(তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মোহাম্মদির ‘ফারসি ও আরবির পরস্পর সম্পর্ক’ প্রবন্ধটি বাইশ সালে একটি ফারসি সংকলনে খুঁজে পাই। এই লেখায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের খুব একটা তথ্য না থাকলেও ফারসি-আরবির অনেকটা ওঁতপ্রোত সম্পর্ক বিষয়ে এই প্রবন্ধ থেকেই প্রথম জানতে পারি এবং একইসাথে কিছুটা ফারসি-চর্চাও যেন হয়, তাই অনুবাদ করি।)
অসংখ্য শব্দ ও পরিভাষার আদান-প্রদানে ফারসি ও আরবির সম্পর্ক প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। দুটি ভাষার পারষ্পরিক এই আধিপত্য অথবা ভাষিক আদান-প্রদানকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়: এক. আরবি ভাষায় ফারসির আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারকাল। দুই. ফারসি ভাষায় আরবির আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারকাল।
আরবি ভাষায় ফারসির আধিপত্যের সূচনা হয় তৎকালীন পারস্যে ইসলাম-প্রসারের সূচনালগ্ন থেকে। ইসলামের মাধ্যমে আরব উপদ্বীপ থেকে আগত এই ভাষা ইরানে এসে অনেক বিষয় ও পরিভাষার মুখাপেক্ষী হয়, যেসব বিষয় ও পরিভাষা আরবিতে বিদ্যমান ছিল না। আবার আরবরা তাঁদের মরু-জীবনে এসবের সাথে পূ্র্ব-পরিচিতও ছিল না। জ্ঞান, বিচার ও প্রসাশন-সংক্রান্ত সমূহ পরিভাষা থেকে নিয়ে জীবন-সংশ্লিষ্ট অসংখ্য ও অগনিত বিষয়াদি এর অন্তর্ভূক্ত ছিল। মফস্বলজীবনের বিভিন্ন উপায়-উপকরণ, কর্ম ও পেশা সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি, খাবার-দাবারের প্রকার, পোশাক-পরিচ্ছদ, ফুল-ফল ও তৃণলতা প্রভৃতিও —যেসব নামের সাথে তাঁরা সেখানে পরিচিত হয় —সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তৎকালীন সময়ে পারস্যের প্রাচীন ও বিস্তৃত ফারসি ভাষায় এই সবকিছুই বিদ্যমান ছিল। ফলে আরবি ভাষা ফারসি থেকে অনেক সাহায্য গ্রহণ করে। আবার আরবদের মধ্যে যারা এসব শব্দ বা পরিভাষা নিজেদের ভাষায় ব্যক্ত করতে পারত না, তাঁরা সরাসরি সেসব 'আরবিকরণ' করে নিজেদের ভাষায় প্রকাশ করত।
যাই হোক, আরবি ভাষা বিশ্বের বিভিন্ন বিদেশি ভাষা থেকে অসংখ্য শব্দ ও পরিভাষা গ্রহণ করলেও সেই গ্রহণ কিছুতেই ফারসি পর্যন্ত পৌঁছেনি। কারণ, ফারসিই একমাত্র ভাষা; যা আরবির মতো অন্য কোনো ভাষাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। আর ফারসি থেকে আরবি হওয়া এসব শব্দের পার্থক্য ও ভিন্নতা বোঝার জন্যে আরবিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বিভিন্ন বইপুস্তক প্রকাশ হওয়া এ যুক্তিটিকে আরো শক্তিশালী করে।
তেইশ শতাব্দীর পূর্বে ফারসি ভাষা এক দীর্ঘসময় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য থেকে দূরে ছিল, তখন এ ভাষাটি বিদ্যমান ছিল কেবলমাত্র একটি কথ্যভাষা হিসাবে। অতঃপর তেইশ শতাব্দীর পরে ফারসি আবারও ধীরেধীরে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যে ফিরে আসে। তখন কিছু কবি-সাহিত্যিক ও লেখক ফারসি ভাষায় কাব্য-রচনা এবং বিভিন্ন বিষয়ে বই লিখতে শুরু করেন। এই সময় আরবি ভাষা নিজের বিশালতা ও সক্ষমতার ফলে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্ম, রজনীতি ও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে প্রধান ভাষা হিশেবে স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধশালী ও শক্তিশালী ভাষায় পরিণত হয়। অপরদিকে ফারসি দীর্ঘসময় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য থেকে বঞ্চিত থাকায় অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। এবং কালক্রমে একটি দূর্বল ভাষায় পরিণত হয়।
তাই তৎকালীন সময়ে ইরানি লেখকগণ ফারসির দূর্বলতা ও অক্ষমতার ফলে সাধরণতই আরবির সাথে পরিচিত হন। আরবির প্রতি মুখাপেক্ষী হন। এবং ফারসিতে স্বল্প জ্ঞান রাখতেন এমন বিষয়ে আরবি থেকেই গ্রহণ করতে থাকেন। ফলে আরবি ফারসির সহায়তায় দ্রুতই সাড়া দেয় এবং বিভিন্ন শব্দ ও পরিভাষা ধার দেয়। এভাবে আরবি ফারসির ওপর গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এবং দুই ভাষারই উন্নতিতে শব্দ ও পরিভাষা আদান-প্রদানের বিষয়টি একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসাবে স্বীকৃতি পায়। এমনকি প্রয়োজনের ক্ষেত্রে উভয় ভাষাই এই আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমৃদ্ধি ও বিস্তৃতি লাভ করে।