Posts

বিশ্ব সাহিত্য

আরবি ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশের ক্রমধারা

February 16, 2025

Md. Mosharraf Hossan ( Kaikobad)

Original Author হাসান আয -যিইয়্যাত

Translated by মোহাম্মদ মোশাররফ হুসাইন

72
View

আরবি ভাষা সেমেটিক ভাষা পরিবারের একটি শাখা। আরবি ভাষা ও অন্যান্য সেমেটিক ভাষার উৎপত্তি একই উৎস থেকে হলেও সময়ের ব্যাবধানে এই ভাষাগুলোর অনেক শাখা- প্রশাখা বেরিয়েছে। সেমেটিকদের জনসংখ্যা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা নিজেদের আবাসভূমি ত্যাগ করলে শব্দের ব্যুৎপত্তিগত ভিন্নতা ও সংমিশ্রণের ফলে তাদের প্রাচীন সময়ের ভাষাগুলোর মধ্যেও যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কালের বিবর্তনে পরিবেশের প্রভাব ও ভাষাগুলোর আন্তঃসম্পর্কহীনতার দরুন এই ভাষিক ভিন্নতাও সমান তালে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রত্যেকটি উপভাষাই স্বতন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ।

মধ্যযুগে ইহুদি রাব্বিগণ সেমেটিক ভাষাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক ও সাদৃশ্যের ব্যাপারে তারাই প্রথম অবগতি লাভ করেছিল বলা হয়ে থাকলেও ইউরোপের প্রাচ্যবিদরাই বিভন্ন টেক্সটের মাধ্যমে সেমেটিক ভাষার এই পারস্পরিক সম্পর্কের প্রমাণ হাজির করেছেন এবং একেই তারা চূড়ান্ত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহন করেছেন।

ভাষাবিজ্ঞানীরা সেমেটিক ভাষাগুলোকে আর্মেনিয়া, কেন’আনি এবং আরবি ভাষার উপজাত হিসেবে গণ্য করেন। যেভাবে তারা আর্য ভাষাকে লাতিন, গ্রীক ও সংস্কৃতি ভাষার উপজাত হিসেবে গণ্য করে থাকেন। আর্মেনেীয় ভাষা থেকে কালদীয়, আসেরীয় ও সুুরিয়ানী ভাষার উৎপত্তি হয়। একইভাবে ফিনিশীয় ও ইবরানি ভাষার মূল হলো কেন'আনি ভাষা। আরবি ভাষার মধ্যে ইয়েমেন ও হাবশার ( ইউথোপিয়া) বিভিন্ন গোত্রের উপভাষা ও বিশুদ্ধ মুধারিয়া ভাষাও অন্তর্ভুক্ত। তবে বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী মাতৃভাষার দিক দিয়ে উল্লেখিত ভাষাগুলোর তিনটি উৎসের মধ্যে আরবি ভাষাকে খুব কাছের বলে ধারণা করা হয়ে থাকে । কারণ বিভিন্ন সময়ে মানব সভ্যতার মধ্যে নানান উত্থান-পতন ও ক্রমোন্নতির ফলে অন্যান্য ভাষাগুলোর মধ্যে যে পরিবর্তন এসেছে আরবি ভাষা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে সেগুলো থেকে এক প্রকার মুক্তই ছিল বলা যায়।

বর্তমান সময়ের গবেষকদের জন্যে আরবি ভাষার প্রাচীন উৎপত্তি -স্তর খুঁজে বের করা প্রায়ই দুঃসাধ্যই বলা যায়। কারণ যতদিনে আরবি ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস জানা গিয়েছে ততদিনে আরবি ভাষা সমৃদ্ধি ও পূর্ণতার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছে। আরব উপদ্বীপ থেকে পাথরে খোদাই করা যে সমস্ত টেক্সটগুলো উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলোর দুষ্প্রাপ্যতার কারণে গবেষকদের অনুসন্ধানের জন্যে অপ্রতুল হয়ে পড়েছে। আরবি ভাষা অনেকগুলো পর্যায় অতিক্রম করলেও তার উপভাষাসমূহকে এক জায়গায় একত্রিত করলে এবং তার শব্দাবলীর বিচার - বিশ্লেষণ করলে যুক্তি ও প্রমাণের আলোকে আরবি ভাষার উৎস খুঁজে বের করা সম্ভব।

 আরবরা ছিল বল্গাহীন এক নিরক্ষর জাতি ছিল। যারা কোন রাজত্ব বা ব্যাবসা- বাণিজ্য কিংবা ধর্মীয় কোন বন্ধনে আবদ্ধ ছিলনা। আরবদের যাযাবর জীবন-যাপন, নানান জায়গায় যাতায়াত, বিভন্ন গোত্রের সাথে সহাবস্থান ও বিহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সমার্থবোধক শব্দের মত আরবি ভাষার মধ্যেও দোটানা অবস্থা তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিলনা। তেমনিভাবে উপভাষাগুলোতে বাক্যের গঠন, ই’রাব, তা'লীল, শব্দের পরিবর্তন ও উচ্চারণেও যথেষ্ট প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়, যেমন- বনু কুধাআর ‘আজআজা’, বনু হিময়ারের ‘তমতমানিয়্যাহ’, বনু হুযাইলের ‘ফুহফাহাহ’, বনু তামিমের ‘আনআ'না’, বনু আসাদের ‘কাশকাশাহ’, বানু তায়্যের ‘কাতআহ’ এছাড়াও এমন আরো অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো কথ্য ভাষাগুলোতে যোজন-যোজন দূরত্ব তৈরি করেছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আরবি ভাষাকেও স্বতন্ত্র কয়েকটি ভাষায় ভাগ করা যেতে পারে। যে ভাষাগুলো খোদ আরবি ভাষা-ভাষীদের কাছেও দূর্বোধ্য হয়ে উঠতে পারে এবং ভাষাগুলোর শেকড় খুঁজে বের করাটাও দুঃসাধ্য হয়ে উঠতে পারে ।

আরবদের ভাষা সমূহ মুলত মৌলিক দুটি ভাষাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সেগুলো হলো উত্তরের ভাষা ও দক্ষিণের ভাষা। এই ভাষা দ্বয়ের মাঝে ইরাব, সর্বনাম, শব্দের উৎপত্তি ও গঠনে যোজন -যোজন পার্থক্য রয়েছে। ভাষাবিদ আমর ইবনে আলা বলেন: “ হিময়ারিদের কথ্য ভাষা আমাদের কথ্য ভাষার মত নয় এবং তাদের ভাষাও আমাদের ভাষা নয় ”। এতদসত্বেও ভাষা দুইটি পরস্পর থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়। জার্মান গবেষক গ্লিজারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী ৪৪৭ খৃিস্টাব্দে বিশাল এক জলোচ্ছ্বাসের পর কাহতানিরা নিজ দেশ ত্যাগ করে জাজিরাতুল আরবের উত্তরদিকে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তারা ইরাক ও শামে আদনানিদের উপর আক্রমণন চালিয়ে তাদের পদানত করে। ইতোপূর্বে কাহতানিরা ইয়েমেনেও আদনানিদেরকে পরাজিত করেছিল। উভয় গোত্রের মাঝে কূটনীতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপিত হলে উভয় গোত্রের ভাষার শব্দের মধ্যেও একটা যোগসূত্র তৈরি হয়। উচ্চারণের ক্ষেত্রে উভয় গোত্রের উপভাষার মধ্যে মিলা- মিল থাকলেও উভয় গোত্রের দ্বন্দের কারণে একটির উপর আরেকটির প্রাধাণ্য পাওয়ার তেমন কোন সুযোগ ছিলনা। ষষ্ঠ হিজরি পর্যন্ত এই অবস্থা বিরাজমান ছিল । ইয়েমেনে আবিসিনিয় ও পারসিকদের একের এক আক্রমণে হিময়ারি সম্রাজ্যের প্রভাব-প্রতিপত্তি ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে থাকে। অপরদিকে আদনানিরা তাদের বীপরিতে হজ্জের মৌসুম, বাণিজ্যহাট, হিময়ারি ও পারসিকদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যুদ্ধ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে রুম ও আবিসিনিয়ার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তাদের মধ্যে সংঘবদ্ধতা,সম্প্রীতি, স্বাধীনতা ও বিপ্লবের পটভূমি তৈরি হয়েছিল। এরপর আদনানিরা নিজেদের ভাষাকে পরাজিত হিময়ারিদের উপর চাপিয়ে দিতে লাগল। ইয়েমেনি জাতির উপভাষা ও দক্ষিণাঞ্চালের উপভাষাগুলো বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে পূর্বের কারণগুলো সাথে ইসলামের আবির্ভাবও সমান্তরালে কাজ করেছে। ফলে বর্তমানে হিময়ারিদের ভাষা ও সাহিত্য এবং তাদের ইতিহাস কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে।

Comments

    Please login to post comment. Login