Posts

উপন্যাস

সারোগেসি (২য় পর্ব)

January 16, 2025

রাজিয়া সুলতানা জেনি

26
View

— একা কেন?

মেয়েলি আওয়াজ। প্রচণ্ড চেনা। তারপরও চমকে উঠলাম। বোধহয় আনমনা ছিলাম, সেজন্য। আওয়াজটা ঠিক আমার বাম পাশ থেকে এসেছে। সেদিকে ঘাড় ঘোরালাম। ইরা।

কিছুটা মুটিয়েছে। তাছাড়া আগের মতই আছে। ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি।

আমি এখন বাগানে। মানে প্রত্যেকটা কটেজের সামনে যে বাগান আছে সেটারই একটায়। আমাদের কটেজের সামনের বাগানটায় ইচ্ছে করেই বসিনি। কয়েকটা কটেজ পরের কটেজের সামনের বাগানে। অলিখিত নিয়ম হচ্ছে, যার যে কটেজ, তার সামনের বাগানটায় তাঁরা বসবে। এই কটেজটা বন্ধ। মানে কোন গেস্ট আসেনি। সো, এটার এই মুহূর্তে কোন মালিকানা নেই।

আসলে প্রীতির সাথে ঘটা সকালের ঘটনার পরে রুমের পরিবেশ বেশ অস্বস্তিকর হয়ে যায়। প্রীতি কিছুক্ষণ আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। স্পষ্ট বুজতে পারি, অঝোরে কাঁদছে। আমার সম্পর্কে এতদিনে গড়ে ওঠা ধারণাটা এক লহমায় চুরমার হয়ে যায়।

কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ওর অভিমান এখন চরমে। অভিমান না, আই থিংক ওটা রাগ। সাথে হয়তো একটু ঘৃণাও মিশে আছে।

— কি দেখো?

ইরার দ্বিতীয় প্রশ্নটা করার কারণ, ওর দিকে একটু বেশিক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম।  অবশ্য সেটা ওর রূপের কারণে না। কেমন স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিলাম। দুটো টাইমলাইনের ভেতরে আঁটকে গিয়েছিলাম। মাথায় ঘুরছিল সকালের ঘটনা, আর চোখের সামনে ইরা। নিজেকে সামলে নিতে তাই কিছুটা সময় লেগে যায়।

অবশ্য আরও একটা ব্যাপার ছিল। আমাদের শেষ দেখাটা যেভাবে শেষ হয়েছিল, ভেবেছিলাম আমাদের আলাপ তারপর থেকে শুরু হবে। সেই রাগ এখন উগড়ে দেবে আমার ওপর। কিন্তু তেমন কিছু না করে, এমন হেসে কথা বলায় কেমন হকচকিয়ে যাই।

এনিওয়ে, সকালের ঘটনাটা আগে সেরে নিই। ইরাকে রেপ করার কথাটা বলার পরে এটাও বুঝতে অসুবিধা হল না, আমাদের সম্পর্কে যে ফাটল ধরল, এই ফাটল ইররিভারসিবল। আর কখনোই ভরাট হবে না।

‘সরি' বলে খুব লাভ হবে না। সম্পর্ক আর কখনোই আগের মত হবে না। সময়ের সাথে সাথে হয়তো রাগ কমে আসবে। বাট ভালোবাসা? শ্রদ্ধা? ওটা আর ফেরত পাব না।

আমার এক মুহূর্তের একটা ইমোশনার সিদ্ধান্তে ভ্যাকেশানটা শিকায় উঠিয়ে ফেলেছি। প্রীতির পরবর্তী স্টেপ কি হবে? আজকেই ফিরে যেতে চাইবে? ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে বাকী দুটো অ্যাক্টিং করে যাবে?

আর পরে? ডিভোর্স? না এভাবে ভালবাসাহীন দাম্পত্য চালিয়ে যাওয়া?

কি করব ভাবলাম। একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমার ঘরে থাকাটা ওর জন্য প্রচণ্ড বিরক্তিকর আর কষ্টের হবে। আমি চোখের সামনে না থাকলে ও হয়তো কেঁদে নিজেকে শান্ত করতে পারবে।

ওর রাগ ভাঙ্গাবার চেষ্টার চেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসাটা বেটার অপশান মনে করলাম। আমাকে যত চোখের সামনে দেখবে, ততো ক্ষতটা টনটন করবে।

তখন থেকে প্রায় ঘণ্টা খানেক আমি এই চেয়ারে বসা। ইরা কখন আমাকে লক্ষ্য করেছে জানি না। হয়তো এদিক দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ চোখে পড়ে যাই আমি।

যাই হোক, আমাকে দেখতে পেয়ে ও এগিয়ে আসে আমার কাছে। আর জানতে চায় আমি একা কেন।

এনিওয়ে, বর্তমানে ফিরে আসি। দ্বিতীয় প্রশ্নটা করে ইরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আমার পাশে বসল। একটু দূরে। এরপরে শাড়িটা একটু গুছিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকাল। ঠিক উত্তরের আসায় না, আমার তরফ থেকে কিছু শোনার জন্য।

ওর এই নিরাপদ দূরত্বে বসা ব্যাপারটায় কেন যেন হাসি পেল। উত্তর না দিয়ে ওর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলাম।

— হাসছো যে?

মাথা দুদিকে নেড়ে বোঝালাম ‘তেমন কিছু না’। এরপরে ভাবলাম বলেই ফেলি কথাটা।

— বেশ খানিকটা গ্যাপ রেখে বসলে, তাই হাসলাম।

— তো কি এক্সপেক্ট কর, আগের মত তোমার হাতে হাত রেখে, কাঁধে মাথা রেখে বসব?

মুখে কিছু না বলে মাথা দুদিকে নাড়লাম শুধু। এরপরে সামনের দিকে তাকালাম।

— তোমার বর কোথায়?

— সামনে কোথায় মাছ ধরার ব্যবস্থা আছে নাকি, ওখানে গেছে।

— আর মেয়ে?

— বাপের সাথে গেছে।

— সুন্দর হয়েছে মেয়েটা।

— বাপের খুব নেওটা।

কেন যেন মনে হল নিজেকে সুখী দেখাবার চেষ্টা করছে ইরা। ব্যাপারটা সন্দেহজনক। ওদের ভেতরও কি মন কষাকষি চলছে?

বিয়ের পর পর বেশ কিছুদিন এর ওর মুখে ইরার সম্পর্কে যা জানতে পেরেছিলাম তার সারাংশ হচ্ছে, বেশ সুখেই আছে।

— তোমার?

প্রশ্নটা বোঝার চেষ্টা করলাম। মনে হল বাচ্চাকাচ্চা সম্পর্কে জানতে চাইছে। জানালাম।

— দুইটা। ছেলে।

উত্তরে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। সামনের বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ শান্তস্বরে বলল

— বউ তো বেশ সুন্দরী দেখলাম।

কি বলব, খুঁজে পেলাম না। স্মাইল টাইপ একটা হাসি হাসলাম শুধু। মানে হাসবার চেষ্টা করলাম। খুব ভাল হল না। কিংবা বলা যায়, হাসির অ্যাক্টিংটা ধরে ফেলল। কিছুটা উদ্বেগ নিয়েই জানতে চাইল

— এনিথিং রং?

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ইরার দিকে। ওকে সব খুলে বলতে প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে। আবার এটাও বুঝতে পারছি, প্রীতির সাথে হওয়া আজ সকালের আলাপটা ইরাকে বলাটা ঠিক হবে না।

তারপরও বড় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল।

— নাথিং সিরিয়াস।

— তোমার চেহারা তো সেটা বলছে না।

ইরার গলার আওয়াজে কিছু একটা ছিল। একটা ‘কেয়ার' টাইপ ব্যাপার। যেন বলতে চাইছে, ‘খুলে বল, মনটা হালকা হবে’।

মত পাল্টালাম। ঠিক করলাম, প্রীতির সাথে ঘটা সকালের ঘটনাটা ইরার সাথে শেয়ার করব। আর  সেদিনের জন্য ক্ষমা চাইব।

কিন্তু কিভাবে শুরু করব? সেই জঘন্য ঘটনা হয়তো ইরা অনেক কষ্টে ভুলেছে। আবার সেই ক্ষতে আঁচড় কাটব?

— অফিশিয়াল? না ফ্যামিলিয়াল?

তাকালাম ইরার দিকে। ওর চোখে জিজ্ঞাসা। ঠিক ‘পাশের বাড়ির সমস্যা জানতে চাওয়া’ মেয়েলি জিজ্ঞাসা না। আমার জন্য খারাপ লাগা থেকে জানতে চাওয়া।

কেন যেন খুব ভাল লাগল। বলে ফেললাম।

— ফ্যামিলিয়াল।

তবে বলাটা এক ঝটকায় হল না। আমার বলায় ছোট্ট যে হেজিটেশানটা ছিল, সেটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল, সমস্যাটা ওকে নিয়ে। আর ইরা আমাকে এতোটাই ভালভাবে চেনে যে আমার গলার এই ছোট্ট হেজিটেশান মিস করল না। পরের প্রশ্নটা তাই অবাক করল না।

— আমাকে নিয়ে?

ওর চোখে অবিশ্বাস। সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। আর নড করে বোঝালাম ‘হ্যাঁ'।

প্রথমে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে আমার দিক তাকিয়ে থাকল। এরপরে ইরাও হেসে ফেলল

— ফিলিং প্রাউড।

— প্রাউড?

প্রাণ খোলা একটা স্মাইল দিল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল

— আমার সম্পর্কে আগে বলো নি?

— বলেছি।

— তাহলে?

উত্তরটা কিভাবে দেবো ভাবছি। এমন সময় ইরা নিজেই আবার জানতে চাইল

— বলোনি গত পনেরো বছর আমাদের একবারও দেখা হয়নি?

কেমন এক্সপ্লেইন করার চেষ্টা। মনে হচ্ছে এই কথাগুলো একটু আগে ও ওর নিজের বরকে শুনিয়ে এসেছে। হঠাৎ করেই প্রশ্নটা মাথায় আসল।

— তোমার দিকের কি খবর?

কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ইরা। ওর চিন্তার পুরোটা জুড়ে ছিল আমার দাম্পত্য সমস্যা। সেখানে ওর নিজের জীবন ঢুকে যাওয়ায় কেমন বিরক্ত হল। কিছুটা বিরক্ত টোনে বলল

— আমার দিকে ঠিক আছে।

— মাছ ধরাটা জেনুইন?

এবার রাগী চোখে আমার দিকে তাকাল ইরা। আমার গোয়েন্দাগিরি পছন্দ হল না।

— সরি।

অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। বোঝার চেষ্টা করল ‘সরি’টা কেন বলছি। ওর সম্পর্কে গোয়েন্দাগিরি করাটা তেমন গর্হিত কোন কাজ না। অন্ততঃ সরি বলার মত না। একটু আগে ইরা নিজেই সেটা করছিল। ওর সাথে ব্রেকাপটাকে বলা যায়। কিন্তু সেটা এতদিন পরে, এভাবে বলার মত কোন ‘কারণ' না। ওর চোখ তখন আমার চেহারায় ‘সরি'র কারণ খুঁজছে।

বোধহয় গেস করে ফেলেছে। আর ওর সন্দেহটা যে ঠিক, সেটা বোঝাতে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। আর মুখে এক্সপ্লানেশানটা দিলাম।

— সরি ফর দ্যাট ডে।

বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল ইরা। বোঝার চেষ্টা করছে কেন হঠাৎ সেদিনের আলাপ তুললাম। অনুশোচনা? না অন্য কিছু?

— হঠাৎ?

উত্তরে কিছু বলতে পারলাম না। ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে ফেললাম।

— সেদিনের পরে তো আজ প্রথম দেখা।

চোখ নামিয়ে ফেললেও স্পষ্ট বুঝতে পারছি ইরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে চোখ তুললাম। বোধহয় কারণটা আমার চেহারায় লেখা ছিল। ধরে ফেলল। সাথে সাথে মুখটা শুকিয়ে গেল। ভয় মেশানো কণ্ঠে কোনরকমে জানতে চাইল

— তোমার বউকে বলেছো কথাটা?

নড করলাম। ‘হ্যাঁ'। আর মুখে বললাম

— আজকে। একটু আগে।

চলবে

Comments

    Please login to post comment. Login