খুব সকালে কে যেন দরজা ধাক্কাছে। শিকাগোর একটা লোকাল বারে অনেক রাত অব্দি শো করে ফিরে, সবে শুয়েছিল চাক। এখন সে কিছুতেই উঠবে না। এদিকে দরজার বাইরে চলছে ধাক্কাধাক্কি! চাক নিজের কানের উপরে কিছুক্ষণ বালিশ চাপা দিয়ে রাখে, এপাশ-ওপাশ করছে। কিছুতেই কমছে না বাইরের হট্টগোল, যেন ক্রমে বেড়ে চলছে আরও।
আর পারা গেল না, শেষ পর্যন্ত চাককে বিছানার মায়া ছাড়তেই হলো। চোখ ডলতে ডলতে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বাইরে থেকে তার নতুন রেকর্ড করা গানটি ভেসে আসছে...
Maybellene, why can’t you be true
Oh Maybellene, why can’t you be true
You’ve started back doing the things you used to do
As I was motivating over the hill
I saw Mabellene in a Coup de Ville
A Cadillac arolling on the open road
Nothin’ will outrun my V8 Ford
The Cadillac doin’ about ninety-five
Bumper to bumper, rolling side by side
চাক খুব অবাক হলো, সকাল সকাল রেকর্ড প্লেয়ার নিয়ে কে চলে এলো? বিস্ময় নিয়ে দরজা খুলে দেখে, পাশের রুমের ভদ্রলোকসহ তিন-চারজনের হাতে রেডিয়ো, আর সেখানেই চাক বেরির সদ্য রেকর্ডিং করা ‘মেইবেলিন’ বাজছে।
চাক বেরি যেন আকাশ থেকে পড়ে! সে ভাবছে, আমার গান কেন, কোনো কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীর গান আগে কখনও রেডিয়ো ষ্টেশনগুলোতে সে শুনেছে, তা ঠিক মনে করতে পারলো না।
গানটির একমাসও হয়নি এখনও। এই তো সেদিনের কথা, লেনারড চেজ, চিন্তা করছিলেন কী করে কৃষ্ণাঙ্গের গান সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, রেডিয়ো ষ্টেশনগুলো বাজাবে! লেন চেজ, মাডি ওটারসকে বলেন, “মাডি চিন্তা করো তো, একজন কৃষ্ণাঙ্গ গায়ককে দিয়ে যদি কান্ট্রি-হিলিবিলি গান করানো হয়, তাহলে বিষয়টা কেমন হয়?”
মাডি প্রথমে ভাবল, লেন তাঁর সাথে দুষ্টামি করে প্রশ্নটা করছেন, তাই সে হেসে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “তোমাদের একজন শ্বেতাঙ্গ গায়কে দিয়ে রিদমঅ্যান্ডব্লুজ করলে কেমন হয়, লেন?”
লেন হেসে উত্তর দেন, “আমার কিন্তু মনে হয় সেটাও খুব ভালো হবে। কিন্তু আমার তো সেটা করার সুযোগ এখনো আসেনি। তুমি তো জানোই তোমাদের নিয়েই আমার সব কাজ।”
কথা সত্য। লেন, তার ভাই ফিলকে নিয়ে চেজ রেকর্ডস শুরু করেন, এবং কৃষ্ণাঙ্গ গায়কদের স্টুডিয়ো রেকর্ডিং করার সব রকম সুযোগ করে দেয়। চেজ রেকর্ডসের পূর্বে কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীদের গান রেকর্ড করার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। তাই দ্রুতই কৃষ্ণাঙ্গ গায়কদের জন্য তীর্থের মতো হয়ে যায় চেজ স্টুডিয়ো।
শ্বেতাঙ্গরা মূলত ফোক-কান্ট্রি-হিলিবিলি এইসব গানই শুনত, এবং যা শ্বেতাঙ্গ গায়করাই করতো। কৃষ্ণাঙ্গদের করা গান তারা একরকম শুনতো না বললেই চলে। যদিও পরে, নাইটক্লাবের বদৌলতে কৃষ্ণাঙ্গদের জ্যাজ কিছুটা তাদের কাছে পৌঁছালেও, রিদমঅ্যান্ডব্লুজ গানের সাথে তারা তখনও সেভাবে পরিচিত হয়নি। কৃষ্ণাঙ্গদের ক্লাবে শ্বেতাঙ্গরা যেত না, আর রেডিয়োর প্লেলিস্টেও তাদের গান স্থান পেত না।
লেনের উদ্দেশ্যের গুরুত্ব বুঝতে পেরে মাডি বলে, “সেন্ট লুইসে এক গায়কের সাথে আমার পরিচয় হয়, চাক বেরি, তাকে দিয়ে চেষ্টা করাতে পার। শ্বেতাঙ্গদের মতোই কান্ট্রি-হিলিবিলি, এইসব ধরনের গান গাইতে পারে, ভালো গিটারও বাজায় চাক।”
সেন্ট লুইসের বিভিন্ন ক্লাবে কান্ট্রি-হিলিবিলি গান গেয়ে দিন কাটাতো চাক। মাডিকে লেন অনেক সম্মান করে, তার কথার ভরসাতেই চাক বেরিকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখতে চায়। চাককে নিয়ে আসা হয় সেন্ট লুইস থেকে শিকাগোর চেজ স্টুডিয়োতে।
ত্রিশের দশকের একটা হিলিবিলি গান ঠিক করে লেন, “আইদা রেড”। চাককে দিয়ে গানকে একটা নতুন রূপ দেয়া হচ্ছে। আসল গানের সাথে মিল রেখে গানের নতুন নাম প্রথমে দেয়া হলো, “আইদা মে”। কিন্তু আইদা নামটা কেমন সেকেলে লাগছিল লেনের কাছে। চিন্তা করছিলেন কী নাম দেয়া যায় গানটির। ঠিক সেসময় স্টুডিয়োর মাটিতে পড়ে থাকা মেয়েদের একটা মাস্কারার বাক্সের উপর তার চোখে পড়ে। সেই মাস্কারা বাক্সের উপরে বিখ্যাত কসমেটিক কোম্পানি নাম লেখা: ‘মেইবেলিন’।
নামের বানানে একটু পরিবর্তন করে লেন গানের নাম রাখেন, “মেইবেলিন”।
এসব চিন্তা করতে করতে চাক বেরি তৈরি হচ্ছে স্টুডিয়োতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। লেনের সাথে দেখা হওয়া দরকার। সে সময় আবারও পাশের রুমগুলি থেকে লাউড ভলিউমে মেইবেলিন বাজছে! চাক এবার একটু ভড়কে যায়। বছর খানেক আগে এল্ভিস প্রিসলির আগমন। এসেই খুব সহজেই রেডিয়ো ষ্টেশন দখল করে নেয়। এল্ভিসের গান সারাদিন রেডিয়োতে বাজবে সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মতো একজন কৃষ্ণাঙ্গের গান এভাবে রেডিয়ো প্লে পাবে, এটা সেসময়ের জন্য একটু আশ্চর্যজনক ঘটনা বটে!
মূলত চাক বেরিকে একজন শ্বেতাঙ্গ গায়ক ভেবেই প্রচুর রেকর্ড বিক্রি হয়। রেডিয়ো ষ্টেশনগুলোও তখন আসলেই বুঝতে পারেনি চাক বেরি একজন কৃষ্ণাঙ্গ গায়ক। যদিও পরে ভুল বুঝতে পেরে তার গান বাজানো কিছুদিন বন্ধ রাখে কিছু রেডিয়ো স্টেশন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
মিশিগানের ডেট্রয়েট শহরের এক কনসার্টে চাক বেরিকে না চিনতে পেরে, প্রথমে তাকে কনসার্ট করতে দেয়া হয় না। কনসার্ট ভেন্যুর গেইটেই চাককে আটকে দেয়া হয়, “কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
চাক উত্তর দেয়, “আমার পারফর্মেন্স আছে এরপর...”
গেইটের লোকটা চাককে থামিয়ে দিয়ে শোর পোস্টারের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলে, “আমি তো তোমার নাম এখানে দেখতে পাচ্ছি না।”
বাডি হলি অ্যান্ড দা ক্রিকেটস, এডি ককরান, এভারলি ব্রাদার্স, পল আংকার সাথে চাকের নামও আছে পোস্টারে। চাক তার নামের দিকে আঙুল তুলে বলে, “চাক বেরি, এটাই আমার নাম।”
“চাক বেরি? সে তো একজন শ্বেতাঙ্গ রকঅ্যান্ড’রোল সিঙ্গার, অ্যান্ড হি ইজ লেইট টুনাইট!”
চাক আর কথা না বড়িয়ে, গিটারে নিজের একটা গান গাওয়া শুরু করলো। গেইটের গার্ড অবাক হয়ে যায়, চাককে তৎক্ষণাৎ ঢুকতে দেয় হয়। চাক স্টেজের দিকে যেতে যেতে গার্ডকে উদ্দেশ্য করে বলল, “অ্যান্ড... চাক বেরি ইজ নেভার লেইট ফর আ শো।”
মেইবেলিন গানের মাধ্যমে কান্ট্রি মিউজিকের সাথে ব্লুজের সংমিশ্রণ করে চাক বেরি রকঅ্যান্ড’রোল মিউজিকের শুরু করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বাজারে কৃষ্ণাঙ্গ একজন গায়কের জন্য টিকে থাকা খুবই মুশকিল কাজ, সেটা চাক অনেক আগেই বুঝতে পারে। এমনকি একটা সময় আসে, যখনই চাক কিছু রেকর্ড করছে, তার ঠিক সাথেসাথেই অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ মিউজিশিয়ানরা তার গান নকল করে গান করছে, কিন্তু অসহায় চাক কিছুই করতে পারছিল না!
চাক বেরিকে নতুন কিছু চিন্তা করতে হয়। সেদিনের শোতে চাক তার নতুন গান, “জনি বি গুড” পরিবেশন করে। গানটি গাইবার সময় চাক নতুন একধরনের অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে লাগলো। মেঝে থেকে একটা পা সোজা করে একটু উঠিয়ে, পুরো স্টেজ জুড়ে মেঝেতে পা ঠুকে ঠুকে হাঁটার মতো, দেখতে অনেকটা হাঁসের হাঁটার মতো। চাক বেরির এই নাচ পরে ‘ডাক ওয়াক’ নামে প্রচুর সুখ্যাতি পায়। সে সময় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ দর্শকদের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ডাক ওয়াকের সাথে চাক যখন জনি বি গুড শুরু করে, তখন হল ভরতি উপস্থিত শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ শ্রোতারা ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই একসাথে মেতে উঠে।
নিজের সামসময়িক শিল্পী এলভিস প্রিসলি, লিটল রিচার্ড, জেরি লি লুইস, কার্ল পারকিন্স এদের মতো শ্বেতাঙ্গ শিল্পীদের পেছনে ফেলে চাক বেরি রকঅ্যান্ড’রোলের আদর্শ হয়ে ওঠে। চাক বেরি পরবর্তীতে তার শোতে গানের সাথে নিয়মিত ডাক ওয়াক পারফর্ম করা শুরু করত।
পঞ্চাশের দশকে চাক বেরির অসাধারণ গিটার বাদনে অভিনবত্ব ও প্রাণবন্ত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তখনকার আমেরিকান সমাজের শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ ভেদরেখা মুছে দিতে পেরেছিলেন। সংগীত জগতের একাধিক প্রজন্মের বহু খ্যাতিমান শিল্পী গেয়েছেন তার গান। চাক বেরির গান দিয়েই রোলিং স্টোনস আর বিটেলসের মতো ব্যান্ডগুলো তাদের যাত্রা শুরু করে। এতে চাক বেরির অবদান বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি বরং আরও উজ্জল হয়েছে।