আবু খিযিরের বয়স আশি পেরুলো। যাইতুনের একটা ডালের সাহায্যে বার্ধক্যপীড়িত শরীরটাকে কোনোরকমে তিনি বয়ে চলেন। লাঠিটাও ঠিক তাঁর পিঠের মতোই বাঁকা। হাতের লাঠি কিংবা শরীর, দুটোতেই খুব সহজে বয়সের ছাপ টের পাওয়া যায়। সাথে ভেতর থেকে উপচেপড়া একপ্রকার গর্বও।
আমাদের দেশ ফিলিস্তিনে যাইতুন গাছগুলো যেনো ইতিহাসের এক বর্ণিল দর্পণ। এই দেশের কষ্ট ও আশা, অশ্রু ও বিজয় এবং লড়াই ও হেরে যাওয়ার প্রাত্যহিক রেখাচিত্রের মিশেলে এই গাছগুলো জীবন্ত ইতিহাসে পরিণত হয়েছে।
প্রতিটি যুদ্ধ যেগুলোর মুখোমুখি হয়েছে এই জমিন, প্রতিটি ধ্বংসযজ্ঞ যেগুলোর মধ্য দিয়ে এই ভূখ-কে যেতে হয়েছে, আমাদের জন্য সেগুলো রেখে গেছে সীমাহীন তিক্ততা। অথচ আমাদের মতোই সব তিক্ততা ও বিস্বাদ বহন করে চলা যাইতুন গাছগুলো কী অবলীলায়ই দাঁড়িয়ে আছে! এর ডালগুলো যেনো নিজ সন্তানের রক্ত পান করে পিপাসা মিটিয়েছে, এর শেকড় ফিলিস্তিনিদের মতোই মাটির খুব গভীরে প্রোথিত।
[সুপ্রাচীন যাইতুন বৃক্ষ]
আবু খিযির জীবন নামক কারাগারে বন্দী সেই গুটিকয়েক মানুষের একজন, যারা জানে আমাদের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া এইসব যাইতুন গাছের রহস্য।
আমার বাবা যাইতুন গাছকে খুব ভালোবাসতেন। যখনই সুযোগ হতো, সাধ্যমতো যাইতুন গাছ কিনে রাখতেন। যখন আমি ছোট ছিলাম, প্রায়ই তিনি আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন যাতে আমি যাইতুন বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠি। তিনি যখন যাইতুন বাগানে অবস্থান করতেন, শহুরে পোশাক খুলে ফেলতেন। ফিলিস্তিনি ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরতেন। তার পরনে তখন শোভা পেতো কুর্তার সাথে লম্বা সাদা পাজামা। স্বচ্ছন্দ চলাফেরার জন্য তিনি পাজামাটা একটু গুটিয়ে হাঁটুর কাছে ভাজ করে নিতেন। আমার বাবা সবরকমের গাছ চিনতেন। তিনি গাছের সাথে কথা বলতেন, যেনো এগুলো তার ছোটবেলার বন্ধু।
এলোমেলোভাবে বেড়ে যাওয়া ছোট ছোট ডালগুলো তিনি ছেঁটে ফেলতেন। ডাল-পাতায় লেপ্টে থাকা ধুলোবালিও তিনি ঝেড়ে ফেলতেন। এঁকেবেঁকে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিলো আমাদের বাগান। কিছু গাছ বিক্ষিপ্তভাবে নানা জায়গায় ছড়ানো ছিলো। তিনি ঠিক ঠিক নিজের যাইতুন গাছগুলোর পরিচর্যা করতেন। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতাম, বাবা, এতোসব গাছের মধ্যে আপনি আমাদের গাছগুলো কী করে চিনেন?
তিনি বরং অবাক হয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেন এবং উজ্জ্বল চেহারাটায় মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলতেন, আমি যাইতুন গাছগুলোকে চিনি যেমন চিনি তোমাদের। কখনো ভুলে কি অন্য কাউকে ডাকি আমি? গাছগুলোর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার, কখনোই ভুল হয় না আমার।
[যাইতুন/জলপাই সংগ্রহ]
আবু খিযির আমার বাবার সাথে আঠার মতো লেগে থাকতো। গাছের বৃদ্ধি, রোগসহ সবধরনের গাছ চেনা এবং কোন গাছ কার কাছ থেকে কেনা হলো সেসবের দেখভালের জন্য। আমি অবাক হই যখন আবু খিযির বলে, এই গাছগুলো তোমাদের ব্যবহারের জন্য নয়। এগুলো প্রয়োজনের সহায়। তবে এই গাছগুলো তোমাদের, ওগুলোও।
তোমার বাবা এই সারির গাছগুলো ইউনুস সাহেবের কাছ থেকে কিনেছিলেন। এগুলোও তোমরা যেভাবে চাও ব্যবহার করতে পারো, এগুলো কেনা হয়েছিলো হাজী সুলায়মানের কাছ থেকে। বন্ধকী চুক্তির মাধ্যমে এগুলো তিনি নিয়েছিলেন। এভাবে একের পর এক সে বলে যেতে থাকে, যেনো হাতের কাগজ দেখে বিবরণ শোনাচ্ছে। আমি গ্রামে এলে আবু খিযিরকে এজন্যই সাথে রাখি যাতে সে চিনিয়ে দিতে পারে আমাদের জন্য বাবার রেখে যাওয়া যাইতুন গাছগুলো।
শেষবার ফিলিস্তিনে ভ্রমণের সময় আমাদের গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাননীয় প্রিন্সিপাল সাহেবের দাওয়াত পেলাম। দুপুরে একসাথে খাওয়ার জন্য তিনি ডেকেছেন। আমি দ্রুতই একদিন সময় বের করলাম এবং সাথে আবু খিযিরকেও নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে ওদিকটার যাইতুন গাছগুলো চিনিয়ে দিতে পারবে এবং গ্রামটাও ঘুরে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে। নতুন কিছু জানার ব্যাপার তো আছেই। গ্রামে পৌঁছে প্রথমেই আবু খিযিরের বাড়িতে হাজির হলাম, মাটি ও খড় দিয়ে তৈরী মাঝারি একটা ঘরে তার বাস। একপাশে একটু উঁচু করে মাচামতো কী একটা বানানো, যাতে গম বা আটা ইত্যাদি রাখা হয়। একটা বেঞ্চে পান ইত্যাদি ছ্যাঁচার হামানদিস্তাও রাখা দেখলাম।
আবু খিযির বাড়ির দোরগোড়ায় বসে ছিলো, পরনে ঘরোয়া লম্বা পাজামা এবং লম্বা হাতাওয়ালা উলের তৈরী সাধারণ একটা জামা। আমাকে দেখতেই সে উঠে দাঁড়ালো এবং বুকে জড়িয়ে ধরলো। ঘরের ভেতরে নিয়ে যেতে চাইলে আমি বাইরেই বসার আহ্বান জানালাম। সে যাইতুন গাছের গোল করে কাটা একটি পুরনো কা- আনলো এবং তাতে এক টুকরো কাপড় বিছিয়ে আমাকে বসতে দিলো। একমাত্র কন্যা আনিসাকে ডেকে বললো, এক কাপ কফি তৈরি করতে। আমি তাকে বসতে বললাম এবং আমাদের যাইতুন বাগানের দিকে রওয়ানা হতে বললাম। মেয়েকে ডেকে সে জিজ্ঞেস করলো, কীরে বেটি, জামাটা শুকিয়েছে? তার কথা শুনে বুঝতে পারলাম, একটাই জামা তার, সেটা ধুয়ে শুকাতে দিয়েছে এবং শুকালে তবেই পরবে।
কফি পানের পর আনিসা উপস্থিত হলো। জামাটি তখনো পুরো শুকোয় নি। তাতেও দু’ দুটো ছিদ্র, ঠিক হাঙরের মতো দেখতে ফিলিস্তিনের পতাকার মতো। আমি আবু খিযিরকে বললাম, তোমার তো নতুন একটা জামা কেনা খুব জরুরি। আবু খিযির হেসে জবাব দেয়, আমাদের হাল একভাবে কেটে যায় ভাই। একসময় তো আমরা সুলতান আবদুল হামিদের সাথেও টক্কর দিয়েছি!
আমি আর কিছু বলি না, ঠাট্টায় সে চরম দারিদ্র্যকে আড়াল করতে চায়। ভাবলেশহীনভাবে আবু খিযির ভেজা জামাটাই শরীরে জড়ায়, মুক্ত বাতাসে এখনই যেনো কাপড়টা শুকিয়ে যাবে। রঙ চটে যাওয়া একজোড়া জুতোয় সে নিজের পা দুখানা ঢুকালো। কতোটুকু ভেতরে ঢুকলো আর কতোটুকু বেরিয়ে রইলো বোঝার কোনো উপায় নেই। নানানদিক দিয়ে ফেটে যাওয়া জুতো জোড়া কোনোরকম তার পা দুটোকে আশ্রয় দিতে পারলো।
[যাইতুন আর আবু খিযিররা যখন একাকার হয়ে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান]
আবু খিযিরকে নিয়ে আমি প্রথমে গ্রামের সেদিকটায় পা বাড়ালাম যেদিকে তরমুজ বেশি ফলে। যাইতুন বাগানের দক্ষিণে তিল ও আনারের বগান। বাগানগুলো গ্রামের একেবারে পাশ ঘেষে অবস্থিত। পাহাড়ের উপর যেগুলোতে মূলত তরমুজ জন্মে সেগুলোর অনেকটাই বর্বর ইসরাইলিরা দখল করে রেখেছে। কিছু কিছু পাহাড়ে তাঁবু বা অস্থায়ী ক্যাম্প বানানো হয়েছে। গ্রামের কৃষক এবং বাগান মালিকদের এরা ফল ও ফসল নিতে প্রায়ই বাধা দেয়।
আমার বাবা সেদিকটায় আমাদের জন্য বিশাল এক বাগান রেখে গেছেন, যাইতুন ছাড়াও সেখানে আনার-আখরোটসহ নানান ফলের গাছ রয়েছে। আমি বাগানের সীমা এবং গাছগুলোর আনুমানিক সংখ্যা লিখে রাখার জন্য পকেট থেকে কলম বের করলাম। হাতের কাছে কোনো কাগজ পেলাম না। আবু খিযিরের কাছে জিজ্ঞেস করলাম সে বেশ অনেকগুলো কাগজ পকেট থেকে বের করে দিলো। দেখলাম সেগুলো সব ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন! সবগুলেতে ওষুধ লেখা, নানারকম রোগের। জিজ্ঞেস করায় আবু খিযির জানালো প্রতিমাসে একবার করে গ্রামে ডাক্তার আসে।
সে প্রতিবারই ডাক্তার দেখাতে যায়। ডাক্তার চেকআপ করে ওষুধও লিখে দেন। টাকার অভাবে ওসব আর কেনা হয়ে ওঠে না তার। কোনো একদিন কিনতে পারবে বলে প্রেসক্রিপশনগুলো ঠিকই রেখে দেয়।
আমি এবার গভীরভাবে আবু খিযিরের দিকে তাকালাম আর প্রশ্ন করলাম তার জীবিকার মূল উৎসটা কী? আবার পাশ কাটাবার চেষ্টায় সে বললো, আছে আলহামদু লিল্লাহ। চলে যায়। আমি ভেঙে বলতে বললাম। তখন জানালো, সামান্য কিছু জমি আছে তার, যেগুলোতে সে গম চাষ করে এবং সাধারণভাবে চলে যাওয়ার মতো আটা সেগুলো থেকেই সে পায়। তা ছাড়া পাঁচ-ছয়টা যাইতুন গাছও আছে, যেগুলো থেকে সে তেল ও জলপাই পায় এবং এগুলো দিয়েই মোটামুটি দিন চলে যায়।
সে আবার বলে, আমি তো তোমাকে বললামই, ভালোই চলে যায় দিন এসব দিয়ে, আলহামদু লিল্লাহ।
আমি তার দিকে তাকিয়ে এবার জিজ্ঞেস করলাম, কিছু মনে করো না, বলো তো শেষ কবে তুমি মাংস খেয়েছিলে? সে একটু নীরব হয়ে গেলো এবং মাথা নামিয়ে বললো, ঠিক মনে নেই তবে বছর দুই আগে হবে। তারপর পাল্ট প্রশ্ন করলো, হঠাৎ মাংসের প্রশ্ন কেন?
বাগানে ঘেরা একটি পাথুরে টিলায় আমরা বসলাম। চিন্তায় নীরব হয়ে রইলাম দুজনেই। কিছুক্ষণ পর আমিই কথা বললাম, আবু খিযির তোমার কাছ থেকে আমি একটা কাজ পেতে চাই। আশা করি তুমি সম্মতি জানাবে। আবু খিযির চিন্তিত মুখেই জানালো, শুধু কাজ কেনো, তুমি চাইলে আমি নিজের গর্দানটাও তোমার সামনে উৎসর্গ করতে পারি।
আবু খিযিরের সিরিয়াসনেস দেখে আমি হেসে ফেললাম। না, তোমার গর্দান আমার দরকার নেই। ওটা তোমার কাঁধেই থাকুক। আপাতত তুমি আমার সাথে চলো স্কুলের প্রিন্সিপাল আমার চাচাতো ভাইয়ের বাসার দাওয়াতে। আবু খিযির খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো এবং বেশ রূঢ়ভাবেই বললো, দাওয়াত ছাড়াই আমি ও বাড়িতে খেতে যাবো! সে আরো যোগ করলো, যেখানে তাকে দাওয়াতই করা হয় নি সেখানে সে কীভাবে যেতে পারে?
আমি বললাম, আমি তোমাকে দাওয়াত করছি। আর আমি তো তোমার এবং তারও একপ্রকার অভিভাবক। সে খুবই বিরক্তি এবং কিছুটা রাগী চেহারায় আমার দিকে তাকালো এবং বললো, না, না, এ আমি ভাবতেই পারছি না, তুমি আমার জন্য এমন একটা ব্যাপার প্রস্তাব করতে পারো যে, আমি দাওয়াত ছাড়া কারো বাড়িতে খেতে যাবো।
আবু খিযিরের জেদের কাছে আমার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলো। এরপর আমি পকেট থেকে পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে তার হাতে রাখলাম। আবু খিযিরের সেই মুহূর্তের অবস্থা হলো হঠাৎ মানুষ চলাচলের রাস্তায় এসে-পড়া-সাপের মতো, যে ক্ষীপ্র গতিতে পালিয়ে বাঁচতে চায়। দূরে সরে যেতে যেতে সে বলতে থাকলো, এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আগে আমার মরণ হলো না কেনো? আয় আল্লাহ, এমন বিপদে আমাকে পড়তে হলো!
আমি যতোরকমে সম্ভব তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। এমনকি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ অন্যান্য নবীর শপথ করেও তাকে রাজি করাতে চাইলাম। কিছুতেই আবু খিযির রাজি হলো না। বারবার তার একই কথা- চলে যাচ্ছে চাচাতো ভাই- আলহামদু লিল্লাহ, আমার দিন ঠিকঠাক চলে যাচ্ছে। কোনো সমস্যা নেই।
হতাশ হয়ে সবশেষে আমি তাকে বললাম, আচ্ছা এইটুকু অনুমতি দাও যে, প্রেসক্রিপশনে যে ওষুধগুলো লেখা আছে সেগুলো অন্তত আমি পাঠিয়ে দিই। সে নীরব হয়ে গেলো। এই নীরবতাই যেনো তার জবাব।
আমরা গ্রামে ফিরে এলাম। তখনও দুজন চুপ। অদ্ভুত এই নীরবতা নিয়েই প্রিন্সিপালের বাসার দাওয়াতে হাজির হলাম। তিনি আমাকে ভেতরে ডাকলেন। এদিকে আবু খিযির পেছনে ফিরে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছেন। আমি ঘুরে দেখি সে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে এবং তার পিঠটা কেবল দেখা যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনি যাইতুন গাছের ডাল দিয়ে বানানো তার লাঠিটার মতোই তার বয়স্ক শরীরও চলার সময় একপ্রকার তাল ও আওয়াজ তৈরি করছে।
সে সমান বিরক্তি ও অভিমান নিয়ে সামনে যেতে থাকলো। লাঠিটা তখনও আওয়াজ করছে, মুসাফির ঠিকানায় পৌঁছে ঘরের দরজায় কড়া নাড়লে যেমন আওয়াজ হয়। অপেক্ষা করে বাড়ির লোকেরা তার আওয়াজ শুনবে এবং তাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসবে।
সে হয়তো পূর্বপুরুষদের দরজার কড়া নাড়ছিলো, যাদের এই জমিনের নিচেই দাফন করা হয়েছে। হয়তো খবর দিতে চাইছে যে, শীঘ্রই সে তাদের সাথে মিলিত হতে আসছে এবং তাদের সান্ত¡না দিচ্ছে, আমরা তো এক এক করে বিদায় নেবোই।
তবে আমাদের যাইতুন গাছগুলো চিরকাল রয়ে যাবে। তারা কেবলই অপেক্ষা করে থাকবে।
ক্লান্তি ও সমাপ্তিহীন এক অপেক্ষা।