পোস্টস

গল্প

সোনালী শাহজাদা

২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মাসুদ হোসেন

মূল লেখক গল্পের উৎস: রাশিয়ার রূপকথা।

অনুবাদক মাসুদ হোসেন

সোনালী শাহজাদা

জিয়ন কাঠি। ছোঁয়ালেই জেগে ওঠে সব। সোনার কাঠি রূপোর কাঠি অদল-বদল করলেই গোলাপ ফুলের পাপড়ির মতো চোখের পাতাগুলো কাঁপতে কাঁপতে খুলে যায়।

বিরাট দীঘি। থই থই করে পানি। তার মাঝখানটাই সিন্দুক। তার ভিতর সোনার কৌটো। তারও ভিতর আছে ভোমরা। কুচকুচে কালো ভোমরা। নিঃশ্বাস বন্ধ করে এক ডুবে আনতে হয় সোনার কৌটা। তারপর দু’আঙ্গুলের মাঝখানটায় এনে শক্ত করে একটা চাল দিলেই সব সব শেষ। দৈত্য-দানোবরা মরে যায়। রাক্ষস-খোক্ষসরা ভয়ে পালায়। নিঝুমপুরী গমগম করে। নহবতখানায় আবার নহবত বাজে। ঘোড়াশালে ঘোড়া জাগে। হাতীশালে হাতী জাগে। আরো জাগে পাখ-পাখালি, গাছের ডালে ডালে।

ফুলে ফুলে প্রজাপতি, লাল-নীল-হলুদ। নিঝুমপুরীতে আলো জ্বলে। ঝলমল করে। ফক ফক করে। সেখানে এখন হাসি আর হাসি। আলো আর আলো।

এমনি করে দিন যায়। মাস যায়। বছরও চলে যায়। একদিন। নিঝুমপুরীর বাসিন্দারা বেখেয়াল হয় হাসতে হাসতে। আর রাক্ষস-খোক্ষসের ছেলেরা ভাবে, এই তো সুযোগ। এ সুযোগ হাতছাড়া করে না তারা। আবার আসে। নিঝুমপুরীর সব হাসি আবার থেমে যায়। আলো নিভে যায়। শুকসারি গান গায় না। পাখি নেই। প্রজাপতি নেই। খুশি নেই। আনন্দ নেই। সব উধাও হয় নিমিষে। সোনার কাঠি রূপোর কাঠি অদল-বদল করে দেয় তারা, আবার। আর অমনি সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। নিঝুমপুরী  রাক্ষস-খোক্ষসের কবজায় চলে যায়।

দিন যায়। মাস যায়। বছর যায়। অনেক বছর। নিঝুমপুরী আর জাগে না। হাসে না। দৈত্য-দানো আর রাক্ষস-খোক্ষসদের মনের ভিতর এখন খুশির ঢেউ। ওঠে আর নামে। তারা ধপ ধপ করে হাঁটে। মাটি কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে হাঁটে। ঘর—বাড়ি কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে হাঁটে। আনন্দে লুটোপুটি খায়। হৈ-হুল্লোড় করে।

অনেকদিন পর। অনেক বছর পর। পঙ্খীরাজে চড়ে আসে আর এক শাহজাদা। মেঘের পাহাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে। সাগর-নদী-বন কেটে কেটে। পুরীর চূড়ায় এসে থামে তার পঙ্খীরাজ। খাপ থেকে তলোয়ার খুলে নেয় শাহজাদা। ব্যাপার দেখে সরদার দৈত্যটার চোখ বড় হয়ে যায়। আর অন্য দৈত্যগুলো ভয়ে পুকুরের ঢেউয়ের মতো কাঁপতে থাকে। তবু শাহজাদার সাথে যুদ্ধ করে তারা। তুমুল যুদ্ধ। নিঝুমপুরীর দেয়ালগুলো লাল হয়ে যায়। লালে লা হয়ে যায় চত্বর। এক লণ্ডভণ্ড অবস্থা। শেষমেশ দৈত্য-দানোরা পালিয়ে যায়, রণে ভঙ্গে দিয়ে। দূরে বহু দূরে। নিঝুমপুরী আযাদ হয়। সোনার কাঠি রুপোর কাঠি অদল-বদল করে দেয় বীর শাহজাদা। জেগে ওঠে সব আবার। তারপর হাসি আর খুশির হুল্লোড়। সারা নিঝুম-পুরীর শরীর জুড়ে স্বপ্ন আর স্বপ্ন।

তারপর? তারপর তো এ গল্পের শেষ। কিন্তু শেষ বললেই কি আর শেষ করা যায়। শেষেরও তো একটা রেশ থাকে। এখন সেই রেশের গল্প। এতো সময় ইনিয়ে বিনিয়ে যা বলা হলো, তা তো রূপকথার কাহিনি। কল্পনার পলকে উড়াল দিয়ে আকাশের নীলে হারিয়ে যাবার কাহিনি। এখন বাস্তবের দিকে চোখ ফেরানো যাক। আকাশের নীল থেকে একাবারে আমাদের এই সবুজ পৃথিবীতে। এখানে আছে মানুষ, পশু-পাখি, লতা-পাতা, গাছ-বৃক্ষ, নদী-সাগর আরো কতো কি। তাই তাদের নিয়ে আছে কতো গল্প, কতো কাহিনি। কখনো গা হিম করা, আবার কখনো খুশির ঝিলিক দেয়া। বিশেষ করে আমাদের মতো মানুষজনদের নুয়ে তো কতো গল্পই না ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এখানে-সেখানে। শুনলে মনে হয়, এ-ও যেন এক রূপকথার কাহিনি। আসলে এর সব ক’টাই কিন্তু বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঝলমলে সত্য। এখন সেই বাস্তবেরই গল্প। মানুষের গল্প। এই দুনিয়ার গল্প।

হযরত আদম আলাইহিস সালাম ছিলেন এই দুনিয়ার প্রথম পুরুষ মানুষ। আর বিবি হাওয়া প্রথম নারী। এখন আমরা যারা দুনিয়ায় আছি, তারা সবাই তাদেরই ছেলেপুলে। মোটকথা, হযরত আদম আলাইহিস সালাম হলেন আমাদের সবার আদি পিতা। বিবি হাওয়া হলেন আদি মাতা।

এজন্যেই তাদের বলা হয় বাবা আদম আর মা হাওয়া। তারা কি করে দুনিয়ায় এলেন-এ নিয়ে অনেক বড় গল্প আছে। তবে অল্প কথায় সে গল্প হলো, বাবা আদম এবং মা হাওয়া আল্লাহর নিষেধ না শুনে গুনাহ করেছিলেন। অবশ্য ইবলিস অর্থাৎ শয়তানই তাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে  সে গুনাহের ফাঁদে ফেলেছিলো। আর শয়তানের কাজ তো একটাই, মানুষকে ফাঁদে আটকে দেয়া। গুনাহর দুর্গন্ধ শরীরে মেখে দেয়া। তবে আল্লাহর কথা স্মরণ থাকলে শয়তান কিন্তু মানুষের কাছে ঘেঁষতেও ভয় পায়। আগেই বলেছি, আদম-হাওয়া আল্লাহর নিষেধ ভুলে গিয়েছিলেন। তাই আল্লাহ তাদের দু’জনকেই এই দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন বেহেশতের বাগান থেকে। এটা ছিল তাদের শাস্তি। আল্লাহর কথা না শুনলে তো শাস্তি হবেই, এ কথা তারা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। তারা এ কথাও বুঝলেন, ইবলিসের সুন্দর সুন্দর কথায় বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি। তারা আল্লাহর কাছে মাফ চাইলেন। কান্নাকাটি করলেন। আল্লাহ তো দয়ার মহাসাগর। তিনি তাদের অপরাধ মাফ করে দিলেন। তখন তারা ঘর-সংসার শুরু করলেন এই দুনিয়ায়।

এক দুই তিন করে মানুষ বাড়ে। সংসার বাড়ে। সাথে বাড়ে মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধিও। বাড়ে মনের ভিতর আল্লাহর ভয়। শাস্তির ভয়। এ ভয়ই তাদের ফুলের পাপড়ি বিছানো পথে চালায়। আল্লাহর কাছাকাছি থাকতে শেখায়। সত্যের পাশা-পাশি হাটতে শেখায়। তাদের মনে হু হু করে সুখ-শান্তির ঠাণ্ডা বাতাস। হাসি-খুশির লাল-নীল প্রজাপতি। এ প্রজাপতি উড়তে উড়তে একদিন থেমে যায়। কারণ ঝিমিয়ে পড়ে বাতাস। বেশি বেশি হাসি আর আনন্দের কালো পলি ঢেকে ফেলে আল্লাহর আদেশ নিষেধ। আদম- সন্তানরা ভুলে যায় শাস্তির কথা। গুনাহর পরিণতির কথা। তার সৃষ্টিকর্তার কথা।

রূপকথার সেই নিঝুমপুরীর মানুষজনদের মতো তারা বেখেয়াল হয়। বেপথু হয়। আসলে সব কাজেরই তো একটা সীমা আছে। দেয়াল আছে। এ দেয়াল ডিঙালেই বিপদ। বেখেয়াল হলেই বিপদ। থেঁতলে যায় বুক, পাঁজর। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কষ্ট হয় চলতে ফিরতে। নিঝুমপুরীর মানুষজনরা হাসতে হাসতে বেখেয়াল হয়েছিল। এই সুযোগ দৈত্য-দোনোরা হাতছাড়া করে নি। তারা হৈ হৈ করে সে পুরী দখলে নিয়েছিলো। আদম-হাওয়ার সন্তানদের বেলায়ও একই অবস্থা। যেই তারা বেখেয়াল হয়, অমনি ইবলিস তার কাজে লেগে যায়। চোখের সামনে টাঙ্গিয়ে দেয় লোভ-লালসার রঙীন পোস্টার। আরো কতো কথার স্বপ্নিল মিছিল। মানুষ তখন ইবলিসের পিছন পিছন হাঁটে। বসে, ঘুমায়। তাদের চোখে তখন লোভ-লালসার স্বপ্ন।

এ-ই তাদের কাল হয়। কাল হয় ইবলিস আর ইবলিসের সাঙ্গ-পাঙ্গদের। মানুষের চারপাশে অন্ধকারের বিশাল বিশাল পাহাড়-পর্বত। অসত্য আর অন্যায়ের বিরাট বিরাট দিঘি। এসব দিঘিতে তারা হাবুডুবু খায়। অন্ধকারে হাটতে গিয়ে পা ভাঙ্গে, হাত ভাঙ্গে। স্বস্তি নেই। শান্তি নেই।

আল্লাহ তো দয়ার মহাসাগর। রহমতের শীতল ঝরণা। মানুষের এ উলট-পালট অবস্থায় তার দুঃখ হয়। কষ্ট হয়। তিনি উদ্ধারকারী পাঠান। তারা আসেন একের পর এক। শত শত বছর পর তারা আসেন। আসেন হাজার হাজার বছর পরও। এদেশে-সেদেশে তারা  আসেন। এ কালে-সেকালে তারা আসেন। আল্লাহর আদেশ-নিষেধের কথা। ভাল-মন্দের কথা। সাথে তাদের আলর একটা বড়সড় গোলক। যে গোলকের আলো অন্ধকার সাফ করে। গুনাহর ধুলিঝড়ে আটকে পড়া মানুষেরা আবার আলোর পথে আসে। মনের নরম ঘরটায় আল্লাহর কথাকে পুঁতে নেয়। ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করে, মাফ চায়। ইবলিশ তখন বেদিশা হয়। তার মনের খুশি থেমে যায়।

এভাবে এসেছেন আল্লাহর উদ্ধারকারী দল। নবী-রসূলগণ। তারা পথহারা মানুষকে পথের দিশা দিয়েছে। শেষবারের মতো আল্লাহ যাকে পাঠিয়েছিলেন, তিনি আমাদের প্রিয় রসূল হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি কালোয় ঢাকা দুনিয়াকে আলোতে এনেছিলেন। ইবলিসের টাঙানো লোভ-লালসার পোস্টারগুলো ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। তার ঘোড়ার খুরের আঘাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে গিয়েছিলো অসত্যের খসখসে শরীর।

তার ইন্তেকালের পরের কথা।

সময়ের পর্দা ঠেলে দিন যায়, মাস যায়। মানুষ আবার বেখেয়াল হয়। শয়তান তার লোভ লালসার পোস্টারগুলো ঠিকঠাক করে পথের বাকে বাঁকে লটকে দেয়। মানুষ তার ফাঁদে পড়ে হাবুডুবু খায়। পথহারা হয়, সত্যের পথ। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পরখ না করে চলাফেরা করলে তো এমন হবেই। কিন্তু এ কথাটা কে বলে দেবে? নবী-রাসূলের যুগ তো সেই কবেই শেষ। এ খবরটাও আল্লাহই জানিয়েছেন আমাদের।

তাহলে এখন উপায়? উপায় অবশ্য আছে। এরপরও উদ্ধারকারীগণ আসেন। তারাও যুগে যুগে আসেন। কালে কালে আসেন। প্রতি শতাব্দীর এ মাথায় সে মাথায় তারা আসেন। সত্যের নিশান দোলাতে দোলাতে তারা আসেন। ঘোড়ার খুরের ধূলি উড়াতে উড়াতে তারা আসেন। তারা আসেন যেনো একেকজন সোনালী শাহজাদা।

মোটকথা, এই দুনিয়ার যেখানেই অন্ধকার, সেখানেই তারা আলো হয়ে দেখা দেন। হাযিরা দেন এক প্রিয় বন্ধুর মতো। আপনজনের মতো। তারা কিন্তু কেউ নবীও নন, রসূলও নন। তবে তারা কারা? এমন একটা প্রশ্ন ঝট করেই করা যায়।

ইবলিসের এতসব আয়োজন যারা উলটে পালটে দেন তাদের বলা হয় মুজাদ্দিদ। নতুন কিছুই কিন্তু তারা আমদানি করেন না। আর তা করার কোন সুযোগও রাখেন নি আল্লাহ। তাই তারা কেবল সত্যের উপ জমে ওটাহ জঞ্জালের ধূলাবালি ছাফসুতর করেন মাত্র। তবে একটা কথা। তাদের সবাই যে মুজাদ্দিদের তালিকায় আসবেন এমন না-ও হতে পারে। তাতে কি! তারা তো একই পথে হাঁটাহাঁটি করেন। কেউ একটু বেশি পথ হাটেন, কেউ কম। এই যা তফাত। আর এটিও তো আল্লাহর ইচ্ছায়ই হয়।

তারা ঝড়ের বেগে আসেন। শতব্দীর এ-মাথায় সে-মাথায় তারা আসেন। নিঝুমপুরীর সেই শাহজাদার মতোই রূপর কাঠি সোনার কাঠি অদল-বদল করেন। যার আলোতে আদম-হাওয়ার সন্তানরা চিনে নেয় ভালো-মন্দের পথ। সাথে সাথে শয়তানের কুটিল চেহারাও।