এক ছিল বুড়ো গরীব চাষী। তার দুই ছেলে—কাসেম আর আলিবাবা। চাষি মরে গেলে তার সামান্য সম্পত্তি সমান ভাগ পেল দুই ভাই। এই সামান্য সম্পত্তি নিয়ে ছেলেরা নিজেদের ভাগ্যের উন্নতি করতে পারল না একটুও; তারা আরও গরিব, একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ল।
দুই ভাইয়ের স্বভাব ছিল সম্পূর্ণ উল্টে। কাসেম খুব লোভী, বড় কুটিল তার মন, অন্যদিকে আলিবাবার মন ফুলের মতো সুন্দর , সৎপথ থেকে কাজ করে বেচে থাকতে চায় সে। দুই ভাইয়ের যখন খুব কষ্টে দিন কাটছিল তখন হঠাৎ এক লােক সওদাগরের সুনজরে পড়ে গেল কাসিম। সওদাগরের সব বানিজ্যের কাজে কাসেম হল বিশ্বাসী আর যােগ্য কর্মচারী। সওদাগর এক সময় বুড়াে হয়ে কাজকর্মের শক্তি হারিয়ে ফেলল। তখন নিজের এক মেয়ের সঙ্গে কাসেমের বিয়ে দিল। সেই সঙ্গে তার সম্পত্তি দেখাশোনার ভারও পেল কাসেম। কাসেম হঠাৎ ধনী হয়ে উঠল ।
আলিবাবা বনে গিয়ে কাঠ কেটে আনে। সেই কাঠ বাজারে বিক্রি করে। এতে যা টাকা পায় তা দিয়ে কোনওরকমে খেয়ে-না-খেয়ে দিন কাটে। আলিবাবার স্বভাব ছিল মধুর। সবার সঙ্গে ছিল তার ভালো সম্পর্ক। প্রয়ােজন ছাড়া টাকা পয়সা খরচ করত না সে। জাঁকজমক করে দিন কাটত না তার; যা আয় কত তার মধ্য থেকে কিছু-না-কিছু পয়সা জমাত প্রতিদিন। এভাবে পয়সা জমিয়ে তিনটি গাছ কিনল আলিবাবা। সেই গাধার পিঠে করে বন থেকে কাঠ কেটে আনত সে।
অন্য এক কাঠুরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হল আলিবাবার। তার ধন-সম্পদ নেই: তবু বউ নিয়ে তার দিন কাটতে লাগল সুখে-শান্তিতে।
একদিন।
আলিবাবা প্রতিদিনের মতাে গাধা তিনটিকে নিয়ে বনে গেল কাঠ কাটতে। বনে গিয়ে গাধাগুলােকে ঘাস খেতে ছেড়ে দিল। তারপর আরেকটু গভীর বনের দিকে এগােল কাঠের খোঁজে। হঠাৎ দূর থেকে অনেকগুলাে ঘােড়ার খুরের শব্দ এল! একি দস্যুদলের ঘােড়ার খুরের শব্দ! নাকি রাজার সৈন্যদল এগিয়ে আসছে এদিকে? বিপদের গন্ধ পেল আলিবাবা। তাড়াতাড়ি একটা ঝুপড়ি গাছে উঠে, পাতার আড়ালে লুকিয়ে রইল। ভাবল দেখা যাক, কী ঘটে!
একটু পরে ঠিক সেই গাছের নিচে এসে থামল একদল ঘােড়সওয়ার । লােকগুলাে একেকটা যেন দেখতে ভয়ঙ্কর দৈত্যের মতাে । এটা বড় কোনও দস্যুদল না হয়েই যায় না! গাছের ডালে বসে ভয়ে কাঁপতে লাগল আলিবাবা । এমন ভয়ংকর মানুষ কখনও দেখেনি সে।
প্রত্যেকের ঘােড়ার পিঠেই অনেক মালপত্র। আলিবাবা যে গাছটার উপর লুকিয়ে আছে সেটা পেরিয়ে একটু সামনে গিয়ে গাছটার একেবারে গােড়ায় এসে থামল ওরা। চল্লিশ জনের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দেখতে যে লােকটা সে চেঁচিয়ে উঠল জোরে, চিচিং ফাক ।
আর অমনি পাহাড়ের গােড়ার মাটি গেল দুভাগ হয়ে। পাহাড়ের মধ্যিখানের একটা অংশে দেখা দিল ফাটল! মনে হল পাহাড়ের দুটি দেয়াল দুদিকে সরে গেল! একে একে সবাই তাদের মালপত্র আর ঘােড়াসহ ঢুকে পড়ল সেই ফাটলের মধ্যে। তারপর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দেখতে লােকটা বাইরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘চিচিং বন্ধ।’
অমনি দুপাশ থেকে পাহাড়ের দেয়াল এগিয়ে এসে বুজিয়ে দিল ফাটলটা । কারও বােঝারই উপায় রইল না যে এই পাহাড়ের ভেতরে লুকিয়ে আছে চল্লিশজন দস্যু। এর ভেতরে জমানাে রয়েছে অনেক অ-নে-ক ধনসম্পদ, মণি-মাণিক্য! আলিবাবা তাে ভয়ে একেবারে চুপ। সেই গাছের আড়ালেই বসে রইল অনেকক্ষণ! কে জানে কখন আবার হঠাৎ পাহাড় ভেঙে সেই দস্যুদল বেরিয়ে আসবে! তাকে ওরা দেখতে পেলে মৃত্যু নিশ্চিত। যা ভয়ঙ্কর এই দস্যুরা। দুপুর গড়িয়ে বিকেলও যায় যায়। আলিবাবা গাছের উপর পাতার আড়ালে লুকিয়ে বসে আছে তাে বসেই আছে। হঠাৎ আবার শােনা গেল সেই শব্দ ‘চিচিং ফাঁক।’
অমনি সেই আগের মতাে পাহাড়ের মধ্যিখানের অংশটা দু ভাগ হয়ে গেল। একে একে বেরিয়ে এল সেই চল্লিশজন ভয়ঙ্কর দস্যু। নিশ্চয় আবার কোথাও থেকে ডাকাতি করে ধনসম্পদ লুঠ করে আনতে যাচ্ছে! দস্যুসর্দার পাহাড়ের ফাটলের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, চিচিং বন্ধ।
আবার সেই একই কাণ্ড। আলিবাবা ভাবল বেশ মজা তাে । চিচিং ফাঁক’ বললেই দরজা খুলে যায় আর চিচিং বন্ধ’ বললেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়!
দস্যুদল ধীরে ধীরে অনেক দূরে চলে গেল। তাদের ঘােড়ার খুরের শব্দও শােনা যায় না। আলিবাবা নেমে এল গাছ থেকে। গাধাগুলােকে ঘাস খেতে যেখানে ছেড়ে দিয়েছিল সেখানে এসে দেখল মনের আনন্দে ঘাস খাচ্ছে ওরা! গাধাগুলােকে নিয়ে আবার ফিরে এল দস্যুদলের সেই ফাটলের সামনে। আলিবাবা সেই দস্যুসর্দারের মতাে চেঁচিয়ে বলল, ‘চিচিং ফাক।’
অমনি দুভাগ হল পাহাড়ের দেয়াল। আলিবাবা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। ফাটলের মধ্যে। মাথা ঘুরে গেল তার। এত মােহর! এত সােনা! রূপা-হিরে-জহরত !!! জীবনে কখনও দেখেনি সে। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ধাতস্থ হয়ে নিল আলিবাবা। তারপর ভাবল, এ নিশ্চয়ই আল্লাহর আশীর্বাদ। নইলে গরিব আলিবাবা এত হিরে-জহরত-মণি-মাণিক্যের সন্ধান পেল কী করে। জীবনে কখনও অসৎ পথে চলেনি, অন্যের ক্ষতি করেনি বলে আল্লাহ খুশি হয়ে তাকে এই পুরস্কার নিয়েছেন।
এত হিরে-জহরত-মণি-মাণিক্য দেখেও অলিবাবা বেশি লােভ করল না। তিনটি গাধায় করে যতগুলাে সােনার মােহর নিয়ে যাওয়া সম্ভব শুধু ততটুকু মােহর নিল। তারপর আলিবাবা ফিরে চলল বাড়ির উদ্দেশ্যে। হিরে-জহরত আর অন্য ধন-সম্পদ যেখানে যা ছিল সেভাবেই রয়ে গেল।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে আলিবাবা ভাবল, এই ধনসম্পদ এখানে জমাতে গিয়ে কত-না মানুষ খুন করেছে এই দস্যুরা। কত মানুষের চোখের পানি ঝরেছে কে জানে : যারা মানুষ মেরে এত ধনসম্পদ জমায় তারা শেষপর্যন্ত তা ভােগ করতে পারে না। কারণ এসব রক্ষা করতে করতেই শেষ হয়ে যায় তাদের জীবন । আল্লাহই তাদের নির্মম শাস্তি দেন । আল্লাহর উদ্দেশ্যে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানান আলিবাবা।
তিন গাধার পিঠে বস্তা ভর্তি করে কী এনেছে দেখতে গিয়ে চোখ দুটো গােল হয়ে গেল আলিবাবার বউয়ের । সরল সাধারণ গরিব কাঠুরের বউ সে এত সােনার মোহর জীবনে দেখেনি। সে ভাবল, আলিবাবা এই মােহর কীভাবে পেল? দস্যুদলে নাম লেখায়নি তাে? নাকি সে কোনও রাজার ভাণ্ডার থেকে চুরি করে এনেছে? বিলাপ করে কান্না জুড়ে দিল সে। অনেক কষ্টে আলিবাবা বুঝিয়ে শুনিয়ে, ঠাণ্ডা করতে পারল তাকে। তারপর খুলে বলল সবকিছু।
আলিবাবা আর তার বউ পড়ে গেল মহা সমস্যায়। এত মােহর তারা রাখবে কোথায়! কত মোহর আছে তাদের সেটাই-বা বুঝবে কী করে! অনেক ভেবে ঠিক করলে ঘরের মেঝেয় গর্ত খুড়ে লুকিয়ে রাখবে সব । কিন্তু তার আগে তাে জানা
চাই কত মােহর আছে! গুণতে বসে তালগোল পাকিয়ে যায় বারবার। শেষে আলিবাবা ঠিক করল, পাল্লায় ওজন মেপে তারপর গর্তে ভরে রাখবে। আলিবাবার বউ ছুটল কাসিমের বাড়িতে।
কাসিমের বউ ভীষণ চলাক! দুষ্ট বুদ্ধিতে গিজগিজ করে তার মাথা। আলিবাবার বউ এসে দাঁড়িপাল্লা ধার চাইলে জিজ্ঞেস করল পাল্লা দিয়ে ওরা কী মাপবে? আলিবাবার বউ বলল, ‘আমার স্বামী বাজার থেকে একবস্তা চাল এনেছে। সেই চাল মাপার জন্যই দাঁড়িপাল্লা দরকার।’
কাসিমের বউয়ের মনে সন্দেহ কিন্তু গেল না । ভাবল, আলিবাবা হঠাৎ এত বড়লোক হল কী করে? একবারে একবস্তা চাল এনেছে বাজার থেকে! দাঁড়িপাল্লা সে ধার দিল ঠিকই। কিন্তু পাল্লার নিচে একটু আঠাও লাগিয়ে দিল। দেখা যাক কী মাপে আলিবাবার বউ। চাল না অন্য কিছু!
সরল, বােকা আলিবাবার বউ এসবের কিছুই বুঝতে পারল না। পাল্লা নিয়ে বাড়ি এল মােহর মেপে গর্তে ভরে রাখল। তারপর ফিরিয়ে দিয়ে এল পাল্লা। কাসিমের বউ অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল আলিবাবার বউ কী মাপে সেটা জানার জন্য। পাল্লাটা উল্টিয়েই কাসিমের বউ অবাক! বুঝতে পারল কোনওভাবে অনেক মােহরের মালিক হয়েছে। সেই মােহরের পরিমাণ এতই বেশি যে মাপতে দাঁড়িপাল্লার দরকার পড়ে গেছে!
কাসিম বাড়ি ফিরতেই বউ তাকে সব ঘটনা জানাল। কাসিমকে ঠেলেঠুলে বাধ্য করল আলিবাবার বাড়ি যেতে। কাসিমের মনেও জেগে উঠল লােভ। তক্ষুনি ছুটল সে। অলিবাবা তখন সবেমাত্র সােনার মােহরগুলাে মাটিতে পুঁতে রেখে কোদাল পরিষ্কার করছিল: আলিবাবাকে দেখে হম্বিতম্বি শুরু করল কাসিম।
‘কোথায় পেলি তুই এত মােহর?
কে বলেছে আমি মােহর পেয়েছি?
‘কে আবার বলবে; এই মােহর আমাদের পালায় এল কোত্থেকে। নিশ্চয়ই তাের কাছে অনেক মােহর আছে । নইলে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে তােরা মােহর মাপলি কেন? চুরি ডাকাতি করেছিস নাকি তুই! আমাদের বংশের নাম ডুবল তাের জন্য।
বকুনি শুনে মন খারাপ হয়ে গেল অলিবাবার বাধ্য হয়ে সবকিছু খুলে বলল কাসিমকে। মােহরগুলাে ভাগ করে অর্ধেক তাকেও দিতে চাইল। কিন্তু লােভী কাসিম এই ভাগে তুষ্ট নয়। কে নিতে চায় তাের এই সামান্য কটা মােহর। তুই বরং আমাকে ঐ জায়গাটা চিনিয়ে দে। আমি নিজেই গিয়ে মােহর নিয়ে আসব। খবরদার! আমাকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবি না।
পাহাড়ের কাছে কীভাবে পৌছতে হবে তা তাে বললই, সেই সঙ্গে ঐ পাহাড়ের দরজা খোলার আর বন্ধ করার মন্ত্রটাও বলে দিল কাসিমকে।
লােভী কাসিম তাে মহাখুশি। বাড়িতে এসে বউকে সব বলল। পরদিনই এই ধনসম্পদ আনতে যাবে সেখানে। খুশিতে তাকে অনেক কিছু রেঁধে খাওয়াল কাসিমের বউ। সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য পুঁটুলি বেঁধেও দিল কিছু! লােভী কাসিম ছুটল ধন-সম্পদ আনতে। তার আনন্দ দেখে কে!
আলিবাবার কথামতাে ঠিক ঠিক মিলে গেল সবকিছু। সব যে ঠিক থাকবে তা জানত কাসিম। কারণ আর যাই হােক আলিবাবা যে মিথ্যেবাদী নয় তা সকলেই জানে। পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল কাসিম, চিচিং ফাঁক।
অমনি খুলে গেল দরজা। ভেতর দিয়ে আবার চেঁচাল কাসিম, “চিচিং বন্ধ। বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
এ কী দেখছে কাসিম! রাশি রাশি সােনার মােহর! হিরে-মণি-মাণিক্য!! এত সম্পদ জীবনে কখনও দেখেনি। আর এখন সে এত কিছুর মালিক! সবকিছু ভােগ করবে কাসিম আর তার বউ! আলিবাবাকেও দেবে না। খুশিতে গুহার মধ্যে ডিগবাজি খেল কয়েকবার। সােনার মােহর আর দামি দামি হিরে-মণি-মুক্তাগুলােকে জড়িয়ে ধরে কী যে করবে ভেবে পেল না।
এভাবে কিছুক্ষণ কাটবার পর সুস্থির হল কাসিম। সঙ্গে করে অনেকগুলাে বস্তা এনেছিল সে। যত পারল বস্তার মধ্যে পুরতে লাগল সবকিছু। কাসিম এনেছিল ছয়টি খচ্চর ; কিন্তু এত মালপত্র নিল যে এগুলাে পনেরটা খচ্চরও বহন করতে পারবে না। বস্তার মুখ ভালাে করে বেঁধেছেদে বাইরে বেরুবার জন্য তৈরি হল কাসিম।
কিন্তু এ কী! কিছুতেই দরজা খােলার মন্ত্র মনে আসছে না যে। এখন কী করবে? মন্ত্র মনে রাখার জন্য কী যেন ভেবেছিল? মনে পড়েছে। সে ভেবে রেখেছিল মানুষ খিদে পেলে যা করে তা মনে এলেই দরজা খোলার মন্ত্রটা মনে আসবে। দরজার সামনে বাড়িয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘খাই খাই ফাঁক।
খুলল না দরজা। এখন কী হবে? দরজা খুলছে না কেন? কেঁদে উঠল কাসিম তবার ভাবতে চেষ্টা করলে খিদে পেলে মানুষ কি করে! খিদে পেলে মানুষ মজার তরকারি আর রুটির কথা ভাবে। চেঁচিয়ে উঠল কাসিম, ‘রুটি আর দুম্বার মাংসের তরকারি ফাঁক!
কই, তবুও তাে খুলছে না দরজা। আলু ফাঁক। বেগুন ফাঁক। খেজুর ফাঁক। কত কিছু ফাঁক যে বলল কাসিম। বলে শেষ করা যাবে না। তবু খুলল না দরজ। কী করে এখান থেকে বেরুবে কাসিম? কোনও বুদ্ধি এল না মাথায় ! ভয়ে, ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়ল সে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্ত হয়ে।
অনেকক্ষণ কেটে গেল এভাবে।।
ফিরে এল চল্লিশজন দস্যু। তারা দেখল গুহার সামনে কয়েকটা গাধা চরে বেড়াচ্ছে : সরদার ভাবল, এখানে বা আশেপাশে কেউ আছে! সব্বনাশ! কে আমাদের এই গােপন আস্তানার সন্ধান জানতে পারল! হুঙ্কার দিয়ে উঠল সর্দার। তার দলের লােকদের বলল,
‘সাবধান। কে যেন আছে আশেপাশে! সামনে পাওয়া মাত্র তার ঘাড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে ফেলবি ?
সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে খুঁজতে লেগে গেল দস্যুরা। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাওয়া গেল না কাউকেই । তারপর সর্দার ‘চিচিং ফাঁক’ বলতেই খুলে গেল পাহাতের দরজা। কাসিম ভয়ে, খিদেয় আর ক্লান্তিতে কাবু হয়ে সেই যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে ঘুম তখনও ভাঙেনি। ভেতরে ঢুকে সবকিছু লণ্ডভণ্ড দেখে সর্দারের বুঝতে অসুবিধা হল না যে শত্রু ভেতরেই আছে। সঙ্গে সঙ্গে হুকুম হল শটাকে দেখামাত্র যেন তার ঘাড় থেকে মুণ্ডটা আলাদা করে ফেলা হয়। হুকুম হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দু-টুকরাে হয়ে গেল ঘুমন্ত কাসিম। তারপর সর্দারে হুকুমে তাকে ছয়-টুকরাে করে বস্তাবন্দি করে রেখে দিল দস্যুরা।
এদিকে কাসিমের বউ অপেক্ষা করে বসে আছে কখন অনেক অ-নে-ক ধন-সম্পদ নিয়ে ফিরবে কাসিম । ছয় খচ্চরের পিঠ-ভর্তি ধন-সম্পদ নিয়ে ফিরবে সে। আরও বড়লােক হয়ে যাবে তারা। সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। সকলে তাদের কথা শুনবে। রাজার হালে কাটবে তাদের দিনকাল।।
কিন্তু কোথায় কাসিম? সে তাে ফিরছে না। সেই ভােরে ছয়টা খচ্চর নিয়ে বেরিয়েছে সে। বিকেলবেলাই ফিরে আসবার কথা।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হল। কই কাসিম? কাসিম কেন ফেরে না! কত মােহর আনছে সে? ভাবল বউ। যতই সময় পেরুতে লাগল ততােই চঞ্চল হয়ে উঠতে লাগল মন। কেমন যেন ভয় এসে ঘেঁকে ধরল তাকে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গভীর হল : ফেরার নাম নেই কাসিমের। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আলিবাবার বাড়ি ছুটল কাসিমের বউ : গিয়েই কান্নাকাটি শুরু করে দিল,
ভাই আলি, তােমার ভাই কাসিম তাে এখনও এল না ‘ আমার কী হবে! বাঘ সিংহে খেয়ে ফেলেনি তাে তাকে?
আলিবাবা’ সান্ত্বনা দিল তার ভাইয়ের বউকে বােঝানাের চেষ্টা করল, আমার ভাই অনেক বুদ্ধিমান আর শক্তিশালী, সে যাবে বাঘ সিংহের পেটে ? তা কি হয় কখনও ! অনেক ধন-সম্পদ বােঝাই করে আনছে তো! তাই সময় লাগছে। হয়তাে মালের ভারে ধীরে ধীরে হাঁটছে খচ্চরগুলাে। তুমি কিছু চিন্তা কোরাে না ভাবি । ঠিক চলে আসবে ভাইজান।
আলিবাবার কথায় কাসিমের বউ শান্ত হল কিছুটা। কিন্তু মনের ভয় দূর হল না একটুও। এখন সে নিজেকে অপরাধী মনে করতে লাগল। তার জন্যেই তাে কাসিম, ধন-সম্পদের জন্য লােভ করেছে। দূরে, অচেনা পাহাড়ে-জঙ্গলে গিয়েছে। সে যদি আলিবাবার মােহরের খবর জানার জন্য ব্যস্ত না হতাে, মােহরের খোঁজ পেয়ে কাসিমকে ঠেলে না পাঠাত তাহলে তাে আর কাসিম নিখোঁজ হতাে না। নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করল কাসিমের বউয়ের । কেন সে বেশি সম্পদের লােভ করেছিল।
সেই রাত্রিও পার হল। কাসিমের দেখা নেই ! কাসিমের বউয়ের প্রায় উন্মাদ হবার দশা আলিবাবা ভােরবেলা ছুটল ভাই কাসিমের সন্ধানে এসে পৌছল সেই জায়গায় যেখান থেকে সে মােহরগুলাে নিয়েছিল। এসেই যা দেখল তাতে তার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। ছয়টা খচ্চর রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে আছে। খচরগুলাের অবস্থা দেখে আলিবাবা বুঝতে পারল তার ভাই কাসিমের অবস্থা কী হয়েছে। ভয়ে ভয়ে পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তেই উচ্চারণ করল, চিচিং ফাঁক।
পাহাড়ের দেয়াল দু’ভাগ হয়ে গেল আগের মতােই আলিবাবা দেখল একটা বস্তা পড়ে আছে। বস্তার মুখ খুলতেই দেখতে পেল কাসিমের টুকরাে-টুকরাে দেহ। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আলিবাবা তাড়াতাড়ি বস্তার মুখ বেঁধে বাড়ি ফিরে চলল। দরজায় দাঁড়িয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছে আলিবাবার বাদি মর্জিনা । আলিবাবা ভাবল, ভালােই হয়েছে ওকেই ব্যাপারটা আগে খুলে বলতে হবে। মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতি । অনেক সময়ই মর্জিনার বুদ্ধি কাজে লেগেছে আলিবাবার ! আলিবাবা আর মর্জিনা ধরাধরি করে কাসিমের লাশের বস্তা ঘরে ঢুকিয়ে রাখল।
সব শুনে মর্জিনা এক বুদ্ধি বের করল মনে মনে । কাসিমের এ অবস্থার কথা অন্যদের জানাবার আগেই লাশটাকে জোড়া লাগাতে হবে : না-হয় ফাঁস হয়ে যাবে সবকিছু। রাজার ফৌজি বাহিনী এসে সবকিছু ওলট-পালট করে দেবে। কিন্তু কী করে যেন কাসিমের বউ আলিবাবার ফেরার খবর টের পেয়ে গেছে । আলিবাবা এক ফিরেছে দেখে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল কাসিমের বউ । তাড়াতাড়ি তার মুখ চেপে ধরল মর্জিনা। কোনওরকমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করল । তারপর সব ঘটনা খুলে বলল, লাশটা যতক্ষণ জোহু লাগানাে না-যাচ্ছে। ততক্ষণ এ ব্যাপারে টু শব্দটি করা যাবে না ।
তারপর। মর্জিনার মনে পড়ল বাজারের বুড়াে মুচি বাবা মুস্তাফার কথা । এই বুড়াে মুচি কিছুদিন আগে তার একটা জুতাে এত সুন্দর করে সেলাই করে দিয়েছিল যে সেলাইয়ের দাগ বােঝাই যায়নি। ওকে দিয়ে আগে লাশটা সেলাই করতে হবে। তারপর ব্যবস্থা করতে হবে দাফনের।
যেই ভাবা সেই কাজ। মর্জিনা বাজারের বুড়াে মুচি বাবা মুস্তাফার দোকানে গিয়ে হাজির। মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে বাবা মুস্তাফাকে তাদের বাড়ি নিয়ে এল সে। তার আগে বুড়াে বাবা মুস্তাফার চোখ বেঁধে নিতে ভুল করেনি মর্জিনা। বাড়িতে নিয়ে আসার আগে ফুসলিয়ে কসম খাইয়ে নিয়েছে তাকে। বলেছে কোনও অবস্থাতেই এই লাশ জোড়া লাগার কথা যেন অন্য কাউকে না বলে। মুখ ফসকে এই লাশ জোড়া লাগাবার কথা কাউকে বলে ফেললেও যেন বাড়িটা চিনতে না পারে সেজন্য বুড়াের এই চোখ বাঁধার ব্যবস্থা।
মর্জিনার অনুমানই ঠিক। বুড়াে বাবা মুস্তাফা নিপুণভাবে লাশটাকে সেলাই করে দিল। বােঝার কোনও উপায় রইল না যে এটা একটা ছয়-টুকরাে করে কাটা মানুষের লাশ। মর্জিনার বুদ্ধিমতে পাড়া-প্রতিবেশীকে জানিয়ে দিল তিন দিনের জ্বরে ভুগে কাসিম হঠাৎ মারা গেছে। কাসিমের বউও প্রাণের ভয়ে এই ব্যবস্থা মেনে নিল।
এদিকে দস্যুর পরদিন আস্তানায় ফিরে দেখল বস্তাবন্দি কাসিমের লাশটা নেই। নিশ্চয়ই কেউ তাদের এই গোপন আস্তানার খবর জেনে গেছে। যে করেই হােক তাকে খুঁজে বের করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে দুনিয়া থেকে। চল্লিশ দস্যুর প্রত্যেকেই শপথ নিল । তাদের আস্তানার খবর যে জানে তাকে খুঁজতে একজন একজন করে বেরুবে তারা। যে সেই লোকটিকে খুঁজে আনতে না-পারবে তার শাস্তি মৃত্যু!
প্রথম দস্যু গেল শহরে । ছদ্মবেশে ঘুরতে ঘুরতে হাজির হল বাবা মুস্তাফার দোকানে । এ-কথা সে-কথা বলে বাবা মুস্তাফার সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেলল। দস্যুটা কথায় কথায় বাবা মুস্তাফা জানাল, সে নিখুঁতভাবে চামড়া সেলাই করতে পারে। সেলাইয়ের দাগ দেখা যায় না। এমনভাবে মরা মানুষ পর্যন্ত সেলাই করতে পারে সে। কান খাড়া হয়ে গেল দস্যুটার। জিজ্ঞাসা করল,
‘কী সাহেব, মরা মানুষ টানুষ কি দুচারটা জোড় দিয়ে দেখেছেন নাকি? না কি খামােখা বড়াই করছেন?
‘আপনি কি ভাবছেন অমি এমনি এমনি কথা বলছি? এই তাে সেদিন ছয় টুকরাে একটা মানুষকে দিব্যি নিখুঁতভাবে সেলাই করে নিলাম। সেলাইয়ে একটা ফোঁড় দেখা যায়নি। বেশ জোর দিয়ে বলল মুচি বাবা মুস্তফা।
ছদ্মবেশী দস্যুটা এমনভাবে কথা বলল যেন সে কিছুই বােঝে না। হাবার মতো জিজ্ঞাসা করল, “তােমাদের দেশে এ কীরকম নিয়ম? কেউ মরে গেলে তাকে ছ টুকরাে করে কাটতে হয়? আবার সেলাই করে জোড়া দিয়ে তারপর তাকে কবর দিতে হয় ?
মুচি হাসল,
‘তা হবে কেন, কারা যেন লােকটাকে মেরে ছয় টুকরাে করে ফেলেছিল। তাই আমাকে দিয়ে সেলাই করিয়ে তারপর কবর দিয়েছে। কাজটার জন্য অনেক ইনাম পেয়েছিলাম।’
ছদ্মবেশী দস্যুটা বলল,
কেমন করে এমনটা হল তা জানার জন্যে আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে। তুমি ভাই আমাকে সে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে?
‘তা পারব কেমন করে? আমার চোখ বেঁধে তারপর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যে! ছদ্মবেশী দস্যু তখন মুচি বাবা মুস্তাফার চোখে রুমাল বেঁধে বল,
তুমি এখন আমার হাত ধরে মনে করে করে এগােও। কখন কোথায় থেমেছ, কখন ডানে-বাঁয়ে মােড় নিয়েছে সেটা আন্দাজ করে করে আমাকে সেই বাড়িতে নিয়ে চল।।
বুড়াে মুচি সেভাবেই তাকে নিয়ে যেতে থাকল : হঠাৎ থেমে সামনের দিকে দেখিয়ে বলল, এই এই, সেই বাড়ি। ছদ্মবেশী দস্যুটা অলিবাবার বাড়ির দরজায় চক নিয়ে একটা কাটা চিহ্ন এঁকে নিল বাবা মুস্তাফাকে খুশি করে দিল ইনাম দিয়ে ।।
আস্তানায় ফিরে সর্দার তার সঙ্গীদের সব কিছু বিস্তারিতভাবে জানাল।
একটা কাজে বাইরে গিয়েছিল মর্জিনা : ফিরে এসে দেখল মনিবের বাড়ির দরজায় একটা কাটা চিহ্ন আঁকা। খটকা লাগল মনে। বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেখল একটা চক পড়ে আছে সামনে। কী যেন মনে করে চকটা নিয়ে আশপাশের সবগুলাে বাড়তেই কাটা চিহ্ন এঁকে রাখল সে।
পরদিন দস্যুদল এসে আর আলিবাবার বাড়ি চিনতে পারল না। ফিরে গিয়ে ছদ্মবেশী দস্যুটা কেটে টুকরো টুকরাে করে ফেলল সর্দার।
এরপর আরও দুজন বেরুল আলিবাবার খোঁজে । প্রত্যেকেই একইভাবে বাবা মুস্তাফার মাধ্যমে বাড়ি চিনে দরজায় চিহ্ন দিয়ে এসেছিল। কিন্তু দলসহ ফিরে এসে অন্য বাড়িগুলাে থেকে আলিবাবার বাড়িটাকে আলাদা করতে পারল না কেউই। প্রাণ গেল সে দুজনেরও।
শেষমেষ দস্যু সর্দার নিজেই গেল আলিবাবার সন্ধানে। সে-ও ঘুরতে ঘুরতে এল বাবা মুস্তাফার কাছে । তার থেকে খোজ নিয়ে আলিবাবার বাড়িতে এসে হাজির । দস্যু সর্দার এবার আলিবাবার বাড়ির দরজায় একটা মোহরের চিহ্ন এঁকে রাখল; সেই সঙ্গে চারপাশের গাছপালা দেখে অনেকগুলাে চিহ্ন এঁকে নিল মনে মনে। কোনওরকম ভুল হবে না এবার।
দস্যু সর্দার অন্য উপায় বের করল।
সে তার দলের লােকগুলাের একেকজনকে একেকটি করে মটকার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল। আর একটা মটকা ভর্তি করে রাখল তেল দিয়ে। অন্য মটকাগুলাের মুখের দিকটাতেও মাখিয়ে রাখল তেল! দেখলে মনে হবে সবগুলো মটকার মুখে ঝাকুনি লেগে তেল ছলকে ছলকে পড়েছে। সওদাগরের ছদ্মবেশ ধরল দস্যু সর্দার। তার সঙ্গে সাঁইত্রিশটা মটকা। রাতে আলিবাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় চাইল। আলিবাবা তো খুব ভালাে মনের মানুষ কেউ তার কাছে কোনওরকম সাহায্য চাইলে তাকে উপেক্ষা করতে পারে না। সাহায্য করার জন্য চেষ্টা করে : সওদাগরের অনুরােধও রাখল সে।
সওদাগরের ছদ্মবেশে-আসা দস্যু সর্দার আলিবাবার বাড়িতে মেহমান। আলিবাবা মর্জিনাকে বলল ভালাে ভালাে খাবার রান্না করতে। যেন অতিথি তার বাড়িতে খাওয়ার কথা সারা জীবন মনে রাখেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই ঘুমােতে যাবে। মর্জিনা আলিবাবাকে জানাল, তার প্রদীপের তেল ফুরিয়ে। গিয়েছে । আলিবাবা বলল,
‘এত রাতে তুই তেলের কথা বললি? এখন তাে কোনও দোকান খােলা পাব না। তুই এক কাজ কর। আমাদের অতিথির তেলের মটকা থেকেই প্রদীপের জন্য তেল নিয়ে আয়। এইটুকু তেল নিলে কী আর মনে করবেন তিনি। মর্জিনা গেল মটকা থেকে তেল নিতে। একটা মটকার ঢাকনা যেই সরিয়েছে অমনি ভেতর থেকে কে যেন ফিসফিস করে বলল, সর্দার সময় হতে দেরি কত?
চমকে উঠল মর্জিনা। এক মুহূর্ত ভাবল সে। ফিসফিস করে বলল, না, সময় হয়নি।
একে একে প্রত্যেকটা মটকার ঢাকনা সরিয়ে দেখল মর্জিনা। শুধু শেষের মটকাতে তেলভর্তি। অন্য সবগুলােতেই মানুষ কথা বলেছে। সওদাগর তার মনিবকে মারতে এসেছে! বুদ্ধিমতি মর্জিনার এ-কথা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলনা। সওদাগরের ছদ্মবেশে আসা লােকটা আসলে দস্যু সর্দার। মর্জিনার মাথায় বুদ্ধি এল একটা ! যে মটকায় তেল ভরা আছে তা থেকে তেল ঢেলে নিল একটা পাতিলে। সেই তেল চুলাের আগুনে টগবগ করে ফুটিয়ে নিল । সেই তেল একে একে ঢেলে দিল প্রত্যেকটা মটকায়। মটকার ঢাকনা দিল বন্ধ করে। এইভাবে ছত্রিশজন দস্যু গেল খতম হয়ে !
মর্জিনা রান্নাঘরে আলাে নিভিয়ে ভেতরবাড়ির ফটকে খিল লাগাল। তারপর শুয়ে পড়ল নিশ্চিন্ত মনে। রাত আরও গভীর হল। সর্দার মনে করল এতক্ষণে বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মটকাগুলাে লক্ষ্য করে একটা-একটা করে ঢিল ছুড়ল সর্দার। আগেই কথা ছিল মটকার গায়ে ঢিল পড়ামাত্র সবাই তলােয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু ছত্রিশ দস্যুর একজনও বের হল না। ক্ষেপে গিয়ে সর্দার নিজেই মটকাগুলাের কাছে গেল তাদের বকুনি দেয়ার জন্য।
সর্দার ভেবেছিল সবাই তাদের কাজের কথা ভুলে ঘুমিয়ে পড়েছে। একে একে সব মটকার ঢাকনা খুলল সে । দেখল সবাই মরে কাঠ হয়ে আছে। শেষ মটকায় একটুও তেল নেই! সর্দারের বুঝতে বাকি রইল না বাড়ির লােকজন তার পরিচয় জেনে গেছে : সর্বনাশ ঘটে গেছে অনেক আগেই। মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে দস্যু সর্দার বাইরের ফটক খুলে একেবারে পগার পার।
মর্জিনা সর্দারের অবস্থা দেখে হাসল মনে মনে বুঝল আপাতত আর কোনও বিপদ নেই। রাতে তাই আলিবাবাকে কিছুই জানাল না।
ঘুম ভাঙার পর অতিখির খবর নেয়ার জন্য বাইরের ঘরের দিকে পা বাড়াল আলিবাবা। তার আগেই ঘুম থেকে উঠে কাজে লেগে গেছে মর্জিনা। মর্জিনা তখন তাকে মটকাগুলাের কাছে নিয়ে এল।
আব্বাজান, আপনি নিজেই দেখুন কাকে আদর-আপ্যায়ন করে ঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আর একটু হলেই তাে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। আলিবাবা তাে অবস্থা দেখে থ। মর্জিনাকে অনেক আদর করল। বলল, তুই আমার মা তাের বুদ্ধিতে দুইবার বিপদ থেকে বেঁচে গেছি।’
বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা।
আলিবাবার বড়ভাই কাসিমের দোকান দেখাশােনা করে আলিবাবার ছেলে । সেই ছেলে তার বাবা আলিবাবাকে একদিন বলল,
বাবা, আমি যখন প্রথম প্রথম-দোকানে বসতাম তখন ব্যবসার অনেক কিছুই বুঝতা না। আমার পাশের দোকানের হুসেন সাহেব আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন, বুঝিয়েছেন। একদিন তাঁকে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়াতে চাই। এমন একজন উপকারী মানুষকে সম্মান দেখানাে উচিত।’
বেশ তো তুইতো ভালো কথাই বলেছিস । যা তাঁকে দাওয়াত করে আয় আলিবাবা বলল।
পরদিন মেহমান দাওয়াত খেতে আসবেন। আলিবাবার ছেলে এসে মর্জিনাকে জানাল মেহমান তরকারিতে লবণ দেয়া পছন্দ করেন না। তার জন্য রান্ন করা তরকারিতে যেন লবণ দেয়া না হয়।’
খটকা লাগল মর্জিনার মনে। রান্নাবান্না সে করল মনােযােগ দিয়েই। তরকারিতে লবণও দেয়নি । কিন্তু মন থেকে তার খটকা যায়নি। মেহমান এলে পর খাবার সাজানাে হল। খেতে খেতে বারবার সুস্বাদু খাবারের প্রশংসা করতে লাগলেন মেহমান ।
খাওয়া-দাওয়া শেষ । মর্জিনা আর আলিবাবার ভাই কাসিমের ক্রীতদাস আবদুল্লা মিলে একটা নাচ দেখাবার আয়ােজন করল । একটা ধারাল ছুরি হাতে নিয়ে মর্জিনা আর আবদুল্লা নাচতে শুরু করল। নাচতে নাচতে এমন ভাব করল যে ছুরি নিয়ে সে একবার নিজের বুকে বসিয়ে দিতে যায়, একবার আলিবাবার বুকে বসিয়ে দিতে যায়, কিন্তু কারও বুকেই সে ছুরি বসায় না। নাচ দেখে খুব মজা পাচ্ছেন মেহমান।
হঠাৎ নাচতে নাচতে এগিয়ে এসে মর্জিনা মেহমানের হৃৎপিণ্ডের উপর প্রচণ্ড জোরে বসিয়ে দিল ছুরিটা। ঢলে পড়ল মেহমান। আলিবাবা আর তার ছেলে হায় হায় করে উঠল।
‘এ কী করলি তুই মর্জিনা ! আমাদের মেহমানকে খুন করলি তুই!’
মর্জিনা তখন মেহমানের কোমরে-বাঁধা কাপড়টা সরিয়ে দিল । সবাই দেখল তার কোমরে একটা ধারাল ছুরি। নকল দাড়িতে ধরে টান দিতেই খুলে এল দাড়ি । আলিবাবা বুঝতে পারল এই ছদ্মবেশী আসলে দস্যু সর্দার।
আলিবাবা বুঝতে পারল মর্জিনার বুদ্ধিই এবারও তার প্রাণ বাঁচিয়েছে । আলিবাবা ভীষণ খুশি হল। মর্জিনাকে একেবারে নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে চিরকালের জন্য স্নেহের বন্ধনে বেঁধে রাখল। পাহাড়ের গুহার সব সম্পত্তি এনে গরিব-দুঃখী মানুষের জন্যে খরচ করল আলিবাবা।
তারপর, সব মানুষের ভালােবাসা নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন কাটতে লাগল তার ।