পোস্টস

গল্প

পাপা পানভ’স স্পেশাল ক্রিসমাস

১৪ জুলাই ২০২৪

আবু আদনান

মূল লেখক রুবেন স্যাইলেন্স (Ruben Saillens)

অনুবাদক আবু আদনান

ক্রিসমাস ইভ।

        বিকেলের আলো এখনো উজ্জ্বল। কিন্তু তারপরেও ছোট্ট রাশিয়ান গ্রামটার বাড়ি আর দোকানগুলোতে একটা একটা করে জ্বলে উঠছে সাঁঝবাতি। কারণ শীতের সময়টাতে দিনগুলো এই অঞ্চলে বড্ড ছোট। বিকেলের আলো মিলিয়ে যেতে না যেতেই ঝপ করে নেমে আসে আঁধারের চাদর।

        দুয়ারে দাঁড়ানো ক্রিসমাসের আনন্দে ঝলমল করছে শিশুরা। হইচই করতে করতে ঢুকে যাচ্ছে যার যার বাড়ির ভেতর। বদ্ধ জানালার ফোঁকর গলে ভেসে আসছে ওদের উচ্ছ্বাস আর হাসি-আনন্দের চাপা কলধ্বনি। 

        এই গাঁয়ের-ই মুচি বুড়ো পাপা পানভ। 

        ক্রিসমাসের ইভের আবহটা আরেকবার উপভোগের জন্য দোকানের দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে আসে সে। এই আনন্দে মুখর ধ্বনি, উৎসবের উজ্জ্বল আলো আর দূর থেকে ভেসে আসা মৃদু কিন্তু সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ পাপা পানভকে মনে করিয়ে দেয় অতীতের ক্রিসমাসগুলোর কথা। তখনও পরপারে পাড়ি জমায়নি তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। আর বাচ্চারাও আজকের মত বড় হয়ে উঠেনি। সময়ের পরিক্রমায় সবাই আজ তাকে ছেড়ে চলে গেছে বহুদূরে। স্টিলের ফ্রেমের ওপারে পাপা পানভের হাসিখুশিমাখা চোখদুটো আজ বড্ড বিষণ্ণ। ঘুরে দাঁড়ায় পাপা পানভ। দৃঢ় পদক্ষেপে ভেতরে প্রবেশ করে শাটার নামিয়ে দেয় দোকানের। কাঠকয়লার চুলোতে কফির পটটা চাপিয়ে দিয়ে আর্মচেয়ারটাতে গিয়ে বসে সে। বুকের গভীর থেকে হাহাকার তুলে বেরিয়ে আসে একটা একাকী দীর্ঘঃশ্বাস।    

 

এমনিতে নিয়মিত বই পড়ার অভ্যেস নেই পাপা পানভের। তবে আজ রাতে সে হাতে তুলে নেয় পুরনো ভারি পারিবারিক বাইবেলটা। ধীরেধীরে তর্জনী বুলিয়ে সে পড়তে শুরু করে ক্রিসমাসের কাহিনী। সে পড়তে থাকে কীভাবে মা মেরি আর জোসেফ বেথেলহেমে যাত্রা করার পথে ক্লান্ত হয়ে আশ্রয় খোঁজে সরাইখানায় আর শেষ পর্যন্ত সেখানে জায়গা না পেয়ে আশ্রয় নেয় এক গোশালায়। আর সেখানেই জন্ম নেয় মা মেরির পুত্র মহান যীশু।

‘আহা,’ দরদভরা কণ্ঠে স্বগতোক্তি করে পাপা পানভ, ‘কত কষ্টই না সইতে হয়েছে ওঁদের। ওঁরা যদি মাত্র একটিবারের জন্যে হলেও আমার এখানে আসতো তাহলে ওঁদের সেবায় ছেড়ে দিতাম আমার এই বিছানা। নিষ্পাপ যীশুকে উষ্ণতায় জড়িয়ে রাখতাম আমার গরম চাদরটায় মুড়ে।’

 

পড়তে থাকে পাপা পানভ। পড়তে থাকে সেই বিজ্ঞ আর জ্ঞানী লোকদের কথা যারা প্রভু যীশুর আগমনবার্তা অনুভব করে দেখতে এসেছিলেন তাঁকে। আর সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন নানারকম উপহার। এইটুকু পড়ে খানিকটা দুঃখ পায় সে। কুণ্ঠিত হয়ে ভাবে, ‘অবশ্য আমার এখানে এলে প্রভু যীশুকে কি-ই বা উপহার দিতাম আমি? তাঁকে দেবার মত কিছুই যে আমার নেই।’ 

 

সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠে তার চেহারা। মনে পড়ে যায় একটা জিনিসের কথা। হাত থেকে বাইবেলটা নামিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। ছোট্ট ঘরটার উঁচু তাক থেকে দীর্ঘ হাত বাড়িয়ে নামিয়ে আনে ধুলোপড়া একটা ছোট্ট বাক্স। ধীরে ধীরে বাক্সটা খুলতে থাকে সে। ওটার ভেতরে রাখা আছে খাঁটি চামড়ার তৈরি চমৎকার একজোড়া ছোট্ট শিশুদের জুতা। অসাধারণ কুশলী হাতের বানানো এই মোলায়েম জুতোজোড়া পাপা পানভের নিজ হাতে বানানো। তার হাতে গড়া শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। ঠিক আগের মতই আছে ওগুলো। হাসি ফুটে উঠে পাপা পানভের মুখে। প্রভু যীশুকে দেবার মত একেবারেই যে কিছু নেই তার, এটা ভুল। নিষ্পাপ ছোট্ট যীশুকে এই দারুণ জুতোজোড়া উপহার দিতে পারত পাপা পানভ। বাক্সটা আবার আগের জায়গায় রেখে সন্তুষ্টচিত্তে চেয়ারে ফিরে আসে সে।  

 

সারাদিনের খাটা-খাটুনির পর ভীষণ ক্লান্ত বোধ করে পাপা পানভ। যতই পড়তে থাকে ততই ঘুমে ভারি হয়ে আসে দু’চোখের পাতা। বাইবেলের হরফগুলো যেন জ্যান্ত হয়ে নাচানাচি করতে থাকে তার চোখের সামনে। অগত্যা চোখ বন্ধ করে সে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হারিয়ে যায় গভীর ঘুমের রাজ্যে। 

 

ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যেতেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে পাপা পানভ। সে দেখে কেউ যেন অতিথি হয়ে এসেছে তার ঘরে। অবাক হয়ে পাপা পানভ আবিষ্কার করে যে আগন্তুক ব্যক্তি আর কেউই নয়, স্বয়ং মহান যীশু নিজে।

দয়াদ্র কণ্ঠে মহান যীশু বলেন, ‘তুমি আমাকে দেখতে চেয়েছিলে, পাপা পানভ। তাই এসেছি আমি। যদি স্বপ্নের মত বাস্তবেও আমার সান্নিধ্য লাভ করতে চাও, তাহলে প্রস্তুত থেকো। আগামীকাল, ক্রিসমাসের দিনে আমি দেখা দেব তোমায়।’

 

যখন ঘুম ভাঙল পাপা পানভের তখন ভোর হয়ে গেছে। ঘণ্টাধ্বনির মিষ্টি রেশ ছড়িয়ে পড়ছে ধরণীর বুকে। ভোরের মোলায়েম আলোকরশ্মি দরজার ফাঁক-ফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে তার ঘরে। জেগে উঠতেই অবারিত আনন্দে নাচন জাগে পাপা পানভের মনে। চেয়ার থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙে সে। বলে উঠে, ‘আহা! কী আনন্দ! আজ ক্রিসমাস!’    

        স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায় তার। মনে মনে ভাবে, এবারের এই ক্রিসমাসটা একেবারেই আলাদা। একেবারেই অন্যরকম। আজ যে প্রভু যীশুর আগমন ঘটতে যাচ্ছে তার বাড়িতে! কী রূপে আসবেন মহান যীশু? কেমনই বা দেখা যাবে তাঁকে? ছোট্ট কোনও শিশু হয়ে? ঠিক যেভাবে প্রথমবার তিনি নেমে এসেছিলেন এই পৃথিবীর বুকে। না কী কোনও পূর্ণবয়স্ক মানুষ হয়ে? না কী তাঁর চিরচেনা মহিমান্বিত রূপেই পাপা পানভকে দেখা দেবেন তিনি! ভাবতে ভাবতে পুলকিত হয় সে। ভাবে, আজকে তীক্ষ্ণ নজর রাখবে সে আশেপাশে। যে রূপেই যীশু আসুক না কেন, তাঁকে সে ঠিক চিনে নেবে। 

        চুলোয় কেটলি চড়িয়ে দোকানের ঝাঁপ তোলে পাপা পানভ। জানালা দিয়ে তাকায় বাইরে। রাস্তাটা একেবারেই জনমানবহীন। কেউ এখনও বেরিয়ে আসেনি ঘর থেকে। শুধুমাত্র একজন ঝাড়ুদারকে দেখা যাচ্ছে। লোকটাকে দেখেই মনে হচ্ছে বড্ড গরিব। ধুলোময়লা মাখা মলিন পোশাক। আর তার চেয়েও মলিন লোকটার চেহারা। অবশ্য গরিব না হলে কী আর এই ক্রিসমাসের দিনেও কাজ করতে বেড়োয় বাইরে। তাও আবার এই সাতসকালের তীব্র ঠাণ্ডায় আর কুয়াশার মাঝে। 

        দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে পাপা পানভ। দরজা খোলার সাথে সাথে একপশলা দমকা শীতল বাতাস প্রবেশ করে ঘরে। চিৎকার করে লোকটাকে ডাকে সে। ‘এইযে শুনছো! এদিকে এস। ভেতরে এসে একটু কফি খেয়ে যাও। শরীরটা একটু চাঙা হবে।’

        মুখ তুলে তাকায় ঝাড়ুদার। নিজের কানকেই যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মত এক নোংরা গরিবকে কেউ কী না ঘরে ডাকছে কফি খাওয়ার জন্যে! ঝাড়ুটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে আসে সে। অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রবেশ করে ঘরের উষ্ণতায়। হাতদুটো সেঁকে নেয় চুলার আগুনে। তীব্র শীতের সাথে যুঝতে থাকা কম্পমান হাতদুটো দিয়ে তুলে নেয় কফির মগটা। ছোট ছোট চুমুক দিতে থাকে। পাপা পানভ সন্তুষ্ট দৃষ্টিতে দেখতে থাকে লোকটাকে। আর এরই ফাঁকে ফাঁকে জানালা দিয়ে নজর বোলায় বাইরে। 

কোনও পথচারীকেই হারানো চলবে না। 

যে করেই হোক প্রভু যীশুকে চিনতেই হবে।

...তাঁকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না কিছুতেই। 

        ‘আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?’ প্রশ্ন করে ঝাড়ুদার। তাকে স্বপ্নের কথা খুলে বলে পাপা পানভ। 

        ‘তিনি নিশ্চয়ই আসবেন।’ জবাবে বলে ঝাড়ুদার। ‘আপনি আমার জন্য যা করলেন তা আমি কখনওই ভুলব না। আমার মত হতদরিদ্র মানুষদের জন্যে এরচেয়ে ভাল আর কোনও ক্রিসমাসের উপহার হয় না। আপনার মত পরোপকারী সৎ মানুষকে দেয়া কথা প্রভু অবশ্যই রাখবেন।’ মৃদু হেসে বেরিয়ে যায় ঝাড়ুদার। 

        লোকটা চলে গেলে খাবারের জন্য চুলোয় বাঁধাকপির সুপ চড়ায় পাপা পানভ। তারপর দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। ছদ্মবেশী বা অপরিচিত কোনও আগন্তুকের খোঁজে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে চারিপাশে।

        নাহ, কেউই তো নেই। একেবারেই জনমানবশূন্য নিস্তব্ধ বিরান পথঘাট যেন খাঁ খাঁ করছে। 

        হঠাৎ করে একটা নড়াচড়া চোখে পড়ে পাপা পানভের। ওই তো দেখা যাচ্ছে একটা মানুষকে। তবে পুরুষ মানুষ নয়, একটা কমবয়েসী মেয়ে। তুষারাবৃত পিচ্ছিল পথে খুব সাবধানে হেঁটে আসছে মেয়েটা। পড়ে যাওয়া ঠেকানোর জন্যে দেয়াল আর লোকের বাড়িঘরের বেড়া ধরে খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে আসছে। মেয়েটার হাতে কিছু একটা ধরা। কোনও পুঁটলি বা এরকম কিছু একটা। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে যে বেশ দূর থেকে হেঁটে আসছে সে। পথশ্রমে একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছে বেচারি। আরেকটু কাছে এগিয়ে আসতেই পাপা পানভ বুঝতে পারল যে মেয়েটার হাতে ওটা কোনও পুঁটলি বা বোঝা নয়, বরং চাদরে পেঁচানো ছোট্ট একটা মানবশিশু। মেয়েটাকে দেখে খুব কষ্ট পেল পাপা পানভ। আহারে বেচারি! এই শীতের মধ্যে এতটুকুন বাচ্চাকে নিয়ে না জানি কত কষ্ট হচ্ছে বেচারির। নেহায়েতই বাধ্য না হলে এরকম প্রতিকূল আবহাওয়ায় কেউ কী আর দুধের শিশুকে বুকে জড়িয়ে ঘর থেকে বেরোয়! 

        মেয়েটা নিকটবর্তী হলে এগিয়ে যায় পাপা পানভ। বলে, ‘একটু ভেতরে আসবে, মা? মনে হচ্ছে হাঁটতে হাঁটতে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছ তুমি। তোমার আর তোমার বাচ্চাটার-দুজনের জন্যেই একটু আগুনের তাপ আর বিশ্রাম এখন খুবই দরকার।’

        সম্মতি জানায় তরুণীটি। পাপা পানভের পেছন পেছন সে প্রবেশ করে ভেতরে। তারপর আর্মচেয়ারটাতে হেলান দিয়ে বসে ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস। ‘বাচ্চাটার জন্যে একটু দুধ গরম করে আনছি। চিন্তা কোরো না। আমার নিজেরও বাচ্চাকাচ্চা ছিল। ওকে আমিই খাওয়াতে পারব’ বলে পাপা পানভ। চুলা থেকে দুধ গরম করে নামিয়ে আনে সে। ছোট একটা চামচে করে খাওয়াতে থাকে শিশুটাকে। একইসাথে ব্যস্ত হয়ে পরে ওর ছোট্ট পা দুটোকে আগুনের তাপে গরম করতে। 

        ‘একজোড়া জুতো দরকার ওর,’ মন্তব্য করে পাপা পানভ। 

        তরুণী মা জবাব দেয়, ‘জুতো কেনার সামর্থ আমার নেই। আমার স্বামী মারা গেছে। খুবই কষ্টে আর অভাব অনটনে কাটছে দিন। খাবার জোগাড় করতেই প্রাণাতিপাত করতে হয়। এখন যাচ্ছিলাম পাশের গ্রামে কাজের খোঁজে।’

        মেয়েটার কথায় মন খারাপ হয়ে যায় পাপা পানভের। তারপর হঠাৎই একটা চিন্তা খেলে যায় মাথায়। বাক্সে তুলে রাখা জুতোজোড়ার কথা মনে পড়ে যায় তার। জুতোজোড়া সে তুলে রেখেছিল প্রভু যীশুর জন্যে। কিন্তু নিষ্পাপ শিশুটির বরফশীতল ঠাণ্ডায় নীল হয়ে যাওয়া পা দুটোর দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে। মায়ের কোলে শিশুটি আর জুতোজোড়া তুলে দিতে দিতে বলে, ‘দেখ তো, এটা ওর পায়ে লাগে কী না।’ 

        বাচ্চা মেয়েটার পায়ে খুব সুন্দর করে এঁটে যায় জুতোজোড়া। স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে তরুণী মা’র চেহারা। শিশুটাও যেন গার্গল করে ধন্যবাদ জানায় পাপা পানভকে। 

        মেয়েকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ায় মা। পাপা পানভের উদ্দেশ্যে বলে, ‘আপনার এই মহানুভবতা ধন্যবাদ দেবার মত নয়। প্রার্থনা করি, ঈশ্বর যেন আপনার প্রতিটি ইচ্ছা পূরণ করেন।’ এই বলে বেরিয়ে যায় মা ও মেয়ে। ওদেরকে বিদায় জানিয়ে চেয়ারে বসে পাপা পানভ। তার মন আচ্ছন্ন হয়ে আসে প্রভু যীশুর চিন্তায়। তবে কী প্রভু যীশু কথা রাখবেন না! দেখা দেবেন না পাপা পানভকে? সে কী কোনও পাপ করেছে! না কী তার কোনও আচরণে রুষ্ট হয়েছেন মহান যীশু! চিন্তিত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় সে। অনেক মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায় এখন। কিন্তু এরা সবাই তার চেনা। পরিবারের সাথে সময় কাটাতে চলেছে সবাই। ওরা সবাই পাপা পানভের সাথে কুশল বিনিময় করে। হাসিমুখে জানায় ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা। ওদের ছাড়া কিছু গরিব দুখী ভিক্ষুকদেরকেও দেখা যায় রাস্তায়। কাউকেই যেতে দেয় না পাপা পানভ। আমন্ত্রণ জানায় ঘরে। আপ্যায়ন করে গরম সুপ আর রুটি খাইয়ে। আবার একইসাথে বাইরের রাস্তায়ও রাখে সজাগ দৃষ্টি। যাতে অপরিচিত কেউ মিস হয়ে না যায়। 

        এভাবেই কেটে যায় সারাটা দিন। দ্রুত নেমে আসে শীতের সন্ধ্যা। 

        পাপা পানভ তারপরেও দাঁড়িয়ে থাকে দোরগোড়ায়। পথিকের উদ্দেশ্যে তাকাতে থাকে এদিক ওদিক। কিন্তু আঁধার নেমে আসায় দূরের পথিকেরা এখন আর দৃষ্টিগোচর হয় না। তাছাড়া মানুষজনও এখন আর নেই রাস্তায়। সবাই ফিরে গেছে যার যার নিবাসে। ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে আসে ভগ্নহৃদয় পাপা পানভ। ঝাঁপ নামিয়ে গিয়ে বসে আর্মচেয়ারে। ভগ্ন মনোরথে ভাবে, নিছকই একটা স্বপ্ন ছিল তাহলে এটা। প্রভু যীশুকে কল্পনা করে নিয়েছে তার অবচেতন মন। তিনি আসবেন না তার মত এক সামান্য মুচিকে দেখা দিতে। 

        তারপর সহসাই অদ্ভুত এক অপার্থিব অনুভূতি জাগে তার মনে। এ এক অন্যরকম অনুভব যা সম্ভব নয় ভাষায় প্রকাশ করা। আবারও তার মনে হয় যে, সে একা না, আরও মানুষ এই ঘরে উপস্থিত আছে তার সাথে। তবে এবার আর গতরাতের মত ঘুমিয়ে নেই সে। জেগে আছে পুরোপুরি। হঠাৎ করেই যেন দিব্যদৃষ্টি পেয়ে যায় পাপা পানভ। চোখের সামনে সে দেখতে পায় একের পর এক অপরিচিত মানুষকে। পাপা পানভ চিনতে পারে তাদেরকে। এরা সকলে সেই সব মানুষ যাদেরকে সে আজ সকাল থেকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, ভাল ব্যবহার করেছে আর ডেকে এনে আপ্যায়ন করেছে ঘরে। সেই ঝাড়ুদার আর অসহায় তরুণী মা-মেয়েকে দেখতে পায় সে। দেখতে পায় ভিক্ষুকদেরকেও। 

        তারা এক সারিতে হেঁটে হেঁটে পার হয়ে যায় পাপা পানভের পাশ দিয়ে। যাওয়ার সময় প্রত্যেকে ফিসফিস করে যায় তার কানে, ‘আমাকে চিনতে পারলে না পাপা পানভ?’

        বিস্ময়ে বিমূঢ় পাপা পানভ বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলে, ‘কে তুমি? কারা তোমরা?’

        কিন্তু ওরা কেউ জবাব দেয় না। জবাব দেয় অন্য একটা কণ্ঠ। এটা সেই কণ্ঠ যা সে শুনতে পেয়েছিল গতরাত্রে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার পর। 

        প্রভু যীশুর কণ্ঠ। 

        তিনি বলেন, ‘আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে খাবার দিয়েছ। আমার গায়ে কাপড় ছিল না, তুমি আমাকে বস্ত্রাবৃত করেছ। শীতের তীব্রতায় আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম, আমাকে উষ্ণতা দিয়ে সাহায্য করেছ তুমি। তুমি যাদেরকে আজ অন্ন, বস্ত্র আর ভালবাসা দিয়ে সাহায্য করেছ, তারাই আমি, তাদের মাঝেই আমি সদা বিরাজমান।’

        তারপর হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে যায় প্রকৃতি। চারদিকে শুনশান নীরবতা। 

        শুধুমাত্র একটা আওয়াজই ভেসে আসে পাপা পানভের কানে। দেয়ালে ঝোলানো বড় ঘড়িটার টিক টক ...টিক টক ...টিক টক। অপার্থিব স্বর্গীয় আনন্দে ভরে উঠে পাপা পানভের হৃদয়। আর্মচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। আনন্দে গাইতে থাকে গান আর নাচতে থাকে মনের আনন্দে। একটা কথাই শুধু বলতে পারে সে।

        ‘তিনি তাহলে সত্যিই এসেছিলেন!’