পণপ্রথা, আদি অনন্তকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত একটা সামাজিক ব্যাধি। যদিও সরকারের তরফে এবং বিভিন্ন ধরনের কল্যাণমূলক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়, "পণ নেব না পণ দেবো না পণ মুক্ত সমাজ গড়ে তুলবো" ইত্যাদি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, এই পণপ্রথার জন্য দায়ী কে? আমি সামাজিকভাবে অনেক গবেষণা করে, সমাজকে অনেক পর্যবেক্ষণ করে, আমার মনে হয়েছে এর জন্য সিংহভাগ দায়ী মেয়ের বাবা, ভাই বা পাত্রীর বাড়ির লোকজন। কারণ তারা সব সময় মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজে 'সুপাত্র' সুপাত্র বলতে চাকরিজীবী, বড় ব্যবসায়ী, ধনী ঘর, ছেলে যেমনই দেখতে হোক, ছেলের চরিত্র যেমনই হোক, অসুবিধা নেই। মুখে একটা কথা বলে 'সোনার আংটি আবার বেঁকা বা সোজা' আমার প্রশ্ন হলো, যারা চাকরি করে না, যারা ব্যবসা করে না, যারা ধনী নয়, তারা কি বিয়ের যোগ্য পাত্র নয়?
প্রথমেই বলে রাখি আমি বিয়ে করেছি বিনা পণে এক পয়সাও নেই নি। কিন্তু যে বাড়িতে বিয়ে করেছি সেই বাড়ির একটিও ছেলে চাকরি করে না। আবার সেই বাড়ির সব মেয়েদের চাকরিজীবী, ধনী ঘরে, বিয়ে দিয়েছে। আমরা সাধারনত অর্থনীতির ভাষাতে জানি, যে জিনিস সমাজে বা বাজারে কম থাকে, তার কদর বেশি হয় বা মূল্যবান। মেয়ের বাড়ির লোকেরা এই মূল্যবান পাত্রদের প্রতিযোগিতা করে মূল্য দিয়ে কিনতে দ্বিধাবোধ করে না।
এ সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি ঘটে যাওয়া ঘটনা আলোচনা করলে ব্যাপারটা আরো পরিস্কার হবে। কারও নাম উল্লেখ করবো না। কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ চাইলে? দিয়ে দিতে পারব।একজন এমএ পাস ছেলের পিতা, গ্রামের একজন কৃষক বন্ধু (সরকারি চাকরিজীবী) তার মেয়ের সাথে বিয়ের কথা বললে, মেয়ের বাপ বলে," এমএ পাস হলেও সে এখন আমার বাড়ির গরুর ঘাস কাটার যোগ্য নয়? 01 বছর 07 মাস পরে ছেলেটা যখন সরকারি চাকরি পেল। তখন ওই কৃষক বন্ধু ছেলের বাবাকে এসে বলল তোমার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দাও।তখন ছেলের বাবা বলেছিল, ভাই আমার এমএ পাস ছেলে এরপর তোমার বাড়ির গরুর ঘাস কাটার যোগ্য হয়েছে? আমার ভাই ডাক্তার (এমডি শিশু বিশেষজ্ঞ) তার জন্য পাত্রী দেখতে গিয়েছিলাম কাটোয়া তে, মেয়ে আমার মায়ের পছন্দ হয়নি। মেয়ের বাবা আমাকে বলেছিল যে, একটা সুপাত্র খুঁজে দিতে আমি তখন মেয়ের বাবাকে বলেছিলাম, আমার একজন জানাশোনা স্কুল মাস্টার আছে। বিয়ে দেবেন? মেয়ের বাবা আমাকে উত্তর দিয়েছিল, আমার মেয়ের বিয়ে স্কুল মাস্টারের সাথে দেব না।কোন গেজেটেড অফিসার,বা ডাক্তার, বা প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার থাকলে বল। এই ক্ষেত্রে একটা বিষয়ে ধারণা আসে, ওই ধরনের মেয়ের বাবার কাছে এই তিন শ্রেণীর পাত্র ছাড়া আর অন্য কোন শ্রেণীর পাত্র তাদের মেয়ের জন্য যোগ্য নয়। অনেক মেয়ের বাবা বা ভাই আমাকে ফোনে বা সাক্ষাতে বলে, আমার মেয়ে বা বোনের জন্য একটা সরকারি চাকরিজীবী পাত্র দেখে দিও। যা টাকা লাগবে দেবো।অথচ তারা নিজে চাকরি করে না। আমি তাদেরকে পরামর্শ দিই, ঐই টাকার অর্ধেক দিয়ে কোন একটা শিক্ষিত বেকারের সাথে বিয়ে দিয়ে তাকে একটা ভালো ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত করে দেন। তাতে যেমন আপনার ভালো হবে সেরকম সমাজের মঙ্গল হবে। এমন অনেক বাড়ি দেখা গেছে, যে বাড়িতে ছেলে বেকার অথচ বাড়ির মেয়েদের সরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। আমার পরিচিত একজন শিক্ষক মহাশয় এর এক বছর বিয়ে হওয়ার পর স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। তাই শিক্ষক মহাশয় এর স্ত্রী শিক্ষক মহাশয় থেকে আলাদা থাকতো এমত অবস্থায় শিক্ষক মহাশয় আমাকে বলল, একটা মেয়ে দেখে দাও। খুব মানসিক অশান্তিতে আছি। বিয়ে করলে এক পয়সাও নেব না। আমি একটা মেয়ের বাবাকে বললাম, বিয়ের কথা,সঙ্গে বিনা পণের কথা বললাম। কিন্তু মেয়ের বাবা আমাকে বলল যে ডিভোর্সটা হোক, এছাড়া উনি বর্তমান স্ত্রীকে ক্ষতিপূরণ দিতে অনেক টাকা ঋণ করে ফেলেছে। অথচ ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল, মাষ্টারমশাই আমাকে বলেনি, আমি মাষ্টারমশাইকে মেয়ের বাবার উত্তর জানালাম। মাষ্টারমশাই আমাকে ডিভোর্সের কাগজ দেখালো এবং বলল যে ওখানে আর বিয়ে করব না। কয়েকদিন পর ডিভোর্সের কথা ও ঋণ পরিশোধের কথা জানাজানি হতে, সেই মেয়ের বাবা আমাকে এসে বলল, বিয়ের ব্যবস্থা করে দেন, নগদ 15 লাখ টাকা দেব। আমার জানা আরও এক মাস্টারমশাই তার স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার জন্য আলাদা থাকতো। দুই সন্তানও আছে, তার সঙ্গে একজন কুমারী মেয়ের পিতা মোটা টাকার বিনিময়ে বিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র চাকরির জন্য।যদিও তার পূর্বের স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে। এই ধরনের হাজার হাজার ঘটনা আছে।
প্রেম ভালোবাসা করে যারা বিয়ে করে, বেশিরভাগ সময় মেয়ের বাড়ি থেকে মানতে চায় না। কারণ ছেলে বেকার। আর চাকরিজীবী ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করলে 90 ভাগ মেয়ের বাবা মেনে নেয়। বেকার থেকে বিয়ে করতে চাওয়াটা কি অন্যায়? বেকার ছেলে, মেয়ের বাবা কে বিয়ের প্রস্তাব দিলে, মেয়ের বাবা বলে, তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছো? জানো? আমার মেয়ে রূপচর্চা করতে কত খরচ হয়? সে কি কি খায় জানো? তার পেছনে কত খরচা আমার হয় জানো? তুমি পাবে কোথায়? যাও। আমার মেয়ের চিন্তা ছেড়ে দাও। না হলে ভালো হবে না। আবার ওই ছেলে চাকরি পেলে, এক বস্তা টাকা নিয়ে তার পিছনে দৌড়ায়।
সমাজে যেমন মিথ্যা খবর প্রচার হয় 10 জন একটা মিথ্যা কথাকে এমন ভাবে বলে যে তা সত্য বলে মনে হয়। এই সূত্রে ধরে বলি, সমাজে যদি কোন বধূ শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে না পারে তাহলে বেশিরভাগ বধূ অভিযোগ করে, শ্বশুরবাড়ি টাকা বা পণের জন্য চাপ দিচ্ছে। আবার কোন কারনে কোন বধূ যদি অঘটন ঘটায়, তাহলে বাড়ির লোকজন প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে। যে, শ্বশুরবাড়ির লোকজন পণের জন্য চাপ দিচ্ছিল বলে এই ঘটনা ঘটেছে। আসল কারণ কেউ দেখেনা। বা আসল কারণ এর তদন্ত হয় না। আবার বিনাপণে বিয়ে করলে ছেলে তার শ্বশুরবাড়িতে কদর পায় না। কারণ টাকা দিয়ে না কিনলে তার মূল্য থাকে না বা ফ্রী পেলে তার কদর থাকে না। আবার মূল্য দিয়ে কিনলে তার কদর ভালো থাকে।এছাড়াও শুনতে হয় ছেলে বিনা পণে বিয়ে করেছে, নিশ্চয়ই ছেলের কোন দোষ আছে, ইত্যাদি। মেয়ের ঠাকুরমা (দাদি বা নানি) ঠাকুরদাদা (দাদু বা নানা) জিজ্ঞেস করেই ফেলে মজার ছলে। "হা ভাই তোমার কোন দোষ নেই তো? তোমার আগে একবার বিয়ে হয়নিতো? বা তোমার কোনো ছেলেপুলে নেই তো?" ইত্যাদি।
পণ নিয়া সামাজিক ব্যাধি, যে মেয়েকে বিয়ে করে ঘরের বউ করবে। বা যে মেয়ে ঘরের বউ মা হবে। তাকে বিয়ে করার জন্য বা বোমা করার জন্য টাকা, সোনা নেয়া হবে, এটা অন্যায়। কিন্তু এই অন্যায়টা করছে কে? অনেক ছেলের বাবারাও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার টা করে। আমার জানা অনেক বেকার ছেলের বিয়ে হয়নি। তাদেরকে যখন ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন করি বিয়ে করোনি কেন? তখন তারা আমাকে বলে, আমার মত বেকার ছেলেকে, কে মেয়ে দেবে? "দ্যা পাওয়ার অফ ওম্যান" বলে একটা গল্প পড়েছিলাম, একটা মেয়ের অনেক ক্ষমতা থাকে। বেকার ছেলের সাথে বিয়ে হলেও সংসারের প্রয়োজনে সে তার বেকার স্বামীকে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজে পাঠাতে পারবে, কাজে উৎসাহ দিতে পারবে।
সারা জীবন ভালোবেসে, ভালোবাসার ছেলেটি চাকরি পায়নি বলে বিয়ে হলো না, বিয়ে হলো পয়সা দিয়ে কিনা চাকরিজীবীর সঙ্গে। কাজের কাজ কি হলো, মন পরে থাকলো একজনের কাছে আর কাঠামো দেহ বা শরীরটা থাকলো চাকরিজীবীর কাছে সংসার করার জন্য। যা সারা জীবন সাংসারিক জীবনে অশান্তি দেখা দেয়। মন থেকে বর্তমান স্বামীকে ভালবাসতে পারেনা। যদি কখনো জানাজানি হয়, অনেক দেরি হয়ে যায়। তখন আর কারো কিছু করার থাকে না।
দুই ভদ্রলোক বসে আছে পাশাপাশি 'পণপ্রথার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠানে' প্রথম ভদ্রলোক, দ্বিতীয় ভদ্রলোককে বলছে আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করলাম।অমুক গ্রামের একজন ভালো চাকরিজীবী ছেলের সাথে। পরের দিন দ্বিতীয় ভদ্রলোক, সেই গ্রামে সেই বাড়িতে হাজির, প্রথমজন যা টাকা দিতে চেয়েছে তার দ্বিগুণ দিয়ে দ্বিতীয়জন নিজের মেয়ের বিয়ে ঠিক করে চলে আসে। অথচ দুইজনই 'পণ প্রথা বিরোধী' সংগঠনের সম্মানীয় সভ্য। সমস্তটাই বাস্তব চিত্র।আমার আবার প্রশ্ন, পণপ্রথার জন্য আসল দায়ী কারা?
আরেকটা কথা না লিখলে প্রবন্ধটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, একশভাগ চাকরিজীবী ছেলের মধ্যে 95 ভাগ চাকরিজীবী ছেলে বেকার মেয়েকে বিয়ে করে। তাতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু একশভাগ চাকরিজীবী মেয়ে 98 ভাগ চাকরিজীবী ছেলেকে বিয়ে করে বা বিয়ে করতে চাই, তারা যদি বেকার ছেলেদের কে বিয়ে করত। তাহলে সামাজিক ভারসাম্য অনেকটা বজায় থাকত। পণপ্রথা ব্যধিটাও অনেকটা কমতো। আফসোস! এর উত্তর কে দেবে।
পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়। বিনা পণে বিয়ে কি হচ্ছে না? হচ্ছে।তবে তা খুবই অল্প,একেবারে নগণ্য, মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হবে।