Posts

গল্প

ফিসফাস গল্প

April 29, 2024

অয়ন আবদুল্লাহ

Original Author সাদাত হাসান মান্টো

Translated by অয়ন আবদুল্লাহ

153
View
সময়টা কনকনে শীতকাল।
রাত তখন দশটা। শালামার বাগ থেকে লাহোর যাওয়ার রাস্তাটা নির্জন আর অন্ধকার ছিলো। চারপাশে ঘন কুয়াশার মেঘ, সেইসাথে জব্বর বাতাস।
আশেপাশের সবকিছু যেন ঠাণ্ডায় জমে আছে। রাস্তার ধারের দুটো নিচু বাড়ি আর গাছগুলোকে দেখাই যাচ্ছে না ঠিকমতো। দূরের বিদ্যুতের খুঁটিগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে অতিরিক্ত শীতে কুঁজো হয়ে পড়ছে। চারিদিকে এক বিষণ্ণ নীরব পরিবেশ। শুধুমাত্র উম্মত্ত বাতাস তার উপস্থিতি জানান দেবার বৃথা চেষ্টা করছে।
 
দুই সাইকেলচালক যখন সেখানে আসলো, তখন তারা নিজেদের ওভারকোটের কলার ঠিক করছিলো। দমকা হাওয়া তাদের কানে বাড়ি মারছিলো, ঠাণ্ডায় কথাও বলতে পারছিলো না। সাইকেলচালক দু’জনের প্যাডেল মারতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু তারা সেই কষ্ট গ্রাহ্য না করে একে অপরের ছায়া হয়ে শালামার বাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, সাইকেল দুটো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর মরিচা ধরা পাতের মতো রাস্তাটা সেইগুলার চাকার তল দিয়ে পিছলে যাচ্ছে।
 
কিছুক্ষণ পাশাপাশি চলার পরে একজন সাইকেল থামিয়ে নিজের হাত দুটো গরম করার জন্য মুঠ করে মুখে ভাপ দিতে লাগলো আর ঘষতে লাগলো। তার সঙ্গীও সাথে সাথে ব্রেক কষে দাঁড়ালো। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই, সেই… সেই হুইস্কিডা কই গেলো?”
“জাহান্নামে গেছে, যেইখানে সারা রাইত লুটপাট হয়, অথবা এখনো শুরু হয় নাই।”
ঐ দুইজন আপন ভাই ছিলো, যারা শরীয়তবিরোধী পাপগুলো একসাথেই করতো। সকালে তারা ঠিক করেছিলো, দুপুর দুইটার কাছাকাছি সময়ে অফিস থেকে বের হয়ে যেই অবৈধ টাকাগুলা পাবে সেগুলো সহীহ উপায়ে কীভাবে খরচ করবে, সেই বিষয়ে একসাথে বসে ভাববে।
কিন্তু ঘুষদাতা তাড়াহুড়ো করায় সেই টাকা দুইটার আগেই তারা পেয়ে গিয়েছিলো। টাকাগুলো বড় ভাই ভালো করে পরীক্ষা করে নিয়েছিলো, কোনো দাগটাগ আছে কি না চেক করার জন্য। বেশি টাকা না, মাত্র দুইশ এক টাকা। কথা হয়েছিলো দুইশ টাকার, উপহার হিসাবে সেই লোক ১ টাকা বেশি দিয়েছে। ছোট ভাইয়ের পরামর্শে বড় ভাই বাড়তি টাকাটা এক অন্ধ ফকিরকে দান করে দিয়েছে। এই মুহূর্তে দুই ভাই হীরাবাজারের দিকে যাচ্ছে।
ছোট ভাইয়ের পকেটে স্কচের বোতল ছিলো, বড়টার পকেটে ছিলো দুটো থ্রী-ফাইভের বাক্স। এমনিতে তারা গোল্ড ফ্লেক খায়, কিন্তু ঘুষের টাকা পকেটে আসলে তাদের দামী ব্র্যান্ড ছাড়া চলে না।  
হীরাবাজারে পৌঁছানোর একটু আগে, বাদশাহী মসজিদে আযান হলো। বড়ভাই ছোটভাইকে বললো, “চল ভাই, নামাজটা পইড়া নেই।”
ছোটভাই নিজের ফুলে থাকা পকেট দেখিয়ে বললো, “এইডা কি করমু, ভাই?
বড়ভাই একটু ভেবে বললো, “চিন্তা করিস না, একটা বুদ্ধি বাইর করছি।”
পাশেই একটা জর্দাপানের দোকান ছিলো। বড়ভাই একটা বড় কাগজে বোতলটা পেচিয়ে দোকানদারকে দিলো। দোকানের পাশে নিজের আর তার ভাইয়ের সাইকেলটা রেখে দোকানদারকে বললো, “আমরা নামাজ পড়তে আসছি।”
দোকানদার হাসলো।
দুই ভাই নামাজ পড়তে মসজিদে ঢুকলো। জামাতে নামাজ পড়ে সাথে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে দু’জন বের হয়ে দেখলো জর্দাপানের দোকানটা বন্ধ। পাশের আরেকটা দোকানের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলে সে বললো, “আমি পূজা করতে গেছিলাম।”
দুই ভাইয়ের অবস্থাটা তখন দেখার মতোন হলো।
পাশের দোকানদার হেসে বললো, “মাঝে মাঝে বছরে চার মাস পরপর তার দেখা পাই।”
দুই ভাই আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। তবুও যখন সেই দোকানদার আসলো না, বড়ভাই ছোটভাইকে বললো, “কপালে শনি আছিলো দেইখাই আমি ওই জারজটারে বিশ্বাস করছিলাম। যা, আরেক বোতল কিনা আন।”
বড়ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছোটভাই বললো, “জিনিসটা আমার পকেটে থাকলে কী সমস্যা হইতো?”
“বাদ দে ভাই। এইটা নিয়া ভাইবা আর লাভ নাই। বোতলটা হারায়া গেছে দেইখা আমার মন খারাপ হয় নাই, ওইটা হাত থেইকা পইড়া ভাইঙ্গাও যাইতে পারতো…! আফসোস হইতাছে এই ভাইবা যে, হারামিটা চুরির মাল মজা নিয়া খাইতাছে।
সাইকেলে উঠতে উঠতে ছোটভাই জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এইখানেই থাকবা নাকি?”
বড়ভাই মন ভার করে বললো, “হ, আমি এইখানেই অপেক্ষা করমু। মাল খায়া টাল হয়া বদমাইশটা ফিরা আসতেও পারে। কিন্তু তুই আবার দেরি করিস না।
 
ছোটভাই তাড়াতাড়িই ফিরলো, কিন্তু মুখ গোমরা করে ফিরলো। ছোটভাইয়ের পেছনে সাইকেলের ক্যারিয়ারে একটা লোক বসে ছিলো। বড় ভাইয়ের মনে সন্দেহ দেখা দিলো- নিশ্চয়ই বড়সড় কোনো ঘাপলা হয়েছে। সাইকেল থেকে নেমে ছোট ভাই বিস্তারিত বললো।
নতুন বোতল নিয়ে যখন সে মদের দোকান থেকে বের হলো, দেখলো একদফা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট পুরোই ভেজা। দ্রুত ফিরে যাবার জন্য সে খুব জোরে সাইকেল চালাতে লাগলো। কিন্তু হঠাৎ করে চাকা পিছলে গেলে সে সামলাতে পারে নি। খোলা রাস্তার উপরে সাইকেল নিয়ে পড়ে যাওয়ায় নতুন বোতলটা চুরমার হয়ে গেছে।
ছোটভাই পুরা ঘটনা বর্ণনা করে বললো, “আল্লাহ’র দয়ায় আমি বাঁইচা ফিরছি। যদি ভাঙ্গা বোতলের টুকরা কাপড় ছ্যাদা কইরা আমার শরীরে ঢুকতো, তাইলে এইখানে আসার পরিবর্তে আমারে হাসপাতালে যাইতে হইতো।”
বড়ভাই হাভেভাবে আল্লাহ’র শুকরিয়া আদায় করার কোনোরকম ইচ্ছা দেখা দিলো না। যেই লোক ছোট ভাইয়ের সাথে এসেছিলো, তার কাছে আরেক বোতল মদ ছিলো। সেই বোতল দুই ভাইয়ের কাছে বেচে দিয়ে পানের দোকানের দিকে তাকিয়ে একটা গালি দিলো। তারপর বললো, “শালার দোকানটারে পুড়ায়া দে!”
দুই ভাই জানতো তারা কই যাবে। চকের এদিকে একটি কাবাব ঘরের উপরের তলার একটি কামরায় এই দুই ভাই তাদের দুই নম্বরি টাকা উড়াতো। সেই ঘরে এক মহিলা থাকতো, যে খেতে খুব ভালোবাসতো। অভ্যাসের দিক থেকে সে বেশ্যার চাইতে কেরানি ছিলো বেশি। দুই ভাইয়ের এই কারণেই তাকে অধিক পছন্দ ছিলো। মদ খেয়ে টাল হওয়ার পর দুই ভাই অফিসের প্যাচাল পাড়তো। হেড ক্লার্কের বর্তমান অবস্থা, বড়সাহেব কী করে, তার কাজের লোকটার বদঅভ্যাস, ইত্যাদি ইত্যাদি। অফিসের সবার অতীত বর্তমান নিয়ে টিপ্পনী মারতে মারতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতো আর সেই মহিলা খুব মনযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনতো।
মহিলাটা দেখতে খুব সুন্দরী। দুই ভাই তার গান এমন গভীর মনযোগ দিয়ে শুনতো, যেন তাদের কানে মধুবর্ষণ হচ্ছে। কিন্তু আজ গান গাওয়ার সময় সে খেয়াল করলো, দুই ভাইয়ের এদিকে যেন কোনো খেয়ালই নেই। তাই সে গান বন্ধ করে যতটুকু মদ বাকি ছিলো, সেটা খাওয়ায় মন দিলো।
মহিলার নাম ছিলো শীদান। সে খুব কম মদ খেতো। কিন্তু আজ যখন দুই ভাই গানে না মযে মদে বেশি ডুব দিলো, তখন ভাঙ্গা মন নিয়ে সে-ও গিলতে শুরু করলো।
বড় ভাইয়ের মেজাজ খারাপ ছিলো, কিন্তু ছোট ভাইয়ের মন ভালো দেখে সে চুপচাপ মদ খাইতেছিলো। কিন্তু এই অবস্থা বেশিক্ষণ থাকলো না। যখন ছোটভাই আবার মদের বোতলটা হাতে নিলো, দেখলো সেটা পুরা খালি। এবার দুই ভাইয়ের মন একসাথে খারাপ হলো।
বড়ভাই ছোটভাইয়ের সাথে পরামর্শ করার দরকার মনে করলো না। খিস্তি মেরে একটা লোককে বললো, “যা, দৌ দিয়া একটা জিমখানা হুইস্কি নিয়া আয়।”
সেই তৃতীয় ব্যক্তি পয়সা পকেটে ঢুকিয়ে বললো, “হুজুর এইখানে শুধু কালাপানি পাওয়া যায়।”
দুই ভাইয়ের মেজাজ চরমে উঠলো। জিদের চোটে বড়ভাই একটা পানির বোতল হাতে তুলে নিলো। তার মন চাচ্ছিলো বোতলটা বেঈমান মদ বিক্রেতার মাথায় ভাঙ্গে। কিন্তু সাথে সাথেই তার মনে পড়লো, যে তার কাছে লাইসেন্স নেই। তাই, আর কিছু না বলে সে চুপ হয়ে গেলো।
ছোটভাই আর শাদীন অনেক চেষ্টা করে তাকে শান্ত করলো। খাওয়া দাওয়ার পরে শাদীন হুক্কা টানতে বসলো, আর দুই ভাই তখন আর সেখানে থাকা উচিৎ হবে না ভেবে সাইকেল নিয়ে বের হইয়া গেলো। তারা কিছুক্ষণ ‘হিরামন্ডি’র অলি-গলিতে সেই দোকানদারকে খুঁজতে লাগলো। সারাদিনে এতো কাহিনী হয়েছে যে, শেষে শরীর আর নিতে পারছিলো না। দুই ভাই বাড়ি ফেরার জন্য যেই রওনা দিবে, তখনই এক ঘটনা দেখলো। দুইভাই এতো গিলেছে যে, মাথা আর ঘাড়ের ব্যথায় সামনে তাকাতে পারছিলো না। ভাবলো, আগে থেমে একজন আরেকজনকে মালিশ করে দিবে। কিন্তু তখনই একটা হাবিলদার এসে সেই লোকটাকে ধরে থানায় নিয়া গেলো, যে তাদের মদ চুরি করে খেয়ে টাল হয়ে ছিলো।  
ছোটভাই বললো, “ভাই, অহন তামাশা দেখবা।”
বড়ভাই জিজ্ঞেস করলো, “কার তামাশা দেখমু?”
ছোটভাই- কার তামাশা মানে?
বড়ভাইয়ের মুখে একটা অর্থবোধক হাসি দেখা দিলো। 
“কেউ যদি আমাদের চিনবার পারে বা আমাদের মুখে যদি কেউ মদের গন্ধ পায়, তাইলে আমরাই তামাশার বিষয় হইয়া যামু।”
ছোটভাই বড়ভাইয়ের কথায় ঘাবড়ে গিয়ে বললো, “ভাই চলো পালাই। বাড়ি ফিরা যাই।”
 
ফাঁক বুঝে দুই ভাই সাইকেল নিয়ে ভেগে গেলো। একটু আগে বৃষ্টি পড়ছিলো, এখন থেমে গেছে। কিন্তু ঠাণ্ডা বাতাসের দাপট সমানে চলছে। হিরাবাজার থেকে বের হওয়ার মুখেই দুইভাই তাদের অফিসের এক বড়সাহেবকে দেখতে পেলো। দুইভাই তাকে এড়াতে চাইলেও সম্ভব হলো না, সে তাদের দেখে ফেললো।
“কই যাও?”, বড়সাহেব জিজ্ঞেস করলো।
তারা জবাব দিলো না।
“আরে, কই যাও?” বড়সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলো।
এই অবস্থায় আর এড়ানো যায় না। দুইভাই সাইকেল থামানের পর বড় অফিসার জিজ্ঞেস করলো, “কি, খুব মজা করলা মনে হয়?”
ছোটভাই বললো, ”জি”। বড়ভাই বললো, “না”।
বড়সাহেব মজা পেয়ে একচোট হাসলো। এরপরে ভদ্রতা করে বললো, “আমার মজা এখনও পুরা হয় নাই। তোমাদের কাছে কি টাকা আছে?”
এইবার বড়ভাই বললো, “জি আছে” আর ছোট ভাই বললো, “না,স্যার।”
বড়সাহেব আরেকবার খুব জোরে হেসে বললো, “আমার একশ টাকার বেশি লাগবে না।“  
বড়ভাই যন্ত্রের মতোন ১০০ টাকা বের করে ছোটভাইকে দিলো। ছোটভাই টাকাটা দিতেই বড়সাহেব “ধন্যবাদ” বলে তাদের পথ ছেড়ে দিলো।
দুইভাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর বড়ভাই তার কপাল থাবড়াতে থাবড়াতে বললো, “আজ সকালে যে কার মুখ দেখছিলাম, আল্লাই জানে।”
ছোটভাই বাজে একটা গালি দিয়ে বললো, “কার মুখ আবার, যেই লোক আজকে দুইশ এক টাকা দিছিলো, সেই শুয়োরের বাচ্চার।
বড়ভাইও সেই লোককে মন ভরে গালি দিলো। এরপর বললো, “আমার মনে হয় সব দোষ ঐ বাড়তি এক টাকার যেইটা সে তার মনের শান্তির জন্য আমাগোরে উপহার দিছিলো।”
“অথবা সকাল বিকাল আমরা যার পিছে খাড়ায়া নামাজ পড়ি।”
“অথবা, সেই শুয়োরটা, যে আমাদের মদ চুরি করছিলো।”
“কপাল ভালো যে পুলিশে ধরছে। নাইলে আজকে ওয় আমার হাতেই মরতো।”
“কিছু পাইতে হইলে কিছু দিতে তো হইবোই।”
“ওরে দিতেও হইতো, নিতেও হইতো। আল্লায় জানে, বড়সাহেব কোইত্থিকা যে নাজিল হইছিলো!”
“তয় কপাল ভালো। ১০০ টাকার বিনিময়ে ইজ্জত রক্ষা হইছে।”
“সেইটাও ঠিক। তয় আজকে আমাদের পকেটের উপর মারাত্মক লুটপাট হইছে।”
“চল ভাই, আবার কোনো ঝামেলা আসার আগেই ফিরা যাই।”
এরপর দুই ভাই সাইকেলে চড়ে হিরাবাজার থেকে বের হয়ে গেলো।
 
অফিস থেকে বের হবার সময় বড়ভাই মনে মনে ঠিক করেছিলো, দুই-তিন পেগ স্কচ খাওয়ার পর শীদানকে ওর ছোট বোনটাকে ডাকতে বলবে। শীদান ওর ছোট বোনের খুব সুনাম করতো। সে দেখতে নাকি খুবই সুন্দরী আর বয়সেও কচি; গ্রামের হাওয়া বাতাস খেয়ে বড় হয়েছে। কয়েক মাস আগে নিজের ধান্দাও শুরু করেছে।
স্কচ, হুইস্কি আর শীদান ছাড়া আর কিছু সুন্দর আসলেই আছে কি না, সেটা দেখার খুব খায়েশ ছিলো। কিন্তু বড়ভাইয়ের মনের সেই গুপ্ত খায়েশ গুপ্তই থেকে গেলো।
ছোটভাইয়ের মনের মধ্যেও রঙ্গলীলা জেগে উঠছিলো। এমন দারুণ মরসুমে হুইস্কি আর শাদীন ওকে খুশি করে দিতে পারতো। এতোটাই খুশি করে দিতে পারতো যে, টানা ১৫-২০ দিন আর কোনো মৌজমাস্তি করার দরকারই হতো না।
দু’জনের মাথা আর মন, দুটোই ভারী হয়ে গিয়েছিলো। তারা যেমনটা ভেবেছিলো, দিনটা তেমন যায় নি। স্কচের প্রথম বোতলটা পানওয়ালা চুরি করে নিয়েছিলো, দ্বিতীয় বোতলটা রাস্তায় পরে ভেঙেছিলো, তৃতীয়টায় ভাগে কম পড়েছিলো, কারণ শাদীনের আসরে আজকে লোক বেশিই ছিলো। চতুর্থবার যখন মদ আনালো তখন দেখলো মদের থেকে পানির পরিমাণই বেশি। আর পঞ্চমবার যখন মদ কেনার কথা ভাবছিলো, তখনই বড়সাহেব এসে ১০০ টাকা ছিনতাই করে নিয়ে গেলো।
বড়ভাই একটু বেশিই রেগেছিলো। এতোটাই রেগেছিলো যে, তার মাথার মধ্যে আজব আজব চিন্তা আসছিলো। সে কিছু একটা করতে চাচ্ছিলো, যেমন কুকুরের মতোন জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করা, অথবা সাইকেলটাকে তুলে আছাড় মেরে গুড়োগুড়ো করে দেয়া, অথবা শরীরের সব কাপড় খুলে উদাম হয়ে কুয়োর মধ্যে ঝাঁপ দেওয়া। যেই পরিস্থিতি তাকে নিয়ে তামাশা করেছে, সেই তামাশাটুকু সে ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছিলো। কিন্তু সেই সময়টা এখন চাইলেও আর হিরামন্ডি থেকে উড়ে আসবে না। এসব ভেবে নিজেকে তার খুব অসহায় লাগছিলো।
 
একটা ঘর, যেখানে তারা শান্তিমতো ঘুমাতে পারতো। কিন্তু শুধু শান্তি দিয়ে কি হবে? ভালো হতো, যদি দুইশ টাকার চরস টেনে সকালে আরামসে উঠে বাড়তি এক টাকা কোনো মাজারে খয়রাত করতে পারতো।
ভাবতে ভাবতে বড়ভাই চিৎকার দিয়ে উঠলো’ “ধুর বাল!”
ছোটভাই ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “টায়ার পাংচার হয়া গেছে নাকি, ভাই?”
বড়ভাই জবাব দিলো, “না, ভাই। আমি আমার ঘিলুটারে পাংচার করার চেষ্টা করতেছি।”
ছোটভাই বুঝতে পারলো। বললো, “হইছে, অখন তাড়াতাড়ি ঘরে চলো।”
বড়ভাইয়ের বিরক্তি আরো বাইড়া গেলো।
“বাড়ি গিয়া কী করবি? বাল ফালাবি?”
ছোটভাই মানসিক রোগীর মতো হাসতে লাগলো। এই হাসি বড়ভাইয়ের মেজাজ আরো খারাপ করে দিলো।
“চুপ কর। হাসবি না!”
এরপর অনেক্ষণ ধরে দুই ভাই চুপচাপ দূরত্ব রেখে চলতে লাগলো। এই মুহূর্তে তারা সেই মরিচা পড়া লোহার মতো রাস্তার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
বড়ভাই সাইকেল থামিয়ে মুখের বাতাস দিয়ে হাত গরম করতে করতে বললো, “খুব ঠাণ্ডা লাগতেছে।”
ছোটভাই তখন মজা করে বললো, “সেই হুইস্কি কই?”
বড়ভাইয়ের ইচ্ছে হলো ছোটভাইকে সাইকেল সমেত তুলে একটা আছাড় মারে। কিন্তু নিজেকে সামলে জবাব দিলো, “জাহান্নামে গেছে, যেইখানে সারা রাইত লুটপাট হয়, অথবা এখনো শুরু হয় নাই।”
এইকথা বলে সে একটা বিদ্যুতের খুঁটির পাশে দাঁড়িয়ে পেশাব করতে লাগলো। এমন সময় ছোটভাই ডাক দিয়ে বললো, “দ্যাহো ভাই, কে যেন আসতেছে!”
বড়ভাই পিছনে তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে তাদের দিকেই আসছে। মেয়েটা ঠাণ্ডায় কাঁপছিলো। কাছাকাছি আসতেই তারা বুঝলো মেয়েটার বয়স কম আর সে চোখে দেখতে পারে না। এতো কাছে থেকেও দুইভাইকে সে দেখতে তো পাচ্ছিলোই না, বরং হাঁটতে হাঁটতে বারবার খুঁটিতে বাড়ি খাচ্ছিলো।
বড়ভাই মনযোগ দিয়ে মেয়েটাকে দেখলো। মেয়েটা যুবতি, ষোলো সতেরো বছর বয়স হবে। পুরনো, ছেঁড়া কাপড় ভেদ করে যেই যৌবন বের হয়ে আসছে, সেটা দেখলে কোনো পুরুষের পক্ষে হুশ ঠিক রাখা সম্ভব না। ছোট ভাই জিজ্ঞেস করলো, “কই যাইতেছো?”
মেয়েটা চাপা গলায় জবাব দিলো, “আমি রাস্তা ভুইলা গেছি। বাসার জন্য কাঠ নিতে বের হইছি।”
বড়ভাই জিজ্ঞেস করলো, “তোমার বাসা কোনখানে?” 
আন্ধা মেয়েটা বললো, “আমি জানি না। মনে হইতেছে, পিছনে ফেলায়া আসছি।”
বড়ভাই মেয়েটার হাত ধরে বললো, “আমার সাথে আসো।”
সে মেয়েটাকে নিয়ে রাস্তার অন্যপাশে একটা পুরনো বাতিল ইটের ভাটায় নিয়ে গেলো। মেয়েটা বুঝলো পথ চেনানোর উসিলায় লোকটা তাকে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে কোনোরকম প্রতিবাদ করলো না; মনে হয় এই রাস্তাটা তার চেনা।
মনের খেদ মিটানোর একটা সুযোগ পেয়ে বড়ভাই সেই খুশি। কোনোরকম বাঁধা দেয়ারও কেউ নেই। গায়ের ওভারকোটটা খুলে সে মাটিতে পেতে দিলো। এরপর সে আর অন্ধ মেয়েটা বসে কথা বলতে শুরু করলো।
মেয়েটা জন্ম থেকেই অন্ধ না। যুদ্ধের সময় শিখরা যখন তার গ্রামে হামলা করছিলো, সেই সময় মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়ার ফলে তার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে।
বড়ভাই মন থেকে মেয়েটার জন্য সহানুভূতি দেখালো। যদিও অতীত নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। সে পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে মেয়েটার হাতে দিয়ে বললো, “মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ কইরো। তোমার জন্য ভালো কিছু জামা কাপড় বানায়া দিমু নে।”
মেয়েটা খুব খুশি হলো। বড়ভাইও তখন খুব মজায় ছিলো, যখন চকচকে দৃষ্টি নিয়ে মেয়েটাকে দেখছিলো আর দুই হাত দিয়ে তার শরীরে হাত বুলাচ্ছিলো। এমন সময় হুট করে ছোট ভাইয়ের কর্কশ গলা শোনা গেলো।
“ভাই! ও বড়ভাই!”
বড়ভাই জিজ্ঞেস করলো, “কী হইছে?”
ছোটভাই সেখানে হাজির হলো। আতঙ্কিত গলায় বললো, “ভাইজান, দুইজন হাবিলদার এইদিকে আসতেছে।”
বড়ভাই এক ঝটকায় ওভারকোটটা টান দিলো, যেটার উপর মেয়েটা বসে ছিলো। হ্যাচকা টানে অন্ধ মেয়েটা একটা খাদে গিয়ে পড়লো যেখানে ইট শুকিয়ে রাখা হতো। পড়তে পড়তে ব্যথায় সে চিৎকার করে উঠলো, কিন্তু দুই ভাই ততক্ষণে সেখান থেকে চলে গেছে।
চিৎকার শুনে হাবিলদার দু’জন সেখানে হাজির হলো আর অন্ধ মেয়েটাকে গর্ত থেকে বের করলো। তার মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর মেয়েটার হুশ ফিরে আসলো আর হাবিলদারদের দেখে এমন ভয় পেলো, যেন ভুত দেখেছে। তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে হুট করেই পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগলো, “আমি দেখতেছি, সব দেখতেছি, আমার চোখ ফিরা পাইছি!!”
বলতে বলতে অন্ধ মেয়েটা সেখান থেইকা চলে গেলো আর তার হাত থেকে যেই দুই টাকা পড়ে গিয়েছিলো, সেটা হাবিলদার দু’জন চুপচাপ পকেটে ভরে ফেললো। 

Comments

    Please login to post comment. Login