১
গত শতাব্দীর পুরোটা জুড়ে সিনেমার বিশ্বে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছে হলিউড, এখনো করছে। সিনেমার শাসন তাই মূলত হলিউডের শাসন। পুরো পৃথিবী সচেতন কি অচেতনভাবে আদতে হলিউডের বেঁধে দেওয়া নিয়মই অনুসরন করে। এর বাইরে কাজ যে হয়নি তা নয়, কিন্তু হলিউডের উপনিবেশায়নের তুলনায় মূলধারায় তার প্রভাব সামান্যই। তবুও প্রচেষ্টা থেমে থাকে না, ফলে যুগে যুগে গদার, ওজু, তারকোভস্কিরদের মত চলচ্চিত্র মহীরুহদের থেকে শুরু করে বিলেতে শন্তাল আকের্মান ও এই পোড়া দেশে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এর মত চলচ্চিত্র যোদ্ধারা আবির্ভূত হন।
আজ তেমনই এক চলচ্চিত্র সৈনিকের কথা বলব। কার্লা সিমন একজন তরুণ এবং স্পেন দেশে কাজ করেন। সবে দুটো ছবি তুলেছেন, এবং দুটো কাজই ভাষাগত দিক বিবেচনায় সরল, নিখাঁদ কিন্তু অতিশয় মানবিক। প্রথম ছবি Summer 1993 বার্লিন উৎসবে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিল, ২য় ছবিখানি তো উৎসবের সর্বোচ্চ পদক গোল্ডেন বেয়ারই জিতে নিল! ইউরোপীয় ছবির ভবিষ্যৎ মুখপাত্র সিমন বর্তমানে তার ৩য় ছবিটির কাজে ব্যস্ত। সেটি যতদিন না মুক্তি পাচ্ছে আসুন এই সীমিত সময়ে তার প্রথম দুটি কাজের গল্প ও বিন্যাসগত কয়েকটা দিক সংক্ষেপে আলোচনা করে তার সৃষ্টির সৎ, একনিষ্ঠ ও অত্যন্ত ব্যক্তিগত এই জগতে উঁকি দেয়া যাক।
সিমনের জন্ম স্পেনের বার্সেলোনায়, তবে শৈশব কেটেছে উত্তর কাতালুনিয়ার গ্রাম্য পরিবেশে। ৫ বছর বয়সে মা-বাবা দুজনকে AIDS এ হারানোর পর চাচা-চাচির কাছেই বড় হন। এরপর ২০০৯ সালে কাতালান ফিল্ম স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে লন্ডন ফিল্ম স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরপর কয়েক বছর প্রস্তুতি হিসেবে কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণের পর, ২০১৭ সালে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি Summer 1993 করে আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলে দেন।
২
প্রথমদিককার ছোট ছবিগুলো বাদ দিলে, Alcarràs ও Summer 1993 এই দুটো পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির সাধারণ নিরিক্ষায় সিমনের চলচ্চিত্র-দর্শন ও সমঝদারি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। Summer 1993 আঙ্গিক ও কাঠামোগত দিক থেকে সরল, অনেকটা পরিচালকের নিজের বিস্মৃত শৈশবের ছবি ও অনুভূতিগুলোর পুনর্নির্মাণ। ৫ বছরের ফ্রিদা মা-বাবাকে হারানোর পর বার্সেলোনা ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে যায় কাতালুনিয়ায়, চাচা-চাচি ও তার ৩ বছরের বোন আনার সাথে বসবাসের উদ্দেশ্যে। এই নতুন পরিবারে ফ্রিদার খাপ খাইয়ে নেয়ার গল্পই Summer 1993। সেটা ফ্রিদার যতটা, তার চাচা-চাচিরও ততটাই, যদিও ছবি পুরোটাই ফ্রিদার দৃষ্টিভঙ্গিতে চিত্রিত। নিজের বাচ্চার পাশাপাশি অন্যের মেয়েকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করা ও করুণার দৃষ্টি থেকে তাকে স্বাভাবিক ভালোবাসার দৃষ্টিতে ক্রম-স্থাপনের মর্মস্পর্শী আখ্যানই এই ছবি।
প্রথম ছবিতে হাত পাকিয়ে সিমন একই প্রেক্ষাপটে আরো বড় পরিসরের গল্পে হাত দিলেন। Alcarràs এ পূর্বের ছবিটির মত কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র বা একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। ছবির গল্প কাতালুনিয়ার এক পিচ চাষী পরিবারকে ঘিরে, দীর্ঘ পারিবারিক পরম্পরার ইতিসূচক এটাই যাদের শেষ পিচ ফলন। বাড়ির বুড়োকর্তা বহুবছর আগে কাতালান গৃহযুদ্ধ চলাকালীন তার বন্ধুকে আশ্রয় দেয়ায় কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বন্ধুর কাছ থেকে বাড়িসহ এই বৃহৎ জমিটি পেয়েছিলেন। বাড়ি রেজিস্ট্রি করা হলেও জমির মালিকানা নিয়ে কোনো লিখিত দলিল হয়নি; ফলতঃ বন্ধু মারা যাবার পর তার ছেলে এসে যখন বলে এই জমিতে পিচ ফলনের বদলে সে সোলার প্যানেল বসাতে চায়, বুড়োর ছেলে—বাড়ির বর্তমান কর্তা—কুইমেতের অর্থহীন রাগারাগি ও চেঁচানো ছাড়া আর কিছু দিয়েই প্রতিবাদ করার থাকেনা। কুইমেত সারাজীবন চাষ করে এসেছে, তাই এই মধ্যবয়সে এসে সে নতুন কোনো পেশায় নাম লেখাতে রাজি নয়। তারচেয়েও বড় কথা, বংশপরম্পরায় চলে আসা পিচচাষ কেবলমাত্র পেশা নয়, ঐতিহ্য তার জন্য। ছবিজুড়ে ঐতিহ্য ও জীবনধারার আকস্মিক অথচ অনিবার্য পতন ক্রমাগত মানসিক পীড়া দিয়ে যায় তাকে।
আধুনিক প্রযুক্তির কাছে সনাতন ব্যবস্থার হার, অথবা যৌথ পরিবারের ভাঙন এসবের ইঙ্গিত গল্পে আছে, তবে ছবির প্রধান বক্তব্য ও বিষয়বস্তু এগুলো নয়। বরং এই অনুসঙ্গগুলোকে অনুসরণ করে একটা বৃহৎ পরিবারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্পর্কগুলো কিভাবে কাজ করে সেটা অনুসন্ধানই রচয়িতার মুখ্য উদ্দেশ্য। পরিচালকের নিজের ভাষায়, “আমি দেখাতে চেয়েছি একটা যৌথ পরিবারে বড় হবার অনুভূতিটা কেমন!”
Alcarràs এর বহুস্বরীয় বর্ণনাভঙ্গিতে একদিকে যেমন উঠে আসে মধ্যবয়সে কুইমেতের কাজ হারানো সংক্রান্ত ক্রাইসিস, তেমনি বিভিন্ন চরিত্রের মিথস্ক্রিয়ায় বোঝা যায় তার স্ত্রী দলোরসকে, যে বাড়ির কেন্দ্রে বসে পুরো বাড়িটাকে ধরে রেখেছে। এখানে যেমন আছে সদ্যতরুণ ছেলের সাথে মাঝবয়সী বাবার দ্বন্দ্ব, তেমনি কিশোরী মেয়ের সাথে বৃদ্ধ দাদুর আন্তরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক। বাড়ির একেবারে ছোট্ট মেয়ে ইরিস সারাদিন ছুটোছুটি করে বেড়ায়, কিংবা তার বয়সের ভারে নূজ্য দিদা- যার মুখ থেকে একেকজনের সম্পর্কে রসালো গল্পের স্রোত বইতে থাকে দিনভর।
তাছাড়া কুইমেতের দুই বোন ও তন্মধ্যে বিবাহিতটির স্বামী ও সন্তান, যারা তার সাথেই থাকে; এদের সাথে সোলার প্যানেলের প্রশ্নে হাতাহাতি বাঁধে, আবার কয়েক দৃশ্য পরে পরবের দিনে পারিবারিক ভোজ শেষে ছেলেবুড়ো একসাথে সুইমিং পুলে দাপাদাপি করতেও কেউ পিছপা হয় না। তরুণ ছেলেটি চায় ফলনকাজে বাবাকে সাহায্য করতে, কিন্তু বাবার একান্ত ইচ্ছে সে লেখাপড়া করুক। চাষের গোটা সময়টা জুড়েই জমির মালিকের সাথে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে; কিন্তু ছবির ঘটনাক্রমে প্রাধান্য পেয়েছে এই চাষকে কেন্দ্র করে পরিবারের সদস্যদের বন্ধন ও আন্তঃসম্পর্ক। অন্যান্য ঘটনাক্রমের সূত্র ধরে আমরা অবলোকন করি মূলত পরিবারটিকেই।
শেষপর্যন্ত কুইমেতরা তাদের বাড়ির লাগোয়া বিস্তীর্ণ প্রান্তরটি হারাতে বাধ্য হয় বটে, কিন্তু পারস্পরিক নানা কোন্দল ও অন্তর্দ্বন্দ্ব ছাপিয়ে শেষ অবধি একে অপরের হাত ধরে টিকে যায় পরিবারটি। পরিচালক যেনবা বলতে চাইছেন, এই বিশেষ সমাজের মানুষগুলি, যেখানে পরস্পর নির্ভরশীলতা ও একে অপরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস এতটাই সহজ ও অটুট যে, রাগ দুঃখ গ্লানি গরিমা কেউ নিজে একলা বইতে পারে না—তা হোক ব্যক্তিগত বা সামগ্রিক—বরং সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়, ফলতঃ শত ঝঞ্ঝা এলেও তাদের বিচ্ছিন্ন করা সহজ নয়। এই ঈষৎ বিষন্ন কিন্তু সত্য ও সর্বজনীন বার্তার ঈঙ্গিতে শেষ হয় ছবি।
৩
সিমনের চলচ্চিত্র দর্শনের কেন্দ্রেই আছে পরিবার। কেননা “আমার চলচ্চৈত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি জন্ম নিয়েছিল অনেকটাই আমার পরিবারকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে”। বটবৃক্ষের মত শাখাপ্রশাখা ছড়ানো বৃহৎ পরিবারের অনুষঙ্গ তাই বারবার তার ছবিতে ঘুরেফিরে আসে। এই পরিবারকে ধরেন তিনি অলস দুপুরবেলা, অথবা অবসরে, টিভি চলতে চলতে সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে কেউ; কেউ যখন রান্নাঘরে বসে পরিবারের সংকাটপন্ন আগামী নিয়ে আলোচনা করে, তখন আরেকদল ফ্রিজ থেকে ইয়া বড় আইসক্রিম বের করে অনেকগুলো একসাথে মুখে পুরে দেয়।
Summer 1993 ছবিতে একাকিত্ত্বের বোধ যতটা আছে, Alcarràs এ একেবারেই নেই। দুটো ছবিকে একদিক দিয়ে একে অপরের পরিশিষ্ট বলা যায়। Summer 1993 হলো পরিবার খুঁজে পাওয়ার গল্প, আর Alcarràs সেই প্রতিষ্ঠিত ভিতকে আরেকবার পরখ করে নেয়ার প্রচেষ্টা। পারিবারিক বন্ধন যেমন ঘনঘন আলিঙ্গনের মত বিভিন্ন শারীরিক অনুষঙ্গে উঠে আসে, তেমনি মনোমালিন্য ও মনখারাপেও অন্যদের ব্যবহারে এর স্বরুপটা ধরা না পড়ে থাকে না। সিমনের কথায়, “বড় পরিবারে কেউ যখন রেগে যায় তখন হুট করে সবাই রেগে যায়, এবং কয়েক মুহুর্ত পর সবাই চেঁচাতে শুরু করে, যদিও কেউই জানেনা তারা কেন চেঁচাচ্ছে। এটা অনেকটা রাগের ব্যাটন অন্যদের মধ্যে পাস করে দেবার মত”।
কার্লা সিমনের দুটো ছবিই গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে রচিত ও কাতালান জীবনের অনুষঙ্গে পরিপূর্ণ। শহর এখানে দূরবর্তী কোনো বস্তু, কয়েকঘন্টা গাড়ি চাপা ব্যতিত যেখানে যাওয়া যায় না। তবে এই গ্রাম আমাদের বাংলার পাড়াগেঁয়ে জনজীবনের মত নয়, বরং সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় পরিপূর্ণ। সামাজিক অনুষ্ঠান, প্রচুর নাচগান, খাওয়া-দাওয়া, আমোদ-ফূর্তি সিমনের ছবির পরিবারগুলির নিত্য যাপনের অংশ। তাই বিমর্ষ গল্পের টোন কখনো বিষন্ন হয় না। তার গল্পের চরিত্ররা নড়েচড়ে বেড়ায়, কাজ করে; পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় নিজের সুখ অথবা দুঃখকে ভাগাভাগি করে নেয় (অথবা নিতে হয়)। শব্দ, চাহনি ও আলিঙ্গনে একে অপরকে কাছে টেনে নেয়। এজন্য বোধকরি সিমনের ছবিতে চরিত্রদের মানসপটের কোন্দল ও মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব ততটা ধরা পড়ে না। তিনি বরং চরিত্ররা কি ভাবছে সেটা দেখানোর চেয়ে তারা কি করছে ও তার ফলে ঘটনাক্রম কোনদিকে মোড় নিচ্ছে সেটা অনুসরণ করতেই বেশি আগ্রহী।
শক্তিশালী তার গল্পের নারী চরিত্ররা। পরিবারকে ধরে রাখে মূলত তারাই। এর অবশ্য অন্য আরেকটা কারনও আছে। সিমন বলছেন, “স্পেনে পরিবার হলো একটা বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সম্ভবত এইজন্য যে আমাদের এক পরিবারেই অনেকগুলো নারী সদস্য থাকে এবং নারীরা সবসময় পরিবারের সকলকে একসাথে গেঁথে রাখেন।”
৪
সিমনের ছবির টেকনিক বুঝতে এজিনিসটা বোঝা জরুরি যে, তার অ্যাপ্রোচ হলিউডের টেকনিকাল ও প্রচলিত ফর্মে বাঁধা অ্যাপ্রোচ নয়, বরং মানবিক অ্যাপ্রোচ। ক্যামেরা এখানে তাই ট্রাইপডের ওপর স্থির বসে নেই, বরং ক্যামেরাম্যানের ত্রস্ত হাতে সদা বিচরণ করছে, এক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্রে ছুটে যাচ্ছে। আজ থেকে ষাট বছর আগে গদার যখন ব্রেথলেস ছবিতে জাম্পকাট ও হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা ব্যবহার করেছিলেন, তখন তা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। তবে এই পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলেন তার গল্প, চরিত্ররাও যথেষ্ট উগ্র ছিল বলে। তখন যে চলচ্চিত্র সমঝদার ও সমালোচকেরা গদারের প্রশংসা করেছিলেন তারা কেউ বোধহয় ভাবতে পারেননি একদিন এই খাপছাড়া ফরম্যাট দিয়ে অত্যন্ত সাধাসিধে family drama ছবিও তোলা সম্ভব হবে!
কার্লা সিমনের ফিল্মে তারই নজির পাই। আপাতদৃষ্টিতে ওঁর টেকনিককে সরল ও অগভীর মনে হতে পারে, কিন্তু জটিল গল্প সহজ ভঙ্গিতে নিয়ে আসার যে দক্ষতা ও ক্রাফটম্যানশিপ, তাকে উপেক্ষা করলে চলবে না। এই সারল্য মূলতঃ চিত্রনাট্যের পেছনে ব্যয় করা বহুদিনের অক্লান্ত শ্রম ও মানসিক অধ্যবসায়ের পরিচায়ক। ছবিদুটির ফর্মের দিকে তাকালে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। পুরো ছবিই কাটিং নির্ভর। বেশিরভাগ দৃশ্যই সময়ের মাপে নাতিদীর্ঘ এবং সেগুলো establish করতে বা তার থেকে বেরিয়ে যেতে খুব বেশি শট (পড়ুন সময়) খরচার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি সেগুলো যদি আঙ্গিকে, আয়োজনে বড় কোনো অনুষ্ঠান, বা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোনো জমায়েতই হয়ে থাকে না কেন।
হলিউডসুলভ নিখুঁত চোখধাঁধানো বিন্যাস সিমনের ছবিতে নেই। বরং এখানে আছে কাতালুনিয়ার মাটির গন্ধ। সিনেমা করার এই ধরনকে অনেকটা তেলরঙের বিপরীতে চক প্যাস্টেলে ছবি আঁকার সাথে তুলনা দেওয়া যেতে পারে। তেলরঙে নিখুঁত বর্ণ, টোন ও কন্ট্রাস্ট পাওয়া সম্ভব। কিন্তু প্যাস্টেলে করা একটা ছবিতে টেকনিক্যাল জৌলুস ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি। আঁকিয়ের মনের ভেতরকার কোনো অনিন্দ্য সুন্দর চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে খাপছাড়া স্ট্রোকেরই সুষমাময় প্যাটার্নে। যে প্যাটার্ন মাপামাপা জ্যামিতিক ধাঁচের নয়, বরং মানুষের অন্তর্নিহিত বোধ দিয়ে যে প্যাটার্নকে উপভোগ ও হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব। তেলরঙে যে শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ পায় না তা নয়, বরং বেশি করেই পায়, তবে তেলরঙ কাজের যে বিস্তার, প্রস্তুতি ও পরিসর দাবী করে, চিত্রকলা তাতে সবসময় আটকে থাকবে এমন কোনো কথা নেই। সিনেমায়ও একই জিনিসটা খাটে। তেলরঙে ছবি আঁকা যদি হয় হলিউড, চকপ্যাস্টেলের এই ছবি হলো মানবিক ছবি/সিনেমা, যার একজন অগ্রপথিক কার্লা সিমন।
সিমনের শটরচনা ও দৃশ্যায়ন থেকে এ জিনিসটা ভালো উপলব্ধি করা যায়। তার ক্যামেরা অনেকটাই স্বাধীন, ইঞ্চিকষে মাপা ফ্রেমের আধিপত্য থেকে মুক্ত। কারো ক্লোজআপে শট শুরু হলে ক্যামেরা তাকে ফলো করতে করতে অন্য কারো ক্লোজআপ অথবা মিড/ফুলশটে গিয়ে শেষ হয়। ক্যামেরা যেহেতু ক্যামেরাম্যানের কাঁধেই থাকে ফলে ক্যামেরার উচ্চতা সবসময় চরিত্রদের আই-লেভেল পায়। ক্যামেরার স্বতঃস্ফূর্ত চলাচল ও আই-লেভেল বজায় রাখার ফলস্বরূপ ছবি দেখতে দেখতে দর্শকও ভুলে যান যে তিনি চরিত্রদের একজন বই কেউ।
আরেকটা উল্লেখ করার মত ব্যাপার হলো সিমনের ছবিতে কোনো আবহসংগীত নেই। যা কিছু সংগীত এসেছে তা নিতান্তই বাস্তবতার নিরিখে (কোনো চরিত্রের গিটার বাজানো বা বাড়িতে বা রাস্তায় কারো লাউডস্পিকারে মিউজিক ছেড়ে দেওয়া), দৃশ্যের দূর্বলতা ঢাকতে বা কিছুতে বিশেষ ঝোঁক আরোপ করতে নয়। সিমন বোধকরি প্রথম থেকেই বুঝে নিয়েছেন চলচ্চিত্র দৃশ্য ও শ্রাব্যের(sound) মাধ্যম। অর্থাৎ কিনা কেবলমাত্র ছবি ও শব্দ দিয়ে চলচ্চিত্র পূর্ণভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে এবং তার ভিন্ন কোনো আর্টের সাহায্য নেবার প্রয়োজন হয় না।
৫
সিমনের ছবিতে দুটো চমৎকার ডিভাইস খেয়াল করেছি যার কথা ছোটো করে বলব। এগুলোর কোনোটাই নতুন কিছু নয় কিন্তু ছবি করিয়েরা হরদম এরূপ সৃজনশীল পন্থা ফেলে অতিরিক্ত সংলাপ, আবহসংগীত ও অন্যান্য বুজরুকি দিয়ে দর্শক ভোলানোর চেষ্টা করেন কেন বলতে পারি না। তারা বোধহয় ভুলে যান যে ছবিতে কাঠামোই আসল কথা। সংগীতের মত কাঠামোর শুরুতে কিছু একটা হাজির করে পরে এক বা একাধিক কাঙ্খিত মুহুর্তে তাকে পুনরাবৃত্তি করলে কাউন্টারপয়েন্টসুলভ দ্যোতনা পাওয়া সম্ভব। এটাই সিমন করেন। Summer 1993 ছবিতে ৫ বছরের ফ্রিদা চাচার বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করতে করতে ঝাড়ের ভেতর এক দেবীবিগ্রহ খুঁজে পায়। শুরুর দিকে ও ছবির বিভিন্ন পর্যায়ে সে বিগ্রহের কাছে সিগারেট ভর্তি প্যাকেট থেকে শুরু করে মায়ের পছন্দানুগ নানা বস্তু অর্পন করে, তার মৃত মায়ের কাছে উপহার স্বরূপ পৌঁছে দেয়ার জন্য। মায়ের জন্য প্রার্থনাও সে করে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে পরপর কয়েকটা ঘটনার পর সে চাচা-চাচির প্রতি প্রবল ক্ষোভে পূর্ণ হয়ে ওঠে বুঝতে পারি, যখন দেখি তার আরাধ্য দেবী মূর্তির কাছে এসে আগের উপহার সব মাটিতে ফেলে দিয়েছে আর তীব্র বিতৃষ্ণা প্রকাশ করছে।
Alcarràs ছবিতে তরুণ ছেলে রোজে কে দেখি প্রতিদিন সকালবেলা এসে জমিতে পর্যাপ্ত পানি প্রবেশ করার পর পাথরের স্ল্যাব দিয়ে পানির মুখ বাইরের দিকে ঘুরিয়ে দিতে। কিন্তু শেষের দিকে বাবা যখন তার ক্ষেতের ভেতর লুকানো অতি সাধের গাঁজার চারাটি পেয়ে পুড়িয়ে ফেলে, প্রতিশোধের তাৎক্ষণিক প্রকাশ হিসেবে সে পরদিন ক্ষেতের পানির পথ না আটকে পাথরের স্ল্যাবটা দূরে ছুড়ে দিয়ে চলে যায়। ফলস্বরূপ পুরো ক্ষেত কাঁদায় থইথই হয়ে সবাইকে নাকাল অবস্থায় ফেলে দেয়। সিমনকে ধন্যবাদ দিতে হয় বাবা-ছেলে মুখোমুখি হবার প্রায়-ক্লিশে একটা দৃশ্যের লোভ সামলে কিভাবে অতি অনায়াসে কয়েকটা কাটিঙে তিনি তার কাজ সেরে বেরিয়ে গেছেন।
দুটো উদাহরণেই দেখা যাচ্ছে মূলত কিভাবে ফর্ম ব্যবহার করে পরিচালক জটিল কিছু অবস্থা ও অনুভুতিকে বাঙময় করলেন, শব্দ ব্যবহার করলে যেখানে অনেক বড় বড় দৃশ্যের অবতারণা করতে হতো।
দ্বিতীয় যে ডিভাইসটার কথা বলব সেটা আরো সাহিত্যঘেষা, তবে বেশ চমকপ্রদ। সিনেমা, নাটক কিংবা উপন্যাসে দৃশ্য রচনার সময় সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ার ভয় সব রচয়িতারই থাকে। একটা ছোট শব্দ, বাক্য বা ইঙ্গিতে একটা ভালো দৃশ্য যেমন তরতর করে ভেঙে পড়তে পারে, ঠিক একইভাবে বুদ্ধিদীপ্ত কোনো চালে একটা প্রায়-সেন্টিমেন্টাল দৃশ্যকেও উদ্ধার করে এনে রসবোধপূর্ণ দৃশ্যে পরিণত করা সম্ভব। এ জিনিসটা একবার আয়ত্ত করে ফেলতে পারলে সুবিধা এই যে- সেন্টিমেন্টাল ম্যাটেরিয়াল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে আর ভয় থাকে না। Summer 1993 এ একপর্যায়ে যাবতীয় দ্বন্দ্বের পর ফ্রিদা রাতেরবেলা ব্যাগ গুছিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটা দেয়। এর ঠিক আগের দৃশ্যে চাচা-চাচির ব্যবহার বয়স অনুসারে ছোট্ট ফ্রিদার জন্য একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল, ফলে দর্শকের চোখের অশ্রু ছলোছলো হয়ে আছে। রাতে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তারা যখন চারদিকে ফ্রিদার খোঁজ শুরু করে তখন দর্শকের জন্য চোখের পানি ঠেকানো একটু মুশকিলই হবে। ফ্রিদাও বেশিদূর আগাতে পারে না। গুটিগুটি পায়ে বাড়ির দিকে ফিরে দেখে সবাই তার খোঁজ করছে। সেই মুহুর্তে কারো মুখে না তাকিয়ে সোজা দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলে, “বাইরে অন্ধকার বেশি, কাল সকালে উঠেই যাব নাহয়।” এই ছোট্ট কথাটার যে কমিক ইফেক্ট, এটা কেমন দৃশ্যটাকে অশ্রু ছলোছল হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিল, পটু বুদ্ধির যেকোনো লোকই মুহুর্তে ধরতে পারবেন।
সিমন তার ব্যক্তিগত জীবনের ওপর দুটো ছবি তুলেছেন। এবং শোনা যাচ্ছে তার পরবর্তী ছবিটা এই ট্রিলজিকে সম্পূর্ণ করবে। পরিচালকের কথা অনুযায়ী নিজের ব্যক্তিগত জীবন থেকে রসদ সংগ্রহ করার সবচেয়ে বড় সুবিধাটা এই যে আপনি যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। তা হোক সে অভিনেতা-অভিনেত্রী বা টেকনিক্যাল ক্রুর কেউ একজন। তবে তিনি এই বলেও সাবধান করে দিচ্ছেন যে নিয়মিত জানাশোনা কিছু লোকেদের চিত্রনাট্য দেখিয়ে ফিডব্যাক নিতে হবে, কারন নিজের ব্যক্তিগত গল্পে হারিয়ে যাওয়া খুব সহজ, এবং নিজের পক্ষপাতিত্ত্বও ধরা মুশকিল এখানে।
সিমনের আগের দুটো ছবিই স্পেনের তরফ থেকে অস্কারে পাঠানো হয়েছিল। দেখা যাক এই তৃতীয় ছবিটির ভাগ্যে কি লেখা আছে। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড ছবির গুণগত মান বিচারে আদর্শ কোনো মাপকাঠি নয়, তবে এটা পেলে সুবিধা এই যে সারাবিশ্বের মার্কেট খুলে যায়। তবে অস্কার পান বা না পান দুটো ছবি করেই ইউরোপ, আমেরিকার সমঝদার দর্শকের হৃদয়ে সিমন যে জায়গা করে নিয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লিখন দত্ত
ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: editorlikhon127@gmail.com