অধ্যায় ১: সকাল বেলার সূর্য
নিমগাঁও, বাংলাদেশের এক নিভৃত ছোট্ট গ্রাম। গ্রামটি যেন প্রকৃতির কোলে সাজানো এক টুকরো স্বর্গ। চারদিকে শস্যক্ষেত্র, মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে সরু এক নদী, যার মৃদু ঢেউ আর কলতান যেন সঙ্গীতের মতো প্রতিদিন গ্রামের মানুষদের সঙ্গ দেয়। এখানকার জীবন ধীরস্থির, সহজ-সরল, কিন্তু এর মধ্যেই আছে প্রকৃতির গভীরতার স্পর্শ। ভোরবেলা গ্রামের মানুষজন উঠে আস্তে আস্তে দিন শুরু করে। তাদের জীবনচক্রের সাথে প্রকৃতির মিল যেন অবিচ্ছেদ্য।
ভোরের আলো যখন ধীরে ধীরে প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তখন ফসলের ক্ষেতে ঝকঝকে সোনালী আভা ফুটে ওঠে। সূর্যের রশ্মি যেন নতুন আশার বার্তা নিয়ে আসে, প্রতিদিনই যেন নতুন কিছু শুরু হতে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা গায়ে হালকা কাপড় জড়িয়ে, মাঠের দিকে হাঁটা দেয়। পাখিরা গান গাইতে শুরু করে, কাকের ডাক শোনা যায় দূর থেকে, আর বাতাসে ভেসে আসে কাঁচা মাটির গন্ধ। প্রকৃতির এমন এক অনবদ্য দৃশ্যের মধ্যে করিম মিয়া প্রতিদিনের মতো বেরিয়ে পড়ে তার ক্ষেতের দিকে।
করিম মিয়া, গ্রামের অন্যতম পরিচিত মুখ। গ্রামের কৃষকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে অভিজ্ঞ। শৈশব থেকেই মাটির সাথে তার সম্পর্ক, মাটির গন্ধেই যেন তার জীবনের আনন্দ লুকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি সবসময় তার জমির দিকে, যেন শস্যের প্রতিটি দানা তার সন্তানের মতো যত্নে লালিত। আজও তিনি সকালে উঠেই মাঠের দিকে পা বাড়ালেন। হাতে লাঙল, মাথায় একটি পুরানো গামছা। শরীরের শক্তি কমে গেলেও তার মনের শক্তি এখনও অটুট। গ্রামের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেন।
আজকের দিনটা একটু আলাদা। গত কয়েকদিনে বৃষ্টির পর মাঠের মাটি নরম হয়ে গেছে, আর সেটা করিম মিয়ার মতো কৃষকের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। মাটি যখন নরম থাকে, তখন চাষাবাদ করা সহজ হয়। ফসলের গাছগুলোও যেন বৃষ্টির জলে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। করিম মিয়া তার লাঙলটা নিয়ে জমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে চোখ বুলালেন। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছগুলো যেন পাহারাদারের মতো সবকিছু দেখছে।
করিম মিয়া শুধু একজন কৃষক নন, তিনি গ্রামের অন্যান্য মানুষদের জন্যও একজন গুরুতুল্য। তার অভিজ্ঞতা আর ধৈর্য গ্রামের যুবকদের কাছে অনুপ্রেরণা। যুবকরা প্রায়ই তার কাছে আসে কৃষি কাজের নানা পরামর্শ নিতে। করিম মিয়ার কাছে কৃষিকাজ শুধু জীবিকা নয়, এটা তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি বলেন, "মাটি আর মানুষ একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে। যতদিন মাটি আছে, ততদিন মানুষ বাঁচবে। মাটির যত্ন নিতে হবে, মাটি আমাদের মা।"
গ্রামের মানুষের জীবন খুবই সাধারণ, কিন্তু সেই সরলতার মধ্যেই যেন প্রকৃত সুখ লুকিয়ে আছে। এখানে কেউ তাড়াহুড়ো করে না, শহরের কোলাহল থেকে বহু দূরে এই গ্রামের মানুষ প্রকৃতির ছন্দে জীবন কাটায়। করিম মিয়ার ক্ষেতের পাশে আরও কয়েকজন কৃষক কাজ করতে এসেছে। তারা সবাই একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় করে। কারও মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা নেই, কেউ কারও থেকে বড় হওয়ার চেষ্টা করে না। বরং একে অপরের সাহায্যে সব কাজ করা হয়।
গ্রামের মহিলারাও কম পরিশ্রমী নয়। তারা ঘরে বসেই নানা রকম কাজ করে, যেমন হাঁস-মুরগি পালন, পাট থেকে সুতা তৈরি, আর নিজেদের ছোট্ট বাগানে শাকসবজি চাষ। করিম মিয়ার স্ত্রী, আমেনা, এমন একজন নারী যিনি পরিবারকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করেন। ঘরের প্রতিটি সদস্যের যত্ন নেয়ার পাশাপাশি, তিনি গ্রামে অনেক নারীর সহায়তায় তাদেরও স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেন। গ্রামের ছোট ছোট মেয়েরা তার কাছে আসে, তাদের শেখানো হয় কীভাবে ছোট ব্যবসা শুরু করা যায়, কিংবা নিজেদের চাহিদা কীভাবে পূরণ করতে হয়।
ফারুক, করিম মিয়ার বড় ছেলে, শহরে পড়াশোনা করছে। সে মাঝে মাঝে গ্রামের সরল জীবনের কথা মনে করে। শহরের জটিলতা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, কিন্তু গ্রামের মাটির টান সে কখনও ভুলতে পারে না। করিম মিয়া জানেন যে একদিন তার ছেলে বড় মানুষ হবে, কিন্তু তার মনে সবসময়ই থাকে গ্রামের প্রতি ভালবাসা। করিম মিয়া প্রায়ই ফারুককে বলেন, "তুই বড় হবি ঠিক আছে, কিন্তু গ্রামের কথা কখনও ভুলবি না। শহরের বড় চাকরি আর টাকার পেছনে ছোটার আগে মনে রাখবি, এই গ্রামের মাটি, এই মানুষগুলো তোর মূল পরিচয়।"
এই ভাবনা করিম মিয়ার দিনকে একটু ভাবগম্ভীর করে তোলে। তিনি তার মাথা উঁচু করে চারপাশটা আবার একবার দেখেন। প্রকৃতি যেন তার প্রতিদিনের অনুপ্রেরণা। জীবনের প্রতিটি দিনের শেষে তিনি ক্লান্ত হলেও শান্তিতে থাকেন। গ্রামের এই সরলতা, প্রকৃতির এই নিবিড় সান্নিধ্য, তার জীবনকে পূর্ণ করেছে। যতদিন এই সবুজ শস্যক্ষেত্র থাকবে, ততদিন তার জীবনও থাকবে উজ্জ্বল।……………………