ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই প্রথম পশ্চিমা মিডিয়ার মুখোমুখি হলেন। মার্কিন সাংবাদিক টাকার কার্লসন এর নেয়া সাক্ষাৎকারটি অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ পুরো ঘটনাটি রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও দেখা জরুরী, যা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না পশ্চিমা মিডিয়ার আগ্রাসী এবং একমুখী প্রচারণার জন্য।
সাক্ষাৎকারটি বেশ দীর্ঘ হওয়ায় ধাপে ধাপে প্রকাশ করছি। কলেবর যাতে বেশি দীর্ঘায়িত না হয় সেজন্য কিছুটা পরিমার্জনাও করা হয়েছে, তবে গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু বাদ দেয়া হয় নি। আশা করি সবাই ধৈর্য সহকারে পড়বেন এবং মতামত জানাবেন।

২য় পর্ব
ভ্লাদিমির পুতিন:
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রকৃত পতনের শুরু কিন্তু রাশিয়ান নেতৃত্বের হাতেই। আমি জানি না সেই সময়কার রাশিয়ান নেতৃবৃন্দ তখন কী ভাবছিলেন, তবে আমার সন্দেহ, উনারা যে ধরে নিয়েছিলেন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে তার পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল।

প্রথমত, আমার মনে হয়, তখনকার রাশিয়ান নেতৃত্ব বিশ্বাস করতেন যে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সম্পর্কের মূল ভিত্তি তাদের একই ভাষা। সেখানকার জনসংখ্যার ৯০% এরও বেশি মানুষ তখন রুশ ভাষায় কথা বলতো। প্রতি তিনজনে একজনের সাথে কোন না কোন ধরণের পারিবারিক বন্ধুত্বের বন্ধন, সাধারণ সংস্কৃতি কিংবা সাধারণ ইতিহাস ছিল। সর্বোপরি, শত বছরেরও বেশি সময় ধরে ছিল একই রাষ্ট্রে একই ধর্মে বিশ্বাসী লোকজনের সহাবস্থান এবং একে অপরের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত অর্থনীতি। এসব মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের উপস্থিতিই আমাদের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে।
দ্বিতীয় বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি চাই একজন আমেরিকান নাগরিক হিসেবে আপনি এবং আপনার দর্শকরাও এর সম্পর্কে জানুন। প্রাক্তন রাশিয়ান নেতৃত্ব ধরে নিয়েছিল যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়ে গেছে তাই আদর্শের ভিত্তিতে আর কোথাও কোনও ধরণের বিভাজন রেখা নেই। এমনকি রাশিয়াও স্বেচ্ছায় ও সক্রিয়ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির ব্যাপারে একমত ছিল। ভেবেছিল, তথাকথিত "সভ্য পশ্চিম" এই পরিবর্তনকে সহযোগীতার আমন্ত্রণ হিসাবে বিবেচনা করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তথাকথিত পশ্চিমা বিশ্ব - উভয়ের কাছেই এরকম প্রত্যাশা ছিল রাশিয়ার।
জার্মানিতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির গুরুত্বপূর্ণ একজন রাজনীতিবিদ এগন বার তাদের মাঝে অন্যতম। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন পতনের দ্বারপ্রান্তে, তখন তিনি সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপচারিতার সময় বেশ জোর দিয়ে ইউরোপের জন্য নতুন এক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। তার অভিমত ছিল, জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া এবং অন্যান্য মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করে একটি নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা উচিত, তবে ন্যাটোর সম্প্রসারণের কোন প্রয়োজন নেই। তিনি হুবুহু এই কথাটিই বলেছিলেন। ন্যাটো সম্প্রসারিত হলে, পরিস্থিতি আবার ঠিক ঠান্ডা যুদ্ধের (কোল্ড ওয়ার) সময়কার মতোই হবে, পার্থক্য হচ্ছে এবার তা হবে রাশিয়ার সীমান্তের আরো কাছাকাছি। দু:খের বিষয়, জ্ঞানী ব্যক্তিটির কথায় কেউ কান দেয় নি। "যদি," তিনি বলেছিলেন, "তোমরা আমার কথা না শোনো, তাহলে আর কখনও মস্কোতে পা রাখব না।"
সবকিছু ঠিক সেভাবেই ঘটে চলেছে যেভাবে তিনি বলেছিলেন।
টাকার কার্লসন:
হ্যাঁ উনার কথাগুলো সত্যি হয়েছে, আপনিও এটা অনেকবারই উল্লেখ করেছেন। আপনার দাবিটাও সঠিক। আমেরিকার অনেকেই ভেবেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের সাথে সাথে রাশিয়া ও আমেরিকার সম্পর্ক ভালো হয়ে যাবে, কিন্তু ঘটেছিল এর উল্টোটা। কিন্তু আপনি কখনোই ব্যাখ্যা করেননি কেন এমনটা ঘটলো, শুধু এটুকুই বলেছেন যে পশ্চিমারা শক্তিশালী রাশিয়াকে ভয় পায়। কিন্তু আমাদের তো একটি শক্তিশালী চীন ও আছে যাকে পশ্চিমারা খুব একটা ভয় পায় বলে মনে হয় না। আপনার মতে, রাশিয়ার কোন দিকটি দেখে নীতিনির্ধারকদের মনে হয়েছে যে একে লাগাম দেয়া প্রয়োজন?
ভ্লাদিমির পুতিন:
পশ্চিমা বিশ্ব শক্তিশালী রাশিয়ার চেয়ে শক্তিশালী চীনকেই বেশি ভয় পায় কারণ রাশিয়ার জনসংখ্যা ১৫ কোটি এবং চীনের জনসংখ্যা ১.৫ বিলিয়ন। সেই সাথে এর অর্থনীতিও কিন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, বছরে ৫% হারে, যা আগে আরো বেশি ছিল। কিন্তু চীনের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। বিসমার্ক বলেছিলেন, সম্ভাবনা থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক দিয়ে চীনের সম্ভাবনা কিন্তু বিশাল। ক্রয়ক্ষমতার সমতা এবং অর্থনীতির আকারের দিক থেকে এটি আজ বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি যা অনেক আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে এবং দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে।
কে কাকে ভয় পায় তা নিয়ে আলোচনা না করে আসুন সত্যটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। ১৯৯১ সালের পর রাশিয়া আশা করেছিল যে সভ্য দেশগুলি তাদের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবারে রাশিয়াকে স্বাগত জানাবে, কিন্তু এরকম কিছুই ঘটেনি। আপনারা আমাদের সাথে প্রতারণা করেছেন। অবশ্যই আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলছি না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলছি। ন্যাটো পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ করবে না এরকম প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর আরও পাঁচবার সম্প্রসারণ ঘটে। প্রতিবার ই আমরা সহ্য করেছি, তাদের বোঝানোরও চেষ্টাও করেছি। বলেছি, আমরা এখন তোমাদের মতোই বুর্জোয়া, বাজার অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল আবার ক্ষমতায় কমিউনিস্ট পার্টিরও কেউ নেই। আসুন আপসে বন্দোবস্ত করি।

তাছাড়া, একথা আমি আগেও বলেছি, প্রকাশ্যেও বলেছি, যে এক সময় আমাদের সম্পর্কের মাঝে কিছু বিষয়ে ফাটল ধরতে শুরু করে। আপনার কি মনে আছে, ইয়েলৎসিন যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে কংগ্রেসে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন তিনি সবার সামনে উচ্চারণ করলেন, “ঈশ্বর আমেরিকার মঙ্গল করুন”, “আমরা আসতে চাই আপনাদের কাছে, আমাদের আসতে দিন” - এগুলো সব ই কিন্তু ছিল ভবিষ্যৎ সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ইঙ্গিত। সবাই যখন ইয়েলৎসিন এর প্রশংসায় মেতে ছিল তখনকার সময়ের যুগোস্লাভিয়ার পরিস্থিতির কথা মনে আছে? যুগোস্লাভিয়ার পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়া শুরু হতেই ইয়েলৎসিন সার্বদের সমর্থনে আওয়াজ তুললেন, আমরাও সার্বদের রক্ষায় তাদের পক্ষে সমর্থন দিলাম। আমি জানি সেখানকার পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। তবুও রাশিয়ার পক্ষে সার্বদের সমর্থন না দিয়ে চুপচাপ থাকা সম্ভব ছিল না কারণ মার্কিনদের মত সার্বদেরও একটি অর্থোডক্স ঘরানার সংস্কৃতি রয়েছে। আর সার্বরা জাতি হিসেবেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম অনেক কষ্ট ভোগ করেছে।
যাই হোক, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইয়েলৎসিন তার সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী করলো? আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন করে বেলগ্রেডে বোমা হামলা চালানো শুরু করে দিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ছিপি খুলে বোতলবন্দী দানবটাকে বাইরে নিয়ে আসে, এরপর দেখে কোনভাবেই তো একে আর বন্দী করা যায় না। তাছাড়া, যখন রাশিয়া প্রতিবাদ জানালো এবং তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করলো, তখন কী বলা হলো? জাতিসংঘ সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইন সেকেলে হয়ে গেছে, এগুলোর এখন আর মূল্য নেই। সবাই কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের কথা বলে আর মেনে চলে, কিন্তু তাদের বেলায় বলতে শুরু করে যে সবকিছুই পুরনো হয়ে গেছে, বদলে ফেলতে হবে। এটা সত্য যে পরিবর্তন আসলেই প্রয়োজন ছিল যেহেতু ক্ষমতার ভারসাম্যই বদলে গেছে, কিন্তু এভাবে নয়। ইয়েলৎসিনকে নিয়ে প্রচুর কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি চললো, বলা হলো ব্যাটা পাঁড় মাতাল, নির্বোধ, অবুঝ আরো নানান কিছু। কিন্তু আমি আপনাকে নিশ্চিত করছি, তিনি সবকিছুই বুঝতেন।
২০০০ সালে আমি রাষ্ট্রপতি হলাম। ভেবেছিলাম, ঠিক আছে, যুগোস্লাভ সমস্যা শেষ হয়ে গেছে, এবার আমাদের সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা উচিত। প্রকাশ্যেই বললাম, রাশিয়ার জন্য আগের মত আবার দ্বার উন্মুক্ত করে দিন। এই ক্রেমলিনে বসেই তখনকার বিদায়ী রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের সাথে এক বৈঠকে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বিল, তুমি কি মনে করো রাশিয়া যদি ন্যাটোতে যোগদানের জন্য অনুরোধ করে, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব? সে বললো, সত্যি বলতে কী, প্রস্তাবটা বেশ আকর্ষণীয়। আমার মনে হয়, সম্ভব। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায়ই ডিনারে আমাকে জানালো, আমি আমার দলের সাথে কথা বলেছি, এটা এখন সম্ভব নয়। আপনি বিলকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন না। আমার মনে হচ্ছে আমাদের সাক্ষাৎকার সে ও দেখবে। সে ই নিশ্চিত করবে আমাদের মাঝে এরকম কথোপকথন হয়েছে কি হয় নি। যদি না ঘটত তবে আমি কিন্তু এমন কিছু বলতাম না। যাই হোক, এখন এটা আর সম্ভব ই না।

টাকার কার্লসন:
আপনই কি সত্যিই ন্যাটোতে যোগদান করতেন?
ভ্লাদিমির পুতিন:
দেখুন, আমি জানতে চেয়েছিলাম, এটা কি সম্ভব? আর উত্তর পেলাম, না। আমি যদি আন্তরিক ই না হতাম মার্কিন নেতৃত্বের অবস্থান জানার ব্যাপারে তবে ……..
টাকার কার্লসন:
কিন্তু যদি তিনি রাজি হতেন, আপনি কী ন্যাটোতে যোগ দিতেন?
ভ্লাদিমির পুতিন:
যদি তিনি রাজি হতেন, তাহলে অন্তত যোগদানের প্রক্রিয়াটা তো শুরু হতো। অন্যান্য অংশীদারদের মাঝে নূন্যতম সদিচ্ছা থাকলে শেষ পর্যন্ত হয়তো বাস্তবায়িতও হয়ে যেতো। কিন্তু কিছুই হয়নি। ঠিক আছে, না ই বা হলো, না মানে তো না ই, তাই না?
টাকার কার্লসন:
আমি জানি আপনি এটা নিয়ে বিরক্ত। কিন্তু আপনার কী মনে হয়, পশ্চিমারা তখন কেন আপনাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল? এই শত্রুতার কারণ কী? কেন ঠান্ডা যুদ্ধের একটি সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটলো না যার ফলে উভয়পক্ষের সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়? এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন?
ভ্লাদিমির পুতিন:
আপনি বললেন আমি বিরক্ত হয়েছিলাম। এটা বিরক্তি নয়, স্রেফ বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর বর্ণনা। আমরা স্বামী-স্ত্রী নই। তিক্ততা, বিরক্তি এসব শব্দ এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য নয়। আমরা বুঝতে পেরেছি যে আমাদের সেখানে আর স্বাগত জানানো হবে না, এটাই আসল কথা। ঠিক আছে, অসুবিধে নেই, তাহলে আসুন অন্যভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলি। আসুন খুঁজে বের করি কোথায় আমরা একসাথে কাজ করতে পারি। আপনিই আপনার নেতাদের জিজ্ঞাসা করুন না আমাদেরকে নিয়ে এত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কেন তাদের। আমি মনে হয় কিছুটা অনুমান করতে পারি কেন। রাশিয়া বিশাল বড় একটি দেশ যে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করে না আবার আমি এটাও দেখেছি যে ন্যাটোতে কিভাবে সমস্যার সমাধান করা হয়। মার্কিন নেতৃত্ব চাপ প্রয়োগ করলে সমস্ত ন্যাটো সদস্য মার্কিনীদের পক্ষেই ভোট দেয়, এমনকি ব্যাপারটা তাদের অপছন্দের হলেও। ২০০৮ সালে ইউক্রেনের সাথে এই বিষয়ে কী ঘটেছিল, সেটাও আপনাকে বলবো। এগুলো কিন্তু কোনও গোপন কথা নয়, নতুন কিছুই নেই এতে।
যাই হোক, এরপরও আমরা বিভিন্ন উপায়ে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইরাক আর মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীর কথা। আমরা কিন্তু খুব বিচক্ষণতার সাথে ও সতর্কভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছিলাম। তাদের বারবার জানিয়েছিলাম যে উত্তর ককেশাসে বিচ্ছিন্নতাবাদ বা সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু তাতে তারা কান দেয় নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার চ্যালারা রাজনৈতিক সমর্থন, তথ্য সহায়তা, আর্থিক সহায়তা এমনকি সামরিক সহায়তাও দিয়েছে ককেশাসের এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির জন্য।
আমি একবার বিষয়টি আমার সহকর্মী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির কাছেও উত্থাপন করি। তিনি বললেন, "অসম্ভব। আপনার কাছে কোন প্রমাণ আছে?" আমি বললাম, "আছে।" এ বিষয়ে আমার আগেই প্রস্তুতি নেয়া ছিল, প্রমাণ দেখাতে দেরি হয় নি। আপনি জানেন দেখার পর তিনি কী বলেছিলেন? “সব ক'টাকে লাথি মেরে বের দিব” - হুবুহু এই কথাটিই তিনি বলেছিলেন। আমরা অপেক্ষা করলাম যে কিছু ঘটবে, কিংবা কোন উত্তর আসবে, কিন্তু কিছুই এলো না। FSB পরিচালককে বললাম, "সিআইএ এর সাথে যোগাযোগ করে দেখুন তো রাষ্ট্রপতির সাথে কথোপকথনের ফলাফল কী হলো?" তিনি একবার না, দুবার যোগাযোগ করার পর আমরা একটি উত্তর পাই, আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে সেই উত্তর। সিআইএ উত্তর দিয়েছিল, "আমরা রাশিয়ার বিরোধীদের সাথে কাজ করছি। আমরা বিশ্বাস করি এটাই সঠিক পন্থা এবং এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।" হাস্যকর। ঠিক আছে, আমরাও বুঝে গিয়েছি আশা করে আর লাভ নেই।
টাকার কার্লসন:
আপনার বিরোধী শক্তির সাথে কাজ করছে! তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে সিআইএ আপনার সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করছে।
ভ্লাদিমির পুতিন:
ককেশাসে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল বিরোধী দল বলতে তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে। গেল দ্বিতীয় বিষয়। তৃতীয় ব্যাপারটি আরো গুরুত্বপূর্ণ - যখন মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হলো, তখন থেকেই সব কিছুর শুরু। এ পথে না আগানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘদিন ধরে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তাছাড়া, বুশ জুনিয়রের বাবা বুশ সিনিয়র এর সাথে দেখা করতে যখন সমুদ্র ভ্রমণে গিয়েছিলাম তখন রাষ্ট্রপতি বুশ এবং তার দলের সাথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা হয়েছিল। প্রস্তাব দিয়েছিলাম - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইউরোপকে নিয়ে যৌথভাবে একটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হোক, কিন্তু যদি একতরফাভাবে তৈরি করা হয় তবে তা হবে আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছিল যে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি মোকাবেলার জন্য এটা তৈরি করা হচ্ছে। আমার পরামর্শ ছিল একসাথে কাজ করার - রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ একসাথে মিলে। তাদের প্রস্তাবটি পছন্দও হয়েছিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, "তুমি কি সিরিয়াস?" আমি বলেছিলাম, "একদম।"
টাকার কার্লসন:
জানতে পারি কী কত সালে ছিল সেটা?
ভ্লাদিমির পুতিন:
আমার মনে নেই। ইন্টারনেটে খুঁজলে সহজেই পেয়ে যাবেন। তখন আমি বুশ সিনিয়রের আমন্ত্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। যার ব্যাপারে কথা বলছি তার থেকে আপনি আরো ভালো ভাবে জানতে পারবেন। যাই হোক, তারা কিন্তু আমার প্রস্তাবে বেশ আগ্রহবোধ করেছিলেন। বলেছিলাম, "একটু ভাবুন তো, আমরা যদি একসাথে বিশ্বব্যাপী কৌশলগত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারি, তাহলে কেমন হবে? পৃথিবী বদলে যাবে। আমাদের মাঝে বিরোধ দেখা দিতে পারে, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক, কিন্তু আমরা সামগ্রিক বিশ্বের পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলেও দিতে পারি।" তিনি বলেন, "হ্যাঁ।" এবং জিজ্ঞাসা করেন, "আপনি কি সিরিয়াস?" আমি বললাম, "অবশ্যই।" আমাকে জানানো হলো "এ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।" আমিও সম্মতি দিলাম “অবশ্যই”। তখনকার প্রতিরক্ষা সচিব গেটস, সিআইএর প্রাক্তন পরিচালক এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাইস এখানে এসেছিলেন, এই মন্ত্রিসভায়, টেবিলের ঠিক এইপাশে বসেছিলেন। আমি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী বসেছিলাম এ পাশটায়। তারা আমাকে বললেন, "আমরা ভেবে দেখেছি, আমরাও একমত।" আমি বললাম, "দারুন, ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।"
টাকার কার্লসন:
এ নিয়ে আপনি দু'বার বললেন যে মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারপর তাদের এজেন্সি প্রধানরা এসে সেই সিদ্ধান্ত পালটে দিচ্ছে। আপনার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটা ব্যবস্থা চালু আছে যেখানে ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিদের কোন ক্ষমতা নেই, তারা দেশ চালানোর জন্য সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না।
ভ্লাদিমির পুতিন:
ঠিক বলেছেন। শেষ পর্যন্ত কিন্তু তারা আমাদের দূরে ঠেলে দিল। আপনাকে এর চে বেশি বিস্তারিত বলতে পারবো না, বলাটা ঠিক ও হবে না। কারণ, এটা ছিল দুই পক্ষের মাঝে গোপন কথোপকথন। কিন্তু আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলো, এটাই আসল কথা।
চলবে