Posts

নন ফিকশন

ভ্লাদিমির পুতিনের সাক্ষাৎকার, নিয়েছেন টাকার কার্লসন - পর্ব ৩ (ইউক্রেন যুদ্ধ, কার উস্কানিতে?)

March 26, 2025

মো; আহসান-উজ-জামান

Original Author ভ্লাদিমির পুতিন, টাকার কার্লসন

Translated by আহসান উজ জামান

33
View

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই প্রথম পশ্চিমা মিডিয়ার মুখোমুখি হলেন। মার্কিন সাংবাদিক টাকার কার্লসন এর নেয়া সাক্ষাৎকারটি অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ পুরো ঘটনাটি রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও দেখা জরুরী, যা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না পশ্চিমা মিডিয়ার আগ্রাসী এবং একমুখী প্রচারণার জন্য। 

সাক্ষাৎকারটি বেশ দীর্ঘ হওয়ায় ধাপে ধাপে প্রকাশ করছি। কলেবর যাতে বেশি দীর্ঘায়িত না হয় সেজন্য কিছুটা পরিমার্জনাও করা হয়েছে, তবে গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু বাদ দেয়া হয় নি। আশা করি সবাই ধৈর্য সহকারে পড়বেন এবং মতামত জানাবেন।

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

Putin Spotted Using Hand To Put Leg in Place During Tucker Carlson  Interview - Newsweek
টাকার কার্লসন এবং ভ্লাদিমির পুতিন

৩য় পর্ব

টাকার কার্লসন:

এ নিয়ে আপনি দু'বার বললেন যে মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারপর তাদের এজেন্সি প্রধানরা এসে সেই সিদ্ধান্ত পালটে দিচ্ছে। আপনার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটা ব্যবস্থা চালু আছে যেখানে ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিদের কোন ক্ষমতা নেই, তারা দেশ চালানোর জন্য সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না।

ভ্লাদিমির পুতিন:

ঠিক বলেছেন। শেষ পর্যন্ত কিন্তু তারা আমাদের দূরে ঠেলে দিল। আপনাকে এর চে বেশি বিস্তারিত বলতে পারবো না, বলাটা ঠিক ও হবে না। কারণ, এটা ছিল দুই পক্ষের মাঝে গোপন কথোপকথন। কিন্তু আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলো, এটাই আসল কথা।

আমি তখনই বলেছিলাম, “দেখুন, আমরা কিন্তু পাল্টা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো। আমরা এমন স্ট্রাইক সিস্টেম তৈরি করব যা নিশ্চিতভাবেই আপনাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হবে।” উত্তর এল, “আমরা তো তোমাদের বিরুদ্ধে কিছু করছি না, তোমরাও যা খুশি করতে পারো, যতক্ষণ না তা আমাদের বিরুদ্ধে হয় কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হয়।” বললাম, “বেশ, তাই হবে।” এভাবেই চলতে লাগলো। আমরা আন্তঃমহাদেশীয় দূরত্ব পাড়ি দিতে সক্ষম এবং শব্দের চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন (হাইপারসনিক) সিস্টেম তৈরি করলাম, এবং এখনো সেগুলোর উন্নতি চালিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে হাইপারসনিক স্ট্রাইক সিস্টেমের দিক থেকে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য যে কোন দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে রাশিয়া, এবং প্রতিনিয়তই এগুলোর উন্নতি করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা এ পথে আগাতে চাই নি। আমরা বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হলো। 

Russia's Sarmat Missile Saga Reflects an Industry in Crisis | Carnegie  Endowment for International Peace
রাশিয়ার সম্রাট মিসাইল

এখন, ন্যাটোর পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ সম্পর্কে কিছু বলি। আমাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে, ন্যাটো পূর্ব দিকে এক ইঞ্চিও আগাবে না, কিন্তু বাস্তবে কী হলো? তারা বলল, “এরকম কিছু কাগজে লেখালেখি নেই, কোন দলিলও নেই, তাই আমরা সম্প্রসারণ চালিয়ে যাব।” এভাবে পাঁচবার সম্প্রসারণ ঘটে ন্যাটোর - বাল্টিক রাষ্ট্র, সমগ্র পূর্ব ইউরোপ, এবং আরও কিছু জায়গায়।

Nato Map: Over 791 Royalty-Free Licensable Stock Illustrations & Drawings |  Shutterstock
ন্যাটো ম্যাপ

এবার মূল বিষয়ে আসি। শেষ পর্যন্ত তারা ইউক্রেনে পৌঁছালো। ২০০৮ সালে বুখারেস্ট শীর্ষ সম্মেলনে তারা ঘোষণা দিলো যে ইউক্রেন এবং জর্জিয়ার জন্য ন্যাটোর দুয়ার উন্মুক্ত। সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত কিভাবে নেওয়া হলো বলি। সম্ভবত জার্মানি, ফ্রান্স এবং কিছু অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ এর বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু পরে জানা গেল যে প্রেসিডেন্ট বুশ, যিনি খুব কঠোর নেতা এবং শক্তিশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত, তিনি নাকি অন্যদের সম্মতি দেয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। “তিনি আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন, এবং আমাদের রাজি হতে হয়েছিল।” হাস্যকর! এটা কী কিন্ডারগার্টেন! কোন কিছুরই কি নিশ্চয়তা নেই?  এরা কেমন ধরনের মানুষ? 

তারা আমাকে আশ্বস্ত করতে চায়, “ইউক্রেন ন্যাটোতে থাকবে না, আপনই নিশ্চিত থাকুন?” আমি বললাম, “এর নিশ্চয়তা কী? আপনারা ইউক্রেনকে নেয়ার জন্য ২০০৮ সালে একবার সম্মত হয়েছিলেন। ভবিষ্যতেও যে আবার হবেন না তার নিশ্চয়তা কী?” “ওই সময় আমাদের চাপ দেওয়া হয়েছিল।” বললাম, “তাহলে আগামীকাল যদি আবার চাপ দেওয়া হয়, তাহলে যদি আপনারা আবার রাজি হয়ে যান?” অর্থহীন কথাবার্তা চালাচালি হতে লাগলো। কাদের সাথে কথা বলব? আমরা আলোচনার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু কার সাথে? আলোচনার ফলাফল যে বাস্তবায়ন হবে তার নিশ্চয়তা  কোথায়? কোনো নিশ্চয়তা নেই। 

সুতরাং তারা ইউক্রেনের ভূখণ্ডকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করল। আমি একটু আগেই আপনাকে বলেছি যে এই ভূখণ্ড কীভাবে গড়ে উঠেছে, রাশিয়ার সাথে কী ধরনের সম্পর্ক ছিল।  তারপরও।

ইউক্রেনে প্রতি দুইজন বা তিনজনে একজন কোনো না কোনোভাবে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক রাখতো। ইউক্রেন তার স্বাধীনতা অর্জন করেছিল স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে, এবং তাতে উল্লেখ ছিল যে ইউক্রেন একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু ২০০৮ সালে হঠাৎ করে ন্যাটোর দরজা তার জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেল। আরে, এরকম তো কথা ছিল না! এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে যে সকল প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এসেছে, তারা কোন না কোনভাবে রাশিয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন ভোটারদের ওপর নির্ভর করে এসেছে।  

ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে বিপুল জনগোষ্ঠীর বসবাস। এবং রাশিয়ার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা এই ভোটারদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা বেশ কঠিন। যার ফলাফল স্বরুপ ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতায় এলেন। প্রেসিডেন্ট কুচমার পরে যখন তিনি ভোটে জিতলেন, তখন তাকে ঠেকানোর জন্য তারা তৃতীয় দফা ভোটের আয়োজন করল, যা ইউক্রেনের সংবিধানেই নেই। এটি এক ধরণের অসাংবিধানিক অভ্যুত্থান। ভাবুন তো, যুক্তরাষ্ট্রে কেউ যদি নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়, তাহলে কী হবে?

 

টাকার কার্লসনঃ

কখনকার ঘটনা এটা? ২০১৪?

ভ্লাদিমির পুতিনঃ

না, তারও আগের।(অনুবাদকের নোটঃ২০০৪ এর নির্বাচনে প্রথম দফায় কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে নি। দ্বিতীয় দফায় জেতেন ইয়ানুকোভিচ। সেটা বাতিল করে তৃতীয় দফার ভোটের আয়োজন করা হয় যাতে জেতেন ইউশ্চেঙ্কো)। প্রেসিডেন্ট কুচমার পর ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ নির্বাচন জিতেছিলেন। তবে, তার বিরোধীরা সেই বিজয় মেনে নেয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিচ্ছিল বিরোধীদের কিন্তু তাদের পছন্দের প্রার্থী না জেতায় তৃতীয় দফার নির্বাচন আয়োজন করে। এটি স্পষ্টই একটি অসাংবিধানিক অভ্যুত্থান। যুক্তরাষ্ট্র এ্তে সমর্থন দেয় এবং তৃতীয় দফার বিজয়ী ক্ষমতায় আসে। কল্পনা করুন, যুক্তরাষ্ট্রে কারো নির্বাচনের ফলাফল পছন্দ হয় নি তাই সংবিধানের বাইরে যেয়ে তৃতীয় দফায় নির্বাচন আয়োজন করা হলো যাতে পছন্দের প্রার্থী ক্ষমতায় আসে, কেমন লাগছে শুনতে ব্যাপারটা?

যাই হোক, ইউক্রেনে তা ই করা হলো। ক্ষমতায় এলেন পশ্চিমা ঘেঁষা রাজনীতিবিদ ভিক্টর ইউশচেঙ্কো। ভালো কথা। আমরাও তার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছিলাম। তিনি মস্কোতে এলেন, আমরাও কিয়েভে গেলাম। আমি নিজেই গিয়েছিলাম, অনানুষ্ঠানিকভাবে সাক্ষাৎও করলাম। তিনি যদি পশ্চিমা ঘেঁষা হয়ে থাকেন, তবে তাই হোক, সমস্যা নেই। মানুষকে তাদের কাজ করতে দেওয়া উচিত। স্বাধীন ইউক্রেনের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া উচিত।

কুচমার নেতৃত্বের পরিস্থিতি বেশ খারাপ হয়ে পড়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতায় আসেন। (অনুবাদকের নোটঃ ২০১০ এর নির্বাচন) তাঁকে হয়তো সেরা প্রেসিডেন্ট কিংবা রাজনীতিবিদের তকমা দেয়া যাবে না তবে আমি কোনো মূল্যায়ন দিতে চাই না। এমন সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ইউক্রেনের সম্পর্কের বিষয়টি সামনে আসে। আমরা সবসময় এ বিষয়ে প্রতি নমনীয় ছিলাম, যেটা ভালো মনে হয় করুক। কিন্তু যখন আমরা সহযোগিতা চুক্তিটি পড়ে দেখলাম, তখন বুঝলাম যে এটা আমাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করবে, কারণ ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার মুক্ত-বাণিজ্য অঞ্চল এবং উন্মুক্ত কাস্টমস বর্ডার ছিল। এই চুক্তির অধীনে ইউক্রেনকে ইউরোপের জন্য তার সীমান্ত খুলে দিতে হবে, যা আমাদের বাজারকে প্রভাবিত করবে। আমরা বললাম, “না, এটা সম্ভব নয়। তাহলে আমরা ইউক্রেনের সাথে আমাদের কাস্টমস সীমান্ত বন্ধ করে দিব।”

ইয়ানুকোভিচ হিসাব করতে শুরু করলেন যে এতে ইউক্রেন কত লাভ করবে, কত ক্ষতি হবে। তিনি তার ইউরোপীয় অংশীদারদের বললেন, “আমি চুক্তি স্বাক্ষর এর আগে আরও সময় চাই চিন্তা করার জন্য।” এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধীরা ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ নিতে শুরু করে, যাতে সমর্থন দেয় পশ্চিমা দেশগুলো। শেষ খেলা হয়  ইউরোমাইদান এ অভ্যুত্থান ঘটানোর মাধ্যমে। (অনুবাদকের নোটঃ ২০১৩-২০১৪ সাল)

টাকার কার্লসন:

তাহলে ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে রাশিয়ার সাথে বেশি বাণিজ্য করতো?

ভ্লাদিমির পুতিন:

অবশ্যই। ব্যাপারটা শুধু বাণিজ্যের পরিমাণের নয়, যদিও সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এটি মূলত সহযোগিতা ও সম্পর্কের বিষয়। ইউক্রেনের পুরো অর্থনীতি এই সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় থেকেই দুই দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে গভীর সম্পর্ক ছিল। এক কারখানা ইউক্রেনে যন্ত্রাংশ তৈরি করত, যা আবার রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশেই সংযোজন করা হতো। আবার উল্টোটাও ঘটতো। খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আমাদের মাঝে।

কিন্তু তারপরও একটি অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। এখন বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না, সেটা ঠিক হবে না। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বলেছিল, “ইয়ানুকোভিচকে সামলান, আমরা বিরোধীদের শান্ত করে দিচ্ছি। পরিস্থিতি রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমেই শান্ত হোক।” আমরা বললাম, “ঠিক আছে, আমরা রাজি। তাই হোক।” মার্কিন অনুরোধ অনুযায়ী ইয়ানুকোভিচ সেনাবাহিনী কিংবা পুলিশকে ব্যবহার করেননি, তবুও বিরোধীরা কিয়েভে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটায়। এর মানে কী? তোমরা নিজেদের কী ভাবো? আমি তখনকার মার্কিন নেতৃত্বকে সরাসরি এই প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম।

টাকার কার্লসন:

কাদের সমর্থনে এটা ঘটেছিল?

ভ্লাদিমির পুতিন:

অবশ্যই, সিআইএ-এর সমর্থনে। যে সংস্থায় আপনিও একসময় যোগ দিতে চেয়েছিলেন, আমি যদ্দুর জানি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানো উচিত যে তারা আপনাকে যোগ দিতে দেয়নি, যদিও এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। আমি বুঝি, কারণ আমিও এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থার প্রথম প্রধান অধিদপ্তরে (ফার্স্ট মেইন ডিরেক্টোরেট) এ কাজ করেছি। তারা সবসময়ই আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে, তারা তাদের কাজ সঠিকভাবেই সম্পন্ন করেছে। তারা সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্য সফলভাবে অর্জন করেছে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এটি ছিল মারাত্মক ভুল। নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভুল হিসাবের ফলাফল এই পটপরিবর্তন।

তারা বুঝতে পারেনি এটি কী পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ২০০৮ সালে, ইউক্রেনের জন্য ন্যাটোর দরজা খুলে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে, একটি অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। যারা অভ্যুত্থান মেনে নেয়নি তাদের উপর দমন-পীড়ন শুরু হয়। এটি কিন্তু সত্যিই একটি অভ্যুত্থান ছিল। তারা ক্রিমিয়ার জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছিল, সেজন্য ক্রিমিয়াকে আমাদের রক্ষা করতে হয়।

২০১৪ সালে, তারা দনবাসে যুদ্ধ শুরু করে। সেখানে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে বিমান এবং আর্টিলারি ব্যবহার করা হয়। এখান থেকেই সবকিছুর শুরু। দনেস্কের উপর বিমান হামলার ভিডিও আছে। তারা কিন্তু একটার পর একটা বেশ বড় আকারের সামরিক অভিযান চালিয়েছিল। যখন তারা ব্যর্থ হয়, তারা পরবর্তী অভিযান এর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

এর সবই ঘটেছে এই ভূখন্ডে সামরিক উন্নয়নের নাম করে এবং ন্যাটোর আসার পথ সুগম করতে। আমরা কীভাবে এসব ঘটনার মাঝে নিশ্চিন্তে বসে থাকি? জেনেও কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা চরম অবহেলার পরিচয়। মার্কিন নেতৃত্ব আমাদেরকে এমন দিকে ঠেলে দিচ্ছিল যে আমরা যদি চুপচাপ বসে থাকতাম তাহলে তা রাশিয়াকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিত। তাছাড়া, আমাদের পক্ষে আমাদের একই ধর্ম বিশ্বাসের ভাইদের এবং রুশ জনগণের একটি অংশকে এই যুদ্ধদানবের সামনে ফেলে পালিয়ে যাওয়াও সম্ভব না।

টাকার কার্লসন:

কিন্তু এ তো বর্তমান সংঘাত শুরু হওয়ার আট বছর আগেকার ঘটনা। তাহলে কখন এবং কেন আপনার মনে হলো যে আপনার সামনে যুদ্ধ ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা নেই?

ভ্লাদিমির পুতিন:

প্রাথমিকভাবে ইউক্রেনে সংঘটিত অভ্যুত্থানই এই সংঘাতকে উসকে দেয়। সেই সময় তিনটি ইউরোপীয় দেশের প্রতিনিধি এসেছিল—জার্মানি, পোল্যান্ড এবং ফ্রান্স। তারা ইয়ানুকোভিচ সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির গ্যারান্টর ছিল। গ্যারান্টর হিসেবে তারা স্বাক্ষরও করে। তা সত্ত্বেও, বিরোধীরা একটি অভ্যুত্থান ঘটায় এবং এই দেশগুলো এমন ভান করলো যেন তাদের কিছুই মনে নেই। সবাই যেন ভুলেই গেল যে তারা একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতার গ্যারান্টর ছিল। তারা চুক্তিটিকে একেবারেই বাতিল করে দিল এবং কেউই তার কথা আর ভুলেও উচ্চারণ করলো না।

আমি জানি না, যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি সম্পর্কে কিছু জানত কি না—বিরোধী দল ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে হওয়া এই চুক্তি এবং এর তিনজন গ্যারান্টর, যারা এই পুরো পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক সমাধানের দিকে ফেরানোর পরিবর্তে অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেছিল।

যদিও এর সব কিছুই ছিল অর্থহীন। কারণ প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ সব শর্তই মেনে নিতে রাজি হয়েছিলেন। তিনি আগাম নির্বাচন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন, যেটাতে তার জয়ের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, সোজা সাপ্টা যদি বলি। সবাই তা জানতোও। তাহলে অভ্যুত্থানের দরকার কী ছিল? কেন এত হতাহত হলো? কেন ক্রিমিয়ার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করা হলো? কেন দনবাসে সামরিক অভিযান শুরু হলো? এটাই আমি বুঝতে পারলাম না। এখানেই তারা হিসেবে অনেক বড় গড়বড় করে ফেলে।

সিআইএ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তার দায়িত্ব পালন করে। যদ্দুর মনে পড়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ডেপুটি সেক্রেটারি অফ স্টেট বলেছিলেন যে এই অভ্যুত্থান ঘটাতে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ভুল এর মাশুল ছিল এর চাইতেও বিশাল। কী দরকার ছিল তাদের এমনটা করার?

আইনসম্মতভাবে, কোনো হতাহতের ঘটনা ছাড়া, কোনো সামরিক পদক্ষেপ ছাড়া, ক্রিমিয়া হারানো ছাড়াই তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারতো। আমরা কখনোই কোনো ব্যবস্থা নিতাম না, যদি ইউরোমাইদানে রক্তপাত না হতো।

কারণ, আমরা সবাই একমত হয়েছিলাম যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর আমাদের সীমান্তগুলো সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর সীমান্ত বরাবর থাকবে। আমরা সবাই তা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু ন্যাটোর সম্প্রসারণের ব্যাপারে আমরা কখনোই সম্মত হইনি, এবং বিশেষ করে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে। কোনো আলোচনা ছাড়াই এ বিষয়ে আগানোর ব্যাপারেও আমরা রাজি হইনি। দশকের পর দশক ধরে আমরা অনুরোধ করেছি, "এটি করবেন না, সেটি করবেন না।"

এবং সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর কারণ কী ছিল? প্রথমত, বর্তমান ইউক্রেনীয় নেতৃত্ব ঘোষণা করেছিল যে তারা মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না। এই চুক্তিগুলো ২০১৪ সালের ঘটনার পর ইউক্রেনের মিনস্ক শহরে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যেখানে দনবাসে বসে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিকল্পনা নির্ধারন করা হয়।

কিন্তু না, বর্তমান ইউক্রেনীয় নেতৃত্ব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অন্যান্য কর্মকর্তারা এবং তারপর প্রেসিডেন্ট নিজেই বললেন যে মিনস্ক চুক্তির কোনো কিছুই তাদের পছন্দ হচ্ছে না। অর্থাৎ, তারা এটি বাস্তবায়ন করতে চায়নি।

প্রায় এক থেকে দেড় বছর আগে জার্মানি ও ফ্রান্সের সাবেক নেতারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন যে তারা মিনস্ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও বাস্তবে এটি কার্যকর করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। তারা স্রেফ চেয়েছিলেন আমাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করতে, নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে।

টাকার কার্লসন:

আপনার কি কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ছিল? আপনি কি কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে বলেছিলেন, “যদি আপনারা ন্যাটো বাহিনীকে দিয়ে ইউক্রেনকে সামরিকীকরণ চালিয়ে যান, তাহলে বড় সমস্যা দেখা দিবে এবং আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হব”?

ভ্লাদিমির পুতিন:

আমরা এটা নিয়ে সবসময়ই আলোচনা করেছি। আমরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় নেতাদের বলেছিলাম যে এই পরিস্থিতি অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। আমাদের মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়ন করা উচিত।

সত্যি বলতে, আমি জানতাম না আমরা কীভাবে এটা বাস্তবায়ন করবো, তবে আমি প্রস্তুত ছিলাম। এই চুক্তিগুলো ইউক্রেনের জন্য কঠিন ছিল। এতে দনবাস অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের অনেক উপাদান ছিল, এটি সত্য। তবে, আমি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছি, আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে আমরা যদি দনবাসের জনগণকে রাজি করাতে পারতাম—যদিও আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হতো—তবুও তারা পুনরায় ইউক্রেনের রাষ্ট্র কাঠামোয় ফিরে আসতে পারতো। ক্ষতগুলো ধীরে ধীরে সেরে উঠত। যখন এই অঞ্চলটি পুনরায় সাধারণ সামাজিক পরিবেশে আবার অন্তর্ভুক্ত হতো, যখন পেনশন ও সামাজিক সুবিধাগুলো আবার প্রদান করা হতো, তখন সবকিছুই ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যেত।

কিন্তু না, কেউই তা চায়নি। সবাই শুধু সামরিক শক্তির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা এটি ঘটতে দিতে পারি না।

পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে ইউক্রেন ঘোষণা করে, “না, আমরা কিছুই করব না।” সেই সাথে তারা সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তারাই ২০১৪ সালে যুদ্ধ শুরু করেছিল। আমাদের লক্ষ্য ছিল এই যুদ্ধ বন্ধ করা। আমরা ২০২২ সালে এই যুদ্ধ শুরু করিনি। এটি কেবল এই যুদ্ধ বন্ধ করার একটি প্রচেষ্টা।

টাকার কার্লসন:

আপনি কি মনে করেন আপনি যুদ্ধ বন্ধ করতে পেরেছেন? আমি বলতে চাইছি, আপনি কি আপনার লক্ষ্য অর্জন করেছেন?

ভ্লাদিমির পুতিন:

না, আমরা এখনও আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি, কারণ আমাদের আরও একটি লক্ষ্য রয়েছে - নাৎসিবাদ নির্মূল করা (ডি-নাজিফিকেশন)। এর অর্থ হলো সমস্ত ধরনের নব্য-নাৎসি আন্দোলনের উপর নিষেধাজ্ঞা। মীমাংসার আলোচনার সময় এটা আমাদের অন্যতম প্রধান ইস্যু ছিল, যা চলতি বছরের শুরুতে ইস্তাম্বুলে শেষ হয়।

এই আলোচনায় ইউরোপীয় নেতারা বলেছিলেন যে চূড়ান্ত চুক্তির জন্য উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করা জরুরি। ফ্রান্স ও জার্মানির প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, “আপনি কীভাবে কল্পনা করেন যে তারা বন্দুকের নলের মুখে চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে? আগে কিয়েভ থেকে আপনাদের সেনা প্রত্যাহার করা উচিত।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে।” আমরা কিয়েভ থেকে আমাদের সেনা প্রত্যাহার করলাম।

কিন্তু কিয়েভ থেকে সেনা প্রত্যাহার করার সাথে সাথেই ইউক্রেনীয় আলোচকরা ইস্তাম্বুলে করা সমস্ত চুক্তি বাতিল করে দিল এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্রদের সহায়তায় দীর্ঘমেয়াদী সামরিক সংঘাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।

এভাবেই সমস্ত ঘটনার শুরু, এটাই এখন বাস্তবতা।

টাকার কার্লসন:

মাফ করবেন। নব্য-নাৎসিবাদ আবার কোথা থেকে এলো? নাৎসিবাদ নির্মূল (ডি-নাজিফিকেশন) বলতে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন?

ভ্লাদিমির পুতিনঃ

এটা নিয়েই আমি এখন কথা বলবো। কারণ আমাদের জন্য বিষয়টা অত্যন্ত উদ্বেগের এবং গুরুত্বপূর্ণ।

নব্য-নাৎসিবাদের অনুসারী আজভ ব্যাটালিয়নের সদস্যবৃন্দ, কিয়েভ, ইউক্রেন

চতুর্থ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন


 

Comments

    Please login to post comment. Login