পোস্টস

গল্প

গল্প কোরবানী

২৫ মে ২০২৪

জালাল উদ্দিন লস্কর

মূল লেখক জালাল উদ্দিন লস্কর

 কোরবানী


জালাল উদ্দিন লস্কর 

সে বার কোরবানী দিতে পারেন নি বারিক মাস্টার।অভাবের বছর।মাস্টারি করে যে সামান্য বেতন পান তা দিয়ে সংসারই ঠিকমতো চলে না।বাপ-দাদার সূত্রে কিছু জমিজমা থাকায় রক্ষা।

প্রচন্ড খরায় ফসলহানীর কারনে এলাকার লোকজনের ভোগান্তির শেষ ছিল না।খেয়ে না না খেয়ে অনেককেই তখন দিনাতিপাত করতে হতো।বারিক মাস্টারের পরিবারের তেমন সমস্যায় পড়তে হয় নি।প্রতিমাসে কিছু রেশন পেতেন তখন।রেশনে পাওয়া চাউল আটা তেল চিনিতে কিছুদিন বেশ ভালোই চলে যেতো।

স্ত্রী ছেলে মেয়ে আর বৃদ্ধা মা। সুখের সংসার।
মাস্টারীর সময়টা ছাড়া বাকী সময়টাতে বারিক মাস্টার নিজের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে গল্পসল্প করেআর আলমারীভরা বই পড়ে সময় কাটান। বন্ধু সার্কেলও খুবই ছোট তার।প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ বারিক মাস্টার গ্রামের যারতার সাথে চলাফেরাও করতেন না।বৈষয়িক ভাবনাচিন্তাও তেমন ছিল না।ঢাকার কয়েকটি নামকরা প্রকাশনা সংস্থা থেকে নিয়মিত অর্ডার দিয়ে ডাক মারফত বই সংগ্রহ করতেন।বই পড়া ছিল তার প্রবল নেশা।বেশী লেখাপড়া করলে বড় চাকুরী পেয়ে বাড়ী ছেড়ে চলে গেলে জমিজমা ও গৃহস্তির কাজ কে দেখবে এই চিন্তায় বারিক মাস্টারের পিতা আজিজ আহমেদ ছেলেকে বেশী লেখাপড়া করতে দেন নি।ইন্টারমিডিয়েট টেস্ট পরীক্ষার পর বারিক মাস্টারের লেখাপড়া আর এগুতে পারে নি।সময় সুযোগে এসব দুঃখের কথা নিজের ছেলেমেয়েদের কাছে বলে মনটা হালকা করতে চাইতেন।পাকিস্তান বিমান বাহিনীতেও বিমান সেনা পদে চাকুরী পেয়েছিলেন।পারিবারিক বাঁধার কারনে যোগ দেওয়া হয় নি।এটা ১৯৬০ সালের কথা।

ঢাকার প্রকাশনা সংস্থাগুলো নতুন বই প্রকাশ করলেই বারিক মাস্টারের কাছে ডাকযোগে ক্যাটালগ পাঠিয়ে দিতেন।ক্যাটালগ দেখে পছন্দের বইয়ের জন্য চিঠি মারফত অর্ডার দিতেন।প্রতিমাসে নতুন বই সংগ্রহ করা রীতিমতো নেশা ছিল বারিক মাস্টারের কাছে।প্রচুর ইংরেজী বইও পড়তেন।আগের দিনের মানুষ বলে ইংরেজীতেও ছিলেন বেশ চোস্ত।

শিক্ষকতায় বেতন তখন নামমাত্র।প্রচুর সিগারেট টানতেন।দিনে কম করে হলেও তিন প্যাকেট।প্রিয় ব্র্যান্ড ছিল বৃস্টল।সাথে সেই অনুপাতে চা।খাওয়াদাওয়ার দিকে তেমন ঝোঁক ছিল না।চা-সিগারেট-বই-বন্ধু আর মাস্টারীই ছিল বারিক মাস্টারের কাজ।গ্রামে কারো সাথেই তার কোনোরকম শত্রুতাও ছিল না।কখনোই কোনো ঝামেলায় জড়াতেন না।দিনকাল এভাবে ভালোই কাটছিল।

সেবার দীর্ঘ খড়ায় ব্যাপক ফসলহানী হলো।তদুপরি জৈষ্ঠ মাসের শেষ দিকে এলো কোরবানীর ঈদ।ব্যক্তিগত জীবনে খুবই ধর্মনিষ্ট মানুষ বারিক মাস্টার এর আগে কোনো বছরই কোরবানী মিস করেন নি।কিন্তু খড়ার বছরে জৈষ্ঠ মাসের সেই ঈদে কোরবানী দেওয়ার মতো টাকাপয়সার ব্যবস্থা তিনি করতে পারলেন না।জমি বন্ধক রাখার মতো লোকও পাওয়া গেলো না।বেতনের টাকায় কোরবানী দিলে সংসার চালানো দায় হবে।তাই শেষ পর্যন্ত কোরবানী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন বাধ্য হয়ে।

বারিক মাস্টারের মনের খছখছানি যায় না।নিজের মনে নিজেই জ্বলে পুড়ে মরেন তিনি।সবসময় মন খারাপ করে থাকেন।বন্ধু-বান্ধবদের সাথেও তেমন মিশেন না।

ঈদের আর তিন দিন বাকি।বারিক মাস্টার এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন।ভয় পেয়ে ঘুম ভাঙ্গে।হাত বাড়িয়ে দেখেন, না,তার সাত বছরের অতি আদরের ছেলে বাইজিদ পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।ছেলেকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেন।আদর করেন।স্বপ্নের কথা কাউকে বলেন না।কেমন জানি একটা মন খারাপ মন খারাপ থাকে তার সারাদিন।স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলেন না।

ঈদের নামাজে ঈমাম সাহেব প্রিয় নবীজির হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে বয়ানে উল্লেখ করেন,সামর্থ্য থাকা অবস্থায়ও যে বা যারা কোরবানী দেবে না তারা যেন ঈদের জামাতে না আসে।বারিক মাস্টারের মন খারাপ হয়ে যায়।নিজের মনে নিজেই জানতে চান,তার কি সামর্থ্য নেই কোরবানী করার!ঈমাম সাহেব বর্ণিত হাদিসটি কি সহিহ? এ প্রশ্নও জাগে বারিক মাস্টারের মনে।কোনো উত্তর খুঁজে পান না।

নামাজ শেষে বাড়ী ফিরে বৃদ্ধা মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে কারো সাথে কোনো কথা না বলে সোজা দহলিজ ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন।হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন।বাড়ীর লোকজন এসে অনেক ডাকাডাকি করার পর দরজা খুলে বাইরে এসেই জানতে চান,বাইজিদ কোথায়?
 -আমার বাইজিদ কোথায়?কয়েকদিন আগে আমি বাইজিদ কে নিয়ে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলাম।বাইজিদ ঈদের দিন পানিতে ডুবে মরে গেছে।আমি কেন এমন একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম।বলেই বুক চাপড়ে কাঁদতে শুরু করলেন বারিক মাস্টার।

বাইজিদকে পাওয়া যাচ্ছে না।বাড়ী এবং বাড়ীর আশেপাশে  খোঁজ করে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না বাইজিদকে।একটু আগেই মায়ের কাছে কাঁঠাল বিচি ভাজা খেতে চেয়েছিল--বারিক মাস্টারের স্ত্রী জানান।সেই মতো কাঁঠাল বিচিও ভাজা করা হয়েছে।এরপর থেকে বাইজিদের আর কোনো খবর নাই।পুরো বাড়ীতে কান্নার রোল উঠলো।

লোকজন বাড়ীর পাশের পুকুরে-যে পুকুরটা গত চৈত্রের খড়ায় অনেক গভীর করে খনন করা হয়েছিল, সেটাতে নেমে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো।একটা সময় পাশের বাড়ীর কুদ্দুস মিয়া  পুকুরের কিনারে গাড়ামতো একটা গর্ত থেকে বাইজিদকে বের করে আনে।মাথায় তুলে ঘুরানো হয়,পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করা হয়।ততোক্ষণে বাইজিদ প্রাণস্পন্দনহীন এক তরতাজা লাশ।