পোস্টস

ফিকশন

উদ্বাস্তু

৪ জুলাই ২০২৪

তুহিন উদ্দিন রনি

পর্ব ০১ঃ 

রুমে ঢুকেই মনটা খাঁখাঁ করে উঠলো। ওর উপস্থিতি আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিলো ও আর আমার জীবনে নেই। কাঁধ থেকে ব্যাগটা রেখে নাকেমুখে পানি দিলাম। একাকীত্বের ঘরটা মোটেও সুন্দর কিছু নয়। একটা একলা ঘর, দিনের আলো দেখে না, রাতে ঘন্টাখানেক নিয়ন বাতির আলোতে একটা অস্পষ্ট মানুষকে দেখে শুধু, যে কিনা ধুঁকে ধুঁকে সবার থেকে দূরে চলে গেছে। 

আধ ভাঁজ করা বিছানায় বসে হঠাৎ নজরে এলো লাল টকটকে একটা প্লাস্টিকের গোলাপের দিকে, ঘরের ভ্যান্টেলেটরের মাঝে গুঁজে রাখা। মুচকি হাসি দিলো একগাল। গত ক্রিসমাসেড ছুটিতে ওরা দুজন মিলে কী যে পাগলামিটানাই করেছে; এই গোলাপ তার প্রমাণ!

“আমাদের মাঝে আর ভালোবাসাটা নেই”। শিশিরের শেষ বাক্য ছিলো এটা। 

পেছন ফিরে তাকায়নি সে, একটিবারও না। 
ওর কোনো মায়া কাজ করেনি? গত দুইটা বছর তিলে তিলে সাজানো পুরো ঘরটার প্রতি! 

শহরের বুকে গড়ে উঠা এই ইট পাথরের ছাদের তলাটাকে শিশির দুই হাতে সাজিয়েছে। দিয়েছে ঘরের মর্যাদা। তবুও, একটিবার ওর বুকটা কেপে কেঁপে উঠেনি যখন সে ভেবেছে চলে যাবে!

 

হঠাৎ একদিন ঘুম ভেঙ্গে শিহাব দেখে ঘরটা এলোমেলো। দুইটা বড় ট্রলি ব্যাগ আর শিশিরের ডোরেমন থিমের নীল ব্যাগটা বোজাই করা। কপালে ঘাম জমেছে বড় বড় ফোটা। শিহাবের দিকে ফিরে বললো, “পাঠাও-তে দেখ তো সিনজি পাস কিনা?, উবারে এক্সেপ্ট করছে না বেশ অনেক্ষণ।” 

শিহাব ফোনটা হাতে নিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, “হঠাৎ ম্যাম ফোন দিলো নাকি?” আর যাবি যখন এত ব্যাগ কেনো?” 

না, আম্মু ফোন দেইনি। 

তাহলে স্যার ফোন দিয়েছে? 
না, বাবাও দেয়নি। আর তুই এই স্যার, ম্যাম ডাকা বন্ধ কর তো, প্লিজ! শরীর জ্বলে এমন ডাক শুনলে। 

হয়েছে কী বলবি তো বাপ? 

কী জানি, আমার মনে হয় আমাদের মাঝে আর কিছুই নাই। 

কী বুঝাতে চাস। 
হ্যাঁ। আমি সেই আগের তোকে খুঁজে পাই না। তোর কোনো দোষ দিচ্ছি না। তবে, আমি সত্যিই তোকে আর ফিল করি না। তোর জন্যে অপেক্ষা করতে আমার আর এক্সাইটম্যান্ট হয় না। যেই তোর ক্লান্ত শরীর আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিলো। তুই অফিস থেকে বের হয়ে যখন লেকপাড় আমার জন্যে আসতি তখন তোকে জড়িয়ে ধরতাম। তোর সেই ক্লান্তিমাখা অবুঝ চেহারাটাই আমার বড্ড ভাল্লাগতো। কিন্তু, ইদানিং আমার একঘেয়ে লাগছে। তোকে তোর ক্যারিয়ার থেকে বিরত করছি না, কিন্তু আমার মনে হয় আমি আমার নিজের সাথে একটা বাজে রকমের কম্প্রমাইজ করে ফেলেছিলাম। তুই বুঝবি হয়ত। আমি তোর জীবনে বিষাক্ত হয়ে উঠার আগেই ছাড়ছি তোকে। 
শিশির কয়েকবার ছলছল চোখে পুরো ঘরটা নজরে বুলালো। “আজকের তারিখটা কী আবার আমি মিস করে ফেললাম? ফাক, এনাদার এপ্রিল ফুল!” 
তুই আবার জিতে গেলি। চল, আজ দুজন নর্থএন্ডে চকলেট ব্রাউনি খেতে যাব। 

শিহাব আবার থেমে গেলো। স্যালারি ঢুকেছে গতকাল, তাই সে ভালো করেই জানে আজ পহেলা এপ্রিল নয়। তাছাড়া বৈশাখ গেছে সেই কয়েক যুগ হল। তবুও মুখে একটা সাময়িক হাসি দিয়ে পরিস্থিকে হাস্যকর রাখার চেষ্টা রাখলো। 

সাথে সাথে শিশিরের ফোনে একটা কল। 
“স্লামুলাইকুম, কই আছেন আপনে?” আর যাইবেন কই?”
“লোকেশনে আসুন। যাব, নতুনবাজার। যমুনার সামনে।” 

 

আমার ব্যাগটা একটু এগিয়ে দে। বেশ ভারী করে ফেলেছি। আরেকদিন এসে বাকি সব নিয়ে যাব নে। তুই পর্দা সরাবি না, ধুলোয় অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। 

শিহাব, গামছাটা গলায় পেছিয়ে একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে নিচে অব্দি গেলো। সিনজিতে উঠাতে উঠাতে বললো, আমি তাহলে বিকেলে আসব। ম্যামকে বলিস খিচুরি রান্না করতে। 

দেখ, তুই বুঝতে চেষ্টা কর। আমাদের মাঝে আর ভালোবাসাটা নেই। 

 

সিএনজিওয়ালা গেটটা টেনে দিয়ে ভেতর থেকে লক করলো। চোখের সামনে দিয়ে প্রথম মোড় পার হয়ে অদৃশ্য গেলো শিশির। 


------------
 

বালতি ভরে পানি উপড়ে পড়ছে। পানির শব্দে শিহাব ধ্যান থেকে উঠলো। নলটা কমিয়ে দিয়ে আবার এসে রুমে রুমে ঘোর ঘোর করতে থাকল খানিক্ষণ। পুরোনো বিছানার চাঁদর দিয়ে ঢাকা বুইগুলো হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো অনেক কথা। দুজন স্যালারি থেকে প্রতিমাসে দুই দুই চারহাজার টাকা জমিয়ে নীলক্ষেত যেতো। পুরোনো, নতুন বইয়ের একটা অংশ প্রতিমাসে ঘরের একটা অংশ দখল করে নিতো। আর প্রতিযোগিতা করে কে কার আগে কয়টা বই পড়তে পারে প্রতি শুক্রবারে মারামারি হত। 


 

বইয়ের নিচে স্তুপ করে রাখা আবার কিছু খাতাও আছে। দুজনের অনার্স, মাস্টার্সের খাতা। একই ব্যাচ না হলেও ইমেডিয়েট সিনিয়র, জুনিয়র। এইচএসসি একই ব্যাচ হওয়ার সুবাদে তুই তুই বন্ধুত্ব। যাগগে, খাতাগুলোও অনেক স্মৃতি বহন করে। সাহিত্যের হাতে খড়ি থেকে একদম এডভান্স থিওরিতে ডুব, সবই এই খাতাগুলোই। শিশিরের খাতাগুলোও পেলাম। আমরা একই রকমের দেখতে জার্নালে লিখতাম। আমাদের প্রতিদিনের তুলনামূলক, সমালোচনামূলক সকল শিক্ষা লিখে রাখতাম চকলেট রঙের চামড়ার কভার করা জার্নালে। একই দেখতে। কিন্তু, একটায় ফেলুদার ছবি সেটে দেওয়া থাকতো তো আরেকটায় উত্তম কুমার এস ব্যোমকেশ। শিশির ফেলুদা তেমন পছন্দ করত না। বলত, বেশি বেশি করে ফেলে ফেলুদা। কেমন অবাস্তব অবাস্তব! 

আমি আমার খাতাটা হাতে নিলাম, ফেলুদার পয়েন্ট টু কোল্ট হাতে নেওয়া ছবিটাই প্রথমেই ভেসে উঠলো, আর ঠিক নিচেই বাংলা নম্বরে দুই হাজার ছব্বিশ লিখা। শিশির আর আমার প্রথম প্রেমের বছর।

মলাটটা সরিয়ে পড়ছি। 

“এটা ও দিয়েছে। উপহার। ও’কে ঘিরে সবকিছু এটায় লিখব।”