পোস্টস

গল্প

বেটোভেন - মোৎসার্ট মুখোমুখি

৩ জুন ২০২৪

মিলু আমান

লুডভিগ পিয়ানো বাজাচ্ছে একটা কনসার্টে, কিন্তু তাকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। একটু পরেই তাকে ভিয়েনার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। জার্মানির ‘বন’ শহর থেকে অষ্ট্রিয়ায় পাড়ি দিবে উল্ফগ্যাং আমাডেয়াস মোৎসার্টের সাথে দেখা করতে। লুডভিগ সবে কৈশোর পেরিয়েছে, যদিও এরই মাঝে লুডভিগ বনের একটা দলের সাথে নিয়মিত পিয়ানো বাজায়। দলের থেকে ছয় মাসের ছুটি নিয়ে লুডভিগ চলছে ভিয়েনায়, মোৎসার্টের কাছে দীক্ষা নেয়ার সুপ্ত বাসনা নিয়ে। 

 

মোৎসার্ট সেসময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো সঙ্গীতজ্ঞ। আর সেটা সে সময়ই সবাই বুঝতে পারে। ত্রিশের কোটায় পা দেয়ার আগেই সারা বিশ্বজুড়ে খ্যাতির শিখরে মোৎসার্ট। এই বয়সেই তিনি ভিয়েনা সিম্ফনি আর্কেস্ট্রা পরিচালনা করেন। অপেরা, কন্সার্টো, সিম্ফনি, সোনাটা—সবকিছুতেই তার পারদর্শীতার ছোঁয়া। বিভিন্ন দেশের রাজা, কাউন্ট, ইলেক্টর, আর্চবিশপ, ডিউক আর প্রিন্স সবার সাথে মোৎসার্টের উঠাবসা। 

 

ভিয়েনায় পৌঁছেই লুডভিগ আর সময় নষ্ট করে না। তার যেন আর তর সইছিল না, কোনো রকম খবর না দিয়েই লুডভিগ হাজির হয়ে যায় মোৎসার্টের ‘ক্যামসিনা’ হাউসে। 

মোৎসার্ট সেদিন তার নিমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে নৈশভোজে আয়োজন করেছেন। বাড়ি ভরতি আমন্ত্রিত সব অতিথি। এ সময় মোৎসার্টের স্ত্রী কনস্টেঞ্জ এসে লুডভিগের আসার খবর দেন। 

মোৎসার্ট প্রথমটায় চিন্তায় পড়ে যান, কে এই লুডভিগ? সে সময় মনে পড়লো এক ইলেক্টর আর্চবিশপ তাকে বলেছিলেন একটা ছেলের কথা। খুব নাকি ভালো পিয়ানো বাজায়, তাকে শিষ্য হিসেবে নিতে পরামর্শ দেন। মোৎসার্ট এই কথা শুনেই বারণ করে দেন। এই রকম গল্প শুনে তিনি অভ্যস্থ। অনেককে পরখও করেছেন কয়েকবার, কিন্তু সত্যিকার অর্থে সেরকম কাউকেই তার এখনও চোখে পড়েনি। তাই আর নতুন কাউকে খোঁজার ব্যাপারে মোৎসার্ট নতুন করে একদমই উৎসাহী হন না। পরে ক্ল্যাসিকেল মিউজিক সমঝদার এক কাউন্টও লুডভিগের কথা অনেক করে বলে। সে নাকি নিজে লুডভিগের বাজানো শুনেছে। তাদের পীড়াপীড়িতে মোৎসার্ট সাক্ষাৎ করার জন্য সম্মতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সে তো অনেক দিন আগের কথা! দিনতারিখ কিছুই ঠিক করা হয়নি। এমনি হুট করে কেউ কারও বাড়িতে আসে না। অন্তত মোৎসার্টের মতো কারও সাথে দেখা করার জন্য তো নয়ই। 

স্ত্রী কনস্টেঞ্জ সব শুনে বললেন, “কী আর করা, এত দূর থেকে এসেছে ছেলেটা। মিউজিক রুমটা খুলে দিতে বলি।”

এই উটকো ঝামেলায় পড়ে মোৎসার্ট বেশ বিব্রত হলেন। ফরমায়েশি কাজ এজন্যই তার ভীষণ অপছন্দের।

 

মোৎসার্টের মিউজিক রুমে দাঁড়িয়ে আছে লুডভিগ। তার কাছে ঠিক যেন একটা স্বপ্নের মতো লাগছে সবকিছু। মোৎসার্ট বেশ বিরক্তি নিয়ে মিউজিক রুমে প্রবেশ করলেন, প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন “কী নাম বললে? লুডভিগ?”

লুডভিগ সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পুরো নাম বলে উঠে, “লুডভিগ ভ্যান বেটোভেন।”

“হুম!” মোৎসার্ট আবারও প্রশ্ন করেন, “আমার কাছে কেন এসেছ? আমি নতুন ছাত্র নিতে একদমই আগ্রহী নই।”

ইতস্ততভাবে বেটোভেন বলে উঠে, “আমার বাজানো যদি একটু শুনতেন...”

মোৎসার্ট বুঝতে পারলেন এই ছেলে নাছোড়বান্দা। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে ইশারায় ঘরের মাঝের পিয়ানোটি দেখান। বেটোভেন পিয়ানোতে বসে, মোৎসার্টের একটা পিয়ানো সিম্ফনি বাজাতে শুরু করে। বাজানোর মাঝখানেই মোৎসার্ট তাকে থামতে বলেন, “এটা তো যে কেউই বাজাতে পারে...”

বেটোভেন পিয়ানো ছেড়ে উঠে পড়ে। “আপনি নতুন কোনো একটা সুর শুরু করে দিন, বাকিটা আমি শেষ করার চেষ্টা করবো।”

প্রস্তাবটা মোৎসার্টের নিজেরও বেশ পছন্দ হলো। তিনি পিয়ানোতে বসে গেলেন, একটা সুর ওঠালেন, যা আগে কেউই শুনেনি। এবার তিনি উঠে বেটোভেনকে পিয়ানো ছেড়ে দিলেন। মোৎসার্ট যেখানে সুরটা ছেড়ে গেলেন, ঠিক তারপর থেকেই শুরু করলো বেটোভেন। মোৎসার্ট সম্মহিত হয়ে শুনছেন, আর যতই বেটোভেনের বাজানো তিনি শুনছেন, ততই তার প্রতিভায় অবাক হয়ে যাচ্ছেন। 

বেটোভেন তার বাজানো শেষ করে মোৎসার্টের দিকে তাকায়। মোৎসার্ট কিছু না বলে উঠে দাঁড়ান। বেটোভেন হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। মোৎসার্ট মিউজিক রুম থেকে বের হওয়ার পথে তাঁর স্ত্রীকে উচ্চস্বরে ডেকে উঠেন, “স্ট্যানজি, স্ট্যানজি।”

স্ত্রী কনস্টেঞ্জ তাঁর ডাকে সারা দিয়ে আসেন, মোৎসার্ট তখন আঙুল তুলে বেটোভেনকে দেখিয়ে বলেন, “দেখে নিয়ো তুমি, আমার মতো এই ছেলেকেও একদিন পৃথিবীর সবাই চিনবে।” 

মোৎসার্ট, বেটোভেনকে দীক্ষা দিতে সম্মতি প্রকাশ করেন। বেটোভেন আনন্দে আত্মহারা, জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া সেদিন যেন সে পেয়েছিল। 

কিন্তু হায়! সেই একই দিনে বন থেকে জরুরি খবর আসে, বেটোভেনের মা শয্যাশায়ী! বাধ্য হয়েই আবার জার্মানি ফিরে যেতে হয়। বেটোভেন, মোৎসার্টকে কথা দিয়ে আসে; দীক্ষা নেয়ার জন্য সে আবার ভিয়েনা ফিরে আসবে। 

 

এর কয়েক মাসের মাঝেই বেটোভেনের মা মারা যায়। বেটোভেন আবার বনের একটা অর্কেস্ট্রায় পিয়ানো বাজানো শুরু করে। বেটোভেনের বাবাও অর্কেস্ট্রার একজন ট্যানর গায়ক ছিলেন, কিন্তু বয়সের কারণে আগের মতো আর গাইতে পারতেন না। তাই তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও অবসরে পাঠানো হয়। বেটোভেনের বাবা কিছুতেই তা মেনে নিতে পারেননি। প্রায়ই তিনি মাতাল হয়ে উলটাপালটা কাজ করে বসতেন। একদিন তাকে ধরে নিয়ে যায়, শুধু মাত্র বেটোভেনের জন্য জেল খাটতে হয়নি। কিন্তু তাকে শর্ত দেয়া হলো, বন শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে হবে। অগত্যা তাই মেনে নিতে হয়। বাবা গ্রামে চলে যায়, আর ছেলে শহরে পিয়ানো বাজায়। 

 

এসময় বেটোভেনের পিয়ানো বাজানো ফ্রাঞ্জ জোসেফ হাইডেনের চোখে পড়ে। বৃদ্ধ হাইডেন তখনকার সবচেয়ে গুণী পিয়ানিস্ট, নিয়মিত মোৎসার্টের সাথে বাজান। ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকে নতুন মাত্রায় পৌঁছনোর পেছনে মোৎসার্টের পাশাপাশি হাইডেনের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। বন থেকে ইংল্যান্ডে যাওয়ার পথে হঠাৎ মোৎসার্টের সাথে দেখা হয় তাঁর। হাইডেন, বেটোভেনকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে ভিয়েনা আসার প্রস্তাব দেন। 

 

ভিয়েনাতে যেতে আরও প্রায় বছর দুই লেগে যায় বেটোভেনের। ততদিনে মোৎসার্ট মারা যান, মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। তাঁর কাছে দীক্ষা নেয়ার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যায় বেটোভেনের। হাইডেনের কাছে ভিয়েনাতে যেতেই আবারও দুর্ঘটনা! বন থেকে খবর আসে—বেটোভেনের বাবা মারা গেছে। এবার আর বেটোভেনের বনে ফেরা হয়নি। 

যদিও হাইডেনের সাথেও বেশি দিন কাজ করা হয়ে উঠেনি বেটোভেনের। তবে দ্রুতই ভিয়েনায় বেটোভেনের নাম ছড়াতে লাগলো। মোৎসার্টের কাছে দীক্ষা না নিয়েও, এ যেন সত্যিই তার উত্তরসূরী! ধীরে ধীরে পুরো বিশ্বে বেটোভেনের নাম ছড়িয়ে পড়ল। 

 

মোৎসার্টের শূন্যস্থান পুরণ করার জন্যই যেন বেটোভেনের আগমন হয়। সারা বিশ্ব জয় করে থেকে গেলেন ভিয়েনাতেই, কিন্তু জীবনে আর কোনোদিনই বনে ফিরে যাননি বেটোভেন।