"সাঁতার জানি না, তবু পানিতে ডুবে মরার ভয় কোনোদিন করিনি। একভাবে না একভাবে তো মরবই, পানিতে ডুবলে কী আর হবে, কয়েক মিনিটই তো কষ্ট, তারপর শেষ। ভয় পেয়ে লাভ কী? লাইফ জ্যাকেট ছাড়া ইচ্ছামত নৌকায় ঘুরেছি। ভাঙাচোরা, ফিটনেসবিহীন স্পিডবোটে মূল ভূখণ্ড থেকে পাড়ি জমিয়েছি দ্বীপে। অ্যাজমা হওয়ার পর থেকে ডুবে মরার ভয় জন্মেছে, কারণ এখন আমি জানি নিঃশ্বাস নিতে না পারলে কেমন লাগে।"
কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল আমার স্বামী। খানিকটা ভেবে নিয়ে বলল, "আচ্ছা, যাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়, ধর ঘরে শুয়ে শুয়েই মারা গেছে, তাদেরও কি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়েই মৃত্যু হয় না?"
"কী জানি। মারা গেছে বলে দম নিচ্ছে না, আর দম নিতে পারেনি বলে মারা গেছে দুটো তো আলাদা। হার্ট বন্ধ হয়েও তো মারা যেতে পারে।"
আমার স্বামী কোনো কিছু নিয়ে বেশিক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করতে পছন্দ করে না, অথবা হয়তো তার সেই ক্ষমতাই নেই। সে নিশ্চিন্তে মোবাইল টিপতে শুরু করে দিল, যেন কখনো মরবে না, সুতরাং এসব ভেবে ফায়দা নেই। আচ্ছা আমি কেন এত ভাবছি? ভেবে ভেবে মৃত্যু ঠেকানো যায় না, পদ্ধতিও বদলানো যায় না। যদি বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকতো তাহলে কীভাবে মরতে চাইতাম আমি?
শুভ সকাল। পৃথিবীতে তোমার মেয়াদ বাকি আছে আর মাত্র তিন মাস। বল, কোন পথে যেতে চাও পরকালে? আমাদের কাছে অসংখ্য অপশন রয়েছে, যদি চাও তো মেইলে পাঠিয়ে দিতে পারি লিস্টটা…
খবরে দেখলাম সাবমেরিনে করে ঘুরতে গিয়ে কিছু হাই প্রোফাইল ট্যুরিস্ট সাবমেরিন বার্স্ট হয়ে মারা গেছে। বিজ্ঞানীদের মতে ওরা নাকি মৃত্যুযন্ত্রণা টের পায়নি, কারণ মৃত্যু ঘটেছে অতি দ্রুত, এত কম সময়ে যন্ত্রণার অনুভূতি মস্তিষ্ক টের পায় না।
এমন মৃত্যু বরণ করা আমার সামর্থ্যের বাইরে। মাথায় গুলি খেয়ে মরলে কেমন হয়? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কে আমাকে গুলি করবে? ধুর কী সব ভাবছি। সাড়ে সাতটা বেজে গেল, কলার মোচা কতদিন ধরে ফ্রিজে পড়ে আছে, ভেবেছিলাম আজ ভাজি করব। থাক গিয়ে, এখন আর সময় নেই।
"আজকেও ডিম ভাজি?" খেতে বসে স্বামী বলল। খাবার নিয়ে কখনো ও অভিযোগ করে না, আমার খুব বিরক্ত লাগলো। বললাম, "ডিম ভাজিতে সমস্যা কী?"
"কোনো সমস্যা নেই, আমার ভাল লাগে ডিম ভাজি।"
"তাহলে বললে কেন?"
"কালকেও ডিম ভাজি খেয়েছিলাম, তাই। কিছু ভেবে বলিনি।"
নিজের উপর ভীষণ রাগ লাগছে। এত ভাল ছেলেটার সাথে কেন এমন করলাম? ঘোড়ার ডিম ভাজিটা আমার নিজেরও খেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু ভাল ভাল রান্না করে কী হবে? একদিন তো মরেই যাব। নাহ্, আবারও মরার কথা ভাবতে শুরু করলাম। আচ্ছা, আমাদের বাসার চুলা তো ইলেকট্রিক, যদি কখনো শক খাই? যদি মরে যাই? শক খেয়ে মরতে কেমন লাগবে ধারণাও করতে পারছি না। মাথার ভেতর দৃশ্যটা GIF ভিডিওর মত বারবার চলছে: পুরো চুলা ইলেকট্র্রিফায়েড হয়ে আছে, আমার হাত লেগে গেল, হাত বেয়ে বিদ্যুতের অদৃশ্য তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে পুরো শরীরে, ঘাড় বেয়ে উঠে যাচ্ছে মাথায়। ঘর থেকে আমার স্বামী বলে উঠছে, পোড়া গন্ধ কীসের? উফ্, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
নাহ্, এভাবে মরা সম্ভব না। অন্য কিছু ভাবতে হবে।
আশ্চর্য! ভাবতে হবে মানে কী! কেন ভাবতে হবে? আমি কি আজরাইল নাকি যে মরার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করব?
ত্রিশ তলা বিল্ডিংয়ের সাতাশ তলায় আমাদের ফ্ল্যাট। রোদে শুকানো মচমচে কাপড় আমার পছন্দ, কিন্তু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে বাস করলে সবার আগে এই চাহিদার কথা ভুলে যেতে হয়। ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়ার উপায় নেই, বারান্দায় চাপাচাপি করে মেলতে হয়, তাও আবার বারান্দায় রোদ পড়ে সামান্যই। বিকালে কাপড় তুলতে গিয়ে ছাদে খানিক হাঁটাহাঁটি, মাগরিবের আজান দিলে কাপড়ের গাট্টি কাঁধে ফেলে ঘরে ফেরা—খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য আমাদের দেশের মফস্বল শহরের বাড়িগুলোতে। ছোটবেলার ওই দৃশ্যটা আমি খুব মিস করি। এখন আমাদের বাসায় সকালে ধোয়া কাপড়ের সুতোর ভাঁজে ভাঁজে জমা হওয়া জলকণাগুলো বাষ্পীভূত হতে হতে রাত হয়ে যায়। রাতের খাবার শেষ করে বারান্দায় গেলাম কাপড় তুলতে। বারান্দা দিয়ে নিচে উঁকি দিলাম, সাথে সাথে মাথা ঘুরে উঠলো। অনেক ভেবেও আমি বের করতে পারলাম না কোন যুক্তিতে এত বড় বড় আর্কিটেক্টরা এই উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলোর বারান্দায় বুক সমান গ্রিল দিয়েই কাজ শেষ করে ফেলার কথা চিন্তা করে। কালকেই তারের জাল কিনে বাকিটা ঢেকে ফেলতে হবে। তারপরেও বারান্দায় আসাটা নিরাপদ না। কী হবে যদি গ্রিলে ভর দিয়ে দাঁড়াই আর দেয়াল থেকে গ্রিল ছুটে গিয়ে নিচে পড়ে যাই? পৃথিবীতে কোনো জিনিসই তো অবিনশ্বর না, গ্রিল ছুটে যেতেই পারে। কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার হবে না সেরকম হলে। ঘরে এসে তেড়ে গেলাম স্বামীর দিকে, গলা উঁচিয়ে বললাম, "এত কষ্ট করে কাপড় ধুই, আর তুমি একটু নিয়েও আসতে পারো না?"
আকাশ থেকে পড়ল বেচারা, "বল নাই তো।"
"বলতে হবে কেন? নিজে বুঝে একটু করা যায় না?"
"আচ্ছা কাল থেকে করব।"
বলেই আবার টিভির স্ক্রিনের দিকে চোখ দিল। মেজাজটা আরো খারাপ হল আমার, বললাম, "আচ্ছা তোমার কি জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল না কেন আমি কাপড় তুলতে যেতে চাই না?"
"কেন চাও না?"
"কারণ আমি ভয় পাই! গ্রিল নেই, যদি পড়ে যাই!"
হা করে তাকিয়ে রইল ও, তারপর বলল, "পড়বে না।"
জ্যোতিষ সম্রাট এসেছে। সব জেনে বসে আছে।
গরমে অস্থির লাগছে। "এসির টেম্পারেচার কত দেখি তো?"
রিমোট দেখে স্বামী জানালো, "বাইশ।"
"কী! এত গরম কেন তাহলে?"
"কী জানি, আজ দেখছি ভালোমত ঠান্ডা হচ্ছে না।"
"নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নাকি? আরো কমাও টেম্পারেচার।"
পিপ পিপ পিপ পিপ পিপ পিপ। তাপমাত্রা এক বারে ছয় ঘর কমিয়ে দিয়েছে আমার স্বামী। শো শো শব্দে চলছে ইঞ্জিন। হঠাৎ মনে হল, জিনিসটা যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হবে। পুড়ে কয়লা হয়ে যাব আমরা দুজন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে তানজানিয়া থেকে কেনিয়ায় পশুদের মাইগ্রেট করার অসাধারণ দৃশ্য দেখানো হচ্ছে, কিন্তু আমি এসি থেকে চোখ সরাতে পারছি না…
"কাল মিস্ত্রি ডেকে ডিপ ক্লিন করাতে হবে এসিটা।"
"আচ্ছা," একমত হলাম আমি।
মেশিনের গুঞ্জন একটু কমে এলে আমার বুকের ধুকপুকানিও স্বাভাবিক হতে শুরু করল।
পরদিন বিকালে এলো মিস্ত্রি। স্বামী অফিসে, আমি একা। কাল রাতে যখন ও মিস্ত্রি ডাকার কথা বলছিলো তখন আমি ভেবেছিলাম উইকেন্ডে ডাকবে, কিন্তু সে তার কর্মতৎপরতা দেখানোর আর সময় পেল না। গাধাটার একটা বারও মনে হল না আমার বিপদ হতে পারে। এসব অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে কেউ কারো খবর রাখে না, এই মিস্ত্রি যদি এখন আমাকে বেঁধে রেখে সব নিয়ে পালায়? তার চেয়ে অনেক খারাপ কিছু হতে পারে যা আমি ভাবতেও চাই না। এসির সব যন্ত্রাংশ খুলে পরিষ্কার করছে মিস্ত্রি, আমি আস্তে আস্তে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলাম, ফল কাটার ছুরিটা নিয়ে ওড়নার আড়ালে লুকালাম, তীক্ষ্ণ নজর রেখেছি লোকটার ওপর। দেখে ভালো মানুষ বলে মনে হয়, কিন্তু চেহারা দেখে যদি ভালো-খারাপ বোঝা যেত তাহলে পৃথিবীর রূপ হত সম্পূর্ণ ভিন্ন। লোকটা কাজে ব্যস্ত থাকতে থাকতেই আলমারি থেকে ওর পাওনা বের করলাম, যাতে এক হাতে ছুরি রেখে টাকাটা ওর হাতে দিতে পারি। আমি চাই না নিরস্ত্র অবস্থায় যখন আমি আলমারি থেকে টাকা বের করছি তখন ও পেছন থেকে আমার উপর হামলে পড়ুক। পূর্ব প্রস্তুতি কাকে বলে লোকের শেখা উচিত আমার কাছ থেকে।
লোকটা টাকা নিয়ে চলে গেলে ভালোমত বন্ধ করে দিলাম দরজাটা, এতক্ষণে সহজভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছি (ইনহেলার আবিষ্কারককে ধন্যবাদ)। ব্যাগ গোছাতে বসলাম। কাল আমরা সীতাকুণ্ড যাচ্ছি। মানুষের নজর সবসময় গাছের আগায় থাকে বলে গোড়ার সৌন্দর্যগুলো চোখ এড়িয়ে যায়। থানচি, সাদাপাথর, সুন্দরবন, মনপুরা ঘোরার প্ল্যান করতে করতে ভুলে যাই হাতের কাছের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কথা। সে যাক, বহুদিন পর পাহাড়ে যাচ্ছি। প্রথমে রাতের বাসে করে চট্টগ্রাম শহর, সকালে একটু বিশ্রাম, তারপর বিকালে পতেঙ্গা বা গুলিয়াখালি ঘুরে আসা। পরদিন ভোরে চলে যাব চন্দ্রনাথ, আস্তে আস্তে চারপাশ দেখতে দেখতে উঠব। এমনিতেও দ্রুত ওঠা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না, দম আটকে মরার ভয়টা সত্যি হয়ে যাবে। আরো একটা ভয় আছে, আজকাল নাকি খুব বেশি ভোরে, যখন হাইকারদের ভিড় থাকে না, তখন নির্জন জায়গাগুলোতে ছিনতাইকারী ওঁত পেতে থাকে। মনে হতেই ধড়াস করে উঠল বুকটা। থাক বাবা, ভোরে যাওয়ার কোনো দরকার নেই, লোকজন আসতে শুরু করলে তবেই যাব। রোদে পুড়ে কয়লা হব তবু ছিনতাইকারীর হাতে যেন না পড়ি।
দশটা পঞ্চাশে আমাদের বাস। দশদিন আগেই টিকিট কেটে রাখা হয়েছে, চতুর্থ সারির বাঁ পাশের দুটো সিট। বেশিরভাগ লোককে দেখেছি বাসে প্রথম বা দ্বিতীয় সারিতে বসতে না পারলে মনে হয় কী যেন ক্ষতি হয়ে গেল। ওরা কি জানে না মুখোমুখি সংঘর্ষের সময় বাসের প্রথম দিকের মানুষগুলো সবার আগে মারা যায়? আর আমার মতে বাঁ দিকের সিটগুলো বেশি নিরাপদ, উল্টো দিকের গাড়ি এসে যদি ধাক্কা মারে তবে ডান পাশেই ধাক্কাটা বেশি লাগবে। জীবনে এসব ছোটখাটো সিদ্ধান্তগুলোও ভেবেচিন্তে নেওয়া জরুরী। নিজেকে অবশ্য কিছুটা স্বার্থপর বলে মনে হয়, কারণ আমার অবচেতন মনে কাজ করছে দুর্ঘটনা ঘটলে সামনের সিট বা ডান পাশের সিটের লোকেরা মরলে মরুক। আচ্ছা, প্রতিদিন কত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়? দিনের পর দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে থেকে মারা যাওয়ার চেয়ে প্রস্তুতিবিহীন হঠাৎ আসা এই মৃত্যুই কি ভাল না?
বেড়াতে বের হয়ে কী যে ভাবতে বসেছি! বাস ছেড়েছে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে, আমার স্বামী মুখ হা করে ঘুম দিয়েছে। রাতের বাস আমার অন্যতম প্রিয় একটা বিষয়। এমনিতেই আমার রাতে ভাল ঘুম হয় না, বাসে উঠলে তো আরও না। অনেকে কানে ইয়ারফোন না গুঁজে ভ্রমণ করতেই পারে না, আমার কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে বেশি ভাল লাগে। শহর ছেড়ে যখন গ্রামের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মহাসড়ক ধরে নিশাচর প্রাণীর মতো ছুটে যায় বাস, তখন ফসলের ক্ষেতের মাঝে মাঝে হঠাৎ দু-একটা চালাঘরে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো দেখা যায়। আসমানেও তারা, জমিনেও তারা। নাকি জোনাকী বলব? নদী পার হওয়ার সময় ব্রিজের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া জলযানগুলো থেকে পানিতে ঠিকরে পড়া রঙিন আলোগুলো যেন রংধনু, যে রংধনু স্থির নয়, এতে স্রোত আছে, ঢেউ আছে, যেন প্রাণ আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বিষয় হচ্ছে প্রাণ। আমি বেঁচে আছি বলে সব আছে, আমি নেই তো কিছুই নেই। শহর নেই, গ্রাম নেই, ফসলের ক্ষেত নেই, নদীর জল নেই, রাতের বাস নেই। চন্দ্রনাথ পাহাড়ও নেই। মনটা প্রচন্ড রকম খারাপ হয়ে গেল, অথচ ঠিক উল্টোটা হওয়ার কথা ছিল।
আচ্ছা, বয়স বাড়লে সবারই কি মৃত্যুভয় বাড়ে? কী কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে? প্রথমত, দায়িত্ববোধ বাড়ে, কেউ মরে গেলে তার পরিবারের সদস্যদের কী অভিজ্ঞতা হতে পারে তার ধারণা পেতে শুরু করে। দ্বিতীয়ত, তরুণ বয়সে মনে হয় পুরো জীবনটা সামনে পড়ে আছে (যদিও তা সত্যি না, মরণ যখন তখন আসতে পারে, আমরা তা জেনেও না জানার ভান করি), যে জিনিসটা মানুষের হাতে প্রচুর পরিমাণে থাকে তার প্রতি মায়া-ভালোবাসা কম থাকে, এক্ষেত্রে জিনিসটা হচ্ছে আয়ু। বয়স বাড়লে মনে পড়ে আয়ুর পরিমাণ তো অনেকখানে কমে গেছে, তখন হাতে থাকা স্বল্প আয়ুটুকুর প্রতি মায়া বেড়ে যায়—
প্যাঁ করে তীক্ষ্ণ শব্দে হর্ন বেজে উঠলো। রাতের বাসের ড্রাইভারদের জানের মায়া বলতে কিচ্ছু থাকে না, নিজেদের রেসিং কারের ড্রাইভার মনে করতে থাকে। হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে একটা কুকুরের রক্তাক্ত শরীর পড়ে আছে। কোনো রেসার বাস ড্রাইভারের অসচেতনতার ফল। আমার মনে হল এটা মা কুকুর, ওর তিন-চারটা দুধের শিশু আছে, এখনো চোখ ফোটেনি। কোনো নির্জন জায়গায়, ডাস্টবিনের পাশে, কার্ডবোর্ডের বাক্সে বা পরিত্যক্ত ড্রামের ভেতর হয়ত বাচ্চাগুলোকে রেখে এসেছে সে, মা ফিরে না গেলে কী হবে ওদের? ওরা না খেয়ে শুকিয়ে মরে যাবে। আচ্ছা, না খেয়ে মরে যাওয়াটা তো দম আটকে মরার চেয়েও কঠিন। এটাই বোধহয় চলে যাওয়ার সবচেয়ে কষ্টের পথ। আর যেভাবেই হোক, ধুঁকে ধুঁকে আমি মরতে চাই না…
* * *
* * *
"দাঁড়াও এখানে," হাঁপাতে হাঁপাতে বলল আমার স্বামী।
সীতাকুণ্ড ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠছি আমরা। ওর চাপাচাপিতে ভোরেই রওনা দিয়েছি। লোকজনের ভিড় আর তাদের রং-বেরংয়ের জামাকাপড়ের ফাঁক দিয়ে পাহাড় দেখায় মজা নেই, আর রোদ মাথার ওপর ওঠার আগেই যতটা সম্ভব উপভোগ করতে চায় সে।
"আমার আগে তুমি হাঁপিয়ে গেলে? কীভাবে সম্ভব!"
"গেলাম। একটানা চড়াই বেয়ে ওঠার মত বয়স নেই এখন আর।"
চড়াই শব্দটা শুনে হঠাৎ হাসি পেল আমার। বললাম, "চড়াই-উৎরাই না হয়ে চড়াই-থাপড়াই হলে ভাল হতো না? হাহা!"
ও কিছু বলল না। কেমন যেন দেখাচ্ছে ওকে, ঘামছে খুব। শরীর খারাপ হল না তো? হাতটা ধরলাম ওর, ঠান্ডা। জিজ্ঞেস করতে বলল ঘামে ভেজা হাতে বাতাস লেগে ঠান্ডা হয়েছে। বিশ্রাম নিতে নিতে পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকালাম, হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো।
"২০১৩ সালে কেদারনাথে যে পাহাড় ধ্বস হয়েছিলো, মনে আছে তোমার?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
"না, কী হয়েছিল যেন?"
"বৃষ্টির পানি আটকে ছিল পাহাড়ের কোথাও, হঠাৎ পাহাড়ের একটা অংশ ধ্বসে পড়ে, পানির ঢল নামে। অনেক তীর্থযাত্রী মারা যায়।"
"ও।"
পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পাহাড় ভ্রমণের আনন্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো আমার। হঠাৎ একটা বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে, এই পাহাড়ও আমাদের ওপর ধ্বসে পড়তে পারে। মাটি চাপা পড়ে মরতে—
মাটি চাপা পড়ে মরতে কেমন লাগবে ভাবতে শুরু করব ঠিক এমন সময় কে যেন পেছন থেকে আমার হাত চেপে ধরল। প্রচন্ড বিস্ময় আমার অনুভূতির ধারক পূর্ণ করে দিয়েছে, আতঙ্ক জন্মানোর জায়গা পাচ্ছে না। রাস্তা থেকে সরিয়ে গাছপালার আড়ালে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাকে, সম্বিত ফিরে পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম, দ্রুত আমার হাত বেঁধে ফেলা হল, তারপর মুখ। আমি তাকিয়ে আছি আমার স্বামীর দিকে। ব্যাগ থেকে একটা সিরিঞ্জ আর ছোট একটা ভায়াল বের করল সে, কাঁপা হাতে ভায়ালের তরলটুকু সিরিঞ্জে ভরে এক হাতে আমার ডান পা চেপে ধরে আরেক হাত দিয়ে সিরিঞ্জটা আমার পায়ের চামড়া ভেদ করে ঢুকিয়ে দিল সর্বশক্তিতে, প্লাঞ্জার ঠেলে দিল যতদূর যায়। শজারুর কাঁটার মত দেখতে একটা জিনিস দিয়ে পাশাপাশি ছোট দুটো ফুটো করল পায়ে। বাঁচার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। তীব্র বিষ রক্তে ভর করে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে পুরো শরীরে, আমার শরীরের প্রতিটি কোষ জ্বলছে। আমার স্বামীর ঘামে ভেজা মুখটা ঝাপসা হতে হতে এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমার মৃত্যু হয়ে গেছে। পেছনের ভ্রমনার্থীরা এসে দেখতে পেল আমার শরীর রাস্তার পাশে পড়ে আছে, আমার স্বামী কাঁদতে কাঁদতে রুমাল দিয়ে আমার হাঁটুর নিচে শক্ত করে বাঁধছে, খুনটাকে খুব সহজেই সাপের কামড়ে মৃত্যু হিসেবে চালিয়ে দিতে পেরেছে সে, ইদানিং এই এলাকায় রাসেল ভাইপার দেখা গেছে কয়েকবার।
অনেকভাবে মরার কথা ভেবেছি আমি, শারীরিক কষ্টের কথা ভেবে ভেবে আতঙ্কে অস্থির হয়েছি। কিন্তু কখনো ভাবিনি স্বামীর বিশ্বাসঘাকতা আর বিষের প্রভাব দুইয়ে মিলে আমাকে মানসিক এবং শারীরিক উভয় যন্ত্রণায় পিষতে পিষতে শেষযাত্রায় পাঠাবে। হ্যাঁ, মরে গিয়ে একটা উপকার হয়েছে। আমার মৃত্যুভয় দূর হয়েছে।