একটা জিপসি ব্যান্ডে গিটার বাজায় জ্যাঙ্গো। রোম্যানি-ফ্রেঞ্চ জিপসি বংশদ্ভুত এই গিটারিস্ট একটা ক্যারেভেনে থাকে। এই ক্যারাভ্যান নিয়েই ঘুরে বেড়ায় ফ্রান্সের শহর থেকে শহরে।
প্যারিসের একটা হোটেলে শো করছিল জ্যাঙ্গো, বেশ কয়েকদিন হলো রাতে আর ক্যারেভেনে ফেরা হয় না, দলসহ হোটেলেই থেকে যাচ্ছে। জ্যাঙ্গো আজ নিজের ক্যারাভ্যানে ফিরে যাবেই ঠিক করেছে। কদিন মাত্র বিয়ে হয়েছে তার, এই ১৭ বছর বয়সেই!
রাস্তা থেকে একতোড়া ফুল কিনে নেয় স্ত্রীর জন্য। না জানি কী করে সময় কাটাচ্ছে বেচারি একা একা। এই ভাবতে ভাবতে, চুপিচুপি ক্যারাভ্যানটার দিকে এগিয়ে যায় জ্যাঙ্গো। কিন্তু ভেতরে ঢুকে সে নিজেই অবাক হয়ে যায়। পুরো ভ্যান ভরতি ফুল! সে মনে মনে ভাবে, ‘এটা আমারই ভ্যান তো, নাকি ভুল করে অন্য কারোটায় ঢুকে পড়েছি। কিন্তু এখানেই তো পার্ক করে গিয়েছিলাম!’
ভ্যান থেকে বেরিয়ে আসে সে, সে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে ভ্যানটাকে, ‘না, এটা তো আমারই ভ্যান, তাহলে এত ফুল এলো কোথা থেকে?’
ঠিক সে সময় পেছন থেকে তার স্ত্রী ফ্লোরিন, জ্যাঙ্গোকে জড়িয়ে ধরে বলে, “সারপ্রাইজ!”
জ্যাঙ্গোর অবাক ভাবটা তখনো কাটেনি, “এত ফুল কোথায় পেলে? এখানে কী করছে?”
“এগুলো আমি তৈরি করেছি।”
“ফুল তৈরি করেছো, মানে?”
“আরে এগুলো নকল ফুল, প্লাস্টিকের তৈরি। তুমি বুঝতে পারনি?”
“না, মানে আমি তো শুধু এক ঝলক দেখেই বেরিয়ে পড়েছি। ভাবলাম অন্য কারও ভ্যানে উঠে পড়েছি কি না। তোমাকে সারপ্রাইজ দিব ঠিক করে এসেছিলাম, নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।”
এই বলে ফুলের তোড়াটা হাতে দিয়ে জ্যাঙ্গো আবার বলে, “কিন্তু এত ফুল দিয়ে কী হবে?”
“তোমাকে বলা হয়নি, আমি এই ফুল বিক্রির ব্যবসায় নেমেছি। ভালো দামে বিকোয় এগুলো।”
“তাই নাকি? খুব সুন্দর দেখতে, আমি কিন্তু সত্যিই ধরতেই পারিনি এগুলো নকল। কিন্তু আসল ফুল রেখে এগুলো কেউ কিনবে?”
“কী যে বল না তুমি! দারুণ চাহিদা, সবাই কিনছে।”
“হুম, পানি দিতে হয় না, তাও দিনের পর দিন বেঁচে থাকে...”
“মনের মতো রং বেছে নেয়া যায়।“ এই বলে হেসে ওঠে ফ্লোরিন।
জ্যাঙ্গোও হাসতে হাসতে বলল, “ব্যাবসা ভালোই হবে মনে হচ্ছে। তুমি তো মনে হয় শীঘ্রই ধনী হয়ে যাবে। যাক আমিও দ্রুত রিটায়ার্ড করে ফেলতে পারব...”
ফ্লোরিন বলে, “অত সহজে জ্যাঙ্গো রেনার্ডকে কেউ গিটার বাজানো থেকে রিটায়ার্ড করাতে পারবে না।”
তারা দুজনেই হেসে উঠে। জ্যাঙ্গো বলে, “চলো, শুয়ে পড়ি। সকালে আবার অন্য দিকে রওনা হতে হবে।”
সে রাতেই ঘটলো দুর্ঘটনা। ভ্যানে রাখা জ্বলন্ত একটা মোম থেকে আগুন লেগে যায় নকল ফুলগুলিতে। দ্রুত আগুন পুরো ক্যারাভ্যানে ছড়িয়ে পরে। জ্যাঙ্গো নিজের শরীরে একটা কম্বল জড়িয়ে নিয়ে, কোনোমতে স্ত্রীকে নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে বের হয়ে আসে।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শরীরের অনেকটা অংশই পুড়ে যায় জ্যাঙ্গোর। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর, তাঁর ডান পা কেটে ফেলার পরামর্শ দেয় ডাক্তার। জ্যাঙ্গো কিছুতেই রাজি হয় না, এবং তা করতেও দেয় না। অন্যদিকে তার বাঁ হাতও প্রায় অসাড়।
জ্যাঙ্গো হাসপাতাল থেকে চলে আসে একটা নার্সিং হোমে। কয়েক মাস পরে একটা লাঠিতে ভর করে হাঁটতে পারে ঠিকই, কিন্তু বাঁ হাতের দুইটা আঙুল একদম অকেজো হয়ে যায়, কোনো রকম সাড়া নেই।
জ্যাঙ্গো কিন্তু কখনোই হাল ছাড়ে নাই। নার্সিং হোমে থাকার সময় সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। সেই সাথে চলতে থাকে আগের মতো করে গিটার বাজানো ফিরে পাওয়ার চেষ্টা।
শুধুমাত্র তর্জনী আর মধ্যমা আঙুল দিয়েই বাজানো প্র্যাকটিস শুরু করে। আর নষ্ট হয়ে যাওয়া দুই আঙুল দিয়ে হোম কর্ড ধরায় কিছুটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে থাকে।
এসময়ই আমেরিকান জ্যাজের খুব ভক্ত হয়ে পড়ে জ্যাঙ্গো। লুই আর্মস্ট্রংয়ের ট্রাম্পেট আর ডিউক ইলেংটনের পিয়ানো তাকে মোহিত করে। গ্রামোফোন ছেড়ে দিয়ে সেসবের সাথেই চলতো প্র্যাকটিস। দুই আঙুল দিয়ে গিটারের তারে তালে তালে বাড়ি দিয়ে পিয়ানোর কম্পনের মতো করে বাজাতে শুরু করে। জ্যাঙ্গোর দুই আঙুল তাতেই ক্ষান্ত হয়নি, সেই একই সাথে ক্ষিপ্রগতিতে খেলতে থাকে ফ্রেটবোর্ড জুড়ে, ঠিক যেভাবে ট্রাম্পেট প্লেয়াররা দ্রুততার সাথে করে। জ্যাঙ্গোর কাছে এ যেন আর গিটার নয়, নতুন কোনো বাদ্যযন্ত্র। বলা যায় গিটার বাজানোর একরকম নতুন টেকনিক বের করল সে।
সুস্থ হয়ে উঠতে জ্যাঙ্গোর প্রায় দেড় বছর লেগে গেল। কিন্তু বের হয়ে এলো তুখোড় এক গিটারিস্ট হয়ে। তাকে আবার নতুন করেই শুরু করতে হয়। ক্যারাভ্যান আর বিভিন্ন ক্লাবে ক্লাবে।
জ্যাঙ্গো খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, এভাবে আর কত দিন?
মনের মধ্যে প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে সেরকমই এক ক্লাবে, সে তার ছোট্ট ব্যান্ড নিয়ে গিটার বাজাচ্ছিল একদিন। হঠাৎ ভায়োলিনের শব্দে সে চমকে উঠে। সে যা বাজাচ্ছে, তাই যেন কেউ ভায়োলিনে তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে! অনেকটা কথোপকথনের মতো। জ্যাঙ্গো অবাক হয়ে দেখে, তার সাথে স্বনামধন্য ভায়োলিনিস্ট স্টেফান গ্রাপেলি!
স্টেফান তাকে বলে, “আমি কখনও এভাবে কাউকে গিটার বাজাতে দেখিনি বা আগে কোনোদিন শুনিনি।”
স্টেফান জ্যাঙ্গোকে একসাথে ব্যান্ড করার প্রস্তাব দেয়। তারা ব্যান্ডের নাম দেয় ‘মানোচে হট ক্লাব অফ ফ্রান্স’। তাদের নতুন ধরনের এই মিউজিকের নাম হয় ‘হট জ্যাজ’।
স্টেফানকে নিয়ে জ্যাঙ্গো বেরিয়ে পড়ে ট্যুরে। দ্রুত সারা বিশ্বে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে।