Posts

বিশ্ব সাহিত্য

মেকানিয়া: দ্য সুপার-স্টেট - একটি ডিস্টোপিয় উপন্যাস

October 6, 2024

হাসিনুল ইসলাম

Original Author ওয়েন গ্রেগরি

Translated by হাসিনুল ইসলাম

150
View

আগস্ট-পূর্ব বাংলাদেশের সাথে মিল পাবেন, এমন একটি ডিস্টোপিয় উপন্যাস এটি। ‘ওয়েন গ্রেগরি’ নামটি মেকানিয়া: দ্য সুপার-স্টেট শিরোনামের উপন্যাসের লেখক/লেখিকার ছদ্মনাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গ্রন্থের শুরুতে আটাশ বছরের বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ কোনো এক W.H.S.-কে লেখক/লেখিকা এটি উৎসর্গ করেছেন। বর্তমান উপন্যাসটি অনেকটাই অপরিচিত; অথচ এটি ইয়েভগেনি জামিয়াতিনের বিখ্যাত উপন্যাস We এর আগেই প্রকাশিত এবং ওয়েন গ্রেগরির এই উপন্যাসে প্রকৃতই এক ডিস্টোপিয় পরিবেশ চিত্রিত হয়েছে। উপন্যাসটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় ৩০০। উপন্যাসটিতে মোট ১৩টি অধ্যায় আছে; এছাড়া শুরুতে যার জবানিতে উপন্যাসটি লেখা হয়েছে তাঁকে বেশ কয়েক পৃষ্ঠায় উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে ১৩টি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম ও শেষ অধ্যায়ের উদ্ধৃতাংশের অনুবাদ উপস্থাপন করা হলো।

উপন্যাসটি ১৯১৮ সালে লন্ডনের মেথুয়েন অ্যান্ড কোং থেকে প্রকাশিত হলেও কাহিনিটি উপন্যাসের দৃষ্টিকোণ থেকে ভবিষ্যতের ১৯৭০ সালের সময়কালে বর্ণনা করা হয়েছে। উপন্যাসটিতে ‘মেকানিয়া’ নামের যে কাল্পনিক দেশের বর্ণনা করা হয়েছে সেটি অনেকাংশে জার্মানির সাথে মিলে যায়। কাল্পনিক দেশটি মধ্য ইউরোপের কোনো একটি দেশ যা ‘ফ্রাঙ্কারিয়া’ (বা ফ্রান্স), ‘লুনিল্যান্ড’ (বা ব্রিটেন), ‘লুগ্রাবিয়া’ (বা অস্ট্রিয়া) এবং ‘ইডিওটিকা’ (বা রাশিয়া) দ্বারা বেষ্টিত।

কাহিনির সারাংশ

মিং ইউয়েন-হুয়াই নামে একজন তরুণ চীনা পর্যটক পাঁচ মাসের জন্য ‘মেকানিয়া’ নামক দেশে প্রবেশ করেন। আমরা ভারববর্ষের ইতিহাসের অনেক কিছু যেমন চীনা পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের লেখা দিনপঞ্জী থেকে জানতে পারি, এখানেও সেভাবে মিং ইউয়েন-হুয়াই-এর ডায়েরি থেকে মেকানিয়া নামক দেশের বিভিন্ন ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানতে পারি। দেশটির অনেক নিয়মই বর্বর ও অমানবিক মনে হতে পারে। পর্যটক মিংকে বারবার বিভিন্নভাবে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। তাঁর সাথে সবসময় একজন অফিসিয়াল গাইড থাকে। এরপরও মিং যখন একটি বিশেষ সংবাদপত্র খোঁজার চেষ্টা করে, তখন মেকানিয়ার রাষ্ট্রীয় বুদ্ধিজীবীরা উষ্মা প্রকাশ করেন কারণ তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে মিং তাঁদের রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে পারেন। সবচেয়ে সমস্যার বিষয়টি হলো: মিং নিজের ডায়েরির জন্য যে ব্যক্তিগত রেকর্ড লিখবেন সেটি আবার তাঁর সাথে থাকা সরকারি গাইডের রেকর্ডের সাথে নিখুঁত নির্ভুলভাবে মিলতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই মাঝে মাঝেই এমনটা ঘটছিল না। তখন উভয়কেই ঝামেলা পোহাতে হতো। পর্যটক মিং মেকানিয়ার ইতিহাসও শেখেন- ‘ব্লাডিরন’ (বা অটো ভন বিসমার্ক) কীভাবে ‘স্পটস’ (বা কার্ল মার্কস) এর সমাজতন্ত্রকে প্রতিরোধ করার জন্য সমগ্র জাতিকে সংগঠিত করেছিলেন, সেই ইতিহাস। 

মেকানিয়া এমন একটি দেশ যেখানে ভিন্নমত পোষণকারীদের মানসিক হাসপাতাল অথবা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। রাষ্ট্র একটি সৌন্দর্যবর্ধক সুপ্রজনন কর্মসূচি প্রতিষ্ঠা করেছে। স্বভাবতই সাধারণ নাগরিকেরা রাষ্ট্র থেকে নির্দেশ পায় কখন তারা সন্তান ধারণ করতে পারবে। দেশে আসা ও দেশের বাইরে যাওয়া সমস্ত চিঠিপত্র সেন্সর করা হয় এবং সেই সাথে টেলিফোন কথোপকথনগুলোর উপর নজরদারি রাখা হয়। নাগরিকেরা তাদের নির্দিষ্ট পেশা অনুসারে নির্দিষ্ট পোশাক (পেশাগত ইউনিফর্ম) পরিধান করে। এই সুপার-স্টেটে কর্মীদের ক্লান্তি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বেশ কিছু জটিল নিয়ম আছে। যেমন ধরুন, যদি কোনো কর্মীর গড় ক্লান্তি-স্তর রাষ্ট্র নির্দেশিত গড় মানের চেয়ে কম হয়, তাহলে তাকে অন্যদের মতো আরো ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত অতিরিক্ত কয়েক ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। এই দেশে সামরিক সরকারের চাপিয়ে দেওয়া রীতিনীতিই সামাজিক জীবনে আধিপত্য বিস্তার করে।

মেকানিয়া: দ্য সুপার-স্টেট [উদ্ধৃতাংশের অনুবাদ]

অধ্যায় এক

পর্যটক হিসেবে আমি বিদেশি পর্যবেক্ষক হলাম

আমি ইতিমধ্যে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছি। যেমন ধরুন, ফ্রাঙ্কারিয়া, রোমানিয়া ও লুনিল্যান্ডে দীর্ঘ সময়ের জন্য অবস্থান করেছি; এ কারণে আমি এখন মেকানিয়া সফর করার জন্য মনঃস্থির করেছি। ইউরোপে যাওয়ার আগে আমি সাধারণত পশ্চিমা সভ্যতা সম্পর্কে যতখানি পেরেছিলাম, পড়েছিলাম। বাস্তবে তাদের অনেক বৈশিষ্ট্যের জন্য আমি তাদের প্রচুর প্রশংসাও করেছি। এভাবে বিভিন্ন দেশে আমার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সামগ্রিকভাবে আমার প্রশংসার অনুভূতিকে শক্তিশালী করেছিল; অবশ্য কোনো একজন প্রাচ্যদেশীয়কে যদি পশ্চিমা দেশগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্যের সমালোচনা করার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে এমনটা ঘটা সম্ভব। রোমানিয়া দেশটির সর্বত্র প্রদর্শিত ইতিহাসের অন্তহীন দৃশ্য দেখে আনন্দিত হয়েছিলাম। তাদের সমগ্র ভূখ- যেন এক সীমাহীন জাদুঘর; কিন্তু বর্তমানকে ধারণ করার শক্তি যেন তাদের নেই। অন্যদিকে, ফ্রাঙ্কারিয়াতে দেখলাম, মানুষেরাই দেশের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় কারণ সেই দেশের মানুষেরা বহু পথের অন্বেষণ করছিল। সেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে জনপ্রিয় করা হচ্ছিল।

তবে লুনিল্যান্ডে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যেন আমি নিজ বাড়িতেই আছি। ঠিক কী ছিল যা আমাকে সবসময় সন্তুষ্ট কিংবা আগ্রহী করে রেখেছিল তা বলতে গেলে বহু সময় লেগে যাবে। লুনিল্যান্ডে আমার পর্যবেক্ষণগুলোকে আমি একদিন সময় নিয়ে বিশেষভাবে উপস্থাপন করব।  তবে, আমি এখন এটুকু বলতে চাই যে লুনিল্যান্ডের সমাজে বর্তমান ধারণার বৈচিত্রের অভাবে আমি খুশি হতে পারি নি। অপরপক্ষে, ফ্রাঙ্কারিয়ায় লোকজনের ধারণায় বরং বহু বৈচিত্র্য ছিল।

অন্যান্য দেশের কথা এখন আর না বলি। তিন-চার বছর ইউরোপে ঘোরাঘুরির সময়ে আমি যথেষ্ট সংখ্যক বন্ধু তৈরি করেছি, আর বহুজনের সাথে পরিচিত হয়েছি। তবে একসময় আমি মেকানিয়ায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হলাম। আমার হাতে সময়ও কম তখন। মেকানিয়া না দেখেই বাড়ি ফিরতে হবে কি না এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হলাম। ইতিমধ্যে পরিবার থেকে দু-একবার চাপ এসেছে দেশে ফেরার জন্য। তবে, আমি আমার কিছু রাজনৈতিক বন্ধুকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে আমি মেকানিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন অনুসন্ধান না করে দেশে ফিরব না। আমার সেই বন্ধুরা আসলে মেকানিয়ার সংস্কৃতির বিষয়ে জানতে খুব আগ্রহী ছিল। আমার প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য তারা বেশ কয়েকবার আমাকে চিঠিও লিখেছিল। আমি তাদেরকে বলেছিলাম যে ইউরোপের কিছু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা না নিয়ে মেকানিয়ায় যাওয়াটা ঠিক হবে না কারণ তখন ওরা হয়ত আমাকে ঢুকতেই দিবে না।

লুনিল্যান্ডে যখন আমি আমার কিছু বন্ধুর সাথে মেকানিয়ার সংস্কৃতি তদন্ত করার জন্য সেখানে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলেছি, তখন আমি সবচেয়ে বেশি পরস্পরবিরোধী পরামর্শ পেয়েছি। কেউ কেউ বলেছেন, ‘কোনভাবেই সেখানে যাবেন না। আপনাকে গুপ্তচর হিসেবে গ্রেপ্তার করা হবে এবং গুলি করে মেরেও ফেলতে পারে!’ অন্যরা বলেছিল যে মেকানিয়া প্রকৃতপক্ষে লুনিল্যান্ডের চেয়ে সব ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে এবং আমি সেখানে গেলে অবশ্যই মনে রাখার মতো অনেক কিছু দেখতে পাবো। অন্যরা আবার বলেছে যে, আমি যদি যাই তবে আমার ফিরে আসার পরে তারা আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতে পারে কারণ মেকানিয়াতে বাস করার ফলে আমার মনোভাব পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। আসলে আমি এটা বুঝেছি যে মেকানিয়া নিয়ে এত ভিন্নদর্শী মনোভাব আছে যে আমার লুনিল্যান্ডের অনেক বন্ধু বিষয়টি তেমন পছন্দ করছেন না। প্রকৃতপক্ষে, আমার বেশিরভাগ বন্ধুর সাথে আলাপ করে সবশেষে আমি মি. ইয়র্কের সাথে পরামর্শ করলাম। তিনি লুনোপোলিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। এক নিপাট ভদ্রলোক, বিস্তৃত সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির একজন মানুষ, যাকে আমার বন্ধু তালিকায় রাখতে পারা আমার জন্য বড়ই সৌভাগ্যের বিষয়। তিনি আমাকে উৎসাহিত করলেন ও আমার নিরাপত্তার বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিলেন।

...... ..... ...

অধ্যায় তের

আর কখনও যাবো না

প্রিসায় পৌঁছানোর কয়েক সপ্তাহ পর আবার কোয়াং সাহেবের দেখা পেলাম। এর মাঝে তিনি যেন হাওয়া হয়ে গেছিলেন। আসল ঘটনা হলো, তিনি সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন যে পররাষ্ট্র দপ্তরের দু’একজন ব্যক্তি তিনি যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সেটির সত্যিকারের প্রকৃতি অনুমান করতে শুরু করেছিল। তবে, তাঁর বিরুদ্ধে কার্যত কোন প্রমাণ ছিল না, কারণ তিনি যে সমস্ত তথ্য পেয়েছিলেন, যা প্রকৃতই প্রচুর পরিমানে ছিল, সেগুলো মূলত মেকানিয়ার সরকারই তাঁকে দিয়েছিল। এই ভেবে যে, তিনি মেকানিয়ার সরকারের সংস্কৃতির এক ধর্মপ্রচারক হয়ে উঠেছেন। হা হতোশ্যি! রাষ্ট্র কী সবসময় ঠিকটা বুঝতে পারে! তিনি পরবর্তীতে আমার কাছে স্বীকার করেছেন যে সরকার তাঁকে গুপ্তচর হিসেবে গ্রেপ্তার করতে পারছিল না কারণ সেক্ষেত্রে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হতে পারে; বরং তাঁকে কোনো সাজানো দুর্ঘটনায় হত্যা করা হতে পারে। এসব কিছু বুঝতে পেরে তিনি নীরবে দেশ ছাড়ার প্রচেষ্টায় সক্ষম হন। আবার, যেন কিছুই হয়নি, এমন ভাব নিয়ে তিনি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবার নিজের দেশে ফিরে যেতে সক্ষম হন। বুঝতেই পারছেন, এ কারণে কোয়াং সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলাটা ঠিক হবে না।

মেকানিয়া থেকে আমার নিজের বের হওয়ার বিষয়টিও অনেকটা এমন ছিল। সেই দেশের মি. বুলি নামের ইন্সপেক্টর অব ফরেনারস এর সাথে আমার সাক্ষাৎকারের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল। সাক্ষাৎকারের আগে আমি একটি চিঠি পেলাম। আমার বিশ্বাস যে সেই চিঠির সব খবরই সরকারি সব দপ্তরে জানা ছিল। তবে মি. বুলি আমাকে সরাসরি কোনো বিপদে ফেলতে চান নি। দেশ ছাড়ার জন্য আমাকে তিন দিনের সময় দেওয়া হয়েছে। আমি কিন্তু পারলে তখন তখনই মেকানিয়া ছেড়ে বেরোতে চাচ্ছিলাম। মি. বুলিকে বিষয়টি বললে তিনি জানালেন যে পরের পরশু দিন আমি দেশত্যাগ করতে পারব, তার আগে নয় কারণ আমার জার্নালের তথ্যের সাথে হয়ত সরকারি তথ্য মিলিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। 

আমার যাত্রার টিকেট ইস্যু করার আগে আমাকে একটি সনদ পেতে হবে যে আমার সবকিছু ঠিকঠাক আছে। কোনো সমস্যা থাকলে প্রতিটি সমস্যার জন্য অন্তত এক পাউন্ড করে জরিমানা দিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো গ্রেভস থেকে ব্রিজটাউন যাওয়ার জন্য প্রায় এক সপ্তাহ কোনো যানবাহন পাওয়া যাবে না। 

মি. বুলি জানালেন যে অন্তত পাঁচ দিন পার না হলে কোনো যানবাহনের ব্যবস্থা হবে না; তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে রাজি হলেন। তিনি জানালেন, বিকল্প রুট হিসেবে প্রিমবুর্গ এবং ডারভেন হয়ে প্রিসার উদ্দেশ্যে যেতে পারি।   সেখান থেকে আমি হয় সরাসরি বাড়ি ফিরতে পারব অথবা প্রথমে লুনোপোলিসে যেতে পারব।

....... ..... ...

আমি পালালাম; দুপুরের খাবারের পরপরই প্রিসার উদ্দেশ্যে ট্রেন ধরলাম। এক এক স্টেশনে একেক রকমের বিভ্রান্তি এবং কোলাহল আমার কাছে বেশ আনন্দদায়ক মনে হচ্ছিল; যাত্রীদের বকবকানি ছিল সবচেয়ে মজার। ছেঁড়াময়লা পোশাক পরা মানুষ যেমন ছিল, তেমনি খুব স্মার্ট পোশাকের লোকেরাও ছিল। ট্রেনগুলোর টিকিট-সংগ্রাহক এবং নিরাপত্তীরক্ষীরা বেশ নোংরা চেহারার ইউনিফর্ম পরে ছিল এবং হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাওয়া ঘোড়ায় চড়া পুলিশদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন তারা কোনো কমিক-অপেরা মঞ্চ থেকে নেমে এসেছে। ট্রেন রুটের দুপাশের গ্রামগুলো দেখতে ইউরোপে যে গ্রামগুলো আমি আগে দেখেছিলাম অনেকটা তেমনই। খামারের ভবন এবং সরকারি মডেল কুটিরগুলোতে অত্যাধুনিক ডিভাইসের সাথে প্রাচীন স্থাপত্য মিশে আছে; গীর্জাগুলো যেন দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত আর ডাকঘরগুলো যেন বিংশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে; এখানে ওখানে মধ্যযুগীয় শস্যাগার এবং সেগুলোর পাশেই হয়ত আধুনিক কারখানা। অবশেষে ট্রেনটি প্রিসা পৌঁছল। এই শহরের কোন বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না।

শহরটিকে পুরানো বন্ধুর মতো লাগছিল, এবং আমি এখানে আমার আগের থাকার সময়ের অভ্যাস মতো চলাফেরা শুরু করলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমি এখানে সেই আগে থেকেই আছি। কিছু পুরনো পরিচিতজনের কাছে গেলাম এবং তারপর আমরা সূর্যের নীচে প্রশান্ত আলোয় বসে সবকিছু নিয়ে অবিরাম আলাপে দিন কাটালাম। খবরের কাগজ পড়া যে কতই না আনন্দের, সেটা বুঝতে পারলাম। সে কাগজ যত নির্বোধ খবরই ছাপুক না কেন, তাও সেটি মজার! সর্বশেষ রাজনৈতিক সঙ্কট, তারপরের নাটকীয় সাফল্য, চারদিক চাউর করা সামাজিক কেলেঙ্কারি, সাম্প্রতিক সাহিত্যিক বিবাদ সম্পর্কে সর্বশেষ হুজুগে আলাপ- এসব কিছু নিজ কানে শোনা বা খবরের কাগজে পড়তে পারাতে কতই না আনন্দ হয়! মেকানিয়ায় এসব থেকে বঞ্চিত ছিলাম।

প্রিসায় থেকে এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে আমি মেকানিয়ার অস্তিত্ব প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। প্রিসায় এমন কিছুই দেখিনি যা আমাকে মেকানিয়ার কথা মনে করিয়ে দিবে। আমি বুঝতে শুরু করলাম কেন ফ্রাঙ্কারিয়া এবং লুনিল্যান্ডের লোকেরা সেই দেশটি সম্পর্কে এত অজ্ঞ। ঐ দেশ নিয়ে তারা মাথা ঘামাবে কেন? কোনোই কারণ নেই। আমার কাছে এখন মেকানিয়ায় কাটানো সময়টাকে একটা খারাপ স্বপ্ন, দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়। ফ্রাঙ্কারিয়া এবং লুনিল্যান্ডের লোকজনের উচিত মেকানিয়াকে উপেক্ষা করা, দেশটার সংস্কৃতি ভুলে যাওয়াই ঠিক। তবুও, মেকানিয়া হয়ত আবার কখনো ইউরোপকে চমকে দেবে! এবার সেই চমক হতে পারে রাসায়নিক যুদ্ধ নিয়ে! মানুষজন কি তখন জান নিয়ে পালাতে পারবে? নাকি তাদের তৈরি করা কোনো সুপার-পতঙ্গ শেষ পর্যন্ত মানব জাতিকে বিজিত ঘোষণা করবে? আমি স্বীকার করছি আমার মাথায় এমন কিছু সন্দেহ কাজ করছে। এটা তো অসম্ভব না যে, আমি যে দুঃস্বপ্ন থেকে পালিয়ে এসেছি তা সমগ্র বিশ্বের জন্য এক আসন্ন সর্বনাশ। বুঝতেই পারছেন, কেন এমন সন্দেহ করছি- কারণ আমি সুপার স্টেট মেকানিয়াতে যা দেখেছি ও শুনেছি তার একটি বিশ্বস্ত বিবরণই আমি এতক্ষণ ধরে লিখেছি।

Comments

    Please login to post comment. Login