সন হাউস একটা জুক জয়েন্টে ব্লুজ মিউজিক পরিবেশন করছেন-
I got a letter this morning
What do you reckon it read?
It said the girl you love is dead
Said “Hurry, Hurry because the girl you love is dead”
Well I packed up my suitcase
I took off down the road
When I got there she was laying on the cooling board
It looked like ten thousand people standing around the burial ground
I didn’t know I loved her 'till they began to let her down
You know it’s so hard to love
Someone that don’t love you
Won’t get satisfaction
Don’t care what you do
উনিশশো শতকের প্রথমভাগে আফ্রিকান-আমেরিকান অধ্যুষিত স্টেইটগুলোতে ব্লুজ মিউজিক বার বেশ জনপ্রিয়। দিনের কাজ শেষে কৃষ্ণাঙ্গরা এইসব ‘জুক জয়েন্টে’ জড়ো হয়। পানীয় হাতে গান-নাচ উপভোগ করে। কাগজকলমে গত শতকের শেষভাগে আব্রাহাম লিংকনের হাতে দাসত্ব শেষ হলেও, বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গরা তখনও কৃষ্ণাঙ্গদের মেনে তো নেয়নি, বরং তাদের একসাথে মেলামেশা বলতে গেলে হয়ই না। আক্ষরিক অর্থে তখনও কালো মানুষদের জোটেনি মুক্তি, মেলেনি তাদের প্রাপ্য। এখানে মিউজিকও যেন বর্ণ বিদ্বেষী!
ট্রাভেলিং মিউজিশিয়ানরা এইরকম জুক-জয়েন্টগুলোতে গান গেয়ে উপার্জনের পথ বেছে নেয়। আর তাদের এইসব পরিবেশনের মধ্যদিয়েই ধীরে ধীরে গড়ে উঠে মিউজিশিয়ানদের ক্যারিয়ার। সারা বছর জুড়ে তারা এইসব জয়েন্টে গান করে। যদিও গোটা আমেরিকাতে তখন ব্ল্যাকদের মিউজিক একরকম নিষিদ্ধ বলা চলে। তবে তা শুধু শ্বেতাঙ্গদের জন্যই। আফ্রিকান আমেরিকান স্টেটগুলো ছাড়া অন্য কোথাও কৃষ্ণাঙ্গ গায়করা তখনও স্থান করে নিতে পারেনি। ব্ল্যাক মিউজিশিয়ান হিসেবে সেসময় সন হাউস পরিচিত নাম, যদিও সেসময় তা শুধু আফ্রিকান আমেরিকানদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল।
সন হাউস গান শেষ করে স্টেজ ছাড়ছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে লিকলিকে গড়নের একটা ছেলে দৌড়ে এসে সন হাউসকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে স্টেজে উঠে যায়। তার লক্ষ্য ষ্টেজে রাখা গিটারটার দিকে। যেই না গিটারটা ধরতে যাবে, জয়েন্টের মালিক দৌড়ে এসে গিটারটা কেড়ে নেয়। সন হাউস অবাক হয়ে বলে, “কী ব্যাপার, উইলি? ওকে আটকালে কেন? একটু বাজাতে চাচ্ছে, দাও না। নিশ্চয়ই ভালো বাজাবে।”
উইলি বলে উঠে, “রবার্ট গিটার বাজাবে? তা হলেই হয়েছে। তুমি জান না সন, ও একদমই গিটারটা বাজাতে পারে না। ও গিটার বাজালে, সবাই বিরক্ত হয়ে আমার জয়েন্ট থেকে চলে যায়। আমার ব্যাবসার অনেক ক্ষতি হয়।”
সন হাউস বলে, “আহা, তুমি গিটারটা দাও তো ওর হাতে, শুনি। কত আর খারাপ বাজাবে?”
সন হাউসের পিড়াপীড়িতে উইলি গিটারটা রবার্টের হাতে ফিরিয়ে দেয়। রবার্ট গিটারটা পেয়ে আনাড়ির মতো করতে লাগলো। সন হাউস দুই হাত কানে দিতে বাধ্য হলেন, তিনি বললেন, “রবার্ট, তোমায় দিয়ে আর যাই হোক গিটার হবে না। তুমি এটার আশা ছেড়ে দাও।”
রবার্ট মন খারাপ করায় সন হাউস তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন, “এতে কিন্তু তোমার বেশ ভালো হলো, রবার্ট। তোমাকে এই গিটার নিয়ে আর কখনও ভাবতে হবে না। তুমি অন্য কিছু এখন মন দিয়ে করতে পারবে, দেখবে সেটায় নিশ্চয়ই ভালো করবে।”
কোনো কথার উত্তর দেয় না রবার্ট, সন হাউস কিছু বোঝার আগেই গিটারটা ছুঁড়ে ফেলে জয়েন্ট থেকে এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় সে।
উইলি চেঁচিয়ে ওঠে, “দিলে আমার গিটারটা ভেঙে। আর যদি কখনও তোমায় দেখি আমার জয়েন্টে!”
সন হাউস অবাক দর্শক!
পাশেই এক হোটেলে ওঠে সন হাউস, অনেক দিন থাকবে এবার। সনের অনেক বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজন এই এলাকায়। হোটেলে নির্ঘুম কাটে সনের, সারা রাত ঘুমাতে পারল না সে। হোটেল বেশ আরামের বলা যায়, কিন্তু বারবারই সনের ওই লিকলিকে ছেলেটির কথা মনে পড়ছে। তার দীপ্ত চোখের আসহায় মুখটা সন কিছুতেই ভুলতে পারছে না। এখন মনে হচ্ছে, বড়ো বাড়াবাড়ি বলে ফেলেছে সে ছেলেটিকে।
পরদিন জয়েন্টে গিয়েই সন হাউস ছেলেটির খোঁজ করে। কিন্তু কেউ বলতে পারল না। উইলি বলল, “আপদ বিদেয় হয়েছে, তুমি আবার ওকে খুঁজছো কেন?”
“না কাল রাতে বড্ড বাড়াবাড়ি বলে ফেলেছি ছেলেটিকে, একটু ভালো করে পরখ করে দেখতাম...”
“তা আর কাজ নেই। আমার ব্যাবসা লাটে উঠুক আরকি!”
সন আর কথা না বাড়িয়ে স্টেজে উঠে গেল। সন হাউস সেই একই জুক জয়েন্ট আর হোটেলে অনেক দিন কাটিয়ে দিল। জুক জয়েন্টে প্রতি রাতেই গান গাওয়ার সময় রবার্টের কথা মনে পড়ে যায় তার। সন হাউস একরকম অনুশোচনায় পড়ে যায়।
কয়েক মাস পর, এক রাতে নিয়মিত সন হাউস গান পরিবেশন করছিলো, এমন সময় দরজা ঠেলে এক তরুণ জুক জয়েন্টে প্রবেশ করে। কাঁধে তার ছালায় মোড়ানো একটা গিটার। সে সোজা স্টেজের দিকে এগিয়ে যায়। উইলি তাকে বাধা দিতে চায়, কিন্তু তার দীপ্ত চোখের চাহনিতে উইলি ভয় পেয়ে সরে দাঁড়ায়।
সে তার গিটারটি বের করে সনের গানের সাথে বাজাতে শুরু করে। গিটারের শব্দ শুনে সন হাউস ফিরে তাকান। এতক্ষণ সন কিছুই খেয়াল করেনি। চমকে উঠে সন, আরে! এ তো স্বয়ং রবার্ট হাজির। লিকলিকে রবার্ট আজ পোড়খাওয়া রবার্ট জন্সন। সে শুধু বলল, “অ্যাম আই রেডি টু প্লে দ্য গিটার নাউ, সন?” বলেই সে শুরু করলো গান...
I went to the crossroad, fell down on my knees
Asked the Lord above “have mercy, now save poor Bob, if you please”
Standing at the crossroad, tried to flag a ride
Didn’t nobody seem to know me, everybody pass me by
Standing at the crossroad, rising sun going down
I believe to my soul, now, poor Bob is sinking down
You can run, you can run, tell my friend Willie Brown
That I got the crossroad blues this morning, Lord, I’m sinking down
And I went to the crossroad, mama, I looked east and west
Lord, I didn’t have no sweet woman, well babe, in my distress
একের পর এক চলতে লাগলো গান। তার গিটারে জয়েন্টের সবাই মেতে উঠে, সন হাউস তো রীতিমতো হতবাক! এই রবার্ট জন্সনকে সে যেন চিনতে পারছে না, এ যেন অন্য কেউ। সন হাউসের চোয়াল যেন মাটিতে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।
কেউ কোনো কথা বলতে পারছিল না, রবার্ট জন্সনের গিটারের মূর্ছনা আর গানে গানে সময় যেন কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়। গানের শেষে সন হাউস বিকট শব্দে বলে উঠলেন, “রবার্ট! তুমি নিশ্চয়ই তোমার আত্মা শয়তানের কাছে সঁপে দিয়েছ। তা না হলে কোনোভাবেই এত কম সময়ে ব্লুজ বিদ্যা তুমি রপ্ত করতে পার না! এটা তোমার কাছে এত দ্রুত কোনো ভাবেই আসতে পারে না। আমার এত দিনের গায়ক জীবনেও আমি তোমার এই দক্ষতা অর্জন করতে পারিনি। বলো, তুমি শয়তানের দেখা পেয়েছিলে... তাই না?”
রবার্ট জন্সন কোনো উত্তর দেয় না। গিটারটা হাতে নিয়ে শুধু হাসতে হাসতে জয়েন্ট থেকে বের হয়ে যায়। সে রাতেই সন হাউস সেই শহর থেকে চলে যায়। রবার্ট নিয়মিত সেই জুক জয়েন্টে পরিবেশন শুরু করে। উইলির জুক জয়েন্টের ব্যাবসা জমে উঠে।
এদিকে রবার্ট জন্সনের ফিরে আসার গল্প চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। সেই রাতে সন হাউসের কথায় কষ্ট পেয়ে রবার্ট জন্সন জয়েন্ট থেকে বেরিয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করে। এরমাঝে আবার শুরু হলো বৃষ্টি, কিন্তু সেদিকে রবার্টের খেয়াল ছিল না। একসময় শহরের একটু বাইরে চলে আসে, নির্জন একটা চৌরাস্তায়। রবার্ট কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সেই ক্রসরোডের উপরে।
এরপর অনেক কষ্টে একটা গিটার জোগাড় করে রবার্ট। নাওয়া-খাওয়া ভুলে, সেই ক্রসরোডের এক কোনায় সে রাতের পর রাত গিটার বাজানো শুরু করে। গিটার বাজানো চলতে লাগলো দিনের পর দিন।
এক ঝড়ের রাতে রবার্ট গিটার বাজাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই সুর তুলতে পারছিল না। এসময় হঠাৎ ভয়ংকর ফ্যাসফ্যাসে একটা কণ্ঠ শুনতে পায়, “আমি তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারি।”
রবার্ট আতঙ্কে বলে উঠে, “কে ওখানে?”
ঠিক সে মুহূর্তে যেন হাওয়া থেকে একটা অবয়ব তৈরি হয়। এ যেন সাক্ষাৎ শয়তান রবার্টের সামনে উপস্থিত হয়েছে। ডেভিলের চেহারা ভালো করে ঠিক বোঝা যায় না, গায়ে কালো একটা কোট। তার সাথে হিংস্র চেহারার একটা হাউন্ড। এবার হাউন্ডটা করুণ সুরে ডেকে উঠছে, যেন গান গেয়ে উঠে।
রবার্ট ভয় পাওয়া ভুলে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়, এমন কুৎসিত একটা জন্তু কিন্তু এমন সুন্দর তার কণ্ঠ! আবার ভয়ও পাচ্ছে সে, বলে ওঠে, “আমার কাছে কী চাই তোমার?”
“আত্মরূপ! তোমার আত্মা আমার কাছে সঁপে দিতে হবে, বিনিময়ে পূরণ হবে তোমার মনের বাসনা।” আবার একটু হেসে বলে, “নরকের হাউন্ডের মতো সুরে গান করতে পারবে, আর তোমার গিটারের মূর্ছনা শুনতে সবাই ছুটে আসবে দূরদূরান্ত থেকে।”
রবার্ট নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে যায়। ডেভিল বলল, “যা, তোর কথা রাখলাম। কিন্তু মনে রাখিস, যেকোনো সময় আমি তোর আত্মা নিয়ে যেতে আসব।“ এই বলে ডেভিল ধীরে ধীরে আবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
ডেলটা মিসিসিপির জুক জয়েন্ট ছাড়িয়ে রবার্ট জন্সন ট্রাভেল করতে লাগলো বিভিন্ন স্টেইটে। আর যেখানেই সে যায়, উপচে পড়ে ভিড়। তাকে দেখার জন্য সত্যিই দূরদূরান্ত থেকে সবাই সমাগম করতে লাগলো। রবার্ট জন্সনকে নিয়ে নানা রকম গল্পগুলোও ছড়িয়ে পরতে লাগলো। সে রকম এক গল্প শুনেই আর্নি ওর্টল মিসিসিপিতে আসে রবার্ট জন্সনকে সাক্ষাৎ দেখতে। প্রথমবার রবার্টের গান শুনে আর্নি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কী আদ্ভুত সুন্দর পরিবেশনা, গিটার আর গানের যেন অপূর্ব মিলন ঘটিয়েছে রবার্ট। আর্নি আর সময় নষ্ট করে না, টেক্সাস শহরের গান্টার হোটেলের রুম নম্বর ৪১৪ প্রথমবারের মতো রেকর্ড করে রবার্ট জন্সন ‘ক্রসরোড ব্লুজ’, ‘হেল হাউন্ড অন মাই ট্রেইল’ সহ প্রায় দশটি গান। বিনিময়ে রবার্টকে দেয়া হয় মাত্র কয়েকশো ডলার।
আর্নি আমেরিকান রেকর্ড কোম্পানির হয়ে তখন কাজ করছিল, কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিদের শোনায় রবার্টের গান। সবাই মোটামুটি বুঝতে পারল, রবার্ট সাধারণ কেউ না। রিলিজ হলো রবার্ট জন্সনের রেকর্ড। এর আগে ব্লুজ গান তেমন একটা জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু রবার্ট জন্সনের ব্লুজ সবাই লুফে নেয়। এবার ডালাসের একটা স্টুডিয়োতে রেকর্ড করে রবার্ট ‘মি অ্যান্ড দ্য ডেভিল ব্লুজ’ সহ আরও প্রায় গোটা বিশেক গান। কিছুদিনের মাঝেই শুরু হবে তার অল আমেরিকান ট্যুর। কিন্তু তা আর হতে দিল না ডেভিল, ট্যুরের আগেই সে হাজির হয়ে যায়।
রবার্ট প্রথমে বুঝতেই পারেনি, সে একটা জুক জয়েন্টে গান করছিল সেসময়। লম্বা কালো কোট পরা এক বিশালদেহী, কুৎসিত একটা হাসি দিয়ে স্টেজের একদম কাছে এসে তাকে দেখছে। গান শেষ করে রবার্ট যখন উঠতে যাচ্ছে, তখনি সে অট্টহাসি দিয়ে বলে উঠে, “আমার জন্য কি একটা গান গাইবে না, রবার্ট জন্সন? আর বলা তো যায় না, দিস কুড বি ইয়োর লাস্ট সং!”
রবার্ট অস্বস্তি নিয়েই আরেকটি গান শুরু করে। কিন্তু গান শেষে লোকটিকে আর খুঁজে পায় না সে। রবার্ট জয়েন্টে তার নির্ধারিত টেবিলে গিয়ে বসে পানাহারের জন্য। রবার্ট যখন প্রায় মাতাল, ঠিক তখনি আবার সেই কুৎসিত হাসি শুনতে পায় সে। রবার্ট একটু চমকে উঠে।
“আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম, রবার্ট।” লোকটির দুই হাতে দুইটা পানীয়ের গ্লাস। “আমার জন্য গান করলে, তাই তোমার জন্য এটা নিয়ে এসেছি।”
এই বলে সে একটা গ্লাস এগিয়ে দেয়। রবার্ট বলে, “আজ বাদ দেই, এমনিতেই অনেক হয়ে গেছে...”
“সে কি? তুমি কথা দিয়েছিলে...”
এই বলে সে এক রকম জোর করেই গ্লাসটি রবার্টের মুখের কাছে নিয়ে যায়। কোনো উপায় না দেখে, রবার্ট সেটা পান করে। কিছু বোঝার আগেই সে লোকটি অট্টহাসি দিয়ে, চোখের নিমিষে আবারও উধাও হয়ে যায়। কী বিকট সে হাসি, যেন বেড়েই চলেছে। রবার্ট জ্ঞান হারায়। মাত্র ২৭ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রবার্ট জন্সন।