পোস্টস

উপন্যাস

দ্যা পেপার ম্যারেজ (২)

১২ জুন ২০২৪

রাজিয়া সুলতানা জেনি

আগের পর্ব

 

 

ইয়েস। অন্ধকার জগতে প্রবেশ করলাম। প্রফেশানটায় বেশ কিছুদিন কাটাবার পরে, প্রফেশানটা সম্পর্কে ধীরে ধীরে কয়েকটা ব্যাপার বুঝেছিলাম। প্রফেশানটা সম্পর্কে ইউজুয়াল যে ধারণা বাজারে চালু আছে, আসল কাহিনী তেমনটা না। অন্য জায়গার কথা জানি না, আমি যে হোটেলে গিয়েছিলাম, জোর করে কাউকেই এখানে ধরে আনা হয় না। সবাই এখানে স্বেচ্ছায় এসেছে।

কয়েকজনের সাথে আলাপ হয়েছে। যা বুঝলাম, কমবেশি সবাই এসেছে টাকার জন্য। দ্রুত, একগাদা টাকা কামাই করতে। কেউ নিজের জন্য, কেউ ফ্যামিলির জন্য। আর আমার মত কেউ কেউ নেশার তাড়নায়। সবারই টাকা দরকার।

কেউ চলে যেতে চাইলে, কোন বাধা দেয়া হয় না। শুধু তা ই না। এখানে মেয়েদের বেশ রাশ। সব ইয়াং, সুন্দরী মেয়ে, লাইন ধরে অপেক্ষায় থাকে ডাক পাওয়ার।

আমি বা আমার মত ইয়াং, ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টদের একটা আলাদা চাহিদা আছে। এদেরকে লাইনে আনতে অনেক বেশি টাকার টোপ দেয়া হয়। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি পড়ুয়াদের, ভালো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের মেয়েদের, রেট একটু বেশি। আর যদি মেয়েটা এই লাইনে নতুন হয়, তাহলে বেশ কিছুদিন এই হাই রেট পায়। তবে প্রথম ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে, সুন্দর মুখশ্রী। অলসো পার্ফম্যান্স।

শুরুর দিনটা আমার এখনো মনে আছে। সন্ধ্যার দিকে দিবা জানাল, আজকে যেতে হবে। কথাটা শোনার পর থেকেই কেমন মুষড়ে পড়ি। কি করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এমন কেউ ছিল না, যার কাছে অ্যাডভাইস চাইব। শুধু বুঝতে পারছিলাম, এমন একটা জালে যেভাবে আঁটকে গেছি, সেটা থেকে আমার বেরোবার কোন পথ নেই।

সন্ধ্যার দিকে তৈরি হলাম। উবার নিয়ে আমি আর দিবা রাত আটটার দিকে হোটেলে পৌঁছে গেলাম। গাড়ী থেকে নামতে নামতে ফিল করলাম টেনশানে হার্টবিট বেড়ে গেছে। দিবাকে দেখে মনে হল, এটা ওর রোজকার কাজ। ও নিজেও এই লাইনে আছে কি না জানি না, তবে এটা বুঝতে পারলাম, হোটেলে ঢোকার পরে কি করতে হবে, সেটা ওর বেশ ভালোই জানা।

হোটেলটার নাম রেইনি গার্ডেনে। মূল দরজায় বেশ বড় করে নাম লেখা। এয়ারপোর্টের কাছেই। দরজার কাছাকাছি আসতেই ডোরম্যান দরজা খুলে ধরল। ভেতরে ঢুকে চারদিকে তাকালাম। বেশ ছিমছাম একটা হোটেল। দিবা দেখলাম বেশ স্মার্টলি রিসেপশানের দিকে এগিয়ে গেল। রিসেপশানিস্ট মেয়েটা মনে হয় ওকে চেনে। হেসে ‘হ্যালো' বলল। দিবা জানালো ম্যানেজারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। মেয়েটার কাছেও বোধহয় ইনফর্মেশানটা ছিল। ম্যানেজারকে ফোন করে চেক করার প্রয়োজন মনে করল না। ঘাড় কাত করে আমাদের এগিয়ে যেতে অ্যালাও করল। এরপরে আমরা 'ম্যানেজার' লেখা রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।

 

ডোর হ্যান্ডলটা ঘুরিয়ে দরজা খুলল দিবা। রুমটা বেশ বড়। সুন্দর করে ডেকোরেট করা। তবে রুমটা দেখে মনে হল ওয়েটিং রুম। তাকালাম দিবার দিকে। ও একটা সোফা দেখিয়ে ইশারায় আমাকে বসতে বলে নিজেও বসল একটা সোফায়। এমন সময় একটা মেয়ে এসে আমাদের ড্রিঙ্কস আর নাস্তা দিয়ে গেল। নাস্তা খেলাম। ম্যানেজারের তখনো দেখা নেই। দিবা জানাল, চলে আসবে। মিনিট পনেরো পরে আরেকজন মেয়ে এসে আমাদের বলল, ‘আসুন'। এবার আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল ভেতরের একটা রুমে। সেখানে দেখা হল ম্যনেজার কাম এখানকার সর্বেসর্বা, ইউসুফ ভাইয়ের সাথে।

দিবার সাথে উনার কিভাবে পরিচয় জানি না, তবে যেভাবে ওরা সেক হ্যান্ড করল তাতে মনে হল, বেশ ভালো পরিচয়। আমাদের দুজনকে বসতে বললেন ইউসুফ ভাই। এরপরে আমার দিকে এক নজর তাকালেন। চোখে অ্যাপ্রিসিয়েশান। আর দিবার দিকে যেভাবে তাকালেন, তাতে মনে হল দিবার ওপরে উনি বেশ খুশি।

 

ইউসুফ ভাই বেশ হ্যান্ডসাম। দেখতেও বেশ সুন্দর। কমপ্লিট পড়া দারুণ হ্যান্ডসাম মানুষটি এমন জঘন্য কাজের সাথে যুক্ত ভাবতেই কেমন যেন লাগল। তবে ভদ্রলোক বেশ প্রফেশনাল। জব ডিস্ক্রিপশানের মত করে তিনি আমাকে ডিটেইল বুঝিয়ে বললেন এখানে কিভাবে কাজ হয়। আমার চোখে মুখে বোধহয় ভয় ছিল, সেকারণেই হয়তো জানালেন, এখানকার ক্লায়েন্টগুলো সবই ভদ্র। টর্চার করে না। তারপরও, কখনো কোন ক্লায়েন্ট মিসবিহেভ করলে, আমি কমপ্লেইন করতে পারি। আরও জানালেন, কেউ যদি বেশি টাকার বিনিময়ে নিজে টর্চার সহ্য করতে চায়, সেটা তার ব্যাপার। সেখানে উনি ইন্টারফেয়ার করেন না।

পর্ন ভিডিও অনেকই দেখেছি। বিভিন্ন ধরণের টর্চার সম্পর্কে কিছু আইডিয়া আছে। সেই সিগারেটের ছ্যাকা দেয়া, কিংবা চাবুক দিয়ে পেটানো টাইপ টর্চারের কথা ভাবতেই গা শিউরে উঠল। একবার ভাবলাম, পালিয়ে যাই। পর মুহূর্তে ভাবলাম, পালিয়ে যাব কোথায়?

ইউসুফ ভাই বলে গেলেন। অসুখ বিসুখের ব্যাপারেও উনারা বেশ খেয়াল রাখেন। জানালেন, এখানে ক্লায়েন্টরা সবাই প্রটেকশান নেয়। সেই সাথে ক্লায়েন্টদের রক্ত টেস্ট করে নেয়া হয়। আমাদেরও রেগুলার চেক করা হবে। ফলে অসুখ, বিশেষ করে এইডসের সুযোগ কম। আর কাজের ব্যাপারে কোন প্রেশার নেই। কল যাওয়ার পরে ইয়েস বললেই কেবল ক্লায়েন্টকে কনফার্ম করা হয়। তাই কোনদিন আসতে না চাইলে, আই অ্যাম ফ্রি টু ডু ইট। শুধু তা ই না, কোনদিন এখান থেকে সরে যেতে চাইলে, সেটাও পারব। যেদিন কাজ বন্ধ করতে চাই, সেদিন থেকেই বন্ধ করতে পারব। এখানকার কেউই, কোন মেয়ের আইডেন্টিটি ডিসক্লোজ করে না। সেদিক দিয়ে হাইয়েস্ট সিক্রেসি মেইন্টেইন করা হয়।

জানালেন একদম নিউ এন্ট্রিদের রেট বেশ হাই। বেশ কিছু ক্লায়েন্ট থাকে যাদের চাহিদাই থাকে ফ্রেসার। সো, সেই রেট আমি মাস খানেক এঞ্জয় করতে পারব।

আমাকে সিলেক্ট করার প্ল্যান আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, না আমাকে দেখে সিলেক্ট করা হল, জানি না। আমি কে, কি করি, কেন আসতে চাইছি এই প্রফেশানে, কিচ্ছু জানতে চাইলেন না।এর দুটোই মানে হয়। হয় এরা সব জানে, আর নয়তো আমি এদের সম্পর্কে কোথাও কমপ্লেইন করে, এদের কিচ্ছু করতে পারব না, সেটা এরা জানে।

ভদ্রলোকের আচরণে কিছু একটা ছিল। কেমন যেন ভরসা পেলাম। ভয়টা ধীরে ধীরে কমে আসল। বুকের ঢিপঢিপানি এখন অনেকটাই কম।

আলাপের শেষ পর্যায়ে ইউসুফ ভাই, আমার আগামী একমাসের রেট জানালেন। মনে মনে হিসেব করে দেখলাম কটা দিন দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে পারলে, হয়তো এযাত্রা লোনের হাত থেকে উদ্ধার পেয়ে যাব।

ইউসুফ ভাইয়ের আচরণ থেকে যেটা বুঝলাম, আমার আগামী এক মাসের ক্লায়েন্ট সম্ভবতঃ উনি রেডি করে রেখেছেন। আমার মনের অবস্থা উনি বুঝলেন কি না জানি না, শুধু জিজ্ঞেস করলেন, আজকে একটা কল আছে, অ্যাটেন্ড করতে চাও?

ঘাড় নেড়ে জানালাম, আমি রাজী। অবশ্য, উপায়ও ছিল না। দিবা বা আসলে দিবার বসের কাছে হওয়া লোন থেকে বেরোতে হলে এখানে জয়েন করতেই হবে।

অবশ্য শেষ রক্ষা হবে কি না, সেব্যাপারে আমি এখনও নিশ্চিত না। আমার এই অনিশ্চয়তার কারণও আছে। নিজের ভুল আগে রিয়ালাইজ করিনি, এমনটা না। নিজেকে রেজিস্ট করার চেষ্টাও করেছি। পারিনি। প্রতিদিনই মনে হয়েছে, আজই শেষ। কাল থেকে সবকিছু বন্ধ করে দেব। কিন্তু সেই ‘কাল' আর কোনদিনই আসেনি।

এই নেশার জগত ছাড়বার চেষ্টায় সফল হব কি না তা নিশ্চিত না হলেও, একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, এই মুহূর্তে এই কাজে নামা ছাড়া, আমার হাতে কোন অপশান নেই। প্রায় লাখ দশেক লোন, সেটাও আবার আন্ডারওয়ার্ল্ডের কাছে। তাই পালিয়ে বাঁচব, সে সুযোগও নেই। বাসায় জানালে, টাকা যোগাড় হবে কি না জানি না তবে বাবা যে জাস্ট হার্ট অ্যাটাক করবে এটা আমি নিশ্চিত। সো, যা করার আমাকেই করতে হবে।

হোটেলের কাজটায় একটা সুবিধা আছে। দিবা আর আমি ছাড়া ব্যাপারটা আর কেউ জানে না। ব্যাপারটা বাইরে জানাজানি হওয়ার বা বাবার কানে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় জিরো। ধীরে ধীরে কাজটায় রেগুলার হওয়া শুরু করলাম। পারত পক্ষে ক্লাস কামাই দিতাম কম। তারপরও মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিতে হত। আসলে রাতে ওখানে স্টে করতাম কম। চেষ্টা করতাম ক্লাস শেষ করে যেতে।

জানি না ইউনিভার্সিটিতে কেউ ব্যাপারটা আঁচ করেছে কি না। করলেও, কথাবার্তায় সেটা এখনো টের পাইনি। যদিও এখানে কেউই কারো ব্যাপারে নাক গলায় না। মফঃস্বলের মত বাসায় নালিশ করার ঘটনা, প্রায় অসম্ভব একটা অপশান। তারপরও একটা ভয় কাজ করত। কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমাকে ক্লাসে দেখলাম না আজকে।'

আরেকটা ভয়ও কাজ করে। যদি কোনভাবে, পরিচিত কেউ ক্লায়েন্ট হিসেবে আসে… নাহ এতো ভাবলে হবে না। আর নিজেকে এই বলে বুঝিয়েছি, মাত্র তো কয়েকটা মাস। আমার যা রেট, তাতে দশ লাখ হতে বড়জোর মাস কয়েক। কিংবা ইউসুফ ভাই যদি একটু হেল্প করেন, প্রতিদিন ক্লায়েন্ট দেন, তাহলে হয়তো আরও আগে। মনে মনে আমি ব্যাপারটা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তখন মরিয়া। নেশা কমাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি।

তারপরও হল না। না নেশা ছাড়তে পারলাম, না কাজ। বরং দেখা গেল, টাকার যোগান আসায় নেশা বেড়ে গেল। এই প্রফেশানে নামার জন্য একটা ঘিনঘিনে ভাব কাজ করছিল। নিজের প্রতি ঘৃণা। আর সেটা ভুলতে চাই আরও নেশা। সব মিলিয়ে রীতিমত একটা চক্রে পড়ে গেলাম।

এখন প্রায় দিনই এসকর্টের কাজ নিচ্ছি। ইভেন ঐ পাঁচ দিন ও। আলাদা কিছু ক্লায়েন্ট থাকে, ওদের চাহিদা অন্য। মেনে নিই। কখনো কখনো টর্চারও। ক্লায়েন্ট যা বলছে, তা ই করছি। আর ওসব করতে গেলে নেশার ঘোরে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তাই আবার নেশাও করছি।

আর এই ধরণের ফ্রাস্ট্রেটেড অবস্থায় সচরাচর যা হয়, ডিপ্রেশান আরও বেশি করে চেপে ধরে। ‘কেন বড় কোন ঘরে জন্মালাম না' টাইপ আফসোসগুলো বেশি করে জাগতে শুরু করল। সব দোষ নিয়তির, এমন সব অদ্ভুত লজিককেই আপন মনে হতে লাগল। আর সেই নেশার কাছেই নিজেকে সঁপে দিতে থাকলাম। যত দিন যেতে লাগল, আমিও চোরাবালিতে ডুবে যেতে লাগলাম।

ওদিকে আরেকটা ঘটনা ঘটল। যত সময় এগোতে লাগল, আমার রেটও কমতে লাগল। এখানে টুয়েন্টি থেকে থার্টি কে র বেশি এখন আর দেয় না। আর নেশার ঘোরে থাকি বলে পার্ফরম্যান্সও বেজায় খারাপ আমার। সব মিলিয়ে দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।

খুব ভালো মতোই বুঝে গেছি, কোন মিরাকল ছাড়া, এই অবস্থা থেকে বেরোবার আর কোন উপায় নেই। আসলে একবার উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেলে ফেরার পথ অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায়। ড্রাগের সাপ্লায়াররা নিজেরাও চায় না কোন খদ্দের ড্রাগ ছাড়ুক। আমি না চাইলেও, আমার পড়ার টেবিলে ড্রাগ চলে আসে। নিজেকে রেজিস্ট করার চেষ্টা একেবারেই কাজে দিচ্ছে না। মাঝে মাঝেই সুইসাইডের আইডিয়া আসে। কিন্তু সাহস হয় না। বাবা মা র মুখ চোখে ভাসে।

 

অ্যান্ড দেন হ্যাপেন্ড দ্যা মিরাকল। হি কেম ইনটু মাই লাইফ।

 

চলবে