Posts

বিশ্ব সাহিত্য

শরৎকাল (একটি ডিস্টোপিয় গল্প)

September 28, 2024

হাসিনুল ইসলাম

Original Author এন্থনি লেনিটিনি

Translated by হাসিনুল ইসলাম

[গল্পকার এন্থনি লেনটিনি (Anthony Lentini) সম্বন্ধে কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারিনি, তার কোনো ছবি তো দূরস্থ। বর্তমান গল্পটির মূল শিরোনাম Autumntime এবং গল্পটি একটি প্রতিনিধিত্বশীল ডিস্টোপিয় গল্প। এই গল্পটি একটি ভবিষ্যত স্থান-কালে বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমানে আমরা যেসব প্রাকৃতিক জিনিসকে খুব স্বাভাবিক হিসেবে পাই, তেমন অনেক কিছু সেখানে প্রযুক্তির সহায়তায় কৃত্রিম, বা নকল বস্তু দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বলে দেখা যাবে। আপনি গল্পটি পড়ার সময় হয়ত লক্ষ করবেন, গল্পের বর্ণনাকারী একটি বাস্তব গাছের সামনে হাজির হলে সে কী রকম অদ্ভূত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এমন প্রতিক্রিয়া আমরা এখন দেখাই না। তবে, প্রকৃতিকে ধ্বংষ করে ফেলা হলে আমাদেরও তেমন অনুভূতি হতে পারে।]

শরৎকাল

  • - এন্থনি লেনটিনি

আমি আজ, আমার জীবনের প্রথম গাছ দেখলাম। বাবা শেষমেষ আমাদের বারংবার করা বায়নার কাছে হার মানতে বাধ্য হলেন। তিনি আমাদেরকে ইস্ট বোস্টন আরবান সেন্টারে নিয়ে গেলেন। আমাদের ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য মা গত দুই সপ্তাহ ধরে ঘ্যানঘ্যান করছিলেন। অবশ্য, আমার মনে হয় আমাদের ওখানে নিয়ে যেতে পেরে বাবা খুশিই হয়েছেন কারণ ফেরার সময়ে দেখলাম তিনি খুব হাসিখুশি আর নীরবে হাসছিলেন।

          ছোটবেলায় বাবা আমাকে তার জীবনে যে কয়েকটি জীবন্ত গাছ দেখেছিলেন সেগুলোর গল্প শোনাতেন। বাবার শৈশবেও যে অনেক গাছ ছিল, তা কিন্তু না। তখনও খুব বেশি গাছ অবশিষ্ট ছিল না, কারণ নগরায়নের কার্যক্রম তখন পুরোদমে চলছে। তবে বাবাদের প্রজন্মের বেশিরভাগ লোক স্কুলে যাওয়া শুরু করার সময় অন্তত একটি গাছ দেখতে পেয়েছিলেন। এটা আজকালের মতো ব্যাপার না, কোনোভাবেই না। হ্যাঁ, আমি প্লাস্টিকের গাছ দেখেছি; আসলে প্রত্যেক রাস্তায় তো প্লাস্টিকের কিছু গাছ আছেই। অবশ্য, মাইক্রোডট লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ছবি দেখে বলে দেওয়া যায় যে প্লাস্টিকের গাছগুলো আসলে কৃত্রিম।

          আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে বাড়ির সবাই বেশ উত্তেজিত বোধ করছিল। মা হালকা নাস্তা হিসেবে পাউরুটির টোস্ট করলেন; সাথে সিন্থেটিক দুধ। উদ্দেশ্য হলো নাস্তায় সময় বাঁচানো। নাস্তা শেষ করে আমরা তিনজন একটি লিফট-বাস নিয়ে চতুর্থ লেভেলে উঠলাম, সেখান থেকে আমরা ব্রুকলিনের এয়ার-ট্র্যাক ধরলাম। এরপর, সেখান থেকে মূল লেভেলে নেমে আমরা আরেকটি লিফট-বাস ধরে মনোরেলে চড়ে ইন্টারসিটি সাবওয়ে স্টেশন ২৭ এ গেলাম এবং বোস্টনের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় সাবলেভেল ‘এএ’ ট্রেন ধরলাম। আমাদের প্রত্যাশা এত বেশি ছিল যে মা যখন আমাদেরকে গাছটি কীভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল তা বলছিল, তখন আমরা দুজন একেবারেই বিরক্ত হইনি। 

          ও’ব্রায়েনদের বাড়িটি পুরানো শৈলীর কাঠের কাঠামোয় তৈরি। এমন আর মাত্র কয়েকটি বাড়ি উদাহরণ হিসেবে আছে। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে বোস্টনের শহুরে-পুনর্নবীকরণ অভিযানের সময় বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়নি। সেই সময় পরিবারটি তাদের সম্পদ এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে বাড়িটির ভেঙে ফেলা এড়াতে পেরেছিল। এরপর বাড়িটি বেশ কয়েক প্রজন্মে হাতবদল হয়ে বর্তমান পর্যন্ত এসেছে। বয়োজেষ্ঠ্য ও’ব্রায়েনের কোনো উত্তরাধিকারী ছিল না, তাই তিনি মারা গেলে পারিবারিক বাড়িটি নিলামে উঠেছিল। তখন আরবান সেন্টার এটি কিনে নেয়। স্থানীয় কর্মকর্তারা যখন বাড়িটির অবস্থা মূল্যায়নের জন্য এসেছিল, তখন তারা আবিষ্কার করে যে বাড়ির পিছনে একটি উঠোন আছে। কিন্তু এমন উঠান রাখা গৃহনির্মাণ বিধিনিষেধ দ্বারা নিষিদ্ধ ছিল।

          শুধু তাই না। ভাবুন একবার- সেই উঠানে একটি জীবন্ত গাছ! মা বলছিলেন যে ওটা একটি ওক বৃক্ষ। গাছের খবর ফাঁস হয়ে গেলে ধীরে ধীরে দর্শনার্থীরা এটি দেখার জন্য আসা শুরু করে এবং তখন স্থানীয় সরকার অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা উপলব্ধি করে প্রবেশ ফি নেওয়া শুরু করে। তারা জায়গাটির বিজ্ঞাপন দেওয়াও শুরু করে। এতদিনে জায়গাটি স্কুলের শিক্ষা সফর এবং পারিবারিক ভ্রমণের জন্য প্রিয় একটি জায়গায় পরিণত হয়েছে।

          বোস্টনের মূল শহরে পৌঁছার পরে আমরা লিফট-বাসে চড়ে গ্রাউন্ড লেভেলে গিয়ে মনোরেল ধরে ইস্ট বোস্টন আরবান সেন্টার ৩-এ পৌঁছলাম। সেখান থেকে আমরা একটি এয়ার-কুশন ট্যাক্সি নিয়ে বাকি পথ পার হলাম।

          বাড়িটা দেখতে আহামরি তেমন কিছু না। এতে আধুনিক ভবনগুলোতে ব্যবহৃত চকচকে মার্বেল বা স্টিল, কিছুই নেই, বরং বাড়িটিকে দেখতে কেমন নিস্তেজ ফ্যাকাশে সাদা মনে হলো। বাড়িটার এখানে ওখানে রঙ চটে গেছে। বাবা প্রবেশ টিকেট নিলেন। আমরা ১৫ মিনিটের জন্য বাড়ির ভেতরের বিরক্তিকর সফর শেষ করলাম। ঘরগুলোকে দড়ি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে যেন কেউ কিছু স্পর্শ করতে না পারে। পিছনের সেই অবৈধ উঠোন বরাবর কোনও জানালাও নেই যে কেউ উঁকি দেবে। তাই উঠান ঘেঁষা ঘরটিতে ঢোকা গেল কী গেল না, সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা হলো না।

          আমার মনজুড়ে খেলা করছিল গাছটা। আমার মনে হচ্ছিল যেন বাড়ির ভেতরের সফরটা শেষই হচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎ আমরা একটা বুকশেলফের কাছে এলে তার পিছন থেকে যেন এক গুপ্ত দরজা খুলে গেল। আমাদের সামনে উন্মোচিত হলো সেই নিষিদ্ধ উঠোন। উঠোনটা বেশ বড়- অন্তত ১০ ফুট গুণ ২০ ফুট হবে- এবং এর চারদিক দিয়ে পর্যটকদের হাঁটার জন্য পাকা রাস্তা। কংক্রিটের সেই হাঁটাপথ ঘেঁষে গজানো সত্যিকারের জীবন্ত ঘাস দেখে আমি বিস্ময়ে হা হয়ে গেলাম। অবশ্য, সেই জীবন্ত ঘাসও আমাকে বেশিক্ষণ মোহমুগ্ধ করে রাখতে পারেনি, কারণ আমার মনজুড়ে ছিল সেই বৃক্ষ। কখন তাকে দেখব! সেই গাছ নজরে না পড়ার কোনো কারণ নেই; সে এক অভাবনীয় দৃশ্য!**

          ওটা ছিল উঠানের এক প্রান্তে। ওর সুরক্ষার জন্য চারপাশে ধাতব জালের একটি বেড়া দেওয়া। ওটা আমার দেখা প্লাস্টিকের গাছগুলোর মতোই, তবে ওর পুরো অবয়বে আরও অনেক বেশি কিছু ছিল। যে কোনও কৃত্রিম গাছে যে ধরনের বিস্তারিত দেহবৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে, ওর দেহে আরও জটিল কিছু দৃশ্যমান হচ্ছিল। আর, ও তো জীবিত, জীবন্ত! বহুকাল আগে কেউ ওর কাণ্ডে ভালোবাসার জুটির নামের আদ্যক্ষর খোদাই করেছিল আর সেই খোদাই করা আদ্যক্ষর গাছটির প্রশস্ত কাণ্ডের বিস্তৃতিতে কোথাও কোথাও মিশে যেতে বসেছে। যেন ক্ষত সেরে উঠছে। তবে, সব থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো ওর গন্ধ। এক তাজা, জীবন্ত ঘ্রাণ, যা বাইরের অ্যান্টিসেপটিক ছিটানো জগতের সমস্ত ধাতু, প্লাস্টিক ও কাচের গন্ধের চেয়ে ভিন্ন। আমি ওর বাকলে হাত ছোঁয়াতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ধাতব বেড়ার জন্য তা পারলাম না। মা এবং বাবা, দুজনেই গভীর, দমভরে শ্বাস নিচ্ছিলেন। তাদের মুখে এক স্বর্গীয় হাসি। সেই হাসি মুখে নিয়ে তারা এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমরা তিনজনেই সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম, কিন্তু ট্যুর গাইড আমাদের জানালেন যে পরের দলের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। আমি সেখান থেকে সরে যেতে চাইনি- আসলে, আমার ভেতরে তখন কান্নার দমক এসে যাচ্ছিল।

          বাড়ি ফেরার সময়ে সারাটা পথ মা-বাবা চুপ হয়ে থাকলেন। আমাদের গাইড যে ব্রোশিওরটা দিয়েছিলেন, আমি সেই সময় সেটা পড়ছিলাম। ওটা পড়ে জানলাম, ও’ব্রায়েনদের বাড়িটি কেবল এই বছরের বাকি সময়ের জন্য খোলা থাকবে। একথা জেনে খুব দুঃখ পেলাম। এক বীমা কোম্পানির প্রয়োজন মেটাতে বাড়িটা গুঁড়িয়ে দিয়ে সে জায়গায় নতুন বিশাল এক ভবন তৈরি করা হবে। ঐ গাছ নিশ্চিতভাবে হারিয়ে যাবে।

          ভ্রমণের বাকি সময়টুকু আমি কেবল বসে থাকলাম। নিশ্চল হয়ে বসে থাকলাম; আর পুরোটা সময় আমার পকেটে থাকা বস্তুটিকে আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করে অনুভব করছিলাম। আমি ওকে ও’ব্রায়েনদের বাড়ির পিছনের উঠোনে, ঘাসের ভেতর থেকে তুলে নিয়েছিলাম। আমার মনে হয় এটি ওক গাছের একটি বীজ।

** এই অনুচ্ছেদের শেষ ৩টি বাংলা বাক্য মূলত ১টি ইংরেজি বাক্যের (The grass didn’t distract me for long, however, because I just couldn’t help noticing the tree!) অনুবাদ। স্বাভাবিকভাবেই এখানে অনুবাদকের নিজস্ব ব্যাখ্যাসূচক বিস্তৃতি ঘটেছে। কারণ couldn’t help noticing এর জন্য ‘চোখে না পড়ে উপায় ছিল না’ বলা যেত কিন্তু এতে পরিপূর্ণ আবেগটি ইংরেজির মতো বাংলায় প্রকাশিত হতো না।

Comments

    Please login to post comment. Login