যে যেমন মানসিকতার মানুষ সে সেইরকম মানসিকতা দিয়ে অন্যকে বিচার করে। এখানে আমি আলোচনা করতে চাইছি, দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। বর্তমান সমাজ যে নিম্ন স্তরে নেমে গেছে এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা কারণ হল দৃষ্টিভঙ্গি। বর্তমান সমাজে আটানব্বই ভাগ, বলা চলে সিংহভাগ, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে নিম্ন থেকে নিম্ন স্তরে নেমে গেছে। এ প্রসঙ্গে তিনটি ঘটনা ছোট্ট করে উল্লেখ করব।
প্রথম ঘটনা:- একটা বড় পুকুরে একজন ভদ্রলোক পুকুরের এক প্রান্তের ঘাটে প্রতিদিন গভীর রাতে স্নান করতো অথবা মুখ হাত পা পরিষ্কার করে ধৌত করত, সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনা করার উদ্দেশ্যে। সেই পুকুরের অপরপ্রান্তে একই সময়ে একজন লোক মাছ চুরি করতো। কিন্তু রাতের অন্ধকার ও অনেকটা দূরত্ব থাকার জন্য কেউ কাউকে দেখতে পেতো না, ও কে কি কর্ম করছে সেটা বুঝতে পারত না। কিন্তু একে অপরের উপস্থিতি বুঝতে পারতো। সেই কারণে প্রথম ভদ্রলোক ভাবতো আমি একা শুধু রাত্রে বেলায় উঠে সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনা করি না ওই প্রান্তে আরো একজন করে। দ্বিতীয় ভদ্রলোক ভাবতো এই পুকুরে আমি একাই মাছ চুরি করি না ওই প্রান্তে আরো একজন করে।
দ্বিতীয় ঘটনা:-দুইজন ভদ্রলোক পুকুরের ঘাটে গেছে স্নান করবো বলে, একজন পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আর একজন পুকুরে কোমর পর্যন্ত নেমে দাঁড়িয়ে আছে, পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি পুকুরে নেমে থাকা ব্যক্তিটি কে বলছে 'তুই প্রস্রাব করছিস' পুকুরে নেমে থাকা ব্যক্তিটি বলছে তুই কি করে বুঝলি, পাড়ে থাকা ব্যক্তিটি বলছে 'আমিও পুকুরে স্নান করার সময় করি'।
তৃতীয় নম্বর ঘটনা:- মহামারীর সময়, গত প্রথম লকডাউনে একটা স্কুলের মাস্টার মশাইরা মোটা অংকের চাঁদা দিয়ে সেই স্কুল এলাকার সমস্ত বিধবাদের কে বিভিন্ন ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে অনুষ্ঠান করে সাহায্য করেছিলেন। তা দেখে গ্রামের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষকে বলতে শোনা গেল, স্কুলের মিড ডে মিলের চাল থেকে ব্যবস্থা করে মাস্টারমশাইরা নিজেদের নামে অনুষ্ঠান করে নিলো। একথা শুনে স্কুলের মাস্টার মশাইরা মনে খুব আঘাত পেয়েছিলন।
বর্তমান সমাজে বেশিরভাগ জন নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অপরকে বিচার করে। সে মনে করে, সে যা সমাজের সকল মানুষ ঠিক সেইরকম। যারা ঘুষ দিয়ে বা অসৎ উপায়ে চাকরি পেয়েছে, বা যারা মেরে খাওয়া প্রবৃত্তির মানুষ, তারা ভাবে ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় না, বা সকলেই মেরে খাচ্ছে। তারা বুঝেনা ঘুষ না দিয়েও চাকরি পাওয়া যায়, বা সমাজের অনেক মানুষ আছে যারা অসৎ নয়। খারাপ চরিত্রের মানুষরা সকলকে চরিত্রহীন বলে ভাবে। সকলের চরিত্রের দোষ ত্রুটি খুঁজে মানুষকে অপদস্থ করার চেষ্টা করে। আপনি দোকানে মাল কিনতে যাবেন, দোকানদার বলবে,"এই চত্বরে আমার দোকানে একমাত্র খাঁটি মাল পাওয়া যায়, আপনি অন্যান্য দোকানে যান, সব ভেজাল এ ভর্তি"।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একজন বিশিষ্ট মানুষ মন্তব্য করেছেন যে "বাড়ি বসে মাইনে পাচ্ছেন শিক্ষকরা ক্লাসে অর্ধেক সময় গল্প করেই কাটিয়ে দেন"। তিনি শিক্ষকদের মধ্যে না ঢুকে তার মনের কথাটা ব্যক্ত করেছেন। তিনি যে ধরনের মানসিকতার।
যদি প্রতিবেশীর, বা সমাজের কারো উন্নতি হয় তাহলে কুদৃষ্টির, বা দৃষ্টিভঙ্গি নিচ মানসিকতার মানুষরা ভাবে, বা বলতে শুরু করে দেয়, পাচ্ছে কোথায়?হচ্ছে কিভাবে? নিশ্চয়ই কোথায় থেকে মেরে নিয়ে আসছে? 'ডাল মে কুচ কালা হ্যায়'। অনেকের কাজ না করে বেতন নেওয়ার মানসিকতা আছে। যারা কাজ করে, তাদের প্রতি ধারণা করে এত কাজ করছে কেন? নিশ্চয়ই কিছু মধু আছে। সে এই ধারণাটা মনে আনতে পারেনা, কাজটাও তার করা দরকার। ধারণাটা আরো পরিস্কার হবে এই উদাহরণ টার মাধ্যমে,একটা ছোট্ট ছেলেকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় মা, বাবা, কাকা, দাদা, দিদা মানে কি? সে তার বাড়িতে মা-বাবা,কাকা, দাদা দিদা কে যেমন দেখবে ঠিক সেই রকম ভাবে, মা, বাবা,কাকা, দাদা দিদার সংজ্ঞা দেবে।
সমাজকে পরিবর্তন করতে গেলে, সমাজকে উন্নত করতে গেলে, নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অপরকে বিচার করা বন্ধ করতে হবে। অসৎ দৃষ্টিভঙ্গির উপরেও যে সৎ দৃষ্টিভঙ্গি আছে, সেই ধারণাকে মনের মধ্যে জন্ম দিতে হবে। জন্মদিতে হবে মানবিকতার, ভালো মানসিকতার, মনে রাখতে হবে আমরা সমাজবদ্ধ জীব। যদি আমাদের মধ্যে হিংস্র মানসিকতা থাকে, তাহলে এই সমাজে থেকে লাভ কি?বেঁচে থাকার অর্থ কি? সমাজ পরিবর্তন করতে গেলে আত্মার মধ্যে সঠিক সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা জন্ম দিতে হবে। সঠিক সমালোচনার জন্য, সঠিক সমালোচনাকারীর প্রতি, শত্রুতা, হিংস্রতা দৃষ্টিভঙ্গি ধারণা করলে হবেনা। এতে হিংসা বাড়বে। আর হিংসা কোনদিন শান্তি আনতে পারে না।