"টিকিট প্লিজ" বলে টিটি আমার কাছে এসে দাঁড়াতে আমি একটু অবাকই হলাম। বললাম "এইমাত্র টিকিট দেখালাম যে!" টিটি বলল "আপনার নয়, আপনার সিটের নিচে আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছি যে।""বেরিয়ে এসো", বলতেই দেখি একটা বছর তেরো কিংবা চৌদ্দর মেয়ে অস্বাভাবিক কান্নাকাটি করছে। টিকিট তো নেইই। তার উপর শীর্ণ, অভুক্ত, মলিন একটা মুখ। টিটি বলল "ভাগো ইঁহা সে।" আমি জিজ্ঞেস করলাম "কোথায় নামবে তুমি?" কোন উত্তর নেই, শুধু কান্নাকাটি। বাধ্য হয়ে টিটিকে বললাম "ওর ভাড়া আমি দিয়ে দিচ্ছি, একদম শেষ স্টেশন ব্যাঙ্গালোর অবধি টিকিট দিন।" টিটি বলল "কেন ফালতু এতগুলো টাকা নষ্ট করবেন, দিদি?" তবুও কি যেন ভেবে বললাম "না, আপনি টিকিটই দিয়ে দিন। মেয়েটি শুধুই কাঁদছে। অন্তত ট্রেনের শেষ গন্তব্যস্থল অবধি টিকেট কাটা থাকুক। মধ্যিখানে যেখানে মন চায়, সেখানে কোথাও নেমে যাবে হয়তো।"আমায় অবাক করে মেয়েটি কোথাওই নামল না। আমি নাম জানলাম, ওর নাম চিত্রা। নিজের বাবা-মা কেউই নেই দুনিয়ায়। সৎ মা নাকি খুব খাটায় এবং মারে। সে তাও সহ্য করে নিয়েছিল, কিন্তু খেতে দিত না যে। খিদের জ্বালায় পালিয়ে এসেছে। শুধু এটুকু ভেবেছে যে, ওই নরকের চেয়ে অন্ততঃ ভালো থাকবে। ব্যাঙ্গালোরে নামলাম। শুধু একবার পিছন ঘুরেছি, দেখি চিত্রা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। টিকিট কাটার সময় একবারও ভাবিনি এই মেয়েটার দায়িত্ব নিতে হতে পারে। আমার পক্ষে এ- গুরু দায়িত্ব নেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব নয়, আমি অফিসিয়াল কাজে ট্যুরে আছি। তবুও বললাম "এসো আমার গাড়িতে এসো।" অফিসের গাড়ির ড্রাইভার অবাক হয়ে বারবার দেখছে। আমার এক বন্ধু আছে রাম প্রসাদ। সে মেয়েদের শেলটার দেয়, আরো সমাজসেবা মূলক কাজ করে। ওর ওখানে চিত্রাকে দিই আর বলি, আমাদের প্রতিষ্ঠান ওর সমস্ত দায়িত্ব নেবে। থাকতে চাইলে থাকবে, নয়তো আবার পালাবে মেয়েটা। ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা হঠাৎ মনে পড়তে দেখতে গেলাম। কি হাসিখুশি হয়েছে এখন চিত্রা আর পড়াশোনায় ভারী আগ্রহ। ও স্কুলে আবার ভর্তি হতে চায়। এভাবেই চলতে লাগল। ওকে একদিন গিয়ে বলেও এলাম, তুমি যতদূর পড়তে চাও পড়তে পারো। আমরা তোমার দায়িত্ব নিয়েছি। আমায় অবাক করে বলল, "না দিদি, আমি খুব তাড়াতাড়ি একটা চাকরি পেতে চাই। তাই কম্পিউটার সায়েন্স এ ডিপ্লোমা করব।" তারপর প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা। হঠাৎ একদিন বিদেশ থেকে ইমেল পেলাম চিত্রার। ও বিদেশে চাকরিতে খুব উন্নতি করেছে আর এখন খুব হাসিখুশি সুন্দর জীবন ওর। ইমেল পড়ে ভগবানকে বললাম, ওর মুখের হাসি যেন এমনিই থাকে। এবারে সানফ্রান্সিসকোতে একটা লেকচার দিতে গিয়েছি। যখন হোটেল থেকে চেক আউট করব , গিয়ে দেখি রিসেপশনিস্ট বলছে, "স্যার, আপনার সমস্ত বিল ফুললি পেইড। ওই লেডি নিশ্চয়ই আপনাকে খুব ভালো করে চেনে।"খুব অবাক হয়ে চারিদিকে দেখলাম, দেখি একজন ভদ্রমহিলা সুন্দর একটা শাড়ি পরা, একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। পাশে ফরেনার বর। কি সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে ছোট ছোট চুলে। ও মা, এতো দেখি সেই চিত্রা। এসে আমায় জড়িয়ে ধরল।"চিত্রা তুমি আমার সমস্ত বিল কেন পে করবে?" আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল "কারণ তুমি একদিন আমার সমস্ত বিল পে করেছিলে। আমার সমস্ত জীবনটাই যে ওই পেমেন্টের ওপর দাঁড়িয়ে। সেই বম্বে টু ব্যাঙ্গালোর।" এই ঘটনা ইনফোসিসের কো-ফাউন্ডার সুধা মূর্তি তাঁর ব্লগে লিখেছিলেন। এই ঘটনা থেকেই যেন তাঁকে খানিকটা চেনা যায়। তিনি বিয়ের আগে ছিলেন সুধা কুলকার্নি। সেই সুধা যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইলেন বাড়ির সবাই বলেছিলেন আমাদের কমিউনিটিতে কিন্তু ছেলে পাওয়া যাবে না। তোমার বিয়ে হবে কি করে? প্রসঙ্গত সুধাদেবীর বাবা ডাক্তার ছিলেন, খুব নাম...