গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে একটা বাসের টিকিট করে চিন্তিত মুখে কাউন্টার থেকে বের হয়ে এলেন জমির সাহেব। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম । পকেট থেকে রুমালের মত ছোট এক টুকরা কাপড় বের করে তা থেকে একটা পান বের করে মুখে দিলেন। দুপুরে খাওয়া হয় নাই। খেতে গেলে বাসের টিকিটের টাকায় কম পরে যায় কিনা এই চিন্তায় আর খাওয়া হই নাই। কিন্তু ক্ষুধায় আর থাকতে পারছেন না, তাই এই ক্ষুধা পেটে শেষ সম্বল পান টাই মুখে দিলেন তিনি। টিকিট করা হয়ে গেছে, তার কাছে এখনো একশত সাতচল্লিশ টাকা অবশিষ্ট আছে। ভাবলেন পান খেয়ে বাস ছাড়ার আগ মুহুর্তে কিছু কিনে খাবেন। বাসে যেতেও ৫-৬ ঘন্টা লেগে যাবে। এই দীর্ঘ সময় এর জন্য আরো দুটো পান কেনা লাগবে। যতবার তিনি ঢাকা আসছেন, ততবারই লক্ষ করছেন, বাসের মধ্যে ফেরি করে অনেক কিছু বিক্রি করে, শসা, পেয়ারা, আমড়া, বই , সিটি গোল্ডের চেইন। কিন্তু পান কেউ বিক্রি করে না। প্রথমবার ঢাকায় আসবার সময় পানের পুটলি আনতে ভুলে গেছিলেন। মাত্র দু বছরের আগের কথা। তার মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। তার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। বাপ বেটা দুজনে বাসে করে এসেছিলেন ঢাকা।
জমির সাহেব গ্রামের মানুষ , জমি জমা বেশ ভালই আছে। দুইবার চেষ্টা করেও যখন মেট্রিক পরীক্ষা পাস করতে পারলেন না, তখন বাবার রাইস মিলের ব্যবসাটাই তার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গেল। স্থানীয় বাজারের একমাত্র রাইস মিল তাদের। সপ্তাহে দু দিন হাট বসে, এই দুদিন এক সেকেন্ডের জন্যও বিশ্রাম পাওয়া যায় না। জমির সাহেবের বাবা মাঝে মাঝে জমির কে বলতেন, বাজার ঘুরে বকেয়া টাকা উঠানোর জন্য। এই একটা কাজ করেই জমির সাহেব আনন্দ পেতেন। দীর্ঘদিন রাইস মিলের ধুলোয় কাজ করে মাথার চুল কমে গিয়ে তাকে এখন বেশ বয়স্ক লাগে। ব্যস্ততার মাঝে কখনো তেমন বাইরে যাওয়া হই নাই। ছেলে কে সঙ্গে নিয়ে প্রথম বার ঢাকা এসেছিলেন তিনি।
তারপর ছেলের সংগে দেখা করতে অনেকবার ঢাকা আসা যাওয়া করেছেন। এসব ভাবতে ভাবতে পান চিবাতে ভুলে যান জমির সাহেব। কাউন্টার থেকে বের হয়ে সুপারভাইজার ডাকতে শুরু করে বাসে উঠার জন্য, সময় হয়ে গেছে। তড়িঘড়ি করে দুটা কলা আর একটা রুটি কিনে বাসে উঠে পরেন জমির সাহেব। হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসেন। রাজ্যের ক্লান্তি তার শরীরে। ঠিক এমন সময় তার পাশে এসে বসেন তারই বয়সী এক লোক। তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেন। রুটি আর কলা কোলের উপরে রেখে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যান জমির সাহেব। চলন্ত বাসের ঝাকুনিতে রুটির প্যাকেট টা খচমচ শব্দে গড়িয়ে পরে পায়ের কাছে। ঘুম ভেঙে যায় জমির সাহেব এর। না রুটি পরে যাওয়ার শব্দে নয়, তার ঘুম ভেঙে গেছে ক্ষুধায়। গলাটা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। রুটি তুলে একটু ছিড়ে মুখে দিতে যাবেন, তখন মনে হল একটু কুলি করে নেওয়া দরকার। এতসময় পরে মনে হল, তার কাছে পানি নেই। শুকনা মুখে রুটি খেতে গেলে গলায় আটকে বিপদও হতে পারে। কলা রুটি হাতে ঝিম ধরে বসে থাকলেন কিছু সময়। বিশ টাকার একটা নোট বের করে, ইশারায় বাসের সুপারভাইজার কে ডাকলেন।
- কি চাচা, কি হইছে, বমি করবেন, পলিথিন লাগব?
তিনি বিশ টাকার নোট টা সুপারভাইজার এর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
- না বাবা, বমি করব না। সামনের স্ট্যান্ডে গাড়ি থামলে আমার এক বোতল পানি কিনে দিতে পারবা না ?
- পানি কি খাইবেন ?
- জ্বি বাবা, এই কলা রুটি কিনছি, তাড়াতাড়ির মধ্যে পানির কথা মনে নাই।
- আচ্ছা আপনি বসেন।
বলেই চলে গেল সে। ফিরে এলো একটা দুই লিটার এর সেভেন এর আপ বোতল ভর্তি পানি নিয়ে।
- এই নেন, ভাল পানি, তয় ঠান্ডা না। বোতল আবার ফেলায়ে দিয়েন না।
- না বাবা, ফেলাবো কেন।
হাসি-মুখে বোতল টা নিলেন জমির সাহেব। মুখ খুলে সাবধানে দুই বার কুলি করলেন জানালা দিয়ে । চলন্ত বাসে কাজটা ঠিক হচ্ছে না, কিন্ত জমির সাহেব এর মনে হল, তার এখন উপায় নাই। ঢক ঢক করে একটু পানি খেয়ে নিলেন তিনি, বাসের ঝাকুনিতে তার কোলের উপর কয়েক ফোটা পানি পরে ভিজে গেল।
জানালার পাশে বোতল টা রেখে রুটি কলা খেতে শুরু করলেন। এই মাসে ছেলেকে ৭ হাজার টাকা দিয়ে একটা রুম ঠিক করে দিয়ে আসলেন। হলে থাকলে নাকি অনেক মিছিল মিটিং করা লাগে , পড়ালেখা ভাল হয় না। টুকি টাকি জিনিস পত্র কেনার জন্য আরো ১৫০০ টাকা দিয়ে এসেছেন। তার কাছে বাড়ি যাবার ভাড়া ছাড়া আর কোন টাকা নাই। ইচ্ছা ছিল মেয়েটার জন্য একটা ভাল ক্যালকুলেটর কিনবেন। সেটা আর হল না । সে ক্লাস নাইনে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হয়েছে। তিনি নিজে মেট্রিক ফেইল করলেও ছেলে মেয়ে দুইটা হয়েছে মেধাবী । তার ইচ্ছা আছে, যতই কষ্ট হোক তিনি ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া ব্যাপারে কোন ছাড় দিবেন না। প্রায়ই মাসেই তার ছেলেকে টাকা দিতে হয় । যদিও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন টাকা লাগে না, তবে হলের খাবার নাকি একদমই ভাল না। ছেলে যতবারই আসে তার মায়ের কাছে কান্না কাটি করে। খাইতে অনেক কষ্ট হয়। তাই তিনি মাস গেলে কিছু টাকা দেন। পাশের গ্রামের রজব আলির ছেলেও ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে , বাজারে একদিন দেখা হল । বললেন তার ছেলে প্রতি মাসেই কম বেশি টাকা দেয়। ছেলের টাকায় গত সপ্তাহে একটা গাভী কিনেছেন। বয়স হয়ে গেছে, এখন এইগুলা নিয়েই থাকেন।
- আপনার ছেলের কথা শুনে খুশি হলাম। তা সে কি কোন চাকরি বাকরি শুরু করছে নাকি?
- না, ওর তো এখনো পড়া লেখা শেষ হতে আরো একবছর বাকি। এই প্রাইভেট , টিউশনি করায় আর কি । টুক টাক দায় নিদেন পরলে টাকা পয়সা দেয়।
জমির সাহেবের কপালে চিন্তার ভাজ পরে । তিনি আর কথা বাড়ান না, বিদায় নিয়ে চলে আসেন। তার ছেলেকে একবার তিনি বলেছিলেন, সবাই নাকি টিউশনি করে নিজের খরচ নিজেই চালায়, আবার লাগলেও বাড়িতেও কিছু টাকা দেয়। উত্তরে তার ছেলে কিছু টা রাগান্বিত হয়ে বলে,
- ওসব মাস্টারি করে বেড়ালে, নিজের ভাল রেজাল্ট হয় না। তখন ত আবার বলবা আমি পড়ালেখা করি না।
জমির সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। আর বেশি কিছু বললে ছেলের মা আবার নতুন করে শুরু করবে। এইতো আর কদিন , দেড় দুই বছর দেখতে শেষ হয়ে যাবে। পাস করে বের হলেই ছেলে ভাল একট চাকরি করবে। তার রাইস মিলের ব্যবসা এখন আর আগের মত নাই। তার নিজেরও বয়স হয়ে গেছে। আগের মত পরিশ্রম করতে পারেন না।
কলা রুটি শেষ করে, কলার খোসা দুইটা রুটির প্যাকেটে ভরে সামনের সিটের জালের মধ্যে ভরে রাখেন, মনে করে নামার সময় নিয়ে বাইরে ফেলতে হবে। বোতল থেকে আরো একটু পানি পান করে নেন তিনি। ক্ষুধাটা কোনরকম গেছে। তার পাশের লোকটা হা করে তার দিকে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। তিনিও চোখ বুঝে চেষ্টা করেন ঘুমানোর।
ফেরির ভো ভো শব্দে ঘুম ভেঙে গেল জমির সাহেব এর । ফেরিতে উঠে গেছে তাদের বাস। পাশের লোকটা জমির সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
- ভাই ত ভালই একটা ঘুম দিলেন।
- হ, ভাই শরীর ডা খুব ক্লান্ত ছিল।
- বলতেছিলাম আপনি যদি নিচে না নামেন, তাহলে আমার ব্যাগটা একটু যদি দেখতেন। আমি নিচে গিয়ে অজু করে আসতাম।
বলেই পায়ের কাছে রাখা ব্যাগ টা নিজের সিটের উপরে রেখে উঠে দাড়ালেন।
জমির সাহেব ব্যাগের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বললেন,
- যান, ভাই কোন সমস্যা নাই। আমি আছি।
লোকটা বলল, বেশি সময় লাগবে না। আমি শুধু অজু করেই চলে আসব। নামাজ বাসের মধ্যে পড়ব।
জমির সাহেব বললেন,
- ফেরির উপর তলায় ত নামাজের জায়গা আছে, সেখানে যাবেন না।
- নারে ভাই, বাতের ব্যাথা আছে, সিড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হয়, তাছাড়া এই ফেরির সিড়ি অনেক খাড়া, ভয় লাগে উঠতে।
- ও আচ্ছা। তাইলে যান, ওজু করে আসেন।
বাসের মধ্যে এর ওর ব্যাগের ফাক ফোকরে পা দিয়ে বের হয়ে আসলেন, সোনা মিয়া।
রমিজ সাহেব সোনা মিয়ার রাখা ব্যাগের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছু সময় । তারপর কি মনে করে আলতো করে একটা থাপ্পর দিলেন ব্যাগের উপর। সিট থেকে একটু ধুলা উড়ে গেল। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বাইরে তাকালেন জমির সাহেব। তাদের বাসের ঠিক হাত দেড়েক দূরে একটা বড় ট্রাক। ট্রাক ভর্তি সাদা রঙের বস্তা। চালের বস্তা হতে পারে। বস্তার উপরে গামছা পেতে শুয়ে আছে দুইজন লোক। একজন ঘুমাচ্ছে, আর একজন কাত হয়ে তাকিয়ে আছে নদীর পানি দিকে। পদ্মার ঘোলা পানি, ছোট ছোট ঢেউ তুলে পাড়ে আছড়ে পরতেছে।
ছোট একটা সাদা রুমালে হাত মুছতে মুছতে বাসে উঠলেন সোনা মিয়া । সিটের কাছে এসে হাসি মুখ করে বললেন,
-বাথরুমের লাইনে দাড়ায়ে একটু দেরি হয়ে গেল। কি গন্ধ রে ভাই । দম বন্ধ হয়ে আসে।
শুকনো মুখে একটু হাসলেন জমির সাহেব। সোনা মিয়া সিট থেকে ব্যাগটা নিয়ে পায়ের কাছে রেখে সিটে বসে ইশারায় নামাজ পড়া শুরু করলেন। জমির সাহেব আবার জানালার দিকে তাকালেন।
নামাজ শেষ করে সোনা মিয়া নিচু হয়ে তার ব্যাগের চেইন খুলে দুটো খিলি পান বের করলেন, একটা জমির সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নেন ভাই, একটা পান খান”। বলেই নিজে আর একটা পান মুখে দিলেন।
জমির সাহেব, “একটু ইতস্তত করে বললেন, আপনি খান, পান আমার কাছে আছে।” এই কথা বলেই জমির সাহেবের মনে হল, তিনি শুধু পানি কিনতেই ভুলেন নাই, পান কিনতেও ভুলে গেছেন। সোনা মিয়া, বললেন,” আরে ভাই, আমি কি বলছি আপনার কাছে নাই। আপনি নেন, আমার কাছে আরো আছে, আমার মেয়ে আসার সময় ৫ টা খিলি পান কিনে দিছে, আমি একটা খাইছি আরো ৪ টা আছে। পান খাইতে খাইতে চলেন একটু কথা বার্তা বলি। “
জমির সাহেব, হাত বাড়িয়ে পান নিলেন। সোনা মিয়া বললেন, আপনি কি ভাই জর্দা খান নাকি, আমি আবার জর্দা ছাড়া পান খাইতে পারি না, এই পানে বাবা জর্দা দেওয়া আছে ।
জমির মিয়া বললেন, “আমি মাঝে মাঝে খাই , সমস্যা নাই”। বলেই তিন পান মুখে দিয়ে চিবুতে লাগলেন।
জমির সাহেব পান মুখে দিয়ে চিবাতে চিবাতে বাইরে তাকালেন। বাস ফেরি পার হয়ে আবারো রাস্তায় উঠল। পাশে বসে থাকা সোনা মিয়ার দিকে এক নজর তাকালেন। অচেনা লোকের সাথে এতক্ষণে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।
সোনা মিয়া হঠাৎ বললেন, “আপনি কি ভাই কাজের জন্য ঢাকা যান?”
জমির সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বললেন, “না, ঢাকায় আমার ছেলে পড়ে। তার সাথে দেখা করতে যাই।”
“বাহ্, ভালো কথা। আমার মেয়ে শ্যামলীতে থাকে, জামাইয়ের সাথে। মাঝে মাঝে তার সাথে দেখা করতে যাই। ঢাকায় থাকা খুব কষ্টের।”
এই আলাপের মাঝেই বাস একটি ছোট শহরের স্ট্যান্ডে থামল। কিছু যাত্রী নামল, কিছু উঠল। এর মাঝে দুইজন অল্প বয়সী ছেলে- মেয়ে বাসে উঠে জমির সাহেব আর সোনা মিয়ার সামনের সিটে বসল। ছেলে-মেয়েটা দেখতে শিক্ষিত ও সজ্জন মনে হল জমির সাহেবের। তাদের কথাবার্তা স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছিল না, তবে তাদের মধ্যে কিছু গোপন কথা চলছে তা বুঝতে পারলেন তিনি।
হঠাৎ ছেলেটা পকেট থেকে একটি চিরকুট বের করে মেয়েটার হাতে দিয়ে বলল, “সব ঠিকঠাক হবে। তুমি শুধু এই ঠিকানায় গিয়ে বলো আমি পাঠিয়েছি।”
মেয়েটা কিছুটা ভয়মিশ্রিত গলায় বলল, “তুমি কি নিশ্চিত? আমাদের বিপদ হতে পারে।”
“বিশ্বাস করো, সব ঠিক হবে।”
জমির সাহেব তাদের কথায় কিছুটা কৌতূহলী হলেন, কিন্তু কিছুই বললেন না। পাশের সোনা মিয়া বিষয়টা বুঝতে পেরে চুপ করে রইলেন।
জমির সাহেবের মন ভীষণ অস্থির হয়ে উঠল। তিনি যতই সামনের সিটের ছেলেটা আর মেয়েটার কথোপকথন শুনতে চান, ততই যেন কৌতূহল বাড়তে থাকে। তবে তিনি বুঝতে পারলেন, এই রহস্যের সমাধান জানতে হলে তাকে ধৈর্য ধরতে হবে।
বাস যখন শহরের উপকণ্ঠ পেরিয়ে গ্রামের পথে চলতে শুরু করল, তখন দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছিল। রাস্তার ধারের গাছপালা আর ফসলের খেতের দৃশ্য জমির সাহেবের চোখে ধরা দিল। চারপাশে সবুজে ঘেরা পরিবেশ, রাস্তায় গ্রামের মানুষের চলাচল- সবকিছু মিলে মনটা একটু শান্ত হলো।
সামনের সিটে বসে থাকা ছেলেটা হঠাৎ মেয়েটাকে বলল, “তুমি স্ট্যান্ডে নামার পর সোজা সেই ঠিকানায় চলে যেও। আমি এখানে কিছু কাজ শেষ করে আসছি।”
মেয়েটা কিছুটা বিচলিত গলায় বলল, “তুমি কি আসতে পারবে?”
“হ্যাঁ, আমি আসব। তুমি শুধু সময়মত পৌঁছাও।”
জমির সাহেবের কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠল। তিনি ভাবতে লাগলেন, কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ যে ছেলেটা নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে। তিনি সামনের সিটের ছেলেটাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইলেন, কিন্তু সেই মুহূর্তে সাহস পেলেন না।
বাস যখন গ্রামের প্রথম স্ট্যান্ডে থামল, তখন জমির সাহেব আর সোনা মিয়া প্রস্তুতি নিলেন নামার। ছেলেটা মেয়েটাকে বলল, “তুমি প্রথমে নামো, আমি পেছনে আসছি।”
মেয়েটা নামার সময় সোনা মিয়া তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার যদি সাহায্যের দরকার হয়, আমাকে বলো। আমি এখানেই থাকব।”
মেয়েটা কৃতজ্ঞতার সাথে বলল, “ধন্যবাদ চাচা, আমি ঠিক আছি।”
জমির সাহেব এবং সোনা মিয়া বাস থেকে নেমে সোজা ফুটপাতে দাঁড়ালেন। জমির সাহেবের মাথায় তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে ছেলেটার কথাবার্তা।
“ভাই, আপনি কোথায় যাবেন?” সোনা মিয়া জিজ্ঞাসা করলেন।
“আমার গ্রামের বাড়ি। আপনাকে ধন্যবাদ এই যাত্রায় সঙ্গ দেওয়ার জন্য।”
“ধন্যবাদ, আপনারও। ভালো থাকুন।”
জমির সাহেব ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। ছেলেটা আর মেয়েটাকে একটু দূরে দেখলেন। ছেলেটা মেয়েটাকে কিছু বুঝিয়ে দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। মেয়েটা একা দাঁড়িয়ে থাকল, কিছুটা অসহায়ের মতো।
জমির সাহেব তার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, “মেয়ে, তুমি কি ঠিক আছো? কোথাও যেতে হবে?”
মেয়েটা একটু হতভম্ব হয়ে তাকাল, তারপর বলল, “জী, আমি ঠিক আছি। একটু সময় লাগবে বুঝতে।”
জমির সাহেব কিছু না বলেই মেয়েটার পাশে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা একটু আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল এবং বলল, “আমার এখানে কিছু কাজ আছে, আপনাকে ধন্যবাদ।”
জমির সাহেব সেখান থেকে ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন। তার মাথায় তখনও ঘুরছে সেই ছেলেটার কথা। কিছুক্ষণ পর তিনি একটি রিকশা নিলেন এবং নিজের গ্রামের ঠিকানায় রওনা দিলেন।
রিকশা চলতে চলতে তিনি ভাবলেন, “কি এমন কাজ ছিল যে ছেলেটা নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে? তাদের ভবিষ্যৎ ঠিকানায় কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে?”
রিকশা যখন তার গন্তব্যে পৌঁছাল, জমির সাহেবের মন কিছুটা শান্ত হল। তিনি গ্রামের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন। তার স্ত্রী দরজা খুলে তাকে দেখে খুব খুশি হলেন।
“তুমি কেমন আছো? যাত্রা কেমন ছিল?”
“ভালো ছিল, কিছুটা ক্লান্ত লাগছে।”
বাড়িতে ঢুকে বসার পর জমির সাহেব তার স্ত্রীর সাথে সব কথা শেয়ার করলেন। স্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “গল্পটা শুনে মনে হচ্ছে ছেলেটার জীবনে কিছু একটা সমস্যা আছে।”
জমির সাহেব ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ, হয়তো তাই। কিন্তু আমি সবসময়ই মনে করব, সেই দিন সেই বাসের যাত্রায় আমি এক রহস্যময় গল্পের সাক্ষী ছিলাম।”
বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে জমির সাহেবের মন কিছুটা প্রশান্ত হল। তবে তার মন থেকে সেই ছেলেটা আর মেয়েটার কথা মুছে গেল না। তিনি সবসময়ই ভাববেন, কি হয়েছিল তাদের ভবিষ্যৎ ঠিকানায়।
পরের দিন সকালে, জমির সাহেব তার নিজের কাজে মন দিলেন। তার মাথায় ছেলের ভবিষ্যৎ, মেয়ের পড়াশোনা, আর নিজের দায়িত্ব নিয়ে নানা ভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগল। তবে তিনি ঠিক করলেন, যতই কষ্ট হোক না কেন, তিনি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবেন না।
সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামে হঠাৎ হৈ চৈ শুরু হল। জমির সাহেব জানলেন, কাছের নদীর পাড়ে এক যুবকের মরদেহ পাওয়া গেছে। তার শরীরে চোটের দাগ, মুখে ভয়াবহ আতঙ্কের ছাপ। জমির সাহেবের মনে সন্দেহ জাগল- সেই ছেলেটা কি মারা গেছে? তিনি নদীর পাড়ে গিয়ে মরদেহ দেখতে পেলেন এবং নিশ্চিত হলেন, এটা সেই বাসের ছেলেটা।
তারপর গ্রামের মানুষজন আলোচনা করতে লাগল। কেউ বলল, ছেলেটা কোন রহস্যময় কাজে যুক্ত ছিল। জমির সাহেব কিছুটা শিউরে উঠলেন। সেই মুহূর্তে তিনি ভাবলেন, “কী এমন কাজ ছিল যে ছেলেটা প্রাণ হারাল?”
জমির সাহেব বাড়ি ফিরে এলেন, কিন্তু তার মন থেকে সেই ঘটনা মুছে গেল না। তিনি ভাবলেন, “জীবন কতটা অনিশ্চিত আর রহস্যময়।” কিন্তু তিনি ঠিক করলেন, যতই কষ্ট হোক না কেন, তিনি ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য তার দায়িত্ব পালন করবেন।
আর এভাবেই, জমির সাহেব জীবনের রহস্যময় গল্পের এক অংশ হয়ে রইলেন, এবং সেই গল্প তার মনে সবসময় এক অম্লান স্মৃতি হয়ে থাকবে।