বিখ্যাত স্কলার হ্যারল্ড লাস্কির সুপারভিশনে পিএইচডি করতে যাওয়া আব্দুর রাজ্জাক, লাস্কির মৃত্যুর পর অন্য কারো তত্ত্বাবধানে ডক্টরেট ডিগ্রী না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফিরে আসেন স্বদেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শি়ক্ষকতা করে জীবন কাটিয়ে দেন "আদমজী" পুরস্কার প্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক।
উপরের তথ্যগুলো অনেকেরই জানা। হুমায়ুন আহমেদ তাঁকে নিয়ে লিখেছেন, হুমায়ুন আজাদ তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। কিন্তু এই অসাধারণ বইটি প্রফেসর রাজ্জাককে আরো ঘনিষ্টভাবে পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই পরিচয় করিয়ে দেয়ার কর্মটি সাধন করেছেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফার মতো নক্ষত্র যাকে গুরু মানেন ধরে নিতে হবে যে তিনি আসলেই একজন মনীষী। এই প্রাঞ্জল ভাষায় লিখা বইয়ে দেখতে পাওয়া যায় গুরু-শিষ্যের এক অকৃত্রিম সম্পর্ক। একটি একাডেমিক কারণে ছফা প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের কাছে গিয়ে হাজির হন। ক্রমে আহমদ ছফা এবং আব্দুর রাজ্জাকের মধ্যে জ্ঞানের আদান প্রদানের উপর ভিত্তি করে এক মধুর সম্পর্কের ভিত রচিত হয়। প্রফেসর সাহেব একধরণের ক্যাওটিক ভাবে আহমদ ছফাকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান আহরণে সাহায্য করে যেতে থাকেন।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক, বাংলার একাডেমিক এবং ইন্টালেকচুয়াল লাইনে এক রহস্য পুরুষ। বিশ্বের বড় বড় স্কলার, বিগ শটরা নিজেদের রচিত মাস্টারপিস তাঁকে উৎসর্গ করেন। বাংলাদেশে আসলে রাজ্জাক সাহেবের সাথে দেখা করতে ছুটে আসেন অথবা দাওয়াত দেন। শুধু আহমদ ছফা নন, বাংলাদেশের অনেক ক্ষমতাশালী মানুষজন প্রফেসর সাহেবের কাছে ছুটে আসেন। কারণ এই ধীর, স্থির মানুষটি অত্যন্ত ক্ষমতাধর। ভোজনরসিক এই ব্যক্তি সবাইকে রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসেন। দাবা খেলার প্রতি গভীর অনুরাগ আছে রাজ্জাক স্যারের। নিজের পছন্দের মানুষজনদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক নিয়মনীতি ভেঙ্গে স্কলারশীপ এবং অন্যান্য সুবিধা পাইয়ে দেন। অর্থনৈতিকভাবে দূর্বলদের আর্থিক সাহায্য করেন যথাসাধ্য। অত্যন্ত সংবেদনশীল একজন মানুষের পরিচয় আমরা পাই ছফার জবানীতে। এমপ্যাথী এবং এফেকশনে কানায় কানায় পূর্ণ একজন মানুষ প্রফেসর রাজ্জাক।
জ্ঞানের রাজ্যে সমাজবিজ্ঞান, রাস্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্মীয় থিওলজী, বিশ্বসাহিত্য এই সকল বিষয়ে গর্বিত পদচারণা আছে এই জাতীয় অধ্যাপকের। তিনি যেন একজন জীবন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া। এত প্রজ্ঞাবান একজন মানুষ হওয়ার পরও এক ঋষিসুলভ নির্লিপ্ততা দেখা যায় তাঁর মাঝে। তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অধিকারী আহমদ ছফা দীর্ঘ সময় ধরে এই বিশ্বকোষ আব্দুর রাজ্জাক এবং ব্যক্তি আব্দুর রাজ্জাকের সাথে মিশে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে স্বয়ং আহমদ ছফা ক্ষান্ত দিয়েছেন এই জ্ঞানের অসমান্তরাল পদচারণায় তাঁর গুরুর সাথে। ছফা নিজেই এই বইয়ে একজন নির্ভেজাল সৎ মানুষ হিসেবে শ্বীকার করে নিয়েছেন কিছু ক্ষেত্রে নিজের জ্ঞানের স্বল্পতা বা কম বুঝা। যখনই কোন বিপদে পড়েছেন ছফা, সেটা ব্যক্তিগত হোক বা বুদ্ধিবৃত্তিক, বিশাল হৃদয়ের অধিকারী তাঁর গুরু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিজের প্রচন্ড সমালোচকদেরও প্রফেসর সাহেব বিভিন্ন সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন।
এই অদ্ভুত সুন্দর বইটি যেকোন লাইফলং লার্নারের কাজে আসবে এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কারণ রাজ্জাক স্যার শুধু আহমদ ছফা নন, আবর্তিত হয়েছেন তিন থেকে চার প্রজন্মের মিডল ক্লাসের মেন্টরে। আহমদ ছফার মতো আপনিও দারুন কিছু বুক সাজেশন পাবেন। লেখালেখি এবং পড়ার উপর কিছু সরল ভাষায় ভালো টিপসও পাবেন আহমদ ছফার গুরুর থেকে। বিশ্বসাহিত্যের সাথে আহমদ ছফার মতো আপনিও পরিচিত হবেন। আরো জানা যাবে বিখ্যাত এবং প্রথিতযশা অনেক ব্যক্তি সম্পর্কে যেসব তথ্য হয়তো অন্য বইতে পাননি। আব্দুর রাজ্জাক স্যার একদম মারদাঙ্গা লেখাপড়া করতেন এবং সেই লেখাপড়ার দারুণ এনালাইসিস করতে পারতেন। আহমদ ছফা শুধু গুরুর বাক্যের প্রতিধ্বনী করেননি, ক্ষ্যাপাটে প্রতিভা হওয়ার সুবাদে অনেক সময় গুরুর সাথে তীব্র দ্বীমত করেছেন, করেছেন বিদ্রোহ। নিজের ভাষায় গুরুকে তিনি বাঙ্গালী মিডল ক্লাসের গুরুতে পরিণত করেছেন যেটা তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এই জীবনীমূলক বই লেখার ক্ষেত্রে। এই বইয়ে কীন অবজার্ভেশনের সাথে চমৎকার উইট পাবেন গুরু-শিষ্যের আলাপচারিতায়।
অকৃতদার, জ্ঞানসাধনায় চিরঅক্লান্ত, পরোপকারি প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের লেখা তেমন কোন বই নেই। এক জায়গায় পড়েছিলাম কোন বিষয়ে অধিক জানা হয়ে গেলে আর লেখা হয়ে উঠে না। হয়তো রাজ্জাক স্যারের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। আহমদ ছফা নিজে স্বীকার করেছেন যে, এই বইয়ের অনেক কথা তাঁর স্মৃতি থেকে আগত, তাই বায়াস বা ভূলত্রুটির অবকাশ উড়িয়ে দেয়া যায় না। ছফা নিজে রাজ্জাক স্যারের উপর লেখা সরদার ফজলুল করিমের বইটিকে আরো অনেক ব্যাটার মনে করেন। এই জায়গাটিতেই আহমদ ছফার সততা প্রকাশ প্রায় প্রায় রেডিক্যালী। ভক্তি এবং শ্রদ্ধার চাইতেও আহমদ ছফার মধ্যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করেছে রাজ্জাক স্যারের জ্ঞানসাধনা এবং দুর্দান্ত ব্যক্তিত্বের প্রতি এক অশেষ মুগ্ধতা। বর্তমান এবং পরবর্তি প্রজন্মের কাছে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক এক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন এই আশাই রইলো।
লেখক আহমদ ছফা একজন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, এবং পরোপকারি একজন ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তিনি হীরের মতো জ্বল জ্বল করছেন আজো। আহমদ ছফা তাঁর রহস্যপুরুষ গুরুর মতো এই বইয়ের নামকরণে নিজে একটি রহস্য সৃষ্টি করেছেন যেটার বিষয়ে বর্তমান সময়ের লিডিং একজন বুদ্ধিজীবী ছফাকে প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান। প্রশ্নটি কিন্তু থেকে যায়।
"যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়
তথাপি তাহার নাম নিত্যানন্দ রায়।"
আব্দুর রাজ্জাক স্যার তো শুঁড়ি বাড়ি যেতেন না। আহমদ ছফা "যদ্যপি" শব্দটি কেন ব্যবহার করলেন? কবিতাটি তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিলো অথবা রাজ্জাক স্যারের কোন "যদ্যপি" ব্যাপার ছিলো। হয়তো আহমদ ছফা তাঁর গুরু যে বিভিন্ন নিয়ম ভেঙ্গে কাছের মানুষজনকে সুবিধে পাইয়ে দিতেন সেটা বুঝিয়েছেন অথবা যোগ্য গুরুর যোগ্য শিষ্য হিসেবে তিনি হয়তো নিজেও কিছু রহস্য রেখে দিয়েছেন।
বই রিভিউ
নাম : যদ্যপি আমার গুরু
লেখক : আহমদ ছফা
প্রকাশনা : মাওলা ব্রাদার্স
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮
প্রচ্ছদ : কাইয়ুম চৌধুরী
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ