকরো খবর। পাংশুর মুখে সকালে বসে থাকতো পুরো গ্রামটা মৃত্যুদূতের অপেক্ষায়, রুটিনের মতো। প্রতি সন্ধ্যায় সিকান্দার আর বেণুবিহারী উঠোনের কোণে বসে অপেক্ষায় থাকতো বিবিসি বাংলা শোনার। সহজে ধরতোনা। টিউনিং করতে করতে খবরটাই শেষ হয়ে যেতো অনেকদিন। কোন খবরই ভালো আসছিলোনা। মৃত্যুর মিছিল লম্বা হতে হতে মনে হতো তাদের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। মৃত লাশেদের গন্ধ, বারুদ মেশানো ছাই ঢাকা, চাঁটগা, রাজশাহী হয়ে খুব দ্রুতই চলে আসবে তাদের এই গ্রামে। অদৃশ্য বিস্ফোরণের দুঃস্বপ্নে প্রতি রাতে ঘুম ভাঙ্গত। শুধু তারা দুজন নয় সারাদেশ তখন এক প্রবল জ্বরের ঘোরে পুড়ে যাচ্ছে। এরমধ্যেই পাশের শহর নাটোর থেকে খবর এলো মিলিটারি পৌঁছে গিয়েছে। কয়েকটা কামান সাথে নিয়ে খাকি পোশাকে আক্রমণকারীরা তাণ্ডব চালাচ্ছে সেখানে। সবাই পালাচ্ছে ভারত সীমান্তের দিকে। সিকান্দার আর বেণীমাধব, দুজনেরই এখন সংসার হয়েছে, নাতিপুতিও হয়েছে। ওদের কথা ভেবে আঁতকে উঠতো দুইজন। তাদের তো জীবনকাল শেষের দিকেই, কিন্তু এতোগুলো জোয়ান মানুষ, যুবতী মেয়ে এদের কি হবে! খবর যা আসছিলো তাতো মোটেও ভালো কিছু নয়। যুবতী সে জাত আর ধর্মেরই হোক রেহাই পাচ্ছিলোনা ওদের লালসার হাত থেকে। বিশেষ করে বেণুবিহারীর তো অবশ্যই সরে পড়া উচিত! পাক আর্মি আর যাই করুক বেণুকে ছেড়ে দিবেনা। আসলে তারা গণহত্যা করছিলো, কাওকেই ছেড়ে দিচ্ছিলনা। সিকান্দার বেণুকে ডেকে বোঝালো অনেক। দেশ স্বাভাবিক হয়ে এলে তো ফিরতেই পারবে সে! আপাতত পরিবারকে বাঁচাতে হলেও তার সীমান্ত পাড়ি দেয়া দরকার। সেদিনের গুমোট সন্ধ্যায় মাথা নীচু করে বেণু ভাবলো অনেক। আধো আলো অন্ধকারে দুই চার ফোঁটা চোখের পানি ঘাসের জমি ছুঁয়ে দিলো। এতদিনের বন্ধুত্বে এতটুকু একজন আরেকজন বুঝতে পারে। সিকান্দারও হয়ত বুঝেছিলো। কিন্তু তখন দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার সময় নয়। ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় রাজী হলো বেনুবিহারী। দুই ছেলে আর তাদের পরিবারকে ডেকে বলে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে। তখন প্রস্থানকাল, ডাক আসলেই পথে নামতে হবে সবার, এটাই সেই সময়ের নির্মম নিয়তি। প্রদোষ দীর্ঘায়িত হয়ে ছিল! কেউ জানতো না সূর্য কখন উঠবে, আবার নতুন করে সোনালি হবে ভোরের মেঘনার পানি!
(৩)
যাবে যাবে করে আরো মাসখানেক পার করে ফেলেছিলো বেণুবিহারী। এরমধ্যে পাকবাহিনী এগিয়ে এসেছিল আরো অনেকখানি। তখন কল্পনায় নয় বাস্তবেই বিস্ফোরণের শব্দ কানে আসতো! শকুনেরা পাল ধরে উড়ে যেতো কোন এক বধ্যভূমির দিকে। দুই বৃদ্ধ বন্ধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো আর বিমানের সাথে শকুনের পাল্লা দেয়া দেখে অজানা আতঙ্কে চোখ বড় করে কি যেন ভাবতো! ১৯৭১ সালের জুন মাসে যখন অ্যান্থনি মাস্ক্যারেনহাস তার Genocide নামের প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য পাঠাচ্ছিলেন তখন এক ভোরে মধ্যপাড়া থেকে পনেরো মাইল দূরে সদরের জিলা স্কুল মাঠে ঘাঁটি গাড়ল পাকবাহিনীর তিন প্লাটুন সৈন্য। সেই খবর বাতাসের আগেই পৌঁছে গেলো আশেপাশের সব গ্রামে, মহল্লায়! আর দেরি করা চলেনা! সিকান্দার শাহ এককালে ঘুরেছে অনেক, উর্দু ভাঙ্গা ভাঙ্গা জানতো। ভাবলো এসে যদি পড়েই তো দুই একটা কথা বলে শান্ত করা যাবে অন্তত। আহা দিল দিয়ে কথা বললে বুঝবেনা এমন চিড়িয়া এই দুনিয়ায় আছে নাকি কেউ! আয়ুউব শাহীর আমলে জাতীয় দিবসের জন্য বানানো বিঘত সাদা সবুজের চাঁদ-তারা আঁকানো পতাকাটা সেদিনই সাবান দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করে ফেলল। তারপর একটা মোটা বাঁশের মাথায় আরেকটা চিকন বাঁশ বেঁধে উড়িয়ে দিলো আকাশে। যাতে মাটি থেকেও দেখা যায় আবার আকাশ থেকেও বোঝা যায়! বলা তো যায়না, যেভাবে যুদ্ধ-বিমান উড়ছে, কখন বোমা ফেলে। আর নিজে দুটো গরুর গাড়ি ডেকে আনল- একটা বেণুবিহারীর জন্য আরেকটা তার পরিবারের জন্য। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো থেকে যাবে, কিন্তু তাই বলে তো পরিবারকে বিপদে ফেলা যায়না। পঙ্গু মানুষ যেখানেই যাবে, ঝামেলা বাড়াবে, তার চেয়ে এখানেই থাকা ভালো। বয়স তো কম হলোনা; হায়াত মউত উপরয়ালার হাতে, এটা তার ততোদিনে জানা হয়ে গিয়েছিলো। বন্ধুকে থাকতে দেখে বেণুও থাকার জন্য জোরাজুরি করছিলো, সে পাত্তা দিলোনা। ওর তো পা আছে, দৌড়াতে পারবে, কী দরকার পেছনে ফেরার! সন্ধ্যা রাতে সবার যাত্রা করার কথা ছিল। সময় খারাপ, পালানোর জন্যেও আঁধারের অবগুণ্ঠন দরকার তখন।বিকেল বেলায় সবাই যখন শেষ সময়ের গোছগাছে ব্যস্ত ছিল, জনা দশেক লোক এলো সেই যমজ বাড়িতে। ওদের মুখ গামছায় ঢাকা, হাতে চটের ব্যাগ, ভারী কিছু ছিল তাতে। গামছার আড়ালে যে এক চিলতে মুখ দেখা যাচ্ছিলো তা শুধুই দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে ঢাকা। তাদের একজন সোজা সিকান্দারের বরাবর এগিয়ে গেলো; তার চোখে-মুখে অবিশ্বাস। ‘চাচা পাকিস্তানের পতাকা লাগাইছেন যে! খুব মায়া নাকি তাদের জন্য!’ পিছন থেকে বাঘের মতো গর্জন দিল আরো কয়েকজন। অবিশ্বাসের সময়ে বিশ্বাস স্থাপন করা খুবই দুরূহ। পাকবাহিনীর আগমন প্রত্যাশিত ছিল সিকান্দারের কাছে। মুক্তিফৌজ যে এভাবে এসে পড়বে তাতো মাথায় ছিলনা। যখন জীবন বাঁচানোই ধর্ম, তখন অতশত চিন্তার সময় ছিলোনা। এমন সময় বেণুবিহারী তার পরিবার সহ সামনে এসে দাঁড়ালো, একপাল লোক, ছেলেদের পরনে সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো গিঁট করে পরা, মেয়েদের কপালের লম্বাটে সিঁদুর, স্পষ্ট জাত পরিচয়ের স্বাক্ষর! বেণু নমস্কার দিয়ে বললো- ‘দাদা, ও আমাদের বাঁচানোর জন্যে এটা করেছে! আমার খুব সুহৃদ বন্ধু!’ কিছু পরিস্থিতিকে অবিশ্বাস করা অসম্ভব। সত্য মাঝে মাঝে এতো তীব্র হতে পারে যে কোন পর্দাই তখন তাকে আর লুকাতে পারেনা। দশ জন লোক তাদের মাথার গামছা সরিয়ে ফেলে ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়ালো। ‘চাচা আমরা মুক্তিফৌজ। একটু খাবারের ব্যবস্থা করবেন, ক্ষুধায় জানটা যায় যায়!’- হেসে বলেছিলো সামনে দাঁড়ানো মুক্তিসেনাদের নেতা। সেদিন অনেক বড় যুদ্ধ হওয়ার কথা ছিল! পাশের থানা অভয়পুরের গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে এসেছিল মুক্তিরা; গোপনসূত্রে খবর ছিল সেদিন রাতেই ওই গ্রামে আসার কথা জল্লাদ পাকবাহিনীর। এই ঘটনা জানার পর পরিবার পরিজনকে দ্রুত গাড়িতে তুলে দিয়ে সিকান্দার বলেছিলেন, যেভাবে হোক বর্ডারে দিয়ে আয়! ফিরে আসলে জমি লিখে দিবো তোদের! যে সময়ে জীবন মূল্যহীন সেখানে জমি জিরাতের দাম কতটুকু! এই ভেবে হতাশার হাসি ঠোটে মেখে গরুর পিঠে থাপ্পড় দিয়ে ধীরে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলো দুই গাড়োয়ান।সেদিন রাত মনে হচ্ছিলো আর কখনো শেষ হবেনা। সিকান্দার একা বসেছিলো চুপ করে গোয়াল ঘরটার পিছনে। রাতের হাওয়া অশুভ বার্তার জন্য তৈরি ছিল হয়ত। সামান্য ধুপধাপ বুকের মধ্যে ধাক্কা দিচ্ছিল অনবরত। খাওয়া শেষে মুক্তিরা কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছে তা মালুম করা গেলোনা! ওরা এরকমই, এই আসে এই যায়! কোথায় থাকে কেউ টের পায়না। হয়ত আশেপাশেই ছিল! একটা অশনি সংকেত নিয়ে চুপচাপ স্তব্ধ হয়েছিল আকাশ। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় এরকম নিঃসঙ্গতা আর কখনো বোধ করেনি সিকান্দার! মাঝরাতের দিকে প্রকৃতির নিয়মে চোখটা ধরে এসেছিল তার! হঠাৎ ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাসের উষ্ণতা পেয়ে ভূত দেখার মতো ভয়ে পিছনে তাকিয়ে তাজ্জব বনে গিয়েছিলো সে! বেণুবিহারী যায়নি! চল্লিশ বছরের বন্ধুত্বের বাঁধন কেটে সে সেদিন যেতে পারেনি! পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ দূরত্বে পার করে পুনরায় ফিরে এসেছিল।কিছু মুহূর্ত থাকে যখন অনুভূতিগুলো শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায়না। কেবল নীরবতাই পারে সেইসব মূহূর্তগুলোকে অভিব্যক্তি দিতে। সেই স্তব্ধতার চাদরে মুড়ি দিয়ে সিকান্দারের পাশে বসে পড়েছিলো বেণু, তারপর অপেক্ষা করছিলো সম্ভাব্য নরকের। রাতে দূর থেকে যখন সারিবদ্ধ পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছিল, বুটের আঘাতে মাটির কাঁপন বোঝা যাচ্ছিল, সেই সময় তাদের পিছনে বাঁশবাগানের ভিতর থেকে উল্কার মতো ঝাঁক ঝাঁক গুলি বের হয়ে এসেছিল। প্রত্যুত্তরে সামনে থেকেও ছুটে আসতে শুরু করেছিলো ভারী গোলার বৃষ্টি। গোলা বারুদের ঝলকানি আর কান ফাটানো শব্দে নরকের বুকে স্থবির হয়ে বসে পড়লো দুই বন্ধু!সিকান্দার আর বেণুবিহারীর পরিবার পরিজন তখন মধ্যপাড়া গ্রাম ছেড়ে প্রায় মাইল পাঁচেক ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো আলমপুরের দিকে। দূর থেকে চোখে পড়েছিলো দাবানলের মতো আগুন গিলে খাচ্ছে তাদের প্রিয় গ্রামটাকে, উল্কার মতো স্ফুলিঙ্গ উড়ছে আকাশে কোথাও কোথাও! টানা বুলেট ছোঁড়ার শব্দ, টের পাওয়া যাচ্ছিলো অত দূর থেকেও!১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের পর দুই পরিবারের লোকজনই আস্তে ধীরে ফিরে এসেছিল এই এলাকায়। কিন্তু দুই বৃদ্ধের খোঁজ আর কেউই পায় নাই। গ্রামের মানুষ যারা ওই রাতে উপস্থিত ছিল, তারাও কোন খোঁজ দিতে পারেনি তাদের। শুধু জমজ বাড়ি দুটো দাঁড়িয়েছিল পাঁজরে অসংখ্য বুলেটের দাগ নিয়ে।
(৪)
দেশ স্বাধীন হলো, তারপর একদিন শেখ সাহেবকে মেরে ফেলা হলো, কত স্বৈরশাসন এলো আবার চলেও গেলো! এখন সময় ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পেরিয়ে গিয়েছে। যমজ রাজাদের কথা পাড়ার বুড়োরা গল্পের তালে এখনো বলে, তবে ওই সময়ের মানুষগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সিকান্দার আর বেণুবিহারীর বংশধরেরাই বাস করছে যমজ বাড়ি দুটোতে। আগের মতো বন্ধুত্ব আর নেই দুই পক্ষের। পালটেছে সময়, পালটেছে মানুষ! দুই বাড়ির জায়গা পিলার দিয়ে আলাদা করা। বাঁশবনটা নাকি কেনার সময় বেণুবিহারীর নামে ছিল, পরে সেটা সিকান্দারকে ভাগ দেয়ার কথা। কিন্তু বেণুর বংশধরেরা তা দিলো কই! আগের জামানায় কথার দাম ছিল বাপু! তার শোধ নিতে গিয়ে সিকান্দারের নাতি পুতিরাও ভাগের পুকুর একাই ভোগদখল করছে! এখন নাকি হিন্দু বাড়ির ছেলে রাইবিহারী উকিল হয়েছে। কথায় কথায় মামলা দেয়ার ভয় দেখায়। একদিন সুযোগ পেলে যে সবকয়টাকে বাড়ি ছাড়া করবে সে কথা উচ্চস্বরে জানিয়ে দিতে ভোলেনা সিকান্দারের নাতি কামাল শাহ। সে রাজনীতি করে। কখনো সরকারি দলে থাকে, কখনো বিরোধীতে! সরাসরি কিছু করলে ইমেজ যাবে এই ভয়ে কিছু করেনি এখনো। তার উপর বাড়ি দুটো একদম গায়ে গায়ে লাগানো।অবিশ্বাস জিনিসটা সংক্রামক, একবার শুরু হলে আশেপাশের মানুষের মধ্যেও ছড়ায়। এখন যেমন ছড়িয়ে গিয়েছে রাইবিহারীর বাড়ির লোকজনের মধ্যে। তার গিন্নী কোনভাবেই এখানে থাকতে রাজী হচ্ছেনা। শহরে পাকাপাকি ভাবে যেতেই হবে। এখানে কখন ছেলে মেয়ের কোন একটা ক্ষতি হয়ে যায় তার ঠিক আছে! যদি কিছু হয়ে যায় রাইবিহারী কি মামলা করে তা ফিরিয়ে আনতে পারবে! কথায় যুক্তি আছে তার, মনে হয় রাইবিহারীর। কামাল শাহের সাথে ছোটবেলায় কত খেলেছে সে। অথচ আজ মানুষটা বদলে গিয়েছে। সব রাজনীতির ক্ষমতার ঝাঁজ, ভাবে রাইবিহারী। যেতে হবে হয়ত, এভাবে আর কতোদিন। কামালের গিন্নী সালেহা সাধারণ ঘরের মেয়ে। অনেক ছোট কালে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল। প্রথম প্রথম খুব ভাব হয়েছিলো অই বাড়ির মানুষগুলার সাথে। পরে দুপক্ষের রেষারেষি দেখে সেও আর ওদের পছন্দ করে না। একমাত্র ছেলে রকিকেও কড়া ভাবে মানা করে দেয়া আছে এ ব্যাপারে। রকির বাপ বলে, বাঁশবাগানে বসে কি সব যাদুটোনা করে তার ঠিক আছে! ওইদিকে ছেলে মেয়েদের না যাওয়াই ভালো! আর কথা বলতে গেলেও ওরা ঝেড়ে কাশেনা, পেটের মধ্যে কথা লুকিয়ে রাখে! অসহ্য ব্যাপার! এভাবেই দূরত্ব সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। সম্প্রতি মধ্যপাড়া গ্রামের পেট চিড়ে মহাসড়ক তৈরি হচ্ছে, আসলে বাইপাস সড়ক। সড়কটা রাজধানীমুখী হওয়ায় পার্শ্ববর্তী জায়গাগুলোর দাম হুহু করে বাড়ছে। সমস্যা হচ্ছে পুরো বাড়িটা যে দাগের উপর তার একপাশ দিয়ে যাচ্ছে রাস্তাটা। কামাল শাহ তার বিরক্তিকর প্রতিবেশীকে শায়েস্তা করার উপায় খুঁজে পেয়েছেন বহুদিন পর। তার গেটের সাথে রাস্তার যোগাযোগের জায়গাটা ঠিক রেখে বাকী অংশে গভীর খাল তৈরি করার বুদ্ধি এসেছে সকালেই। তখন রাইবিহারী ব্যাটা চাইলেও মহাসড়কে উঠতে পারবেনা। পিছনের জমির আইল দিয়ে ঘুরে এসে উঠতে হবে, আর ওখানের জোঁক গুলো যখন সপাটে কামড়ে দেবে ওর বাড়ির সবাইকে, তখন বুঝবে কামাল শাহ কি জিনিস! তাই ভোর থেকেই লোক লাগিয়েছে, তারা খুড়ে যাচ্ছে একমনে। সাথে কয়েকজন ভাড়া করা লাঠিয়ালও রেখেছে, নির্দেশ দেয়া আছে থামাতে আসলেই আগে মার! তারপর দেখা যাবে বিচার সালিশে কী হয়!রাইবিহারী জেলা শহরে ওকালতি করে মোটামুটি নাম জমিয়েছে এতোদিনে। সকালে যখন এই খবর পেলেন, বুঝলেন কামাল শাহ প্রস্তুতি ছাড়া মাঠে নামেনি। খালি হাতে বীরত্ব দেখাতে যাওয়ার পরিণতি তার ভালোই জানা, এমন মক্কেল কত সামলিয়েছে। সদর থানার ওসির সাথে তার সদ্ভাব ছিল কর্মসূত্রেই। ফোন মারফত সাহায্য চাইল! আর ফোর্স না আসা পর্যন্ত আরামকেদারায় বসে কামাল শাহের নামে কি লিখবে মামলায় তার খসড়া বানাতে শুরু করলো। এক কাপ চা চাইলো গিন্নীর কাছে। চায়ে চুমুক না দিলে তার আবার মাথার বুদ্ধি খোলেনা। আর হ্যাঁ, ওর নামে মামলা দিয়ে তো বাকী জীবন এই বাড়িতে শান্তিতে বাস করার কোন সম্ভাবনা নেই। পরিবার নিয়ে তাকে শহরে স্থানান্তরিত হবে সপ্তাহের মধ্যেই। পরে সুযোগ বুঝে মালদার কোন পার্টির কাছে বেঁচে দিবে জায়গাটা। ওর মতন পাতি নেতাকে প্যাঁদানি দিয়ে এলাকা ছাড়া করে দিবে এমন কারো কাছেই বেচবে সে। এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে কখন ঘন্টাখানেক পার হয়ে গিয়েছে তার খেয়ালেই ছিলোনা। বাইরে হুইসেল বাজছে, পুলিশের হুইসেল! কালো কোটটা গায়ে জড়িয়ে অকুস্থলের দিকে রওনা দিলো রাইবিহারী।এক মহাকান্ড হয়ে গিয়েছে আজ মধ্যপাড়ায়! কামাল শাহের লোকজনকে থামাতে পুলিশ যখন পৌঁছেছিল, ততক্ষণে অনেকটা গভীর পর্যন্ত খুড়ে ফেলছিলো তারা। তাতেই ঘটেছে ঘটনাটা; বামদিকের জায়গাটা থেকে উঠেছে দশ বারোটা মাথার খুলি আর হাড়গোড়! আর ডানদিকের একটা ছোটমতোন জায়গা থেকে উঠে এসেছে দুইটা মাথার খুলি আর হাড়গোড়। অসংখ্য মানুষ জড়ো হচ্ছে। এই গ্রাম আশেপাশের গ্রাম এমনকি শহর থেকেও আসছে সবাই! এত নতুন বধ্যভূমির আবিষ্কার! সাংবাদিকরা লাইভ কাভারেজ করছেন। মধ্যপাড়ার নাম জাতীয় সংবাদে দেখাচ্ছে। শুধু রাইবিহারী আর কামাল শাহ দাঁড়িয়ে আছে যে পাশে দুটো কঙ্কাল ছিল সেই পাশে। একটা কিশোর ছেলে যত্ন করে হাড়গোড় গুলো সাজিয়ে রাখছে। আরে ওইতো, একটা কঙ্কালের এক পাশের হাতের হাড় কম! আরেকটা কঙ্কালের পায়ের হাড় মসৃণ করে কাটা। পাশের ভাটফুলের ঝোপে বসে আছে পাড়ার সবচেয়ে বুড়ো গোবিন্দ খুড়ো আর মোসলেম চাচা; দুজনেরই বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই! ওরা মাথা নাড়াচ্ছে আর বলছে “এরাই সিকান্দার আর বেণুবিহারী, মধ্যপাড়ার জমজ রাজা! এতদিন পর খোঁজ মিললো তবে!” বুনো বাতাসে দুই একটা ভাট ফুল ঝরে পড়ছিল কঙ্কাল দুটোর উপর!কামাল শাহ কাঁদছেন, কাঁদছেন রাইবিহারী ও! দুজন দুজনের হাত শক্ত করে ধরে আছেন। সাংবাদিকদের ক্যামেরা গুলো একটার পর একটা ফ্ল্যাশ দিচ্ছে তাদের মুখের উপর। বাতাসে প্রশ্ন ভেসে আসছে হাজারটা। তারা দুজন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। চোখের পানিতে পৃথিবী ঝাপসা লাগছে খুব!
মধ্যপাড়ার ঠিক মাঝ বরাবর আর সব বাড়ি থেকে তফাতে দাঁড়িয়ে দুইটি বাড়ি, অনেকটা যমজের মতো শরীরে শরীর লাগিয়ে। দুটোই পাকিস্তান আমলের লালরঙ্গা ইটে গড়া। পার্থক্য এই যে একটা নিয়মিত যত্নে রাজকীয় সুন্দরীর মতো পুরাতনের আভিজাত্য নিয়ে বাঁকা চোখে ঠায় দাঁড়িয়ে আর অন্যটায় বহুদিন সংস্কারের ছোঁয়া নেই! অযত্নে পলেস্তারা খসে পড়েছে সবখানে। ফার্নের জঙ্গলের গভীরতা এতোটাই বেশি যে অনেক দূর থেকে দেখলে মনে হয়, বাড়িটার রং আসলে বোধহয় সবুজ! তবে ফাঁকে ফাঁকে কিছু শতবর্ষী ইট দাঁত বের করে জানান দেয় তার ভিত্তির সংবাদ।বাড়ি দুটোর যমজাকৃতির পিছনে আছে এক চমকপ্রদ ইতিহাস। সিকান্দার শাহ আর বেণুবিহারী ছিল মধ্যপাড়া গ্রামের দুই হতভাগ্য যুবক, বয়স প্রায় কাছাকাছি। বেণুবিহারীর জন্মভাগ্য ভালো ছিল না। তার মা ভাগ্যলক্ষ্মী গর্ভকালে বহু পুজা-মানত করেছিলো অনাগত সন্তানের শুভ আগমনের আশায়। তবু কোন অজানা পাপে বেণুবিহারীর মাতৃগর্ভ থেকে ভূলোকে আগমন মসৃণ হলেও, দেখা গেলো ডান হাতটা নেই। গর্ভে তার ডানহাত বিকাশই হয়নি। মধ্যপাড়া গ্রামের মানুষ জনের কাছে এ এক নতুন ঘটনা। মানুষের হাত ভেঙ্গে যেতে পারে, কেটে যেতে পারে অথবা কেউ কেটে দিতেও পারে, তাই বলে জন্ম থেকেই থাকবেনা। এরকম হয় নাকি! নিশ্চয়ই কোন শাপগ্রস্ত অপদেবতা জন্ম নিয়েছে!সময়টা ১৯২০ এর দশক ছিল, তাই এমন ভাবাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্ত মানুষের মনে বেণুবিহারীকে নিয়ে যে ভয় তৈরি হয়েছিলো তা আর কমেনি বরং অনাকাঙ্ক্ষিত একটা অস্বস্তি কাজ করতো। পালদের বাঁশবাগানে যখন চাঁদ উঠতো মধ্যরাতে, বেণুবিহারী একা বসে বাম হাতে বাঁশি বাজাতো। বাঁশের পাতায় চাঁদের আলো কেটে গলে পড়তো আর একটা ভয় ভেসে বেড়াতো গ্রামের রাস্তায়, চাটাইয়ের বেড়ার ফাঁকে। রাতে ঘুম ভেঙ্গে পোষা মুরগিগুলো পোকার কামড়ে কক কক করে ডেকে উঠলেও, ভয়ে কেঁপে উঠতো অনেকেই! সে অনেক কাল আগের কথা। পাশের বাড়িটা সিকান্দার শাহর। বাড়ির ছোট ছেলে হওয়ার সুবাদে একটু বেশিই সাহসী ছিল সিকান্দার। যৌবনকালটা পৃথিবী দেখবে বলে পথে নেমেছিলো। পড়াশুনা বেশিদূর না আগালেও যেটুকু করেছিল তা দিয়েই অনেক কিছু জেনে ফেলেছিলো সে। প্রবীণেরা বলেন সেকালে নাকি পড়ার খুব মান ছিল! সেকালের ফাইভপাশের সাথে একালের মেট্রিকয়ালা লাগুক তো দেখি! যাই হোক নাম এক হলেও ভ্রমণভাগ্য সিকান্দারের মতো সুপ্রসন্ন ছিল না! সাহেবদের শহর দেখার খেয়ালে কোলকাতার ট্রেনে উঠে পড়ল একদিন। ট্রেনটা শিয়ালদার কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ লাইন থেকে ফস্কে গেলো! সিকান্দারের ডান পাটা লোহার দরজায় আটকে এমনভাবে দুমড়ে মুচড়ে গেলো, কেটে ফেলা ছাড়া উপায় থাকলো না। সিকান্দার অবশ্য বলেছিলো, স্বয়ং ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় নাকি কোলকাতার হাসপাতালে তার অপারেশন করেছিলেন! গ্রামের লোকের তাতে কোন কিছু এসে যেতোনা, যেই অপারেশন করুক, পাতো কাটতে হয়েছে! তবু সিকান্দার বুক ভরেই গল্পটা শোনাতো। এতেও সমস্যার কিছু ছিল না, যতদিন না সে আবিষ্কার করলো তার অপর দুই ভাই বাবাকে ভুলভাল বুঝিয়ে জায়গা জিরাত সব নিজেদের নামে করে নিয়েছে! অবশ্য তখন আর কিছু করার ছিল না। পঙ্গু মানুষ, কীই বা করার ক্ষমতা ছিল তার। একবুক হতাশা নিয়ে সেইদিন চাঁদরাতে বাঁশবনের দিকে তাকে হেঁটে যেতে দেখেছিলো সবাই। সমালোচকেরা বলে সে নাকি গলায় দিতে দড়ি দিতে বের হয়েছিলো; কিন্তু তার কোনোই প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। যে কারণেই গিয়ে থাকুক, শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছিল সে। হয়ত চাঁদনী রাতে কারো সাথে দেখা হয়েছিল তার! লোকে বলে তাকে বেণুই বাঁচিয়েছিল সেদিন! কিছুদিন পর সবাই দেখলো সিকান্দার আর বেণুবিহারী খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত একই রকমের দুঃখ মানুষকে খুব কাছে টেনে নিয়ে আসে। তারা বাঁশবনে ঘুরে বেড়াতো নিজেদের মতো। মাঝে মাঝে এক গঞ্জ থেকে আরেক গঞ্জে যেতো। এটুকুই মানুষের চোখে পড়েছিলো, এর চেয়ে বেশি কিছু আসলে সত্যও নয় আবার মিথ্যাও নয়; কেউতো দেখেনি। ১৭৮৫ সালের দিকে এই বুড়ো বাঁশবনের গহীনে আশ্রয় নিয়েছিলো ফকির আন্দোলনের বিদ্রোহীরা। লালমুখো গোরারা তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছিল দিল্লী থেকে ঢাকা। আর এই মধ্যপাড়াটা সেই তখন থেকেই হদ্দ অজ পাড়াগাঁ! এদিক ফকিরদের লুকানোর জন্য বেশ নিরাপদ ছিল। সবাই বলে এখানে নাকি তাদের লুকানো ধন রত্ন রাখা ছিল! ফকির সন্ন্যাসীর জিনিসে কি না কি তাবিজ কবজ করা থাকে, এই ভয়ে গ্রামের লোকেরা কয়েক পুরুষ ধরেই ঢুকতোনা এদিকটায়! কিন্তু বেণুবিহারী আর সিকান্দারের ভয় ছিলোনা! কথায় আছে না, ন্যাংটোর নেই বাটপারের ভয়! যাদের সব গিয়েছে কপালের ফেড়ে তাদের ভয় করে কি লাভ। তারা আসলেও গুপ্তধন জোগাড় করে ফেলেছিলো কিনা, তা কেওই জানতোনা, কিন্তু বিশ্বাস করতো। নাহলে দেশভাগের আগে যারা কপর্দকশূন্য ছিলো, আইয়ুব শাহীর আমলে আঙুল ফুলে এতো ধনী কীভাবে হলো! যেভাবেই হোক দুইবন্ধু সত্তর সালে মধ্যপাড়ার সবচেয়ে ধনীলোক বনে গিয়েছিলো! লোকে ঠাট্টা করে বলত-“যমজ রাজা!” যমজ রাজারা কোন এক অজানা কারণে বাঁশবনটাও কিনে নিয়েছিলো সব শরীকদের কাছে থেকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে। লোকে অবশ্য তাতেও অন্য মানে খুঁজেছিল, কিন্তু লোকের কথায় কান দিয়ে আমাদের কাজ নেই।
(২)
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের পর যখন তাবৎ বিশ্ব মিডিয়ায় civil war in Pakistan শিরোনামে খবর আসতে শুরু করেছিলো, তখনো প্রথম দুইমাস মধ্যপাড়ায় যুদ্ধের আগুনের আঁচ পৌঁছায়নি। মাঝে মাঝে বীভৎস গর্জনে কিছু যুদ্ধবিমান আকাশের এই মাথা থেকে ওই মাথা থেকে উড়ে যেতে দেখেছিলো এখানকার লোকেরা। তবে বাতাসে ভেসে উড়ে আসছিল ভয়াবহতার টুকরো টুকরো খবর। পাংশুর মুখে সকালে বসে থাকতো পুরো গ্রামটা মৃত্যুদূতের অপেক্ষায়, রুটিনের মতো। প্রতি সন্ধ্যায় সিকান্দার আর বেণুবিহারী উঠোনের কোণে বসে অপেক্ষায় থাকতো বিবিসি বাংলা শোনার। সহজে ধরতোনা। টিউনিং করতে করতে খবরটাই শেষ হয়ে যেতো অনেকদিন। কোন খবরই ভালো আসছিলোনা। মৃত্যুর মিছিল লম্বা হতে হতে মনে হতো তাদের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। মৃত লাশেদের গন্ধ, বারুদ মেশানো ছাই ঢাকা, চাঁটগা, রাজশাহী হয়ে খুব দ্রুতই চলে আসবে তাদের এই গ্রামে। অদৃশ্য বিস্ফোরণের দুঃস্বপ্নে প্রতি রাতে ঘুম ভাঙ্গত। শুধু তারা দুজন নয় সারাদেশ তখন এক প্রবল জ্বরের ঘোরে পুড়ে যাচ্ছে। এরমধ্যেই পাশের শহর নাটোর থেকে খবর এলো মিলিটারি পৌঁছে গিয়েছে। কয়েকটা কামান সাথে নিয়ে খাকি পোশাকে আক্রমণকারীরা তাণ্ডব চালাচ্ছে সেখানে। সবাই পালাচ্ছে ভারত সীমান্তের দিকে। সিকান্দার আর বেণীমাধব, দুজনেরই এখন সংসার হয়েছে, নাতিপুতিও হয়েছে। ওদের কথা ভেবে আঁতকে উঠতো দুইজন। তাদের তো জীবনকাল শেষের দিকেই, কিন্তু এতোগুলো জোয়ান মানুষ, যুবতী মেয়ে এদের কি হবে! খবর যা আসছিলো তাতো মোটেও ভালো কিছু নয়। যুবতী সে জাত আর ধর্মেরই হোক রেহাই পাচ্ছিলোনা ওদের লালসার হাত থেকে। বিশেষ করে বেণুবিহারীর তো অবশ্যই সরে পড়া উচিত! পাক আর্মি আর যাই করুক বেণুকে ছেড়ে দিবেনা। আসলে তারা গণহত্যা করছিলো, কাওকেই ছেড়ে দিচ্ছিলনা। সিকান্দার বেণুকে ডেকে বোঝালো অনেক। দেশ স্বাভাবিক হয়ে এলে তো ফিরতেই পারবে সে! আপাতত পরিবারকে বাঁচাতে হলেও তার সীমান্ত পাড়ি দেয়া দরকার। সেদিনের গুমোট সন্ধ্যায় মাথা নীচু করে বেণু ভাবলো অনেক। আধো আলো অন্ধকারে দুই চার ফোঁটা চোখের পানি ঘাসের জমি ছুঁয়ে দিলো। এতদিনের বন্ধুত্বে এতটুকু একজন আরেকজন বুঝতে পারে। সিকান্দারও হয়ত বুঝেছিলো। কিন্তু তখন দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার সময় নয়। ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় রাজী হলো বেনুবিহারী। দুই ছেলে আর তাদের পরিবারকে ডেকে বলে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে। তখন প্রস্থানকাল, ডাক আসলেই পথে নামতে হবে সবার, এটাই সেই সময়ের নির্মম নিয়তি। প্রদোষ দীর্ঘায়িত হয়ে ছিল! কেউ জানতো না সূর্য কখন উঠবে, আবার নতুন করে সোনালি হবে ভোরের মেঘনার পানি!
(৩)
যাবে যাবে করে আরো মাসখানেক পার করে ফেলেছিলো বেণুবিহারী। এরমধ্যে পাকবাহিনী এগিয়ে এসেছিল আরো অনেকখানি। তখন কল্পনায় নয় বাস্তবেই বিস্ফোরণের শব্দ কানে আসতো! শকুনেরা পাল ধরে উড়ে যেতো কোন এক বধ্যভূমির দিকে। দুই বৃদ্ধ বন্ধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো আর বিমানের সাথে শকুনের পাল্লা দেয়া দেখে অজানা আতঙ্কে চোখ বড় করে কি যেন ভাবতো! ১৯৭১ সালের জুন মাসে যখন অ্যান্থনি মাস্ক্যারেনহাস তার Genocide নামের প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য পাঠাচ্ছিলেন তখন এক ভোরে মধ্যপাড়া থেকে পনেরো মাইল দূরে সদরের জিলা স্কুল মাঠে ঘাঁটি গাড়ল পাকবাহিনীর তিন প্লাটুন সৈন্য। সেই খবর বাতাসের আগেই পৌঁছে গেলো আশেপাশের সব গ্রামে, মহল্লায়! আর দেরি করা চলেনা! সিকান্দার শাহ এককালে ঘুরেছে অনেক, উর্দু ভাঙ্গা ভাঙ্গা জানতো। ভাবলো এসে যদি পড়েই তো দুই একটা কথা বলে শান্ত করা যাবে অন্তত। আহা দিল দিয়ে কথা বললে বুঝবেনা এমন চিড়িয়া এই দুনিয়ায় আছে নাকি কেউ! আয়ুউব শাহীর আমলে জাতীয় দিবসের জন্য বানানো বিঘত সাদা সবুজের চাঁদ-তারা আঁকানো পতাকাটা সেদিনই সাবান দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করে ফেলল। তারপর একটা মোটা বাঁশের মাথায় আরেকটা চিকন বাঁশ বেঁধে উড়িয়ে দিলো আকাশে। যাতে মাটি থেকেও দেখা যায় আবার আকাশ থেকেও বোঝা যায়! বলা তো যায়না, যেভাবে যুদ্ধ-বিমান উড়ছে, কখন বোমা ফেলে। আর নিজে দুটো গরুর গাড়ি ডেকে আনল- একটা বেণুবিহারীর জন্য আরেকটা তার পরিবারের জন্য। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো থেকে যাবে, কিন্তু তাই বলে তো পরিবারকে বিপদে ফেলা যায়না। পঙ্গু মানুষ যেখানেই যাবে, ঝামেলা বাড়াবে, তার চেয়ে এখানেই থাকা ভালো। বয়স তো কম হলোনা; হায়াত মউত উপরয়ালার হাতে, এটা তার ততোদিনে জানা হয়ে গিয়েছিলো। বন্ধুকে থাকতে দেখে বেণুও থাকার জন্য জোরাজুরি করছিলো, সে পাত্তা দিলোনা। ওর তো পা আছে, দৌড়াতে পারবে, কী দরকার পেছনে ফেরার! সন্ধ্যা রাতে সবার যাত্রা করার কথা ছিল। সময় খারাপ, পালানোর জন্যেও আঁধারের অবগুণ্ঠন দরকার তখন।বিকেল বেলায় সবাই যখন শেষ সময়ের গোছগাছে ব্যস্ত ছিল, জনা দশেক লোক এলো সেই যমজ বাড়িতে। ওদের মুখ গামছায় ঢাকা, হাতে চটের ব্যাগ, ভারী কিছু ছিল তাতে। গামছার আড়ালে যে এক চিলতে মুখ দেখা যাচ্ছিলো তা শুধুই দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে ঢাকা। তাদের একজন সোজা সিকান্দারের বরাবর এগিয়ে গেলো; তার চোখে-মুখে অবিশ্বাস। ‘চাচা পাকিস্তানের পতাকা লাগাইছেন যে! খুব মায়া নাকি তাদের জন্য!’ পিছন থেকে বাঘের মতো গর্জন দিল আরো কয়েকজন। অবিশ্বাসের সময়ে বিশ্বাস স্থাপন করা খুবই দুরূহ। পাকবাহিনীর আগমন প্রত্যাশিত ছিল সিকান্দারের কাছে। মুক্তিফৌজ যে এভাবে এসে পড়বে তাতো মাথায় ছিলনা। যখন জীবন বাঁচানোই ধর্ম, তখন অতশত চিন্তার সময় ছিলোনা। এমন সময় বেণুবিহারী তার পরিবার সহ সামনে এসে দাঁড়ালো, একপাল লোক, ছেলেদের পরনে সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো গিঁট করে পরা, মেয়েদের কপালের লম্বাটে সিঁদুর, স্পষ্ট জাত পরিচয়ের স্বাক্ষর! বেণু নমস্কার দিয়ে বললো- ‘দাদা, ও আমাদের বাঁচানোর জন্যে এটা করেছে! আমার খুব সুহৃদ বন্ধু!’ কিছু পরিস্থিতিকে অবিশ্বাস করা অসম্ভব। সত্য মাঝে মাঝে এতো তীব্র হতে পারে যে কোন পর্দাই তখন তাকে আর লুকাতে পারেনা। দশ জন লোক তাদের মাথার গামছা সরিয়ে ফেলে ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়ালো। ‘চাচা আমরা মুক্তিফৌজ। একটু খাবারের ব্যবস্থা করবেন, ক্ষুধায় জানটা যায় যায়!’- হেসে বলেছিলো সামনে দাঁড়ানো মুক্তিসেনাদের নেতা। সেদিন অনেক বড় যুদ্ধ হওয়ার কথা ছিল! পাশের থানা অভয়পুরের গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে এসেছিল মুক্তিরা; গোপনসূত্রে খবর ছিল সেদিন রাতেই ওই গ্রামে আসার কথা জল্লাদ পাকবাহিনীর। এই ঘটনা জানার পর পরিবার পরিজনকে দ্রুত গাড়িতে তুলে দিয়ে সিকান্দার বলেছিলেন, যেভাবে হোক বর্ডারে দিয়ে আয়! ফিরে আসলে জমি লিখে দিবো তোদের! যে সময়ে জীবন মূল্যহীন সেখানে জমি জিরাতের দাম কতটুকু! এই ভেবে হতাশার হাসি ঠোটে মেখে গরুর পিঠে থাপ্পড় দিয়ে ধীরে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলো দুই গাড়োয়ান।সেদিন রাত মনে হচ্ছিলো আর কখনো শেষ হবেনা। সিকান্দার একা বসেছিলো চুপ করে গোয়াল ঘরটার পিছনে। রাতের হাওয়া অশুভ বার্তার জন্য তৈরি ছিল হয়ত। সামান্য ধুপধাপ বুকের মধ্যে ধাক্কা দিচ্ছিল অনবরত। খাওয়া শেষে মুক্তিরা কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছে তা মালুম করা গেলোনা! ওরা এরকমই, এই আসে এই যায়! কোথায় থাকে কেউ টের পায়না। হয়ত আশেপাশেই ছিল! একটা অশনি সংকেত নিয়ে চুপচাপ স্তব্ধ হয়েছিল আকাশ। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় এরকম নিঃসঙ্গতা আর কখনো বোধ করেনি সিকান্দার! মাঝরাতের দিকে প্রকৃতির নিয়মে চোখটা ধরে এসেছিল তার! হঠাৎ ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাসের উষ্ণতা পেয়ে ভূত দেখার মতো ভয়ে পিছনে তাকিয়ে তাজ্জব বনে গিয়েছিলো সে! বেণুবিহারী যায়নি! চল্লিশ বছরের বন্ধুত্বের বাঁধন কেটে সে সেদিন যেতে পারেনি! পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ দূরত্বে পার করে পুনরায় ফিরে এসেছিল।কিছু মুহূর্ত থাকে যখন অনুভূতিগুলো শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায়না। কেবল নীরবতাই পারে সেইসব মূহূর্তগুলোকে অভিব্যক্তি দিতে। সেই স্তব্ধতার চাদরে মুড়ি দিয়ে সিকান্দারের পাশে বসে পড়েছিলো বেণু, তারপর অপেক্ষা করছিলো সম্ভাব্য নরকের। রাতে দূর থেকে যখন সারিবদ্ধ পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছিল, বুটের আঘাতে মাটির কাঁপন বোঝা যাচ্ছিল, সেই সময় তাদের পিছনে বাঁশবাগানের ভিতর থেকে উল্কার মতো ঝাঁক ঝাঁক গুলি বের হয়ে এসেছিল। প্রত্যুত্তরে সামনে থেকেও ছুটে আসতে শুরু করেছিলো ভারী গোলার বৃষ্টি। গোলা বারুদের ঝলকানি আর কান ফাটানো শব্দে নরকের বুকে স্থবির হয়ে বসে পড়লো দুই বন্ধু!সিকান্দার আর বেণুবিহারীর পরিবার পরিজন তখন মধ্যপাড়া গ্রাম ছেড়ে প্রায় মাইল পাঁচেক ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো আলমপুরের দিকে। দূর থেকে চোখে পড়েছিলো দাবানলের মতো আগুন গিলে খাচ্ছে তাদের প্রিয় গ্রামটাকে, উল্কার মতো স্ফুলিঙ্গ উড়ছে আকাশে কোথাও কোথাও! টানা বুলেট ছোঁড়ার শব্দ, টের পাওয়া যাচ্ছিলো অত দূর থেকেও!১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের পর দুই পরিবারের লোকজনই আস্তে ধীরে ফিরে এসেছিল এই এলাকায়। কিন্তু দুই বৃদ্ধের খোঁজ আর কেউই পায় নাই। গ্রামের মানুষ যারা ওই রাতে উপস্থিত ছিল, তারাও কোন খোঁজ দিতে পারেনি তাদের। শুধু জমজ বাড়ি দুটো দাঁড়িয়েছিল পাঁজরে অসংখ্য বুলেটের দাগ নিয়ে।
(৪)
দেশ স্বাধীন হলো, তারপর একদিন শেখ সাহেবকে মেরে ফেলা হলো, কত স্বৈরশাসন এলো আবার চলেও গেলো! এখন সময় ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পেরিয়ে গিয়েছে। যমজ রাজাদের কথা পাড়ার বুড়োরা গল্পের তালে এখনো বলে, তবে ওই সময়ের মানুষগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সিকান্দার আর বেণুবিহারীর বংশধরেরাই বাস করছে যমজ বাড়ি দুটোতে। আগের মতো বন্ধুত্ব আর নেই দুই পক্ষের। পালটেছে সময়, পালটেছে মানুষ! দুই বাড়ির জায়গা পিলার দিয়ে আলাদা করা। বাঁশবনটা নাকি কেনার সময় বেণুবিহারীর নামে ছিল, পরে সেটা সিকান্দারকে ভাগ দেয়ার কথা। কিন্তু বেণুর বংশধরেরা তা দিলো কই! আগের জামানায় কথার দাম ছিল বাপু! তার শোধ নিতে গিয়ে সিকান্দারের নাতি পুতিরাও ভাগের পুকুর একাই ভোগদখল করছে! এখন নাকি হিন্দু বাড়ির ছেলে রাইবিহারী উকিল হয়েছে। কথায় কথায় মামলা দেয়ার ভয় দেখায়। একদিন সুযোগ পেলে যে সবকয়টাকে বাড়ি ছাড়া করবে সে কথা উচ্চস্বরে জানিয়ে দিতে ভোলেনা সিকান্দারের নাতি কামাল শাহ। সে রাজনীতি করে। কখনো সরকারি দলে থাকে, কখনো বিরোধীতে! সরাসরি কিছু করলে ইমেজ যাবে এই ভয়ে কিছু করেনি এখনো। তার উপর বাড়ি দুটো একদম গায়ে গায়ে লাগানো।অবিশ্বাস জিনিসটা সংক্রামক, একবার শুরু হলে আশেপাশের মানুষের মধ্যেও ছড়ায়। এখন যেমন ছড়িয়ে গিয়েছে রাইবিহারীর বাড়ির লোকজনের মধ্যে। তার গিন্নী কোনভাবেই এখানে থাকতে রাজী হচ্ছেনা। শহরে পাকাপাকি ভাবে যেতেই হবে। এখানে কখন ছেলে মেয়ের কোন একটা ক্ষতি হয়ে যায় তার ঠিক আছে! যদি কিছু হয়ে যায় রাইবিহারী কি মামলা করে তা ফিরিয়ে আনতে পারবে! কথায় যুক্তি আছে তার, মনে হয় রাইবিহারীর। কামাল শাহের সাথে ছোটবেলায় কত খেলেছে সে। অথচ আজ মানুষটা বদলে গিয়েছে। সব রাজনীতির ক্ষমতার ঝাঁজ, ভাবে রাইবিহারী। যেতে হবে হয়ত, এভাবে আর কতোদিন। কামালের গিন্নী সালেহা সাধারণ ঘরের মেয়ে। অনেক ছোট কালে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল। প্রথম প্রথম খুব ভাব হয়েছিলো অই বাড়ির মানুষগুলার সাথে। পরে দুপক্ষের রেষারেষি দেখে সেও আর ওদের পছন্দ করে না। একমাত্র ছেলে রকিকেও কড়া ভাবে মানা করে দেয়া আছে এ ব্যাপারে। রকির বাপ বলে, বাঁশবাগানে বসে কি সব যাদুটোনা করে তার ঠিক আছে! ওইদিকে ছেলে মেয়েদের না যাওয়াই ভালো! আর কথা বলতে গেলেও ওরা ঝেড়ে কাশেনা, পেটের মধ্যে কথা লুকিয়ে রাখে! অসহ্য ব্যাপার! এভাবেই দূরত্ব সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। সম্প্রতি মধ্যপাড়া গ্রামের পেট চিড়ে মহাসড়ক তৈরি হচ্ছে, আসলে বাইপাস সড়ক। সড়কটা রাজধানীমুখী হওয়ায় পার্শ্ববর্তী জায়গাগুলোর দাম হুহু করে বাড়ছে। সমস্যা হচ্ছে পুরো বাড়িটা যে দাগের উপর তার একপাশ দিয়ে যাচ্ছে রাস্তাটা। কামাল শাহ তার বিরক্তিকর প্রতিবেশীকে শায়েস্তা করার উপায় খুঁজে পেয়েছেন বহুদিন পর। তার গেটের সাথে রাস্তার যোগাযোগের জায়গাটা ঠিক রেখে বাকী অংশে গভীর খাল তৈরি করার বুদ্ধি এসেছে সকালেই। তখন রাইবিহারী ব্যাটা চাইলেও মহাসড়কে উঠতে পারবেনা। পিছনের জমির আইল দিয়ে ঘুরে এসে উঠতে হবে, আর ওখানের জোঁক গুলো যখন সপাটে কামড়ে দেবে ওর বাড়ির সবাইকে, তখন বুঝবে কামাল শাহ কি জিনিস! তাই ভোর থেকেই লোক লাগিয়েছে, তারা খুড়ে যাচ্ছে একমনে। সাথে কয়েকজন ভাড়া করা লাঠিয়ালও রেখেছে, নির্দেশ দেয়া আছে থামাতে আসলেই আগে মার! তারপর দেখা যাবে বিচার সালিশে কী হয়!রাইবিহারী জেলা শহরে ওকালতি করে মোটামুটি নাম জমিয়েছে এতোদিনে। সকালে যখন এই খবর পেলেন, বুঝলেন কামাল শাহ প্রস্তুতি ছাড়া মাঠে নামেনি। খালি হাতে বীরত্ব দেখাতে যাওয়ার পরিণতি তার ভালোই জানা, এমন মক্কেল কত সামলিয়েছে। সদর থানার ওসির সাথে তার সদ্ভাব ছিল কর্মসূত্রেই। ফোন মারফত সাহায্য চাইল! আর ফোর্স না আসা পর্যন্ত আরামকেদারায় বসে কামাল শাহের নামে কি লিখবে মামলায় তার খসড়া বানাতে শুরু করলো। এক কাপ চা চাইলো গিন্নীর কাছে। চায়ে চুমুক না দিলে তার আবার মাথার বুদ্ধি খোলেনা। আর হ্যাঁ, ওর নামে মামলা দিয়ে তো বাকী জীবন এই বাড়িতে শান্তিতে বাস করার কোন সম্ভাবনা নেই। পরিবার নিয়ে তাকে শহরে স্থানান্তরিত হবে সপ্তাহের মধ্যেই। পরে সুযোগ বুঝে মালদার কোন পার্টির কাছে বেঁচে দিবে জায়গাটা। ওর মতন পাতি নেতাকে প্যাঁদানি দিয়ে এলাকা ছাড়া করে দিবে এমন কারো কাছেই বেচবে সে। এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে কখন ঘন্টাখানেক পার হয়ে গিয়েছে তার খেয়ালেই ছিলোনা। বাইরে হুইসেল বাজছে, পুলিশের হুইসেল! কালো কোটটা গায়ে জড়িয়ে অকুস্থলের দিকে রওনা দিলো রাইবিহারী।এক মহাকান্ড হয়ে গিয়েছে আজ মধ্যপাড়ায়! কামাল শাহের লোকজনকে থামাতে পুলিশ যখন পৌঁছেছিল, ততক্ষণে অনেকটা গভীর পর্যন্ত খুড়ে ফেলছিলো তারা। তাতেই ঘটেছে ঘটনাটা; বামদিকের জায়গাটা থেকে উঠেছে দশ বারোটা মাথার খুলি আর হাড়গোড়! আর ডানদিকের একটা ছোটমতোন জায়গা থেকে উঠে এসেছে দুইটা মাথার খুলি আর হাড়গোড়। অসংখ্য মানুষ জড়ো হচ্ছে। এই গ্রাম আশেপাশের গ্রাম এমনকি শহর থেকেও আসছে সবাই! এত নতুন বধ্যভূমির আবিষ্কার! সাংবাদিকরা লাইভ কাভারেজ করছেন। মধ্যপাড়ার নাম জাতীয় সংবাদে দেখাচ্ছে। শুধু রাইবিহারী আর কামাল শাহ দাঁড়িয়ে আছে যে পাশে দুটো কঙ্কাল ছিল সেই পাশে। একটা কিশোর ছেলে যত্ন করে হাড়গোড় গুলো সাজিয়ে রাখছে। আরে ওইতো, একটা কঙ্কালের এক পাশের হাতের হাড় কম! আরেকটা কঙ্কালের পায়ের হাড় মসৃণ করে কাটা। পাশের ভাটফুলের ঝোপে বসে আছে পাড়ার সবচেয়ে বুড়ো গোবিন্দ খুড়ো আর মোসলেম চাচা; দুজনেরই বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই! ওরা মাথা নাড়াচ্ছে আর বলছে “এরাই সিকান্দার আর বেণুবিহারী, মধ্যপাড়ার জমজ রাজা! এতদিন পর খোঁজ মিললো তবে!” বুনো বাতাসে দুই একটা ভাট ফুল ঝরে পড়ছিল কঙ্কাল দুটোর উপর!কামাল শাহ কাঁদছেন, কাঁদছেন রাইবিহারী ও! দুজন দুজনের হাত শক্ত করে ধরে আছেন। সাংবাদিকদের ক্যামেরা গুলো একটার পর একটা ফ্ল্যাশ দিচ্ছে তাদের মুখের উপর। বাতাসে প্রশ্ন ভেসে আসছে হাজারটা। তারা দুজন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। চোখের পানিতে পৃথিবী ঝাপসা লাগছে খুব!