শুভ্রের মায়ং থেকে ফেরার পর আচরণ অস্বাভাবিক রকম হয়ে গেছে। অন্ধকারে একা-একা বসে থাকা, ময়লার স্তুপে মৃত জীবের শরীর পঁচে গিয়ে পেট ফেঁপে নাড়িভুড়ি বের হয়ে গেছে তার দুর্গন্ধ একটা অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে নিজের ভিতরে টেনে নিয়ে কিছু একটা অনুভব করা, সব-ই শুভ্রের স্বভাবের একেবারে বিপরীত। হঠাৎ এমন পরিবর্তন কেনো! কি হয়েছে শুভ্রের! জিজ্ঞাসা করলে সেই প্রাণবন্ত শুভ্র কেমন দাম্ভিক গলায় অদ্ভুত কি সব কথা বলে তা সাধারণ অবস্থায় মানুষের বোধগম্য হবে না। সেদিন আমাকে বললো ভালো খারাপ শক্তি তোমার মাঝে আছে। তুমি সিদ্ধান্ত নিবে কোন পথ তুমি বেছে নিবে।আর তোমার সিদ্ধান্তই তোমার পরিচয়। এ শক্তি জ্ঞান নয় এটা সুপ্ত অবস্থায় সবার মাঝে আছে। জাগিয়ে তোলো তোমার সেই সুপ্ত শক্তি আর অতিশক্তিশালী করো তাকে। সে ক্ষুধার্ত। শুভ্রের আচরণ কথাবার্তা কেমন অদ্ভুত। কিছুই আমার বোধগম্য হয় না। শুভ্রের মায়ের অনুরোধে রাতের খাবার ওর রুমে নিয়ে গেলাম। ছোটবেলা থেকে আমরা একসাথে বড় হয়েছি। শুভ্রের বাবা আমার মেঝো মামা আবার তারা আমাদের প্রতিবেশিও। মামী শুভ্রের আচরণে অনেক চিন্তিত। আমাকে বলেছে শুভ্রের আশেপাশে থাকতে। অনেক ভেঙে পড়েছে মামী। নেত্রকোনায় থাকাকালীন মামা মামীর দুজনের অনুরোধে বাড়িতে ফিরে আসি। এসে দেখি এ অবস্থা। খাবার নিয়ে গিয়ে শুভ্রের টেবিলে রাখলাম কিন্তু রুমে তো শুভ্র নেই। শুভ্র বলে কয়েকবার ডাকলাম কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। রুম থেকে বের হয়ে মামীকে ডাকতে যাবো এমন সময় স্টোররুমের দিকে নজর পড়লো। তালা খোলা আর ভিতর থেকে অল্প আওয়াজ আসছে। ধীরে ধীরে দরজাটা খুললাম। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। লাইটের সুইচটা অন করতেই হলুদ আলো জ্বলে উঠলো ভিতরে। কাউকে না দেখতে পেয়ে আরেকটু ভিতরে ঢুকতেই ডান পাশ থেকে হটাৎ একটি হাত এগিয়ে আসলো আমার দিকে। শুভ্রের হাত। হাতে পঁচে পোকা হয়ে যাওয়া ইঁদুরের শরীরের অবশিষ্টাংশ। আর শুভ্রের গালে লেগে আছে কালো নাড়িভুড়ি যা থেকে রস টপটপ করে পড়ছে নিচে। হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো খাবি একে! শরীরটা গুলিয়ে আসলো। দৌঁড়ে বেসিনে গিয়ে রাতের খাবার সবটুকু উগরে দিলাম। মামা বাসায় ফিরতেই তার সাথে সবকিছু আলোচনা করলাম। সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম কাল শুভ্রকে নিয়ে আমরা শহরের সবচেয়ে বড় সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাবো। মামী সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে। অনেক কান্নাকাটি করছে। রাতটা কোনো রকমে কাটলো। সকালে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা শেষ করে শুভ্রের রুমের দিকে গেলাম। ওর আচরণের পরিবর্তন হওয়ার পর থেকে ওর রুমের দরজা তেমন একটা খোলা রাখে না ও। কিন্তু আজ দরজা খোলা পেলাম। রুমে ঢুকে কোথাও শুভ্রের দেখা পেলাম না। বাসায় সব জায়গায় খোঁজা হলো কিন্তু শুভ্রকে পাওয়া গেলো না। পরিচিত সবার কাছে খোঁজখবর নেওয়া হলো কিন্তু কোনো খবর পাওয়া গেলো না শুভ্রের। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে মামা আর আমি থানায় গেলাম। তারা আমাদেরকে আশ্বস্ত করলো তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেবে বলে। তারপর দুইদিন পার হয়ে গেলো শুভ্রের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এদিকে নেত্রকোনা থেকে আমার প্রোজেক্ট ম্যানেজারের কলের পর কল আসতে লাগলো ওখানে ওয়ার্কারদের মাঝে কিসব নিয়ে ঝামেলা বেধেছে আমাকে তারাতাড়ি যেতে হবে নাহলে সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। বড় মামা মামীও আসছে আর বাবা মা তো গত কয়েকদিন ধরে মেঝো মামার বাড়িতেই আছে। আমি না চাইতেও নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হলো। ওখানে গিয়ে পুরো একদিন সময় লাগলো ওয়ার্কারদের ঝামেলা মেটাতে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে হোটেল রুমে ফিরছি এমন সময় শুভ্রের ভার্সিটির এক ফ্রেন্ড রিহানের কল আসলো। পরিচয়টা দিয়ে রিহান বললো ভাইয়া শুভ্রকে কোলকাতার এক নিউজ চ্যানেলে নাকি দেখাচ্ছে আমার এক কাজিন ইন্ডিয়ায় থাকে সে বললো। অনলাইনে সেই নিউজ চ্যানেলে গিয়েই দেখি "এইমাত্র পাওয়া,ওড়িশার কুশভদ্রা নদীর তীরে এক অজ্ঞাত যুবকের সন্ধান পাওয়া গেছে।তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। যুবকের আচরণ সন্দেহ জনক মনে হওয়ায় ঐ এলাকার কিছু বাসিন্দা পুলিশকে খবর দেয়।তারপর পুলিশ ঘটনা স্থলে যেয়ে যুবককে আটক করে এবং সাথে থাকা একটি ব্যাগ বাজেয়াপ্ত করে। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট এর ভাষ্যমতে ব্যাগটিতে কিছু মৃত প্রাণীর খুলি, মানুষের তিনটি আঙুল ও একটি চোখ পাওয়া গেছে। যুবকটির অবস্থা আশংকাজনক। ডাক্তার বলছে অতিরিক্ত কাঁচা মাংস রক্তসহ খাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। যুবকটি সুস্থ হলে তাকে রিমান্ডে নেওয়া হবে বলে পুলিশ আমাদের সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে।" শুভ্রের খবর পেয়েই আমি নেত্রকোনা থেকে সোজা মেঝো মামার বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলাম। পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ২টা বেজে গেলো। গেটের বাইরে থেকে মাকে কল করলাম, মা এবং বড় মামা বের হয়ে এসে গেটটা খুলে দিলো। তাদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি এড়িয়ে কোনো রকমে বাড়িতে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি আমার হঠাৎ বাড়িতে আসার সংবাদ শুনে রুম থেকে মেঝো মামা ও বাবা বেড়িয়ে ড্রইংরুমে এসে বসেছে। সবার একটাই কথা কি হয়েছে বাবা! শুভ্রের কি কোনো খবর পেলি! হঠাৎ এমন করে আসলি যে! শুভ্রের নিউজটা সবাইকে দেখালাম। সবাই কিছু সময় চুপ করে বসে রইলো। বাবা আমাকে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিতে বললো অনেকটা পথ জার্নি করে আসছি তাই। সারাদিনের ক্লান্তি তার সাথে জার্নি সব মিলিয়ে একটু রেস্ট নেওয়ার প্রয়োজন ছিলো। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দুচোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসলো। সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো।ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে গিয়ে দেখি সবাই সেখানে আলোচনায় ব্যস্ত। বাবা আমাকে বললো তুই আর তোর মেঝো মামা ইন্ডিয়ায় যতদ্রুত সম্ভব যাবি তার ব্যবস্থা আমি করছি আর কিভাবে শুভ্রকে বের করা যায় তার কিছুটা সমাধান আমি রাতেই করে রেখেছি, বাকিটুকু তোরা ওখানে পৌঁছা তারপর কি করতে হবে আমি জানিয়ে দেবো। বাবার কিছু ফ্রেন্ড উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তা। তাদের সাথে হয়তো শুভ্রের বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছে। পরদিন সন্ধ্যায় আমি আর মেঝো মামা ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্য রওনা হলাম। বাবা যোগাযোগ করে দ্রুত ইন্ডিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো।মেঝো মামী অনেক কান্নাকাটি করছিলো আমাদের সাথে যাবে বলে কিন্তু ওখানে শুভ্রের জন্য ছোটাছুটি করবো নাকি কে কাকে দেখে রাখবো তাই মামীকে অনেক বুঝিয়ে বাসায় রেখে আসা হয়েছে। আর বড় মামার পাসপোর্টে কিছু সমস্যা ছিলো বলে আমাদের সাথে আসতে পারেনি। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদেরকে একজন রিসিভ করে নিয়ে গেলো। বাবার বন্ধু পাঠিয়েছে তাকে আমাদেরকে আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য। উনি গাড়ি চালাতে চালাতে বললো শুভ্রের কেসটা নাকি আরও জটিল হয়ে গেছে। আপনারা শুভ্রের পরিবার বলে দাবি করার পর পুলিশ আরেক জনের পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছে। আপনারা কি অণিমা নামের কাউকে চিনেন? অণিমা নামটা শুনেই আমি চমকে উঠলাম। মামা না সূচক উত্তর দিলো।অণিমাকে মামার না চেনারই কথা। অণিমা আর শুভ্রের প্রায় ৬ বছরের সম্পর্ক ছিলো কিন্তু একটা ভুলবোঝাবুঝির কারণে শুভ্রের উপর অভিমান করে অণিমা তার বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে নেয়। ভুলটা অবশ্য শুভ্রের ছিলো। পরে শুভ্র নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে অনেক ভেঙে পড়ে কিন্তু অণিমার সাথে তো শুভ্রের যোগাযোগ অনেকদিন ধরে নেই তাহলে শুভ্রের কেসের সাথে অণিমার নামটা জড়ালো কেনো? আমি অণিমাকে না চেনার ভান করে করে উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম শুভ্রের কেসের সাথে অণিমা নামের মেয়েটার কি সম্পর্ক। উনি গাড়িটা হঠাৎ থামিয়ে আমাকে নামতে বললেন। মামা শুভ্রের চিন্তায় কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে। আমি গাড়ি থেকে নামলাম। উনি আমাকে একটু দূরে নিয়ে যেয়ে বললো আপনার মামার মানুষিক অবস্থা দেখে তার সামনে কথাটা বললাম না। এজন্য আপনাকে আলাদা ডাকলাম। আসলে শুভ্রকে এরেস্ট করা হয়েছে অণিমা মার্ডার কেসে। শুভ্রকে যেদিন এরেস্ট করা হয় সেদিন সকালে কিছু মানুষ মন্দিরে পূজা দিতে আসে তখন মন্দিরের পিছনে কিছু আওয়াজ পায়। মন্দিরের পুরোহিত যেয়ে দেখে একটি মেয়ে জখম হয়ে পড়ে আছে আর তার গলার শিরা জোর করে টেনে বের করে একজন চিবুচ্ছে। এমন বিভৎস অবস্থা দেখে পুরোহিত চিৎকার করে ওঠে। আশেপাশের লোক জড়ো হতে হতে ছেলেটা পালিয়ে যায়। পুলিশকে সাথে সাথে খবর দেওয়া হয়।পুলিশ আশেপাশে চেকপোস্ট বসিয়ে পুরো এলাকা সার্চ করতে থাকে।এক পর্যায়ে কুশভদ্রা নদীর তীরে পুরোহিতের বর্ণনা অনুযায়ী একজনকে পুলিশ খুঁজে পায়।তার আচরণ কথাবার্তা অসংলগ্ন দেখে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।পুরোহিতকে দেখানো হলে তিনি বলেন একেই দেখেছিলাম মেয়েটার গলার শিরা কিভাবে টেনে বের করার চেষ্টা করছে আর চিবুচ্ছিলো। পুলিশ মিডিয়াকে সবকিছু জানায়নি কারণ তদন্ত বাধাগ্রস্ত হতে পারে এমন বিভৎস ঘটনা সারাদেশে যদি রটে যায়। আর এলাকার মানুষদেরকেও সাবধান করে আসছে তদন্তের স্বার্থে যেনো ঘটনাটা এখুনি প্রকাশ না পায়। শুভ্রের কাছে পাওয়া তিনটি আঙুল আর একটি চোখ অণিমার-ই বলে শনাক্ত করা হয়েছে।পুলিশ বলছে অণিমা আর শুভ্র নাকি একি ফ্লাইটে ইন্ডিয়া আসছে। মিডিয়া অবশ্য কিছু সত্য উদঘাটন করতে পেরেছে কিন্তু শিওর হতে পারেনি। এজন্য পুলিশের উপর অনেক চাপ আসছে। পুলিশ এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত শেষ না করা পর্যন্ত প্রকাশ করতে চাচ্ছে না। সময় যত যাচ্ছে শুভ্রের কেসটা ততোই জটিল হচ্ছে। আপনার বাবা তার ফ্রেন্ডের কাছে বিষয়টা একটু গুরুত্বের সাথে দেখতে বলেছে বলে সে আমাকে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছে হেল্প করার জন্য। আমি আসলে একজন সাংবাদিক। আর শুভ্রের কেসের এতো ডিটেইলস এই প্রথম কাউকে জানালাম। বিষয়টা কতোটা জটিল বুঝতেই তো পারছেন। শুভ্রের জামিন পাওয়া একেবারে অসম্ভব বলতে গেলে। আমি আগে থেকে বিষয়টা আপনাদের পরিবারকে জানিয়ে নিরাশ করতে চায়নি। চেষ্টা করতে থাকেন উপর ওয়ালা ভরসা এখন শুধু আর আমার পক্ষে যা যা হেল্প করা সম্ভব তা আমি করবো এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। গাড়িতে ফিরতেই মামা জিজ্ঞাসা করলো এতো সময় কোথায় ছিলি শুভ্রের কাছে কখন নিয়ে যাবি। গাড়িটা সোজা বারিপাদা সার্কেল জেলে নিয়ে যাওয়া হলো। সাংবাদিক জানালেন খবর নিয়ে জেনেছি শুভ্রকে আপাতত এখানে রাখা হয়েছে। অনেক জোরাজোরির পর জেল কর্তৃপক্ষ তাদের উর্ধ্বতন কর্মকতাদের কাছে থেকে পারমিশন নিয়ে শুধুমাত্র একজনকে শুভ্রের সাথে ১৫ মিনিট কথা বলার অনুমতি দিয়েছে। মেঝোমামা শুভ্রের সাথে দেখা করতে ভিতরে চলে গেলো। আর সাংবাদিকটি কিসব জরুরি কথা বলছে মোবাইলে। আমি একটু দূরে চায়ের টোংঘর দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে চা খেতে লাগলাম। চা খেতে খেতে আমার মুচকি মুচকি হাসি দেখে এক বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলো ঐ পোয়া তামে হাসেক ক্যালা। মনে মনে ভাবছি হাসছি কেনো যদি বলতে পারতাম তাহলে তো দাদু ভালোই হতো। চায়ের বিলটা দিয়ে বৃদ্ধকে বললাম তেমন কিছু না এমনি হাসি লাগলো হঠাৎ। মামা বাইরে বের হয়ে সোজা গাড়িতে গিয়ে বসলেন। চুপচাপ হয়ে বসে আছে, চোখ দুইটা ফুলে লাল। দেখে বোঝা যাচ্ছে ছেলের অবস্থা দেখে অনেক কান্নাকাটি করেছেন। আমরা আরও দুই সপ্তাহ মতো ছিলাম ওড়িশায় কিন্তু কেসটা অনেক জটিল হওয়ার কারণে শুভ্রের জামিন পাওয়া গেলো না। আর অণিমা ও শুভ্র দুইজনেই বাংলাদেশের নাগরিক বলে তাদের কেসটা কোনোভাবে বাংলাদেশের অধীনে নিয়ে আসা যায় কিনা এরজন্য বাবা বড় মামা সহ সবাই অনেক ছোটাছুটি যোগাযোগ করলো কিন্তু তার কোনো ফল আসলো না। ভিসার কারণে আমাদেরকে ইন্ডিয়া থেকে ফিরে আসতে হলো দুই সপ্তাহের মাথায়। সাংবাদিক, যাকে বাবার বন্ধু আমাদেরকে সাহায্যের জন্য পাঠিয়েছিলো তিনি আসলে আমাদের সাথে থেকে শুভ্রের কেসটা আরও কাছে থেকে দেখার চেষ্টা করছিলেন নিজের নিউজ চ্যানেলের স্বার্থের জন্য। পরে তার প্রতিবেদন দেখতে পেয়ে বুঝতে পেরেছিলাম কেনো তিনি আমাদেরকে এতো হেল্প করছিলেন যেচে পড়ে।
২ বছর পর...
শুভ্রের ফাঁসি হয়েছে আজ প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে।মেঝো মামা তার ব্যবসাটা কোনো রকমে চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় সময় সে উদাস হয়ে একা-একা বসে থাকেন, তেমন কারোর সাথে কথা বলেন না অনেক প্রয়োজন না হলে।তবে মামীর অবস্থা আরও খারাপ। প্রায় পাগল হয়ে যাওয়ার পথে। আর সবকিছু ঠিক আছে। এখন আমি নেত্রকোনায় পার্মানেন্ট থাকি। নিজের উদ্যোগে একটি কোম্পানি শুরু করেছিলাম সেটার-ই দেখাশোনা করছি বর্তমানে। বাবা মাকে এখানে আমার কাছে চলে আসতে বলেছিলাম কিন্তু তারা আমাদের পুরনো বাসাটিতেই থাকবে বলে জানিয়েছে। মায়ের সাথে কথা হলো সে বললো তোর বাবা তার ব্যবসা থেকে সব টাকা উঠিয়ে তোর মেঝো মামার ব্যবসায় ইনভেস্ট করেছে।তোর মেঝো মামার মানুষিক অবস্থা তো জানিস এখন কেমন আর তোর বাবাও তার ব্যবসা তোর মামার ব্যবসা একসাথে সময় দিয়ে ঠিক সামলে উঠতে পারছিলো না তাই এমন সিদ্ধান্ত নিলো। আর আমরা তোর কাছে চলে আসলে তোর মামা মামীকে দেখবে কে। আমরা ছাড়া কেই বা আছে তাদের সব সময় দেখার জন্য। তুই সময় পেলে বাসা থেকে ঘুরে যাস তোকে অনেক দিন হলো দেখি না। মায়ের সাথে কথা বলা শেষ করে অতীতের কিছু ঘটনার কথা মনে করছিলাম। হঠাৎ আমার কেবিনের দরজায় নক করার শব্দ হলো। "স্যার অমিত নামের একজন ভদ্রলোক আপনার সাথে দেখা করতে চাই।" " আচ্ছা উনাকে বসতে বলো, চা খেতে দিও। আর আমি হাতের কাজটা শেষ করে ডাকছি।" হাতের ফাইলটা কমপ্লিট করে উনাকে ভিতরে ডাকলাম। উনাকে বসতে বলে জিজ্ঞাসা করলাম কি সাহায্য করতে পারি আপনাকে। উনি হাসলেন। বললেন "আপনি আমাকে চিনবেন না হয়তো। আগে আমার সংক্ষিপ্ত পরিচয়টা বলি। আমি অণিমার হাসবেন্ড। এখন আবার যেনো বইলেন না যে আপনি অণিমাকে চিনতেন না।" অমিত সাহেবের কথা গুলো শুনে চুপ করে রইলাম। হ্যাঁ না কিছুই বলছি না। তিনি আমার নিরবতা দেখে একটু হেসে আবার বলা শুরু করলেন -" অণিমার সাথে আমার বিয়ে হয় পারিবারিক ভাবে। প্রথমে ভেবেছিলাম ও চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। সেজন্য আমার সাথে তেমন কথা বলে না। কিন্তু কিছুদিন পর আমার ভুলটা ভেঙে যায় ওকে মোবাইলে কথা বলতে শুনে।অপর প্রান্তে কে ছিলো তখন জানতাম না, পরে জেনেছিলাম। নাম্বারটা নিয়ে চেক করে জানতে পারি ঐটা শুভ্র নামের একটা ছেলের নাম্বার যার সাথে অণিমার বিয়ের আগে সম্পর্ক ছিলো। অণিমাকে এটা নিয়ে সন্দেহ করতাম না। বিয়ের আগে যা হয়েছে তা তো আমি পরিবর্তন করতে পারবো না কিন্তু বিয়ের পরের জীবনটা আমি চাইলে অনেক সুন্দর করে তুলতে পারি যদি অণিমা আমার পাশে একটু থাকে। কিন্তু দিনদিন যেনো পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। দেখি লুকিয়ে লুকিয়ে মোবাইলে কথা বলাটা অনেক বেড়ে যেতে শুরু করে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি অণিমাকে আমাদের ছোট সংসারটায় মন দেওয়াতে কিন্তু তার মনে শুধু শুভ্রই ছিলো আর কিছু না। একদিন জিজ্ঞাসা করেই ফেলি অণিমাকে যে সে কি চাই। তখন অণিমা বলেছিলো দেখো অমিত আমাকে তোমার অপছন্দ হলে বলো আমি বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি কিন্তু আমার চরিত্র নিয়ে আর একটা বাজে কথা শুনবো না। আমি অস্বীকার করছি না যে শুভ্রের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো না কিন্তু সেটা বিয়ের আগে এখন আর নেই। সবকিছু অতীত আর তুমি অমিত ভিতর থেকে এমন আমি জানতাম না।আমার অতীত নিয়ে খোঁচা দিচ্ছো! তুমিও দেখি অন্যদের থেকে একটুও আলাদা না। অণিমার কথা শুনে অনেক খারাপ লেগেছিলো। ভেবেছিলাম হয়তো শুভ্রই এখনো অণিমাকে ডিস্টার্ব করে সেটা অণিমা ভয়ে বা কোনো কারণে আমাকে বলতে পারছে না। শুধু শুধু অণিমাকে সন্দেহ করলাম এই জিনিসটা আমাকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিচ্ছিলো। শুভ্র মনে হয় অণিমাকে ব্লাকমেইল করছে তাই হয়তো অণিমা বাধ্য হয়ে শুভ্রের সাথে কথা বলছে। এমন কিছু আছে যেটা অণিমা ভয়ে আমার কাছে থেকে লুকিয়ে রাখছে যেনো আমাদের সংসারে কোনো প্রভাব না পড়ে এজন্য। অণিমাকে প্রথম যেদিন ওর বাসায় দেখতে গেছিলাম সেদিন থেকেই ওকে ভালোবেসে ফেলি। অতীতে ভুল হতেই পারে সেজন্য বর্তমানে তার শাস্তি আমি অণিমাকে দিবো এমন মানুষ আমি না। অনেক কিছু ভেবে না চাইতেও অণিমার ফোনে কল রেকর্ড চালু করে রাখি এটা বোঝার জন্য আসলে সমস্যাটা কি নিয়ে। অণিমা বুঝে যায় কিনা ওর ফোনে কল রেকর্ড চালু করা হয়েছে এই ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি অণিমা বুঝতে পারেনি। ফোন চেক করে দেখি আজও শুভ্রের সাথে কথা হয়েছে। ওর আর শুভ্রের কল রেকর্ড গুলো আমার ফোনে নিয়ে ওর ফোন থেকে সব রেকর্ড ডিলিট করে কল রেকর্ডিং অফ করে রাখি। রাতে আর শোনার সময় পাইনি রেকর্ড গুলো। পরদিন সকালে অফিসে যেয়ে রেকর্ডটা শুনি। কল রেকর্ড শুনে আমি কিছু মুহূর্তের জন্য বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না অণিমা এমনটা করতে পারে আমার সাথে। কল রেকর্ড শুনে প্রথম জানতে পারি আমার বাচ্চা অণিমার পেটে।তিন মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলো তখন অণিমা। শুভ্রকে অণিমা বলছে আমি আর পারছি না এটা মেনে নিতে ঐ লোকের বাচ্চা আমার মাঝে বড় হচ্ছে। তুমি কোনো একটা ব্যবস্থা করো নাহলে বাচ্চা যত বড় হচ্ছে তত বেশি ঝামেলা হবে। বাচ্চাটা আমি আর একটাদিনও রাখতে চাই না। শুভ্র তখন অণিমাকে বলে তুমি আর চিন্তা করো না। তোমার বিষয়টা নিয়ে মায়ের সাথে কথা হয়েছে। মা বলেছে তার গ্রামের একটা ছেলে সে এখন শহরের অনেক বড় একজন ডাক্তার তার কাছে তোমাকে নিয়ে যাবে অ্যাবরশন করাতে। তুমি চিন্তা করো না। এরপর শুভ্র আর অণিমার মাঝে আরও অনেক কথা হয় যা শুনতে আমার লজ্জা ঘৃণা দু’টোই লাগছিলো। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে অণিমাকে কল করি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও অণিমাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। অফিস থেকে তখনি রওনা হই বাসার পথে। বাসায় গিয়ে দেখি তালা দেওয়া। আমার কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে লকটা খুলে ভিতরে ঢুকি। অণিমার ফোন আসে আমার কাছে দুপুর তিনটার দিকে। ও বলে হঠাৎ মা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আমি মায়ের কাছে আসছি। তোমাকে সংবাদটা দিয়ে ডিস্টার্ব করতে চাইনি তখন। এখন মা একটু সুস্থ। আমি দুইদিন পর আসলে কি কোনো অসুবিধা। অণিমাকে তখন থাকতে বললাম যতদিন ওর ইচ্ছা। বুঝতে পারছিলাম না সেই মুহুর্তে আমার কি করা উচিৎ। অপেক্ষা করলাম অণিমার জন্য। ও দুইদিন নয় পুরো এক সপ্তাহ পর ফিরলো। এর মাঝে ওর সাথে তেমন একটা কথা হয়নি আমার। বাসায় ফেরার পর থেকে অণিমাকে অন্যরকম খুশি লাগছে। কল রেকর্ডটা নিয়ে বা ওর খুশি কেনো লাগছে তাই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলাম না। আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না অণিমা আমার সাথে এমনটা করতে পারে। অণিমার ফোনটা চেক করে তেমন কিছু পেলাম না শুধু একজন ডাক্তারের নাম্বার পেলাম। কল হিস্টোরি চেক করে দেখি ডাক্তারের সাথে কোনো কল আদান-প্রদানের তথ্য নেই। আর কল হিস্টোরির প্রথম নাম্বারটা দেখি ওর এক বান্ধবীর যার সাথে প্রায় ছয় মিনিট কথা হয়েছে কিন্তু লাস্ট কলে কত মিনিট কথা বলেছে সেটা চেক করে দেখলাম সাড়ে নয় মিনিট কথা বলা হয়েছে। ডাক্তারের নাম্বারটা নিয়ে আমার এক কলিগকে দিয়ে কথা বলিয়ে ডাক্তারের ক্লিনিকের ঠিকানাটা নিলাম। ক্লিনিকে গিয়ে রিসেপশনিস্টকে কিছু টাকা দিয়ে গত দুই সপ্তাহের অ্যাবশন করা রোগিদের লিস্টটা নিলাম। নিয়ে দেখি যেদিন অণিমা ওর মায়ের অসুস্থতার কথা বলেছিলো সেদিন ও অ্যাবরশন করিয়ে গিয়েছে। সেজন্য ফোন বন্ধ রেখেছিলো। লিস্টে ওর নাম দেখেও কেনো জানি না তখনও বিশ্বাস হচ্ছিলো না। পরে রিসেপশনিস্টকে আরও কিছু টাকা দিয়ে সেদিনের ভিডিও ফুটেজটা দেখলাম। অণিমার সাথে একটা ছেলে আর একজন মহিলাকেও দেখলাম। তাদেরকে এর আগে কখনো দেখিনি। লিস্টে দেখি সে ছেলেটাও সিগনেচার করছে। আবার লিস্টটা চেক করে দেখলাম অণিমার পাশে স্বামীর নাম দেওয়া শুভ্র। রিসেপশনিস্টকে ওদের সাথে থাকা মহিলাকে চিনে কিনা বললাম ও বললো উনি তো মেয়েটার শাশুড়ী আর আমাদের ডাক্তার সাহেবের গ্রামের আত্মীয় হয় নাকি। বুঝতে বাকি রইলো না ঐ ছেলেটা শুভ্র আর মহিলাটা শুভ্রের মা। আমি চিন্তাও করতে পারছিলাম না একজন মহিলা কি করে একটা মেয়ের সন্তান নষ্ট করতে সাহায্য করে যে কিনা তার ছেলের প্রাক্তন আর অন্য কারও স্ত্রী। আর তিনিই বা কি করে তার ছেলের অন্যায় আব্দার মেনে নিলেন। বাসায় অনেক রাত করে ফিরেছিলাম সেদিন। জিজ্ঞাসা না করলেই নয় তাই অণিমা জিজ্ঞাসা করলো এতো দেরি হলো কেনো আমার। আমি উত্তর না দিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম ঘুমানোর জন্য। তারপর থেকে অণিমার থেকে একটু দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করি। ধৈর্য ধরে ছিলাম আমার দ্বারা যেনো কোনো বড় ভুল না হয়। কিন্তু অণিমা কারণে অকারণে আমার সাথে ঝগড়া বাধানোর চেষ্টা করা শুরু করে। এমন এমন ভাষায় কথা বলতো যা একজন স্বাভাবিক মানুষের সহ্যের বাইরে। একদিন আমার মা বাবার সম্পর্কে এমন বাজে মন্তব্য করে যার জন্য আমাকে বাধ্য হয়ে ওর গায়ে হাত তুলতে হয়। ও মনে হয় এইটার জন্যই এতোদিন অপেক্ষা করছিলো। সেদিন-ই ও সব গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। কিছুদিন পর আমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠায় আমি ওর গায়ে হাত তুলি এজন্য। তার কয়েকদিন পর আমার এক বন্ধু কল দিয়ে বলে কি ব্যাপার বন্ধু ভাবিকে দেখলাম অন্য এক ছেলের সাথে হাত ধরে ঘুরছে। শুনেই কলটা কেটে দিলাম। অফিসে গিয়েও শান্তি হলো না। নানা জনে নানান কথা বলা শুরু করে। চাকরিটা বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিতে হয়। তারপর একটু মানুষিক শান্তির জন্য কোথাও ঘুরে আসার পরিকল্পনা করি। রওনা হয়ে গেলাম ইন্ডিয়ার পথে। একটু ঘোরাঘুরি করে যেনো মনটা হাল্কা হতে শুরু করলো। তার মাঝে হঠাৎ আমার এক কলিগের মেসেজ আসলো। দেখলাম শুভ্রের সাথে অণিমার অন্তরঙ্গ মুহুর্তের একটি ছবি আর নিচে লিখেছে অমিত ভাই আপনার বউয়ের উপর শুধু তার অধিকার নাকি আমাদেরকেও একটু সুযোগ দেন। তখন নিজের রাগকে কোনোভাবে কন্ট্রোল করে রাখতে পারলাম না। ফোনটা আছড়ে ভেঙে ফেললাম। তখন আমি ছিলাম ওড়িশার মায়ং-এ। নাম তো শুনেছেন মনে হয়। তখন যেনো আমার ভিতরে একটা পশু জেগে গেলো। দুইমাস ওখানে ছিলাম। তারপর ফিরে আসি। তারপর খোঁজ খবর নিয়ে আপনার পরিচয় পেলাম যার মাধ্যমে আমার জীবনকে যারা নরক বানিয়েছে তাদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। আপনি জ্ঞানী মানুষ। আমার এতোটুকু কথায় আশাকরি সব বুঝে গেছেন। আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আমি আপনাকে এগুলো না বললেও পারতাম তাই তো। আসলে হঠাৎ মনুষ্যত্ব জেগে উঠলো তাই সবকিছু বলে গেলাম যেনো সারাজীবন আপনাকে অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে না হয়। জানি এখন আপনার মাঝে মনুষ্যত্ববোধটা অনুপস্থিত কিন্তু সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। একটা সময় আপনিও আগের মতো হয়ে যাবেন। আজ আসি তাহলে। এইটা হয়তো আপনার আর আমার শেষ দেখা। আজ সন্ধ্যায় আমার ফ্লাইট। দেশ ছাড়ছি। আর কখনো ফেরার ইচ্ছা নেই। আপনাকে একটা উপদেশ দেওয়ার ছিলো। ভালো করে খোঁজ খবর না নিয়ে আর কাউকে রক্ত দিবেন না।"
অমিতের কথা গুলো শুনে কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। অমিত যাওয়ার পর মনে হলো শরীরের উপর থেকে অদৃশ্য একটি চাপ উঠে গেলো। এ কি করলাম আমি! নিজের হাতে একটা পরিবারকে শেষ করে দিলাম! অণিমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন থেকেই ওকে ভালো লাগতো। শুভ্র আমি অণিমা একই কলেজে পড়তাম। শুভ্রও জানতো আমি অণিমাকে পছন্দ করতাম কিন্তু সাহস করে বলতে পারিনি কখনো। একদিন অণিমা আমাকে ডেকে বলে তুমি শুভ্রের ভাই না! শুভ্রকে আমার অনেক পছন্দ। তুমি একটু দেখবে আমাদের বিষয়টা। কথাটা শুনে তখন একটু খারাপ লেগেছিলো কিন্তু পরে বিষয়টা মেনে নিয়েছিলাম। অণিমা অনেক সুন্দরী। তাকে যে দেখবে তার পছন্দ হবে। কিন্তু সে তো আর সবাইকে পছন্দ করবে না। একজনকে তার পছন্দ হতেই পারে সেটা যে কেউ হোক। শুভ্রকে বিষয়টা জানানোর পর শুভ্র তখন কিছু বলেনি। পরে একদিন আমাকে এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি অণিমা বসে আছে। তখন জানতে পারলাম ওদের সম্পর্কের কথা। এভাবে কয়েক বছর পার হয়ে যায়। পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই নিজের উদ্যোগে একটি ব্যবসা শুরু করি। সেখানে ব্যস্ত থাকার কারণে শুভ্রের সাথে যোগাযোগ অনেক কমে যায়। শুভ্রও অণিমার সাথে সম্পর্কে যাওয়ার পর থেকে তেমন একটা যোগাযোগ করতো না।এদিকে আমার একটা প্রোজেক্টের বিল আটকিয়ে ছিলো। অন্তত ওয়ার্কারদের বকেয়া পরিশোধ করার জন্য আমার তখনি কয়েক লাখ টাকার প্রয়োজন ছিলো। অনেক ধারদেনা করে প্রজেক্টের পিছনে অনেক টাকা ব্যয় করা হয়ে গেছিলো। নতুন করে টাকা নেওয়ার সুযোগ ছিলো না কারও কাছে থেকে। বাবাকে বললাম কিন্তু কোনো কাজ হলো না। সে-ই তার ব্যবসা নিয়ে তখন ঝামেলার মাঝে ছিলো আর সে চাইতো আমি নতুন কিছু শুরু না করে তার সাথে তার ব্যবসাটায় যেনো সময় দি। এজন্য তখন বাবা তেমন গুরুত্ব দেখায়নি আমাকে হেল্প করার। মা বললো তুই চিন্তা করিস না। আমার নামে কিছু জমি আছে সেগুলো বন্ধক রেখে তোকে টাকা দিলাম,তুই না হয় পরে তোর প্রোজেক্টের বিল পাশ হলে বন্ধকী মূল্য পরিশোধ করে জমিটা ছাড়িয়ে নিলি। তারপর মা এ বিষয়ে মেঝো মামার সাথে কথা বলে। মামার কাছে দলিলটা ছিলো কিন্তু মেঝো মামী রাজি ছিলো না দলিলটা বের করে দিতে। শেষ পর্যন্ত দলিলটা না পেয়ে টাকার কোনো ব্যবস্থা করা গেলো না। টাকার জন্য তখন আমার প্রজেক্টে অনেক ক্ষতি হয়। অবশ্য এ ক্ষতি সামাল দিতে আমার বেশিদিন সময় লাগেনি। এভাবে দিন পার হতে থাকে আর সবকিছু স্বাভাবিক হতে থাকে। এসব নিয়ে পরে আর কোনো বাড়াবাড়ি হয়নি মেঝো মামা আর আমাদের মাঝে। দিন পার হয় বছর পার হয়। একদিন শুনি অণিমা আর শুভ্রের মাঝে কি সব নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়। পরে শুভ্রের কাছে শুনি ভুলটা শুভ্রের-ই ছিলো কিন্তু কি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি সেটা আর বলেনি ও। ওদিকে অণিমা রাগ করে ওর বাবা মায়ের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে নেয়। তখন শুভ্র অনেক ভেঙে পড়ে। আমার নতুন প্রোজেক্টের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ওদিকের খোঁজ খবর তেমন নেওয়া হতো না। এর মাঝে একদিন বাসায় যায়। গিয়ে জানতে পারি শুভ্র এখন তেমন বাসায় থাকে না। প্রোজেক্টের কাজ কিছুদিন বন্ধ থাকার কারণে বাসায় সে কয়দিন ছিলাম। একদিন মেঝো মামা মামীর সাথে দেখা করার জন্য ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। দরজায় নক করার আগে ভিতরে শুনি অনেক গণ্ডগোল চলছে। আসলে মেঝো মামী ছিলো একটু মর্ডান টাইপের। পর্দা করতো না আর পুরুষ বন্ধুও ছিলো অনেক। মামা এসব পছন্দ করতো না কিন্তু মামীর এসবকিছু গায়ে লাগতো না। সে তার মতো করে উশৃংখল ভাবে চলতো। মামা বিশেষ করে মামীর একজন বন্ধুকে সহ্য করতে পারতো না। যতদূর শুনেছি সেই লোক নাকি ততটা সুবিধার না। অনেক বাজে কথা শুনেছি সেই লোকের নামে। বিশেষ করে মামা এই লোকটার সাথে মামীর মেশাটা পছন্দ করতো না। কিন্তু মামীর সব সময় একটাই কথা তোমার চরিত্রে সমস্যা আছে নাহলে অন্যদের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে না।এইটা শুনে মামা আরও বেশি রেগে যেতো। কিন্তু আজকের কথা গুলো অনেক বাজে ছিলো। মামা গন্ডগোল করার এক পর্যায়ে মামীকে বলে বসে তুমি জানো তোমার মেয়েকে আমি সহ্য করতে পারি না কেনো। তোমার যা চরিত্র তাতে সন্দেহ হয় নায়া আসলেই আমার মেয়ে কিনা। কথাগুলো শুনে আমি বাসায় ফিরে আসি। ঐদিন আর মেঝো মামার বাসায় যায়নি। পরেরদিন মা বললো এইটা তোর মামাকে দিয়ে আয় তো। তোর মামা এটা খেতে পছন্দ করে। দরজায় নক করলে মামী এসে দরজাটা খুললো। আমাকে ভিতরে বসতে বলে মামী প্লেটটা ভিতরে নিয়ে গেলো। মামীকে জিজ্ঞাসা করলাম মামা আর নায়া কোথায়। মামী বললো তোমার মামার কি জরুরি কল আসছিলো তাই বাইরে গেছে আর নায়া স্কুলে। তুমি তো এদিকে আসা ছেড়েই দিয়েছো। মামীকে জিজ্ঞাসা করলাম তাকে অনেক উদাসীন দেখাচ্ছে কিছু হয়েছে কিনা। মামী প্রথমে বিষয়টা এড়িয়ে গেলো। কিছু সময় কথা বলার পর মামী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি কান্না করে দিলো। মামী বলা শুরু করলো বাবা তুমি বয়সে ছোট কিন্তু তারপরও বলি কথা গুলো আর চাপা রাখতে পারছি না। তোমার মামার সাথে আমার অনেক সমস্যা হচ্ছে ইদানীং। সে যেনো দুচোখেই আমাকে সহ্য করতে পারছে না। এমনি কি গতকাল বলেই ফেললো সে নাকি সন্দেহ করে নায়া তার নিজের মেয়ে না। আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলে। তুমিই বলো ছেলে বন্ধু হোক আর মেয়ে বন্ধু হোক তা থাকাটা কি দোষের কিছু! এই কথাটা তোমার মামাকে বোঝাতেই পারি না। আমি তোমার মামাকে অনেক ভালোবাসি। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি তার সাথে থাকতে চাই। নায়া মাত্র ৭ বছরের একটা বাচ্চা। ওর দোষটা কোথায়। মামী কথা গুলো বলছে আর অঝোরে কানতে রয়েছে। তখন নিজের ভিতরে কেমন হতে লাগলো। মামীকে শান্তনা দিয়ে বললাম মামী আমার মনে হয় আপনার সংসারে কারোর নজর লেগেছে। না হলে মামাকে যতোদূর জানি সে এ কথা মরে গেলেও বলবে না। আমার থেকে ভালো তো আপনিই তাকে চিনেন। বিষয়টা কিন্তু সামান্য না। বিষয়টা আপনার সারাজীবনের। আমি একজনকে চিনি। তার ঠিকানা আপনাকে দিবো আপনি তার কাছে যাবেন। তার কথা মতো চললে দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। মামীকে ঠিকানাটা দিয়ে চলে আসি। আসলে ঠিকানাটা ছিলো একজন শয়তানের পূজারীর। সে কালোজাদু বিদ্যায় পারদর্শী ছিল। কেনো জানি না অতীতের কিছু ক্ষোভ তখন প্রচন্ড ভয়ংকর রূপে প্রতিশোধে পরিণত হয়। আমি একজনের কাছে শুনেছিলাম ঔ পূজারীর আস্থানায় যে যায় সেই তার বসে চলে আসে। তার কথা শুনতে বাধ্য হয়। মামী তার সংসার বাঁচাতে তার সাথে দেখা করে। আমার প্রোজেক্টের কাজ শুরু হয়ে যাওয়ায় আবার চলে যেতে হয়।কিন্তু দূর থেকে খবর নিতে থাকি কি চলছে ওখানে। সেই শয়তানের পূজারীর দেখানো পথে চলে মামীর মনোবাসনা অনেক পূর্ণ হতে থাকে। এক সময় মামী শয়তানের সাধনায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। এতোটাই সাধনায় মগ্ন হয়ে যায় যে তার মনোবাসনা লালসা অধিক জাগ্রত হয়ে তার নিজের হাতে নিজের মেয়েকে শয়তানকে উৎসর্গ করার জন্য বলি দেওয়ায়। শয়তানকে জাগ্রত করার সেই পূজায় নিজের নিষ্পাপ মেয়ের মাথা কালো কুকুরের মাথা কেটে সেখানে সেলাই করে সিঁদুর হলুদ লাগিয়ে দেয় আর কুকুরের মাথাটা নায়ার ঘাড়ে মোটা সুতা দিয়ে সেলাই করে একইভাবে সিঁদুর হলুদ লাগিয়ে দেয়। আর কুকুর আর নায়ার রক্ত মিশিয়ে তাই দিয়ে গোসল করে শয়তানের সাধনা করতে বসে। মামীর উশৃংখলতা দিন দিন বাড়তে থাকে। মামারও মাঝে পরিবর্তন এসে যায়। সে মামীর কোনো কাজে বাধা দেয় না। মামার ব্যবসারও উন্নতি হতে থাকে। এর মাঝে একদিন মায়ের কাছে থেকে জানতে পারি শুভ্র বাসায় থাকে না কারণ সে নাকি আমি মাঝে বাসায় যাওয়ারও বেশকিছুদিন আগে থেকে অণিমাকে নিয়ে সংসার করছে। বিষয়টা নাকি মেঝো মামাকে জানানো হয়নি কিন্তু মামী সব জানে। এটা বাবা জানতে পেরে মাকে বললো তাই মা জানালো আমাকে। নায়াকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে শুভ্র বাসায় ফিরে আসছে। মেঝো মামার সাথে বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করছে। আমি প্রোজেক্ট রেখে যেতে না পারার দোহাই দিয়ে নেত্রকোনা থেকে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে মেঝো মামা ও শুভ্রকে সেখানে সেখানে পাঠালাম নায়াকে খোঁজায় পুলিশ যেনো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় তার জন্য। কিন্তু আমি জানতাম নায়ার সাথে কি হয়েছে। আর এটাও জানতাম শয়তানের সাধনা করলে যতোটা না পাওয়া যায় তারচেয়ে বেশী হারাতে হয়। জীবন অভিশপ্ত হয়ে যায়। ঐ জগতের একটাই পথ শুধু ঢোকার কিন্তু একবার ঢুকলে বের হওয়ার কোনো পথ নেই। মামীকে চরম মূল্য দিতে হলো তার শয়তানের সাধনা করায়। নায়াকে খোঁজার নাম করে শুভ্রকে মামী মায়ং-এ পাঠায় কিছু কালো জাদুর সরঞ্জাম নিয়ে আসার জন্য। সে শুভ্রকে বোঝায় নায়াকে খুঁজে পাওয়ার এই একটা পথ ছাড়া আর কিছু বেঁচে নেই। শুভ্র প্রথমে মানতে চাইনি কিন্তু নায়াকে ও খুব ভালোবাসতো সেজন্য মন না চাইলেও সে মায়ং-এ যায়। যে শয়তানকে সাধনা করে একবার জাগ্রত করে শয়তান তার মনোবাসনা পূর্ণ করার বিনিময়ে তার সব সুখ শান্তি প্রিয় জিনিস সবকিছু কেঁড়ে নেয়। জীবনটাকে অভিশপ্ত করে দেয়। মামী নায়াকে দায়ী ভাবা শুরু করে যখন তার সংসার শেষ হয়ে যাওয়ার দারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। মামীর কর্মের ফল তার ছেলের মৃত্যুর বিনিময়ে সাময়িক চোকাতে হয়। মায়ং থেকে ফিরে আসার পর শুভ্র যখন গায়েব হয়ে যায় ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন মায়ং-এ আবার যাওয়ার ব্যবস্থা আমি করেছিলাম শুভ্র আর অণিমার। নেত্রকোনা থেকে ফিরে কিছুদিন পর অণিমার সাথে কথা বলে ওকে শুভ্রকে নিয়ে আবার মায়ং-এ যাওয়ার কথা বলেছিলাম। অণিমা রাজি হয়েছিলো শুভ্র আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে এই আশায়। শুভ্র তার মায়ের কথা শুনে মায়ং-এ প্রথমে শয়তানের উপাসনার জন্য কিছু জিনিস আনতে গেলেও ও শয়তানের ধোকায় পড়ে নিজেই কালো জাদু সাধনা করে নায়াকে ফিরে পাওয়ার জন্য। পরবর্তীতে যখন বাড়ির সবার কাছে থেকে লুকিয়ে শুভ্রকে অণিমার সাথে আবার মায়ং এর উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দি এটা জেনেও যে শুভ্র শয়তানের সাধনা করেছে বলে শয়তান তার কাছে থেকে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষের রক্ত চাইবে।মৃত্যুর খেলায় নায়া অণিমা শুভ্র সবাই হেরে গেলো আর মামী সব হারিয়ে এখন পাগল প্রায়। আমি যেনো এতোদিন কেমন একটা প্রতিশোধের ঘোরের ভিতরে ছিলাম। সব সময় মনে হতো অণিমা শুভ্র আর মামীর উপরে প্রতিশোধ নেওয়ার। হঠাৎ একটি অজানা নাম্বার থেকে কল আসলো। রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠলো ফোন ধরতে এতো সময় লাগানেন কেনো। কোনো চিন্তা করছিলেন নাকি। চিনতে পেরেছেন তো আমাকে আমি অমিত। ফ্লাইট ছাড়ার আগে শেষবারের মতো বিদায় নিলাম আপনার কাছে থেকে। ভালো থাকবেন আশাকরি। কলটা কেটে যেতেই দেখি এই নাম্বার থেকে আগেও কয়েকবার কল আসছে। এই তো সেই নাম্বার যে নাম্বার থেকে বেশকিছু দিন আগে আমাকে ফোন দিয়ে বলা হয় "ভাই ইমারজেন্সি রক্ত লাগবে আমার স্ত্রীর জন্য এবি নেগেটিভ। আপনার নাম্বার একজন ভাইয়ের কাছে থেকে পেলাম। প্লিজ ভাই আমার একজন লোক যাবে আপনার কাছে। সে আপনাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাবে। ঐ গ্রুপের রক্ত আর কোথাও পাচ্ছি না বলে আপনার কাছে কল করলাম।আমি শহর থেকে দূরের এক হসপিটালে। আপনাকে কষ্ট করে আসা লাগবে না। আমার লোক-ই রক্তটা নিয়ে আসবে।প্লিজ ভাই জীবন মরণের সমস্যা।" তাহলে অমিত আমার রক্ত নিয়ে!