Posts

গল্প

কিছু স্বপ্নের অপমৃত্যু ও অন্যান্য

June 10, 2024

খেরোর খাতা

:


রাত ৮টা /৮.৩০টা।এলোমেলো পা ফেলে রাস্তায় হেটে চলছে রাশেদ। যেন হাটার দিকে আজ তার কোন মনোযোগই নেই। হোঁচট খেয়ে তার পড়নের স্যান্ডেলটি খুলে যায়, আবার তা পায়ে পড়ে নেয়। কোন কিছুতেই যেন আজ তার বিকার নেই।
রাস্তার পাশে নূর ফার্মেসি। রাশেদ কি মনে করে হঠাৎ সেটায় ঢুকে পড়ে।রাশেদের বাসার পাশে হওয়াতে নূর ফার্মেসির মালিক হোসেন ভাই রাশেদের পূর্ব পরিচিত। রাশেদকে দোকানে ঢুকতে দেখে হোসেন ভাই হাসি মুখে বলেন, আরে রাশেদ ভাই যে, কি খবর আপনার? দেখাই তো পাওয়া যায় না আজকাল...
রাশেদঃ এই তো ভাই একটু ব্যাস্ত ছিলাম।
হোসেনঃ ভাইয়ের কি শরীর খারাপ? কেমন যেন লাগছে...
রাশেদঃ হুম সেই জন্যই তো আপনার দোকানে আসলাম। কয়েকদিন যাবৎ ভালো ঘুম হচ্ছে না, কম পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ খেয়েও কাজ হয় না। তাই ভাবছি বেশি পাওয়ারেরটা খাবো। বুঝলেন হোসেন ভাই , ঘুমটা হওয়াটা দরকার। আপনার কাছে কি ভালো এবং বেশি পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ আছে? থাকলে দেন তো ২০-৩০ টা , একমাসের টা একবারে নিয়ে যাই।
হোসেনঃ কিছু মনে কইরেন না রাশেদ ভাই, এভাবে প্রেসক্রিপশন ছাড়া এতগুলা ঘুমের ওষুধ..
রাশেদঃ না দিতে পারলে বলেন , চলে যাই। আপনি পরিচিত মানুষ , তাই আগে আপনার দোকানে এসেছিলাম, ভাবলাম আপনি আমার সমস্যা টা বুঝবেন। যাই হোক , তাহলে আর কি, চলে যাই , ডিস্পেন্সারির তো অভাব নাই এলাকায়।
হোসেনঃ আহা রাগ করেন ক্যান ভাই? আপনি চাইলে দিবো না কেন? তবে ভাই এইভাবে ভাঙ্গা ২০-৩০ টা নিলে তো বোতলে দিতে পারবো না, প্যাকেটে দিলে চলবে?
রাশেদঃ সমস্যা নাই। দিয়া দেন। ওষুধ দরকার, প্যাকেট দিয়া কি করবো?
হোসেন একটা প্যকেটে ৩০টা ওষুধ প্যকেট করে রাশেদকে দেয়। রাশেদ দাম পরিশোধ করে দ্রুত দোকান থেকে বেড়িয়ে যায়। এর চেয়ে বেশি সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা হয়ত তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আজ রাশেদ হোসেন ভাইকে মিথ্যা কথা বলে ওষুধগুলো এনেছে। তার ঘুমের কোন সমস্যা নেই। সে ঠিক করেছে আজ রাতে এই সবগুলো ওষুধ একসাথে খাবে। বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাও যেন আজ তার মরে গেছে।
তানিয়ার সাথে ব্রেকআপটা রাশেদ কিছুতেই মানতে পারছিলো না। সব ঠিক ঠাক ছিলো। হঠাৎ কেমন যেন ঝড়ের মতো একদিন সব ওলট পালট হয়ে গেলো। রাশেদের জন্য এটা অনেক বড় ধাক্কা ছিলো। তাই বেশ কিছুদিন যাবত অনেক ডিপ্রেশনে ভুগছিলো সে। জীবনের সব কিছু যেন অর্থহীন লাগছিলো তার। কাজে মন ছিলো না, ক্লায়েন্টরাও তার সাম্প্রতিক ব্যবহারে অসন্তুষ্ট ছিলো, ২টা প্রজেক্ট প্রায় যায় যায় অবস্থা। তাই আজ গত দুই দিন আগে রাশেদের বস তাকে ডেকে নিয়ে চাকরি থেকে ছাটাই করে দিয়েছে।
আজ রাশেদের জীবনের সব কিছু কেমন তেতো লাগছে। তানিয়া নেই, চাকরী নেই, ভাড়া দিতে না পারলে হয়ত সামনের মাসে বাসাটাও ছেড়ে দিতে হবে,গ্রামের বাড়িতে মা কে টাকা পাঠাতে হবে...

উ উ উ উ উ উ ফফফফ ... রাশেদ আর ভাবতে পারছে না। রাশেদের এই মুহুর্তে নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।

বাসায় ফিরে ফ্যনটা ছেড়ে বিছানায় বসলো রাশেদ। পকেট থেকে ওষুধের প্যাকেটটা বের করলো। বিছানার পাশে সাইড টেবিলের উপর রাখা পানির বোতলটার দিকে তাকালো সে। জানালাটা খুলে একবার চারপাশটা দেখল, যেন শেষবারের মত সব দেখে নিতে চাইছে । চোখের কোণ টা নিজে থেকেই যেন ভিজে এল রাশেদের। জানালাটা বন্ধ করে প্যাকেট থেকে ওষুধগুলো বের করে বোতল থেকে পানি দিয়ে সবগুলো একসাথে খেয়ে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল রাশেদ। চোখের কোনে জমে থাকা পানিটা হয়ত তখনই গড়িয়ে পড়ল।

জানালার কাঁচ গলে আসা আলোটা চোখে পড়তেই রোজকার মতো ঊঠে পড়লো রাশেদ। বিছানায় ঊঠে বসতেই গতকালের সব ঘটনা একের পর এক মনে পড়ে তার। রাশেদ নিজের মনেই বললো, "ব্যাটা ভেজাল ওষুধ দিসে মনে হয়"। বিছানার থেকে ঊঠে জানালার দিকে গেল রাশেদ। হঠাৎ কি মনে করে তার বিছানার দিকে তাকালো রাশেদ। সেখানে যা দেখলো তাতে তার মেরুদন্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। সে দেখলো বিছানায় শুয়ে আছে আরেক রাশেদ
প্রথম ধাক্কাটা কোন মতে সামলে নিয়ে রাশেদ ধীরে ধীরে বিছানায় শুয়ে থাকা রাশেদের দিকে এগিয়ে যায়।
নাহ , সেই রাশেদের কোন নড়াচড়া নেই।
রাশেদ ঝুকে বিছানায় শুয়ে থাকা রাশেদের শ্বাস প্রশ্বাস দেখার চেষ্টা করে।
নাহ , সেই রাশেদের কোন নিঃশ্বাসের লক্ষণও নেই..
রাশেদ বুঝতে পারে বিছানায় শুয়ে থাকা আরেক রাশেদও সে নিজেই, যার শরীরে এখন জীবনের অস্তিত্ব নেই।
রাশেদ কিছুক্ষন মৃত রাশেদের পাশে বসে ভাবতে থাকে , এখন তার কি করা উচিত। কেউ এসে তার মৃত শরীরটা না দেখা পর্যন্ত সে তো যেতে পারছে না।
দরজায় খট খট শব্দ। সকালে বুয়া আসার কথা। হয়ত সেই এসেছে। কিন্তু রাশেদ তো আজ দরজা খুলতে পারবে না।
ভাইজান.. ও ভাইজান..
রাশেদ নিশ্চুপ ভাবে বসে রইলো। তার তো কিছু করার নেই।
খট খট শব্দ টা আরো কিছুক্ষন হয়ে মিলিয়ে গেলো।
রাশেদ সেই একই ভাবে নিশ্চুপ বসে রইলো।



এখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল। রাশেদ একইভাবে বসে আছে। দরজায় আবার খট খট শব্দ।
ভাইজান.. ভাইজান.. দরজা খুলেন ভাইজান..
বুয়া এই সময়টাতে এসে সাধারনত রাশেদের রাতের রান্না করে দিয়ে যায়। বুয়ার কাছে বাসার তালার একটা এক্সট্রা চাবি থাকায় রাশেদ এই সময়টাতে অফিসে থাকলেও কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু আজ রাশেদ ভেতরে থাকায় বুয়া বাইরে থেকে খুলতে পারছে না।

ভাইজান.. ভাইজান.. কি হইসে আপনার? দরজা খুলেন না ক্যান??

ভাইজান.. ভাইজান.. ও ভাইজান..

সম্ভবত বুয়ার ধাক্কার আওয়াজে পাশের বাসার সালাম ভাইও রাশেদের বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন বোধহয়। রাশেদ বসে বসে তাদের সব কথাই শুনছে। সালাম ভাই চিন্তিত গলায় দরজা ভাঙ্গার কথা বলে সম্ভবত আরো কয়েকজন মানুষ ডাকতে গেলেন ।

বাইরে সবাই মিলে রাশেদের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছে।

বিকট শব্দে রাশেদের দরজা ভেঙ্গে সবাই ঘরের ভেতরে ধুকলো। রাশেদকে ওই ভাবে বিছানায় পরে থাকতে দেখে সবাই তার দিকে ছুটে গেলো। কেউ একজন তার হাত পা ঠান্ডা দেখে ঘষে ঘষে গরম করার চেষ্টা করতে লাগলো, কেঊ একজন রাশেদের চোখে মুখে পানির ছিটা দিতে লাগলো...
একজন দৌড়ে পাশের ডিসপেন্সারি থেকে ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসলো..


২.

রাশেদের বাসা এখন মানুষ জনে ভর্তি।

রাশেদের মা হাউমাউ করে কাঁদছেন। ছেলের খবর পেয়েই তিনি দৌড়ে চলে এসেছেন ঢাকায়, রাশেদের বাসায়।

রাশেদের কেমন যেন খারাপ লাগছে তার মায়ের কান্না দেখে। তার ইচ্ছা করছে তার মায়ের কোলে ঝাপ দিয়ে বলতে, " মা কাঁদছো কেন? এইতো আমি.."

কিন্তু রাশেদের মা তো এখন রাশেদকে দেখতে পারছেন না।

রাশেদের ভেতর কেমন যেন না পারার কষ্ট দানা বাধছে, যার কাছে তার আগের কষ্টগুলো কিছুই না, যার জন্য সে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।

রাশেদের সব বন্ধুরাই এসেছে। তারা রাশেদের মাকে শ্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু রাশেদের মা কার কথাই শুনতে চাইছেন না।

এমন সময় রাশেদের আরেক বন্ধু আসিফ ঘরে এসে ঢুকলো।

আসিফ বেশ কিছুক্ষন রাশেদের মাকে সামলানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষে চোখের পানি মুছতে মুছতে দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো।
ওর সাথে সাথে রাশেদও উঠে দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো।

কিছুক্ষন পর রাশেদের আরেক বন্ধু মঈন এসে আসিফের পাশে দাঁড়ালো।

আসিফঃ এমন একটা কাজ করার ওর কি দরকার ছিলো বল তো? এখন ওর মাকে কে সামলাবে বল..

মঈনঃ সেটাই তো আমিও ভাবছি রে দোস্ত, উনি তো কারো কোন কথাই শুনতে চাইছেন না। খবর টা পাওয়ার পর থেকে খালি হাঊমাউ করে কেঁদেই যাচ্ছেন।

আসিফঃ হুম, রাশেদের জন্য একটা গুড নিউজ নিয়ে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম ওকে খবরটা দিয়ে চমকে দিবো। ভাবতেও পারিনি যে এখানে এসে নিজেই এতো বড় ধাক্কা খাবো।

মঈনঃ কি গুড নিউজ রে?

আসিফঃ গত মাসে আমার অফিসের একটা পোস্টের জন্য রাশেদ সিভি দিয়েছিলো।

রাশেদেরও হঠাত মনে পড়লো ব্যাপারটা। তাই আসিফের কথা শুনতে আরো একটু সামনে এগিয়ে গেলো।

আসিফঃ কয়েক দিন আগে আমার বসের সাথে ছোটখাটো একটা ইন্টারভিউ সেশনের মতোও হয়েছিলো। বসের খুব পছন্দ হয়েছিলো রাশেদকে। উনি ডিসাইড করেছিলেন এক বছরে জন্য রাশেদকে আমাদের সাভার ব্রাঞ্চের ইনচার্জ করে পাঠাবেন। এক বছর পর চাইলে ও আমাদের ঢাকার অফিসে শিফট করতে পারতো। বেতন হতো ওর এখনকার বেতনের তিনগুন।

মঈনঃ হুমমমমমমম.. এখন কি আর বলব বল। মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক..


মঈনের পিছনে দাঁড়িয়ে রাশেদ সব কথাই শুনলো।


রাশেদের প্রচন্ড আফসোস হচ্ছে। তার সমস্যা গুলো একে একে সমাধান হয়ে যাওয়ার রাস্তা তার সামনে , কিন্তু তার এখন কিছুই করার নেই। কেন সে হুট করেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে গেলো। ইশ.. যদি আর একটা দিন অপেক্ষা করতো সে।

সমস্ত গা গুলিয়ে কেমন যেন দম বন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে রাশেদের।


যেন মনে হচ্ছে তার ফুসফুস বাতাসের জন্য ফেটে যাচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে বুক ভরে দম নিতে চায় সে।


এমন এক দমবন্ধ অনুভূতি নিয়ে রাশেদ ধরফর করে ঘুম থেকে উঠে বসলো।



সারা শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম পড়ছে রাশেদের। বিছানার চাদর পর্যন্ত ঘামে ভিজে গেছে।

বিছানার পাশে রাখা বোতল থেকে ঢক ঢক করে পানি খেয়ে পুরো বোতল খালি করে ফেললো সে। তারপর বুক ভরে দম নিলো। নিজেকে আয়নার সামনে ভালো করে দেখলো সে। নাহ, বেঁচে আছে সে। বুক থেকে কেমন যেনো একটা ভার নেমে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হয়ে আসলো।
কিন্তু কেমন করে হলো এটা ? সবগুলো ওষুধ তো সে খেয়ে ফেলেছিলো। প্যাকেটটাও সাইডে পরে আছে।
তাহলে?

মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাশেদ ফোন করলো হোসেন ভাইকে।

হোসেনঃ হ্যালো রাশেদ ভাই, কি খবর?

রাশেদঃ ভালো আছি হোসেন ভাই , খুব ভালো। ভাই, একটা কথা সত্যি করে বলবেন?

হোসেনঃ কি কথা?বলেন ভাই..

রাশেদঃ কাল আমাকে কি ওষুধ দিয়েছিলেন?

হোসেনঃ রাশেদ ভাই, সত্যি কথাটাই বলবো, রাগ করবেন না তো?

রাশেদঃ না ভাই, বলেন।

হোসেনঃ ভাই, কাল আপনার কথা বার্তায় আমার কেমন একটু সন্দেহ হয়েছিলো। তাই আপনাকে আমি হাই পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ না দিয়ে কিছু ভিটামিন ক্যাপ্সুলের সাথে খালি ক্যাপ্সুল মিশিয়ে দিয়েছিলাম। তাই আপনাকে কোন ওষুধের প্যাকেট দিতে পারি নাই, নরমাল প্যাকেট দিয়েছিলাম।

রাশেদঃ আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি না। আজ আপনি আমাকে বড় একটা অঘটন ঘটানোর হাত থেকে বাঁচালেন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভাই।

হোসেনঃ ৭ বছর যাবত দোকান চালাই ভাই। অনেক মানুষের সাথেই উঠাবসা , কথাবার্তা হয় । এতটুকু বুঝি ভাই যে মানুষ শুধু একা মরে না , তার সাথে জড়িয়ে থাকা অনেক কিছুই মারা যায়। ভালো থাকবেন ভাই।


কলটা কাটার পর রাশেদ অনেক্ষন মোবাইল হাতে বসে বসে চিন্তা করলো। আসলেই তো, সে যে ডিসিশনটা নিয়েছিলো তাতে তো শুধু রাশেদের নিজের এবং তার আশেপাশের মানুষগুলোরই ক্ষতি হতো। তানিয়ার তো তাতে কিছু আসতো বা যেতো না। সুইসাইডে তো তার সমস্যাগুলো সমাধানের কোন রাস্তা বের হতো না। বরং ভবিষ্যতের যে অনাগত সম্ভাবনা থাকবে সেগুলোও হারিয়ে যাবে তার মৃত্যুর সাথেই। যে পরিমান কষ্ট করে রাশেদ নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সাহস জুটিয়েছিলো, তার অর্ধেকের ব্যাবহারও যদি সে করে তবে তার সমস্যাগুলো ডালপালা ছড়ানোর আগেই শেষ হয়ে যাবে ।

নাহ , প্রথমে যাবো হোসেন ভাইয়ের দোকানে। মানুষটা এত বড় উপকার করলো, তাকে মিষ্টি না খাওয়ালেই নয়। তারপর যাই আসিফের সাথে দেখা করে আসি, দেখি কি হয়- বলে রাশেদ উঠে পড়লো এক নতুন উদ্যমের সাথে।

Comments

    Please login to post comment. Login