Posts

প্রবন্ধ

জীবন সঙ্গী

September 19, 2024

মাসুদ হোসেন

Original Author কুহকী

Translated by মাসুদ হোসেন

61
View

-মুখটা শুকিয়ে গেছে তো, আমার ফ্লাস্কে চা আছে, একটু দিই? সঙ্গে ডালমুটও আছে। (story) 

পাশে বসা বৃদ্ধের অযাচিত মন্তব্যে আমি বিরক্ত বোধ করি। হাত নেড়ে বোঝাই আমি আগ্রহী নয়। আমি মরছি নিজের জ্বালায়। আজ সাত দিন হল আমার স্ত্রী ভর্তি এই হাসপাতালে (hospital)। আমি রিটায়ার করেছি। কেরানি ছিলাম। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। ঝাড়া হাত-পা হয়ে কোথায় এখন আমার তাস-পাশা খেলে, আড্ডা মেরে দিন কাটানোর কথা, তা না আমাকে হাসপাতাল-বাড়ি করতে হচ্ছে। দেখুন মশাই, আমরা মফস্বলের লোক, আমাদের অত লোক দেখানো ভালোবাসা নেই। সোজা কথায় বলতে গেলে, আমি আর পেরে উঠছি না। কিন্তু করারই বা কী আছে। বৌকে তো ফেলে দিতে পারি না। মেয়ে থাকে অন্য রাজ্যে, হুট্ করে সেও আসতে পারবে না।  আমাদের এই মফস্বলে এটাই যা একটু ভালো হাসপাতাল।  নেহাত মেডিক্লেমটা করা ছিল।  নইলে যা খরচা এখানে !  

সত্যি বলতে কী, সরমা কিন্তু খুব যত্ন নিয়ে দেখভাল করেছে আমার পুরো চাকরি জীবনটা। আমার খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-জামা কাচা, প্রত্যেক ব্যাপারে ওর তীক্ষ্ণ নজর ছিল। ওর সেবা পাওয়াতেই আমি যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। কিন্তু অবসর গ্রহণের পরে দিনের অনেকটা সময় ওর সঙ্গে কাটাতে হঠাৎ করে আমি কেমন যেন হাঁফিয়ে উঠছিলাম। ওর ঘুমোনোর সময় নাক ডাকা, আলুথালু করে শাড়ি পড়া, সব কিছুতেই আমি কেমন বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছিলাম। তারপর ও যখন অসুস্থ হল, তখন ওর ওষুধপত্র সময় মতো দেওয়া, শাড়ি-সায়াটা ধুয়ে দেওয়া – এসব যে করিনি তা তো নয়। কিন্তু কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। তাই ভালবাসা বলতে এখন শুধুই অভ্যাস। সম্বিৎ ফিরে পেলাম পাশে বসা বৃদ্ধের কথায় – চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। মেজাজটা হঠাৎ খিঁচড়ে গেল। -কে বলেছে বলুন তো আমি চিন্তা করছি।  আমাকে আমার মতো থাকতে দিন…বিরক্ত করবেন না প্লিজ – কথাগুলো এক নিমেষে বলেই বুঝলাম খুব রূঢ় ভাবে বলা হয়ে গেছে। আসলে আমার বয়স ষাট…এই বয়েসে ধৈর্য্য একটু কমে যায় বইকী। কিন্তু পরমুহূর্তেইমনে হল আমার পাশে বসা বৃদ্ধের নিশ্চয়ই প্রায় সত্তরের উর্দ্ধে বয়েস হবে। তাহলে! না, উচিত হয়নি। তাই ‘সরি’ বলতে প্রস্তুত হলাম। কিন্তু যেই ওনার দিকে ফিরে বলতে গেছি, উনি ব্যস্তভাবে ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে আমাকে ইশারা করলেন চুপ করতে – শোনো, শোনো… 

আরও পড়ুন: গল্প: হঠাৎ দেখা 

হাসপাতালের এনাউন্সমেন্টমাইকে তখন গতানুগতিক ডেঙ্গি-সচেতনা বিষয়ক ঘোষণা হচ্ছে – বাড়ির আশেপাশে জমা জল রাখবেন না…এর থেকেই ডেঙ্গির মশার উৎপাত বাড়ে…ইত্যাদি।  

কি সুন্দর না?- বৃদ্ধের চোখের কোনটা চিকচিক করে ওঠে।   

আমি নতুনত্বের কিছু খুঁজে পাই না। আমার ভাগ্নে কলকাতায় নামী এক হাসপাতালে পিওনের কাজ করে। তার কাছে গল্প শুনেছি, এখনকার আধুনিক সব হাসপাতালের এনাউন্সমেন্ট সিস্টেম নাকি অটোমেটেড। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারদ্বারা নিয়ন্ত্রিত ‘স্পিচ রেকগনিশন’ দিয়ে যা লেখা হয়, তাই ঘোষণা করা যায়। আমাদের মফস্বলে সেরকম প্রযুক্তি এখনও আসেনি। এখানে এখনও ঘোষক বা ঘোষিকা থাকে।  ওই রেলওয়ে স্টেশনে যেমন থাকে, ঠিক তেমনি।  কখনো বলছে – কাউন্টারের সামনে ভিড় করবেন না, আবার কখনো বলছে – অমুকবাবু, আপনি যেখানেই থাকুন,ওয়ার্ড নাম্বার একশো বাইশে তমুক ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করুন। কেবল মাত্র এই ধরণের ডেঙ্গি বা সাধারণ সচেতনা মূলক এনাউন্সমেন্টঅটোমেটেড। মানে রেকর্ডেড। ঐসব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপার নেই। শুধুমাত্র আগে থেকে কোনও মহিলা বা পুরুষের কণ্ঠে রেকর্ড করা একই এনাউন্সমেন্ট। ওই যে বাজারে যেমন ইঁদুর মারা বিষের বিজ্ঞাপন হকারদের মাইকে বাজে বা অটোতে যেমন নতুন যাত্রাপালার বা পলিটিকাল নেতাদের সভা-সমিতির এনাউন্সমেন্ট হয়, ঠিক তেমনি। 

অতএব বৃদ্ধ এতে কী ‘সুন্দর’ দেখলেন আমি বুঝতে পারি না। তবে আমার ‘সরি’ বলার উদ্দেশ্যে ভাঁটা পড়ে। নিকুচি করেছে ক্ষমাপ্রার্থীহওয়ায়। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাই, এমন সময় সেই বৃদ্ধ বলেন – আরে, উঠছো নাকি, বসো, বসো…তোমার স্ত্রী কে যে ডাক্তার দেখছেন তাঁর আসতে এখনও মিনিমাম আধ ঘন্টা বাকি। আর এখন তো ভিজিটিং আওয়ার্সও, নয় যে তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারবে। তার চেয়ে বসো, একটু গল্প করা যাক। আরও একটা সুন্দর এনাউন্সমেন্ট হবে ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে। শুনে দেখো, কী সুন্দর গলা।  

সত্যি বলতে কী, সরমা কিন্তু খুব যত্ন নিয়ে দেখভাল করেছে আমার পুরো চাকরি জীবনটা। আমার খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-জামা কাচা, প্রত্যেক ব্যাপারে ওর তীক্ষ্ণ নজর ছিল। ওর সেবা পাওয়াতেই আমি যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। কিন্তু অবসর গ্রহণের পরে দিনের অনেকটা সময় ওর সঙ্গে কাটাতে হঠাৎ করে আমি কেমন যেন হাঁফিয়ে উঠছিলাম। ওর ঘুমোনোর সময় নাক ডাকা, আলুথালু করে শাড়ি পড়া, সব কিছুতেই আমি কেমন বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছিলাম।

আমি মনে মনে ভাবি লোকটার কী মাথা খারাপ না কী! অথচ আমি এনাকে আগে খেয়াল না করে থাকলেও, ইনি কিন্তু আমাকে যথেষ্ট লক্ষ্য করেছেন। নইলে জানেন কি করে আমার স্ত্রীকে কোন ডাক্তার দেখছেন, সেই ডাক্তার সাধারণত কখন আসেন ইত্যাদি। আর এই বয়েসে ইনিই বা কার জন্য হাসপাতালে আসছেন। আর কি কোনো কম বয়েসী কেউ নেই ওনার বাড়িতে যে ওনাকেই আসতে হচ্ছে। 

আমি জিজ্ঞেস করি – আপনি এখানে কার জন্য এসেছেন।  

উনি এক গাল হেসে বললেন – আমার স্ত্রীর জন্য।  

কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই যাব,, এমন সময় হাসপাতালের কয়েকজন নার্স ওখান দিয়ে যাচ্ছিল, তারা বৃদ্ধ কে দেখে বলল – দাদু ভালো তো? 

বৃদ্ধ ও হাসি মুখে হাত নাড়লেন – ফার্স্ট ক্লাস। 

উল্টো দিক থেকে আরেকজন ফার্মেসী ডিভিশনের লোক আসছিল। সে নার্সগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল – সত্যি, দাদুর এক দিনও কামাই নেই।   

আমি তখন ভাবছি, তার মানে এই বৃদ্ধ এতই রেগুলার আসেন এখানে যে হাসপাতালের স্টাফ সবাই এনাকে চেনে। অথচ দেখে তো হাসপাতালের মালিক পক্ষ বলেও মনে হয় না। বৃদ্ধ যেন আমার চিন্তাধারাটা বুঝতে পেরে গেলেন। 

-আমি এখানে রোজই আসি। গত পাঁচ বছরে বিশেষ শরীর খারাপ না হলে সত্যিই আমার কখনো কামাই হয়নি।  

-পাঁচ বছর! কিছু মনে করবেন না, আপনার স্ত্রী কি তাহলে কোমাতে লং টার্ম… – আমি আমতা আমতা করি।  

-আরে না, না, আমার স্ত্রী গত হয়েছেন আজ প্রায় সাত বছর হল।  

-ও…আসলে আপনি যে বললেন আপনার স্ত্রীর জন্য এখানে আসেন, তাই আমি ভাবলাম… 

আমি ইতস্তত বোধ করি। অনুধাবন করি ওনার স্ত্রী নিশ্চয়ই এই হাসপাতালেই মারা গেছেন। সেই থেকে বৃদ্ধ এখানে রোজ আসেন। অবাক লাগে ভাবতে। কিন্তু বৃদ্ধের পরবর্তী কথাতেই ভুলটা ভেঙে যায়।  

bengali story life partner by kuhaki

গত পাঁচ বছরে বিশেষ শরীর খারাপ না হলে সত্যিই আমার কখনো কামাই হয়নি

-হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাক, বুঝলে। হাসপাতালে আনার সময়টুকু পেলাম না। আমার থেকে দশ বছরের ছোট। মাত্র সাতান্ন বছর বয়েস তখন। চলে যাওয়ার এটা কোনো বয়েস, বলো? ভারী সুন্দর গলা ছিল ওর। কী ভালো গান গাইতো। 

আমার গুলিয়ে যায়। তার মানে এই হাসপাতালে ওনার স্ত্রী মারা যাননি। যেই আবার প্রশ্ন করে ব্যাপারটা ডিটেলে বোঝার চেষ্টা করার কথা ভাবছি, অমনি উনি আমাকে আবার থামিয়ে দেন – ওই শোনো শোনো, আবার এনাউন্সমেন্ট। মন দিয়ে শোনো।  

আবার গতানুগতিক সচেতনা বৃদ্ধির এনাউন্সমেন্ট।আমি ভাবি এটা আবার কী রকম শখ? কাজ নেই, তাই হাসপাতালে এসে অপরিচিত লোকদের সাথে খোশ গল্প করা অথবা এনাউন্সমেন্টশুনে তারিফ করা। মনে একটা সন্দেহ হয় অবিশ্যি। এমন নয়তো উনি এই হাসপাতালে একটা বড় অনুদান দিয়েছেন। খবরের কাগজে এরকম একটা সংবাদ বেশ কয়েকদিন আগে পড়েছিলাম। এক গরিব বৃদ্ধা তার ছেলের জন্য হাসপাতালে ভর্তির টাকা জোগাড় করতে পারেননি। তার ছেলেকে বাঁচানো যায়নি।  পরে তিনিই পাই-পাই পয়সা জমিয়ে গরিবদের জন্য সম্পূর্ণ নিখরচায় নিরাময়ের জন্য একটা হাসপাতাল গড়েছিলেন। আমার পাশের ব্যক্তিটিও কী তাহলে তেমনই এক দাতা বা এই হাসপাতালের স্বত্বাধিকারী। সরাসরি জিজ্ঞেস করতে কেমন লাগে। তাই ঠিক করলাম রিসেপশনে গিয়ে কায়দা করে জিজ্ঞেস করবো। মুখে বললাম – আচ্ছা আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি।  

https://banglalive.com/wp-content/uploads/2024/05/1-5-1024x718.jpg

আমি এখানে রোজই আসি

বৃদ্ধ আমাকে আবার বললেন – ডান দিকেরটায় যাও। বাঁ দিকেরটায় প্লাম্বিং এর কাজ চলছে।  

আমার ধারণাটা ক্রমশ বদ্ধমূল হতে থাকে। আমি উঠে কথা মতো প্রথমে বাথরুমেই যাই। একটু চোখেমুখে জল দিয়ে বেরিয়ে সোজা রিসেপশনের দিকে যাই।   

-মাফ করবেন, ঐ যে সাদা বুশ শার্ট আর খয়েরি ঢিলা প্যান্ট পড়া ভদ্রলোক, উনি কি এই হাসপাতালের কতৃপক্ষদের মধ্যে কেউ? 

-কার কথা বলছেন – বিনয়বাবু? 

-নামটা তো ঠিক জানি না, মানে… 

-ওই তো যিনি রোজ হাসপাতালে এসে নন-ভিজিটিং আওরার্সএ বসে থাকেন। আরে না, না, উনি কতৃপক্ষ-টক্ষ কেউ নন।  

-রোজ আসেন? তা হবে। খেয়াল করে দেখলে আমি গত সাতদিন দেখছি বইকী ওনাকে। কী ব্যাপার বলুন তো? ওনার কোনো পেশেন্ট আছে বলে তো মনে হলো না। উনি একবার বলছেন স্ত্রীর জন্য আসেন, আবার বলছেন স্ত্রী মারা গেছেন সাত বছর আগে। আর পেশেন্ট না থাকলে যে কোনও লোককে আপনারা ঢুকতে দেন নাকি? – আমি উষ্মা প্রকাশ করি। আসলে সরমার জন্য হাসপাতাল-বাড়ি করতে করতে বোধহয় একটু খিটখিটে হয়ে গেছিলাম।  

-ওহ, আপনি জানেন না। জানবেনই বা কী করে। আচ্ছা একটু দাঁড়ান। কাউন্টার এর ভিড়টা একটু সামলে নিই, তারপর বলছি।  

আমি একটু সরে এসে ভিড়টা এড়িয়ে দাঁড়াই। আড় চোখে দেখি সেই বিনয়বাবু আমাকে হাত তুলে ইশারায় ‘আসছি’ বলে মেন্ গেটের দিকে এগোচ্ছে। মানে উনি হাসপাতাল থেকে বেরোচ্ছেন। ভেবেছেন বোধহয় আমি কমপ্লেন করতে এসেছি। আমি না দেখার ভান করি।  

খানিক পরে, রিসেপশন খালি হলে কাউন্টারের ছোকরা ছেলেটা বেরিয়ে আসে। আমাকে বলে – চলুন, বাইরে যাওয়া যাক।  

বেরিয়ে আসতেই ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে বলে – একটা সিগারেট হবে।  

আমি বলি – ওই বিনয়বাবুর ব্যাপারটা… 

-বলছি বলছি, যদি একটা সিগারেট দ্যান – লোকটা দাঁত বার করেই রাখে।  

অগত্যা দিলাম।  

-দাদা কি সাংবাদিক নাকি? – আবার প্রশ্ন।  

-আরে না রে বাবা – এবার আমি বিরক্তি দেখাই। – ওই লোকটার মতন যে কোনও লোককেই কি আপনারা হাসপাতালে যখন তখন ঢুকতে দেন? নাকি উনিও স্টাফদের নিয়মিত চা, সিগারেট, বিড়ি খাওয়ান? 

https://banglalive.com/wp-content/uploads/2024/05/3-2.jpg

এমন সময় হাসপাতালের কয়েকজন নার্স ওখান দিয়ে যাচ্ছিল

-কী যে বলেন দাদা, বিনয়দার ব্যাপারই আলাদা। শুনুন তবে। সত্যি ওনার স্ত্রী সাত বছর হল মারা গেছেন। এই হাসপাতালেই ওনার স্ত্রী রিসেপশনে কাজ করতেন। দু-তিন বছরের মধ্যেই ওনার রিটায়ারমেন্ট ছিল। কিন্তু রিটায়ারমেন্টের আগেই উনি মারা গেলেন। ওনার মারা যাওয়ার দু-বছর পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিক করে এখানে অটোমেটেড ভয়েস মেসেজ সিস্টেম লাগাবে। মানে আজকাল যে রকম কম্পিউটারাইজড হচ্ছে, সে রকম আর কী। সব প্রায় ঠিক, এমন সময় বিনয়বাবু একদিন এলেন। উনিও বাইরে এ ব্যাপারে শুনেছিলেন। ব্যাপার হল- কয়েক বছর আগে হাসপাতালের তরফ থেকে একটা কমিউনিটি ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছিল আশেপাশেরর বস্তির জন্য। ওই বেসিক স্বাস্থ-সচেতনতা  বিষয়ক আর কী।। স্বাভাবিক কারণে ওনার স্ত্রীও অংশ নিয়েছিলেন। পুরো ব্যাপারটা রেকর্ডেড হয়েছিল। সেখান থেকেই বিনয়বাবু ওনার স্ত্রীর করা এনাউন্সমেন্টের কিছু অংশ, নিজে কেটে ছেঁটে এডিট করে সাধারণ সচেতনতা বিষয়ক এনাউন্সমেন্টের একটা কোলাজ করে নিয়ে এসেছিলেন। সাথে দরখাস্ত। পুরোটা অটোমেটেড ভয়েস সিস্টেম না করে, অন্তত এ ধরণের সাধারণ সচেতনতা বৃদ্ধির এনাউন্সমেন্টেরজন্য যেন ওই রেকর্ডেডটা চালানো হয়। প্রথমেই মঞ্জুর হয়নি। কিন্তু উনিও ছাড়বার পাত্র নন। অনুরোধ, প্রার্থনা চলতেই লাগলো। আসলে ওঁর স্ত্রী খুব ভালো গান করতেন। ভারী মিষ্টি গলা। সেই গলার এনাউন্সমেন্ট উনি রোজ শুনতে পারবেন, এটাই ছিল ওঁর একমাত্র অভিলাষ। ওঁর মনে হবে, ওঁর স্ত্রী এখনও ওঁর পাশে আছেন। এখনও ওঁর সাথে কথা বলছেন। এই আর কী। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার জিত হল। ওঁর রেকর্ডটাকেই ভালো করে ঘষা-মাজা করে, ডিজিটাল-রিমাস্টার করে, আজ পাঁচ বছর ধরে চালানো হচ্ছে সকালে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে নন-ভিজিটিং আওরার্সে। আর উনি আজ পাঁচ বছর ধরে প্রায় রোজ এসে সেটা শোনেন। যেন কী পরম এক আনন্দ পাচ্ছেন।  

https://banglalive.com/wp-content/uploads/2024/05/4-1.jpg

আজ পাঁচ বছর ধরে চালানো হচ্ছে সকালে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে নন-ভিজিটিং আওরার্সে

সব শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলাম। এ কী প্রেম, কী ভালোবাসা! একই সাথে নিজেকে কেমন ছোটো মনে হচ্ছিল। যে মহিলা অক্লান্ত পরিশ্রম করে সারা জীবন আমাকে ভালোবেসেছে, আমার সেবা করেছে, আজকে তার শরীর খারাপের সময় আমি কতটা হৃদয়হীন আচরণ করছি, বিরক্ত হচ্ছি, মুক্তি চাইছি। ছিঃ – নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিই।  

সারাদিন মাথার মধ্যে একটা গ্লানি বয়ে বেড়াই। ভিজিটিং আওরার্সে সরমার বেডের কাছে যাই। ও উঠে বসতে চেষ্টা করে, পারে না। ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে – আমার জন্য, তোমার ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে না, শরীর ভেঙে গেছে। দুধওয়ালাকে বলো আধ সের দুধ বাড়িয়ে দিতে। জামার কলারটা তো নোংরা হয়ে গেছে। ধোপার কাছে যাওয়ার সময় হচ্ছে না, তাই না? 

আমার গলার কাছে কেমন জমা কান্না দলা পাকিয়ে থাকে। সরমার কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলো হাত দিয়ে পরম মমতায় সরিয়ে দিয়ে শুধু বলি – সরমা, তাড়াতড়ি সুস্থ হয়ে নাও, বাড়ি চলো। তোমাকে ছাড়া আর ভালো লাগছে না আমার।  

সরমার দু-চোখ বেয়ে শুধু নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ে ।

অনুপ্রেরণা:- লন্ডনের ডা. মার্গারেট ম্যাককলাম, ২০০৭ সালে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে প্রতিদিন এম্ব্যাঙ্কমেন্ট স্টেশনে যান। তাঁর স্বামী- অসওয়াল্ড ১৯৫০ এর দশকে উত্তর লাইনের জন্য ‘মাইন্ড দ্য গ্যাপ’ ঘোষণাটি রেকর্ড করেছিলেন। ২০১২ সালে, যখন টিউব স্টেশন একটি ডিজিটাল সিস্টেমের সঙ্গে অডিও প্রতিস্থাপন করেছিল, তখন মার্গারেট হতবাক হয়েছিলেন, কারণ তিনি তার স্বামীর ভয়েস খুঁজে পাননি। তিনি রেল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেন এবং বোঝান অসওয়াল্ডের গলার স্বর তাঁর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অবশেষে কর্তৃপক্ষ একটি পুরোনো সিডি থেকে রেকর্ডিংটা উদ্ধার করে এযাবৎ চালিয়ে আসছে। ভালোবাসার এমন নিদর্শন সত্যি গল্পের মতন।

Comments

    Please login to post comment. Login