পোস্টস

গল্প

সাক্ষী

১৩ এপ্রিল ২০২৪

ইমরান চৌধুরী

মূল লেখক আলবার্তো মিলগো

অনুবাদক ইমরান চৌধুরী


সকালের নরম রোদ উপচে পড়ছে শহরে। আট-দশটা স্বাভাবিক শহরের মতই অজানা এ শহর—সরু রাস্তা, জীর্ণ বিল্ডিং। পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় হতে পারে তা। 

আজকের আবহাওয়াও চমৎকার। এ মনোরম আবহাওয়ার মাঝে ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে এক আয়তনয়না রমণী দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। একটু পরেই তাকে কাজের উদ্দেশ্যে বের হতে হবে, ঠোঁটে দ্রুত লিপস্টিক দেওয়ার চেষ্টা করছে। 

অস্পষ্ট হাতাহাতির শব্দ শোনা যাচ্ছে কোথাও। ছোট্ট শহরে সাত-সকালে এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু, সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় কোথায়! বেশিরভাগ মানুষ তখনো ঘুমিয়ে। হঠাৎ স্পষ্ট দুটো গুলির শব্দে চমকে উঠলো সে। হাত কেঁপে উঠেছিল। লিপস্টিক ছড়িয়ে গেছে ঠোঁটের বাইরে। 

তারপর, আবার—ঢুম! ঢুম! ঢুম! তিনটি গুলির শব্দ।

জানালার কাছে সরে গেলো সে। সোজা রাস্তার ওপারে অ্যাপার্টেমেন্টের ভেতরে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন এক লোক। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সবকিছু।

***

জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। একটু আগে মারামারি করেছেন। মুখে লেগে আছে রক্ত। দেয়ালেও লেপটে রয়েছে।

এক জোড়া চোখ দেখছে তাকে, বুঝতে পারেছেন। ধীরে ধীরে ঘুরলেন পেছনের দিকে। জানালার বাইরে তাকালেন। রাস্তার ওপারে, সামনের অ্যাপার্টমেন্টে—একটা মেয়ে। 

একজন সাক্ষী।

চোখাচোখি হলো তাদের। চমকে উঠলেন। মেঝেতে পড়ে থাকা মৃত মেয়েটার দিকে তাকালেন একবার। প্রায় অর্ধনগ্ন, মেয়েটার পরনে পাতলা রোব। ঠোঁটের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে লিপস্টিক। ঠিক যেন রাস্তার ওপারের মেয়েটা।

জানালা দিয়ে তাকালেন আবার, কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটা চলে গেছে।

***

ভয়ে আতঙ্কে হাঁটু গেড়ে জানালার নিচে বসে আছে মেয়েটা। লোকটাকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না। মাথা নিচু করে হামাগুড়ি দিয়ে দরজা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

গায়ের কোটটা শক্ত করে জড়িয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। ছিটকে বের হল রাস্তায়। উপরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো একবার। লোকটার চোখ তখনো তাকে খুঁজে চলেছে। আবার চোখাচোখি হল তাদের।

দৌড়ে কাছের ট্যাক্সিটাতে লাফিয়ে উঠে পরে সে। কোনোরকমে ভেতরে ঢুকতেই ক্যাবের ছাদটা বাড়ি খায় মাথায়। এরপর সিটের সাথে মিশে থাকে একদম।

***

অ্যাপার্টমেন্ট ব্যালকনিতে দাড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে লোকটা। মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা করছেন। ওই তো নিচে রাস্তায় মেয়েটা। 

দরজা দিয়ে দৌড় শুরু করলেন। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছেন দ্রুত। মেয়েটাকে একটা ক্যাবে উঠতে দেখেছেন। 

***

পেছনে ঘুরে একবার দেখার চেষ্টা করলো মেয়েটা। লোকটা রাস্তায় নেমে এসেছে। দ্রুত থানার টাইপ করে তারপর। রিং বাজতেই এক মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল।

“ইমার্জেন্সি সার্ভিস। আপনার সমস্যা বলুন…।”

“হ্যালো…? আমি মনে হয় একটা খুন হতে দেখেছি…।”

“আপনি শান্ত হোন। লোকেশন, প্লিজ।”

“মনে হয় খুনীটা আমার পিছু নিয়েছে।”

“ঠিক আছে। আপনি লোকেশন বলুন, দয়া করে?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিল্ডিংটা… বিল্ডিংটা…। উহ…। দ্য ব্লু হেন্ডারসন? দ্য ব্লু হেরিংটন!”

“দ্য ব্লু হেরিংটন?”

“না… না… দাঁড়ান। আমার ঠিক সামনের অ্যাপার্টমেন্টেই… লোকটা আমাকে জানালা দিয়ে দেখে ফেলেছে। আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টে ছিলাম; সে ছিল না। ধুর! আর… আর… দ্বিতীয় তলায়। না… তৃতীয় তলায়।

“ম্যাম। নাম বলুন আপনার?”

“দয়া করে কাউকে পাঠান শুধু!”

“ম্যাম, আমরা—”

কল কেটে দিয়েছে সে। 

সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

আরেকটা নম্বরে ডায়াল করে। সেটা বাজতে বাজতেই নিজের ব্যাগ হাতাতে থাকে। সানগ্লাসটা পরে নেয়। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে অটোমেটিক ভয়েসমেইল দিতে শুরু করেছে।

“… ভ্লাদিমির… একটা মেসেজ দিয়ে রাখুন।”

“ভ্লাদিমির? আমি রাস্তায়। এসে পড়েছি প্রায়…।”

লাইন কেটে গেছে। সে সিটে সজোরে আছাড় মারে ফোনটা। ট্র্যাফিক লাইটের লাল আলোর নিচে থেমে গেছে ক্যাব।

বালের একটা দিন।

***

সামনেই ক্যাবটাকে দেখতে পাচ্ছে লোকটা। ট্রাফিকের ফাঁদে পড়ে গেছে। ওই ক্যাবের ঠিক পাশেই দাঁড়ালো তার ক্যাবটা। তিনি পেছনের সিটে বসে আছেন। জানালা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন এটাই সেই মেয়ে কিনা। নিশ্চিত এটা সেই মেয়ে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন এখন। একই সাথে বিস্ময় আর ভয় কাজ করছে তার ভেতর। 

অন্যমনস্ক মেয়েটা কিছু লক্ষ্যই করেনি। জানেও না তার ঠিক কত কাছে রয়েছেন তিনি। 

রাস্তায় সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে। আবার ক্যাব চলতে শুরু করেছে তাদের।

***

পরিচিত বিল্ডিংয়ের নিচে ক্যাব থামায় সে। এটাই তার কর্মস্থল। জিনিসপত্র নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায়।

সরু সিঁড়ি বেয়ে ছুটছে। সামনে একটা দরজা। গোলাপি উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত সেটা। নক করল সে। 

এক লম্বা মহিলা খুলে দিল দরজাটা। কড়া মেকআপ নিয়েছেন তিনি। রাবারের কস্টিউম পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ছোট হলওয়ের শেষে আরেকটা দরজা দিয়ে জোরে জোরে মিউজিকের শব্দ ভেসে আসছে।

“এটা কোন আসার সময় হল? অনেক দেরি করে ফেলেছো। শো মিস হয়ে গেছে তোমার। বিশ্বাসই হচ্ছে না।” 

“আমি… আমি… দুঃখিত, আমি জানি… আসলে…।” কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার। 

“ঘাটের মরা একটা। তাকাও আমার দিকে।”

“…একটা খুন হতে দেখেছি আমি।”

“ইস! মানে, সবচেয়ে উদ্ভট অজুহাতটাই দেখাতে হবে সবসময়। যাও, ভেতরে গিয়ে রেডি হও তাড়াতাড়ি!” তার কোনও কথাই আমলে নিলেন না মহিলাটা।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। নাচবো আমি। কিন্তু, তার আগে ভ্লাদিমিরের সাথে দেখা করতে হবে। ও কি নেই এখানে?”

সিঁড়ি বেয়ে কারো উঠে আসার শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। হয়ত কোনো মেম্বার।

“আছে। আছে। ভেতরে কোথাও। ঠিক জানি না। তুমি এখন ভেতরে যাও।”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার আগেই চটপট তাকে ঠেলে ক্লাবের ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন মহিলাটা। সিঁড়ির লোকটা সম্পর্কে জানা হল না আর।

***

বিচ্ছিরি এক বিল্ডিংয়ের সামনে দাড়িয়েছে মেয়েটার ক্যাব। ভেতরে চলে গেছে সে তাড়াহুড়ো করে। তিনিও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ক্যাব থেমে নেমে এসেছেন। বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। সামনে একটা দরজা। সেখানে অদ্ভুত দর্শন এক মহিলা দাঁড়িয়ে। থমকে যান তিনি। বিরক্তিকর।  

মহিলা যেন একটু আগেই কারো সাথে ঝগড়া করছিলেন। দ্রুত নিজের অভিব্যক্তি সামলে নিলেন। তারপর মেকি হাসি বানিয়ে বললেন, “হেই, ইয়াংম্যান। ক্লাবের মেম্বার নাকি?”

“…ওহ, না…।”

“না… তাতে সমস্যা নেই! ভেতরে গিয়ে মজা নিতে চান না?”

হাত ধরে টেনে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ছেড়ে দিলেন দর্শকের মাঝে।

ক্লাবটা বেশ অদ্ভুত। সবাই হয় সোফায় বসে আছে, না হয় মেঝেতে। মেম্বাররা সবাই রাবারের কস্টিউম এবং মাস্ক পড়ে আছে, শুধু তিনিই সাধারণ। একটা সোফায় বসতেই সবাই ঘুরে তাকালো তার দিকে।

এরপর, মহিলা স্টেজের মাঝখানে গিয়ে দাড়ালেন, মাইকটা আঁকড়ে ধরেছেন, পরের অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিচ্ছেন, নাচেরও প্রশংসা করছে।

“আপনাদের সবার মনোযোগ আকর্ষণ করছি। …আমাদের পরবর্তী ড্যান্সার চলে এসেছে…।”

***

সে একাই চেন্জিং রুমে। নিজের শো এর জন্য পোশাক বদলে ফেলেছে। নাম ঘোষণা করা হচ্ছে তার। 

ধীরপায়ে সে স্টেজে এসে দাঁড়ালো, দর্শকরাও আগ্রহে সামনে ঝুঁকে এসেছে। মিউজিক বাজতে লাগলো।

একটু ইতস্তত করে সেও ধীরে ধীরে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই গানের তালের সাথে মানিয়ে নেয় নিজেকে। ভুলে যায় সবকিছু। শরীর বাঁকিয়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে নাচতে থাকে। বেশ আবেদনময়ী এক নাচ।

নাচের চরম মুহূর্তে চলে গেছে সে। হঠাৎ সামনের দিকে নজর চলে যায়, ভিড়ের মাঝে এক জোড়া চোখ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, মুখখানা তার পরিচিত –

সেই খুনীটা।

চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। নাচের তাল কেটে গেছে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে, পিছিয়ে যায় একটু। হঠাৎ নাচ ভুলে সবাইকে হতভম্ব করে পেছনের স্টেজে হারিয়ে গেল মেয়েটা।

***

চোখ বড় বড় করে স্টেজে তাকিয়ে আছেন তিনি। এইতো সেই মেয়েটা, নাচছে স্টেজ জুড়ে। তার দিকে নজর পড়ল মেয়েটার। ভয় পেয়েছে। নাচ বন্ধ করে দিয়েছে। ছুটে পালাচ্ছে এখন। পুরো ক্লাব যেন চুপ হয়ে গেল। 

ওর পিছু নিতে হবে। তিনিও ভিড় ঠেলে সামনে যেতে লাগলেন।

***

দ্রুত চেন্জিং রুমে ফিরে এসেছে সে। গায়ে রোব চড়িয়ে জিনিসপত্র দ্রুত ব্যাগে ঢোকাতে থাকে। সরু হলওয়ে পার হচ্ছে। বামের একটা দরজায় নক করলো।

“ভ্লাদিমির!”

কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভয়ে ভয়ে সে পেছনে ফিরে তাকায়, এরপর জোরে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেললো। ধপ করে পেছনে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। এখন অন্ধকার এক অফিসে।

“ভ্লাদিমির?”

ভ্লাদিমির রুমেই আছে। অর্ধনগ্ন, আধো ঘুমে, আধো জাগ্রত, মদ খেয়ে মাতাল অবস্থা তার। কোন কাজের না, এলোমেলো এক বিছানায় শুয়ে আছে। বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। কড়া ডোজের ড্রাগের কারণে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, মেয়েটা দৌড়ে যায় তার কাছে।

“গোল… গোল!” স্বপ্ন দেখছে ভ্লাদিমির।

সপাটে চড় কসায় ভ্লাদিমিরের গালে। “ভ্লাদিমির।” কিন্তু, ভ্লাদিমিরের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।

কোন সাহায্যেই আসবে না ভ্লাদিমির। হতাশ হয়ে যায় সে। একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে, ঘুরে পেছনে তাকায়। পাশের ড্রয়ারের দিকে ছুটে যায়। ড্রয়ার ঘেটে এলোমেলো করে ফেলে। প্যাকেটের পর প্যাকেট নেশার ঔষধ… অবশেষে যা খুঁজছিল পেয়ে গেল… একটা বন্দুক। নিজের ব্যাগে পুরে নিল, দ্রুত ত্যাগ করে রুমটা।

***

হারিয়ে গেছে মেয়েটা। তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না ক্লাবের ভেতরে কোথাও। সামনের দিক দিয়ে পালানোর সম্ভাবনা কম, দেখে ফেলতেন তাহলে। পেছনের দিকে যাচ্ছেন তাই। সরু গলি দিয়ে হাঁটছেন। সামনেই এক্সিট ডোর। ঠিক তখনই বামের দরজা ঠেলে মেয়েটা বেরিয়ে এল।

***

লোকটার একবারে সামনে পরে গেছে সে। এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে তার দিকে—তখনই সে হাতের জিনিসপত্র ছুড়ে দেয়। তারপর ইমার্জেন্সি এক্সিট দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে যায়, চিৎকার করছে। গায়ের রোবটা বাতাসে উড়ছে প্রায়, শক্ত করে হাতব্যাগ আঁকড়ে ধরে। 

লোকটাও তার পিছু পিছু ছুটছে। শহরের অলিগলির গোলকধাঁধা পেরিয়ে যাচ্ছে সে।

একটা সরু গলি দিয়ে দৌড়ানো শুরু করলো, সেটা ধরে মূল রাস্তায় উঠে এসেছে। এখনো রাস্তাঘাট ফাঁকা, সকালের ঘোর কাটেনি।

***

সরু গলিতে আসতেই হিলের টক টক টক আওয়াজ শুনতে পেলেন তিনি। দৌড়ে মূল রাস্তায় চলে এলেন। ঐ তো! কিছু দূরেই মেয়েটা।

“এক সেকেন্ড দাঁড়ান।” 

মেয়েটা না থেমে পুনরায় চিৎকার করে আরো জোরে ছুটতে থাকে। চিৎকারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে আরো।

তিনিও তীর বেগে পেছনে ছুট লাগান।

***

জোরে দৌড়াতে অসুবিধা হচ্ছে তার। পায়ের হিলগুলো খুলে হাতে নেয়।

“দয়া করে দাঁড়ান একটু।” পেছন থেকে থামতে বলছে লোকটা।

একটা ওভারপাস ধরে যেন উড়ে চলেছে সে, লেন পরিবর্তন করে পাশে চলে যায়। লোকটা প্রায় ধরে ফেলেছিল তাকে। হাতের হিলগুলো ছুড়ে দেয় লোকটার উদ্দেশ্যে। শক্ত হিলের আঘাতে ব্যথা পায় লোকটা। গতি কমে যায়। 

“প্লিজ, দাঁড়ান না। এক সেকেন্ড। এক মিনিটের জন্য।” পেছন থেকে লোকটা ডেকেই চলেছে।

লোকটা হঠাৎ পেছন থেকে হারিয়ে গেল। সে কিছু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং খুঁজে পেয়েছে। ক্লান্তিতে অবসন্ন স্বত্বেও একের পর এক দরজায় আঘাত করতে থাকে। যদি খোলা থাকে কোন একটা। কিন্তু সবগুলো তালাবদ্ধ।

আরেকটা দরজায় চেষ্টা করে। খুলে যায় সেটা। ভেতরে ঢুকে পড়ে সে। 

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। প্রতিটা দরজার লক চেক করে। অবশেষে তৃতীয় তলায় একটা খোলা দরজা খুঁজে পায়।

লাফিয়ে ঘরে ঢুকেই দরজা লক করে দেয়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিজেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে তার।

***

মেয়েটার পিছু পিছু তিনিও বিল্ডিংয়ের ভেতরে প্রবেশ করেছেন। কিছুটা বিস্মিত, কিন্তু কোন কারণে ভীষণ শান্ত। সবকিছু অদ্ভুত ঠেকছে তার কাছে। অনেক দ্বিধার মধ্যে পরে গেছেন।

***

একটা পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে, টের পাচ্ছে মেয়েটা। সেটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। লোকটাই ওটা। দরজার ঠিক বাইরে। প্রথমে লোকটা দরজার হাতল ধরে টান দিল। তালাবদ্ধ! সে ভাবলো, হয়ত এ যাত্রায় বেঁচে গেছে। এরপর চাবির শব্দ শুনতে পেল। ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায়। হচ্ছেটা কি? লোকটার কাছে চাবি কেন?

চাবিটা স্বাভাবিকভাবেই লকে ঢুকে গেল। ক্লিক শব্দ হল তালায়। দরজাটা খুলে গেল তারপর।

লোকটা অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে ফেলেছে। সে তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ হাতাতে থাকে। 

“ওহ… হাই…” লোকটা বলল।

তখনও উন্মত্তের মত ব্যাগ হাতিয়ে চলেছে সে, বন্দুকটা হাতে উঠে এলো।

***

“শুধু কথা বলবো আমরা। এর বেশি কিছু না।”

বন্দুকটা দেখে থমকে গেল লোকটা।  

“হোলি শিট।”

দ্বেজা-ভ্যু হচ্ছে তার। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে।

মেয়েটা ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে, তিনিও একটু একটু করে আগাচ্ছেন।

“শুধু কথা বলবো আমরা।”

তারপর, পিস্তল কেড়ে নেয়ার জন্য লাফ দিলেন তিনি। তাদের হাতাহাতি শুরু হয়েছে, শরীর মোচরাচ্ছেন, ধাক্কা দিচ্ছেন একে অপরকে। ধাম করে পড়ে গেলেন দু’জনে। বাড়ি খেলেন ফার্নিচারে, কাচে, আয়নায়!... তারপর ঢুম! ঢুম!

এরপর, তিনি বন্দুকটা ধরে ফেললেন। আবার লড়াই চলছে তাদের। এলোমেলোভাবে। এবার… ঢুম! ঢুম! ঢুম! তিনটা গুলির শব্দ।

***

লড়াই থেমে গেছে।

মেয়েটা টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। খোলা ব্যালকনির বাতাসে তার রোবটা উড়ছে প্রায়। হাতের বন্দুকটাও ভারি মনে হচ্ছে অনেক। 

***

মেয়েটার পায়ের কাছেই ধীরে ধীরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন লোকটা, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন তার খুনির দিকে—এখনো হতভম্ব, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। অ্যাপার্টমেন্টটা তার নিজের।

***

কিছু একটা অনুভব করল মেয়েটা। এক জোড়া চোখ দেখছে তাকে, টের পেয়েছে। ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরলো। জানালার বাইরে তাকালো। 

রাস্তার অপরদিকের অ্যাপার্টমেন্টে—তার দিকে তাকিয়ে আছে—মৃত লোকটার মত হুবহু আরেকটা লোক।

একজন সাক্ষী।

চোখাচোখি হল তাদের। চমকে গেল দু’জনেই।