পোস্টস

গল্প

মুসকান ভিলায় একরাত

১ জুন ২০২৪

ইসহাক তুহিন

মূল লেখক ইসহাক তুহিন

মুসকান ভিলায় একরাত
ইসহাক তুহিন

ইচ্ছে করছে ফুটপাতে বসে একটু জিরিয়ে নিতে। সাত ঘণ্টার ক্লান্তিকর জার্নি শেষে একটু আগেই বাস থেকে নামল ওরহান। শরীরটা একেবারে কাহিল। একবার ভাবল মুসকানকে কল দিয়ে বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নিবে কিনা। কল দিয়ে লাভ নেই। রিসিভ করবে না, ইদানীং তার কল রিসিভ করে না মুসকান।
ফোনে একটা মেসেজ এসেছে। ফোন বের করে ওরহান দেখল, মুসকানের ছোটভাইয়ের মেসেজ! বাড়ির ঠিকানা লিখে পাঠিয়েছে। এতোক্ষণ পর তার কলিজায় পানি এসেছে। নইলে এতো বড় শহরে মুসকানকে কোথায় খুঁজতো! শহরে তো আর মুসকান একটা না!  

কয়েকমাস আগে পুরাতন বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে ওঠেছে মুসকানরা। বাড়ির গেইটে বড় বড় বাংলা অক্ষরে লিখা "মুসকান ভিলা"। পুরনো বাড়িটার নির্দিষ্ট কোনো নাম ছিল না। নতুন বাড়িটাতে আগে একবারও আসা হয়নি ওরহানের। 
বাড়ির গেইটে বুড়ো দারোয়ান খুকখুক কাশতে কাশতে ওরহানকে আটকে দিয়েছেন।
- স্যার আর ম্যাডাম তো দেশের বাড়িতে গেছেন! আপনি কার কাছে এসেছেন?
- আমি মুসকানের কাছে এসেছি।
- দাঁড়ান। আমি মুসকান মামুনিকে একটা কল দিয়ে দেখি।
দারোয়ান কল দিয়ে নিশ্চিত হলেন যে, তাঁর মুসকান মামুনির কাছেই এসেছে ওরহান। 
সিঁড়ি মাড়িয়ে দুতলায় ওঠে দোরঘণ্টি বাজাল। বেশ কয়েকবার বাজানোর পর দরজা খুলল মুসকানের ছোট ভাই তানজিম। ওরহানকে দেখে তার চোখে-মুখে একধরনের উচ্ছ্বাস। 
- ভাইয়া, এতোদিন পর?
- হু, এতোদিন পর তোকে দেখতে এলাম।
- আমাকে নাকি আপুকে?
ওরহান ঢোঁক গিলে বলল, তোর আপুকে!
তানজিম হো হো করে হেসে উঠল।

ড্রয়িংরুমে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে ওরহান। তার পাশে বসে ভারতীয় চ্যানেলে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে তানজিম। এ হিন্দি সিরিয়ালগুলো একদমই পছন্দ না ওরহানের। টেবিলের ওপর রাখা তিনদিনের বাসি পত্রিকাটি হাতে তুলে নিল সে। পড়ার মতো তেমন কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না পত্রিকায়, হুদাই পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে।
"বিদায় অনুষ্ঠানে মানপত্র না থাকায় প্রধান শিক্ষককের নাক ফাটালেন সহকারী শিক্ষক" এ টাইপের খবরে ভর্তি। বিরক্ত হয়ে পত্রিকাটা রেখে দিল সে। 
এখানে আসার পর থেকে মুসকানকে বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে সে। মুসকান কল তো রিসিভ করছেই না, উল্টো কল কেটে দিচ্ছে!
ইতোমধ্যে ছোটভাইকে দিয়ে মেহমানের জন্য নুডলস আর চা পাঠিয়েছে মুসকান । নুডলস খায়নি ওরহান। চা-টা খেয়েছে শুধু। আজকাল খাবারের প্রতি তেমন রুচি নেই তার। রুচি উবে গেছে। 
- তানজিম, তোর আপুকে একটু ডেকে নিয়ে আয়।
- আপুকে কেন? আপনি না প্রথমে বলেছিলেন, আপনি আমাকে দেখতে এসেছেন!
- হু, তোকেই তো দেখতে এসেছি। কিন্তু তোর আপুর সাথে আমার একটা জরুরি আলাপ আছে। একটু ডেকে নিয়ে আয় ভাই।
-না, না ভাইয়া। আমি যেতে পারব না। আপু আমাকে বকবে, চড়-থাপ্পড়ও দিয়ে বসতে পারে। বলা যায় না।
হেনতেন আরো অনেক আজাইরা প্যাচাল! এসব কিছুই না, তানজিমের আসল ব্যামো ধরে ফেলেছি ওরহান। একহাজার টাকার একটা কড়কড়ে নোট তামজিমের হাতে গুঁজে দিল। খুশিতে আটখানা তানজিম। মুহূর্তেই তার চোখেমুখের বিরক্তি ভাবটা কেটে গেল। 
- আপু বকলে বকুক, চড় দিলে দিক। আপনার জন্য একটা রিস্ক না হয় নিলাম! বলে একগাল হেসে ভেতরে গেল সে।
আসরের নামাজে দাঁড়িয়েছে মুসকান। নিয়মিত নামাজ পড়ে সে। কখনো তাহাজ্জুদও ছুটে না তার। নামাজ পড়ার বিষয়টা তাদের পরিবারে চর্চা আছে। নামাজ আসলে চর্চার বিষয়। চর্চা না থাকলে একজন মানুষ যতই ধর্মভীরু হোক না কেন তার পক্ষে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া এতো সোজা না! 
নামাজ শেষে জায়নামাজ হাতে ওঠে দাঁড়াল মুসকান। তার নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তানজিম। চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে বলল, ওরহান ভাইয়া একা একা বসে থাকবে নাকি? দেখা করবি না? 
- হু, করব। এতো অস্থির হবার কি আছে! 
তানজিমের হাতে একটা চিরকুট দিয়ে মুসকান বলল,
তুই আগে এটা ওরহানকে দিয়ে আয়।
চিরকুটটা হাতে নিয়ে খুলে দেখতে চাইল তানজিম।
- এটা খোলার জন্য আমি তোকে পারমিশন দিয়েছি?
ধমকে উঠল মুসকান। 
- না।
-তাহলে সোজা গিয়ে ওরহানকে দিয়ে আয় ওটা।

চিরকুটটি ওরহানের হাতে এলো। এক আকাশ কৌতূহল নিয়ে খুলে দেখল ওরহান। মুহূর্তেই তার কৌতূহলটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। চিরকুটে লেখা-

প্রিয় ওরহান,
আমি আপনার সাথে দেখা করবো, তবে এক শর্তে। শর্তটি হলো- এশার নামাজের পর আপনি আমার রুমে আসবেন। দুজনে বসে আলাপ করবো। কিন্তু রুমে কোনো আলো থাকবে না। যদি শর্তে রাজি হন, তবে চিরকুটের নিচে একটা স্বাক্ষর করে তানজিমকে দিন।

ওরহান মনে মনে বলল, অদ্ভুত এক শর্ত। মুসকানের মাথা-টাথা গেছে নাকি! শর্তে রাজি না হয়েও কোনো উপায় নেই তার। চিরকুটের নিচে স্বাক্ষর করে অসহায় আত্মসমর্পণ করে বিড়বিড় করল সে , পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে! 
এশার নামাজের পর মুসকানের রুমে ডাক পড়ল তার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে, কবরে শুইয়ে দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে তাকে! কবরে শুয়ে থাকার অনুভূতি কি রকম তার  জানার কথা না। তবু তেমনটাই মনে হচ্ছে তার। 
পারফিউমের একটা কড়া ঘ্রাণ এসে তার নাকে-মুখে ধাক্কা দিল। এ ঘ্রাণটা তার কাছে নতুন না। সে বুঝে গেল, মুসকান রুমে ঢুকেছে। এ পারফিউমটাই সবসময় ব্যবহার করে মুসকান, অন্য কোনো পারফিউমে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। 
- মুসকান! 
- হু, শুনছি।
- তুই কি আমাকে এভোয়েড করছিস?
- হু, করছি।
- কিন্তু কেন?
-  কারণ আছে।
- কারণটা জানতে চাই।
- আপনি তো জানেন, আমি এ বছর আব্বুর সাথে হজে গেছি। 
- হু, জানি। তো কী হয়েছে?
মুসকান এবার দৃঢ় গলায় বলল, হজ করার পরও আমি তো কোনো অনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকতে পারি না। আল্লাহ মানুষের মনটাকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। আর সেটা অনৈতিকভাবে কাউকে দিয়ে দিলে তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হন।
- হু, বুঝেছি। চল্, তাহলে আমরা বিয়ে করে ফেলি।
- আপনার সাথে তো আমার বিয়ে হবে না।
- কী বলিস! বিয়ে হবে না মানে কি? ওরহান তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।
- হজ থেকে আসার পর আমি ইস্তেখারা নামাজ পড়ে আমার জীবনসঙ্গীর বিষয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি।
- তারপর?
- তারপর আমি ইস্তেখারার ফলাফল হাতেনাতে পেয়েছি।
- ফলাফল কী?
মুসকান কোনো জবাব দিল না। ওরহান চেঁচিয়ে উঠলো, চুপ করে আছিস কেন?
- স্বপ্নে আমার হবু স্বামীকে দেখেছি। ওটা আপনি নন, অন্য কেউ।
ওরহানের কলিজাটা ধক করে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই লোকটাকে চিনস?
- না, চিনি না। আগে কখনো দেখিনি।
- দেখ্ মুসকান, আমি এতকিছু বুঝি না। চল্, আমরা বিয়ে করে ফেলি।
- আপনার সাথে আমার আর কথা নেই। যা বলার ছিল, বলে ফেলেছি। রাতে খেয়ে আপনি বিদায় হন।
- না, আজকের রাতটা থাকি। ভোরে উঠে চলে যাব।
- আব্বু-আম্মু বাড়িতে নেই। দারোয়ান চাচা মাইন্ড করবেন।
- প্লিজ, প্লিজ। ভোরে উঠে চলে যাব। প্রমিজ!
- আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখি কি করা যায়। দারোয়ান চাচাকে ম্যানেজ করতে হবে আর কি!
- একটা অনুরোধ করলে রাখবি? ওরহানের গলাটা অসহায়ের মতো শুনালো।
- বলুন।
- রুমের লাইটটা একটু জ্বালাই, তোকে এক পলক দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে। 
সাপের মতো ফোঁস করে উঠল মুসকান, আপনি কিন্তু শর্ত ভাঙার চেষ্টা করছেন। এটা মোটেও মুমিনের লক্ষণ না।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখলাম না!

রাত বাড়ছে। ইদানীং তার একটা বদ্যাভাস হয়ে গেছে। সারারাত ঘুম আসে না। ফজরের আজানের পরপরই চোখে রাজ্যের সব ঘুম এসে জড়ো হয়। ইচ্ছে করলেও তো ফজরের পর কর্মব্যস্ততার কারণে ঘুমানো সম্ভব হয় না। 
আজকেও ঘুম আসছে না তার। এপাশ-ওপাশ করছে শুধু। বুকের ভেতরটা কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। সিথান থেকে মোবাইলটা হাতড়ে নিয়ে দেখল, এতোরাতেও ফেসবুকে একটিভ মুসকান। তাকে ম্যাসেঞ্জারে একটা মেসেজ পাঠাল ওরহান। মুসকানকে নক দিয়েও কোনো লাভ নেই। ইদানীং মেসেঞ্জারে তাকে কোনো মেসেজ পাঠালে রিপ্লাই তো দূরের কথা, সিনও করে না। গতবছর বার্থডে উইশ করে তাকে যে মেসেজটা পাঠিয়েছিল ওরহান, ওই মেসেজটা আজও সিন করেনি মুসকান। এতো অপমানের পরও ওরহানের আগ্রহটা দমে যায় না, দিনের পর দিন মুসকানকে ইনবক্সে নক দেয় সে।
বেচারা খুব বড় আশা নিয়ে এখানে এসেছে -  মুসকানকে একটু কাছে পাবে, পাশাপাশি বসে একটু সুখ-দুঃখের গল্প করবে শেয়ার করবে। তার আশা তো পূরণ হচ্ছেই না, উল্টো কীসব আজেবাজে প্রলাপ বকছে মুসকান! তাহলে কি মুসকান অন্য কারো প্রেমে পড়েছে? নাকি অন্য কাউকে ভালোবেসে গোপনে বিয়ে-শাদি করে ফেলেছে? তাকে অনেক বছর ধরে চিনে ওরহান, ও সেই রকম মেয়ে না। রকম মেয়ে না, ঠিক আছে। কিন্তু সে রকম মেয়ে হতে কতক্ষণ? এসব আকাশ-পাতাল ভেবে কোনো কূলকিনারা পায় না ওরহান, নিজেকে খুব অসহায় লাগে তার। 
হঠাৎ একটা ছায়া তার সিথানের পাশ দিয়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মোবাইলটা হাত থেকে রেখে তড়াক করে বিছানা থেকে নামল ওরহান। ছায়াটা পিছু নিল সে। কয়েক কদম যাওয়ার পর ছায়াটার নাগাল পেল সে। খপ করে ছায়াটিকে স্পর্শ করল।
- কী করছেন? ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি!
হাতটা ছেড়ে দিল ওরহান। ছেড়ে দেবার সাথে সাথেই তার ঠোঁটে দুম করে একটা ঘুষি পড়ল। ঠোঁট থেকে দরদরিয়ে রক্ত বেরোল। দু'হাতে ঠোঁট চেপে ধরে রক্তাক্ত অবস্থায় ওয়াশরুমে ঢুকল সে। বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল, নিচের ঠোঁট ফেটে গেছে। ঠোঁটে পানি ছিটালো সে, কুলকুচি করল, মুখ ধুলো। 
সকালে তার ফোলা ঠোঁট দেখে তানজিম আঁতকে উঠল, আপনার ঠোঁটে কী হয়েছে, ভাইয়া?
- আর বলিস না। রাতে ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা খেয়েছি! 
- বলেন কী! রুমের লাইট জ্বালাননি?
- ঘুমের ঘোরে লাইট জ্বালাতে খেয়াল ছিল না।
তানজিম খবরটা তার বোনকে দেয়ার জন্য ছুটে গেল। খবরটা শুনে খুবই মর্মাহত হলো মুসকান। তানজিমের হাতে তিন হাজার টাকা দিয়ে সে বলল, তোর ওরহান ভাইয়াকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যা।