হযরত উমামার (রা:) বড় পরিচয় হলো তিনি মুহাম্মদ (সা:) এর আদরের নাতনী। উমামার মাতা হলেন রাসুল (স:)-এর বড় মেয়ে হযরত জয়নাব (রা:) এবং পিতা হলেন হযরত আবিল ‘আস (রা:। উমামা তার নানা মুহাম্মদ (স:)-এর জীবদ্দশায় মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তার জন্মের অনেক আগেই উমামার নানী উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা:) ইন্তেকাল করেন। উমামার দাদী ছিলেন হযরত খাদীজা (রা:)-এর ছোট বোন হালা বিনতে খুওয়ায়লিদ। হিজরী ৮ম সনে উমামার মা হযরত যায়নাব (রা:) এবং ১২শ সনে পিতা হযরত আবিল 'আস, (রা:) ইন্তেকাল করেন।
নানা রাসূল (সা:) শিশু উমামাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। সব সময় তাকে সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন,এমনকি নামাযের সময়ও কাছে রাখতেন। মাঝে মাঝে এমনও হতো যে, রাসূল (সা:) তাকে কাঁধের উপর বসিয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। রুকূ’তে যাওয়ার সময় কাঁধ থেকে নামিয়ে দিতেন।
তারপর সিজদায় গিয়ে তাকে মাথার উপর বসাতেন এবং সিজদা থেকে উঠার সময় কাঁধের উপর নিয়ে আসতেন। এভাবে তিনি নামায শেষ করতেন। এ আচরণ দ্বারা উমামার প্রতি তাঁর স্নেহের আধিক্য কিছুটা অনুমান করা যায়।
রাসূলুল্লাহর (সা:) সাহাবী হযরত আবু কাতাদা (রা:) বলেন: “একদিন বেলাল (রা:) আযান দেওয়ার পর আমরা জুহর অথবা আসরের নামাযের জন্য অপেক্ষায় আছি , এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সা:) শিশু উমামাকে কাঁধে বসিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হলেন । রাসূল (সা:) নামাযে দাঁড়ালেন এবং আমরাও তাঁর পিছনে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলাম। শিশু উমামা তখনও তাঁর নানার কাঁধে একইভাবে বসা অবস্থায় ছিল। রাসূল (সা) রুকূ’তে যাবার সময় তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখেন। তারপর রুকূ’-সিজদা শেষ করে আবার যখন উঠে দাঁড়ান তখন আবার তাঁকে ধরে কাঁধের উপর উঠিয়ে নেন। প্রত্যেক রাক’আতে এমনটি করে তিনি নামায শেষ করেন।“
উম্মুল মু’মিনীন হযরত ‘আয়েশা (রা:) বর্ণনা করেছেন: “হাবশার সম্রাট নাজ্জাশী রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে কিছু স্বর্ণের অলঙ্কার উপহার হিসেবে পাঠান, যার মধ্যে একটি স্বর্ণের আংটিও ছিল। রাসূল (সা:) সেটি শিশু উমামাকে উপহার দেন।”
উমামার প্রতি রাসূলুল্লাহর (সা) স্নেহের প্রবলতা আরেকটি ঘটনার দ্বারাও অনুমান করা যায়। একবার রাসূলুল্লাহর (সা:) নিকট মুক্তা বসানো স্বর্ণের একটি হার উপহার আসে। হারটি হাতে করে ঘরে নিয়ে এসে স্ত্রী-দের দেখিয়ে বলেনঃ দেখ তো, এটি কেমন? তাঁরা সবাই বলেনঃ “অতি চমৎকার! এর চেয়ে সুন্দর হার আমরা এর আগে কখনো দেখি নি। রাসূল (সা:) বললেনঃ এটি আমি আমার পরিবারের মধ্যে যে আমার সবচেয়ে বেশী প্রিয় তাঁর গলায় পরিয়ে দেব। ‘আয়েশা (রা:) মনে মনে ভাবলেন, না জানি তিনি এটা আমাকে না দিয়ে অন্য কোন স্ত্রী'র গলায় পরিয়ে দেন কিনা! অন্য স্ত্রীগণও ধারণা করলেন, এটা হয়তো ‘আয়েশার (রা:) ভাগ্যেই জুটবে। এদিকে বালিকা উমামা তাঁর নানা ও নানীদের অদূরেই মাটিতে খেলছিল। রাসূল (সা:) তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁর গলায় হারটি পরিয়ে দেন।”
হযরত উমামার (রা:)-এর পিতা আবিল ‘আস (রা:) হিজরী ১২ সনে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর মামাতো ভাই যুবাইর ইবনে আল-‘আওয়ামের সাথে উমামার বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছার কথা বলে যান। এদিকে উমামার ছোট খালা হযরত ফাতিমাও (রা:) ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বে তিনি স্বামী ‘আলী (রা:)-কে বলে যান, তাঁর পড়ে তিনি যেন উমামা (রা:)-কে বিয়ে করে। অতঃপর উমামার (রা) বিয়ের বয়স হলো। যুবাইর ইবনে আল-‘আওয়াম (রা:) হযরত ফাতিমার (রা:) অন্তিম ইচ্ছা পূরণের জন্য উদ্যোগ হলেন। তাঁরই মধ্যস্থতায় ‘ হযরত আলীর (রা:) সাথে উমামার (রা:) বিয়ে সম্পন্ন হলো। তখন আমীরুল মু’মিনীন ‘হযরত উমারের (রা:) খিলাফতকাল।
হিজরী ৪০ সন পরর্যন্ত তিনি ‘আলীর (রা:) সাথে বৈবাহিক জীবন যাপন করেন। এর মধ্যে ‘আলীর (রা:) জীবনের উপর দিয়ে নানা রকম ঝড়-ঝঞা বয়ে যায়। অবশেষে হিজরী ৪০ সনে তিনি আততায়ীর হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন, এই আঘাতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি স্ত্রী উমামা (রা:)-কে বলেন, আমার পরে যদি তোমার কোন বিয়ের প্রয়োজন বোধ কর, তাহলে আল-মুগীরা ইবন নাওফাল (রা:),-কে বিয়ে করতে পার। তিনি আল-মুগীরাকেও বলে যান, তাঁর মৃত্যুর পরে তিনি যেন উমামা (রা:)-কে বিয়ে করেন। আলী (রা:) আশংকা করেন, তাঁর মৃত্যুর পরে হযরত মু’আবিয়া (রা:) উমামা (রা:)-কে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন। তবে তার এ আশংকা সত্যে পরিণত হলো, হযরত আলী (রা:) তখন ইন্তেকাল করলেন। হযরত উমামা (রা:) ‘ইদ্দত তথা অপেক্ষার নির্ধারিত সময় সীমা অতিবাহিত করলেন। হযরত মু’আবিয়া (রা:) মোটেই দেরী করলেন না। তিনি মারওয়ানকে লিখলেন, তুমি আমার পক্ষ থেকে উমামার নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও এবং এ উপলক্ষে এক হাজার দীনার ব্যয় কর। এ খবর হযরত উমামার (রা:)-এর কানে গেল। তিনি সাথে সাথে হযরত আল-মুগীরা (রা:)-কে লোক মারফত বললেন: “যদি আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান, তাহলে দ্রুত চলে আসুন। হযরত আল-মুগীরা (রা:) উপস্থিত হলেন এবং মুহাম্মদ (স:)-এর নাতি হযরত হাসান (রা:) মধ্যস্থতায় বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়।“
মুহাম্মদ (স:)-এর নাতনী হযরত উমামা (রা:) আল-মুগীরার (রা:) স্ত্রী থাকা অবস্থায় মু’আবিয়ার (রা:) খিলাফতকালে তিনি ইন্তেকাল করেন। ‘ হযরত আলীর (রা:)-এর ঘরে উমামার কোন সন্তান হয় নি। তবে আল-মুগীরার (রা:)-এর ঘরে তিনি এক ছেলের মা হন এবং তাঁর নাম রাখেন ইয়াহইয়া। অনেক ইতিহাসবিদ বলেছেন, আল- মুগীরার (রা:) ঘরেও তিনি কোন সন্তানের মা হননি। তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহর (সা:) কন্যাদের মধ্যে একমাত্র ছোট কন্যা ফাতিমা (রা:) ছাড়া আর কারো বংশধারা অব্যাহত নেই। এমন হতে পারে আল-মুগীরার ঔরসে ইয়াহইয়া নামের এক সন্তানের জন্ম দেন, কিন্তু শিশুকালেই তাঁর মৃত্যু হয়। উমামার মৃত্যুর মাধ্যমে মুহাম্মদ (স:)-এর বড় কন্যা হযরত যায়নাবের (রা:) বংশধারার সমাপ্তি ঘটে। কারণ তাঁর পূর্বেই মুহাম্মদ (স:)-এর বড় কন্যা হযরত জয়নাব (রা:)-এর পুত্রসন্তান আলীর মৃত্যু হয়।