র্যাপ মূলত একধরণের দক্ষতা। হিপ-হপ মিউজিকের প্রধান একটি উপকরণ র্যাপ। কিন্তু র্যাপের শিকড়ের সন্ধানে যেতে হবে হিপ-হপ সংস্কৃতির অবিরভাবেরও পূর্বের সময়। র্যাপের ইতিহাসটা আরেকটু পুরনো, ফিরে যেতে হবে যেখানে সঙ্গীত ও কথার ছন্দময় সংমিশ্রণ শিল্পে রূপ নিয়েছিল। '৩০ দশকে ক্যাব ক্যালোওয়ে ‘মিনি দা মুচার’ গানে কথা ও শব্দ মিলিয়ে একধরণের ছন্দ তৈরি করেন। যেন গানের মাঝে একটা গল্প বলা হচ্ছে, যদিও সেসব শব্দের আক্ষরিক কোন অর্থ ছিল না। এই কৌশলকে ‘স্ক্যাটিং’ করা বলা হয়। জ্যাজ সিঙ্গার এলা ফিটজেরাল্ড তার গানের কথা দিয়ে স্ক্যাট করে ছন্দ তৈরি করতেন। ফ্রিস্টাইল র্যাপের শুরু সম্ভবত সেখান থেকেই। র্যাপ করে গান গাওয়া মূলত এক ধরণের কৌশল, যা একজন গায়কের দক্ষতার প্রমাণ দেয়। ১৯৬৫ সালে বব ডিলানের ‘সাবটেরিনিয়ান হোমসিক ব্লুজ’ গানের গভীর কথামালা আর রিদমিক লিরিক্স বক্তব্যধর্মী র্যাপ গানের এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। জ্যামাইকার ডিজেরা গানের সাথে ছন্দ মিলিয়ে কথা বলে ‘টোস্টিং’ করতো। মূল ধারার র্যাপে জ্যামাইকান টোস্টিংয়ের একটা বড় ভূমিকা আছে। গিল স্কট হ্যারন ফাংক-জ্যাজ মিউজিকের সাথে কথা (স্পোকেন ওয়ার্ড) মিশিয়ে ১৯৭১ সালে রিলিজ করেন ‘দ্য রেভুলেশন উইল নট বি টেলিভাইসড’।
'৭০ দশকেই নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কসে হিপ-হপ সংস্কৃতির আবির্ভাব হয়। আমেরিকান র্যাপার কিফ কাউবয় মঞ্চে গান গাওয়া মধ্যে মজার ছলে ‘হিপ-হপ-হিপ-হপ’ র্যাপ করতেন, যার কোন আক্ষরিক মানে নেই। পরবর্তী সময়ে তা জনপ্রিয়তা লাভ করে, সে থেকেই হিপ-হপ শব্দটির প্রচলন হয়। ডিজে কুল হার্ক-এর ‘ব্রেকবিট’ এবং গ্র্যান্ডমাস্টার ফ্ল্যাশের নিখুঁত মিক্সিং টেকনিক র্যাপ মিউজিককে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। র্যাপ দক্ষতার মঞ্চ থেকে মূলধারার সঙ্গীতের অংশ করে তোলে ১৯৭৯ সালে সুগারহিল গ্যাং-এর ‘র্যাপারস ডিলাইট’ গানটির মাধ্যমে। ১৯৮০ সালে পপরক ব্যান্ড ব্লন্ডি র্যাপের মিশ্রণে ‘র্যাপচার’ গান রিলিজ করে। র্যাপ সঙ্গীতের সাথে পাশাপাশি ভিন্নধর্মী নাচের স্টাইল আসে, সেসময় ব্রেকড্যান্স-এর বিকাশ ঘটে। '৮০ দশকে বিশ্বব্যাপী তুমুলভাবে সারা ফেলল ডিসকো ঘরানার গান, সেসময় হিপহপ মিউজিকে ডিসকোর প্রভাব দেখা যায়। হিপহপ সংস্কৃতির মূল উপাদান চারটি- র্যাপ, ডিজে, ব্রেকড্যান্সিং ও গ্রাফিতি। পরবর্তীতে, বিটবক্সিং এবং হিপ-হপ ফ্যাশন ছাড়াও কালের বিবর্তনে আরো কিছু উপাদান যোগ হয়েছে।
১৯৮৬ সালে রক ব্যান্ড এ্যারোস্মিথ এবং হিপ-হপ গ্রুপ রান-ডি.এম.সি. ‘ওয়াক দিস ওয়ে’ রিলিজ করে। গানটি র্যাপ এবং রকের মিশ্রণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। র্যাপ কখনও এক ঘরানায় আবদ্ধ থাকেনি। বিস্টি বয়েজ, পাঙ্ক রক এবং হিপ-হপ সংমিশ্রণ ঘটায়। র্যাপ-হার্ডরক ব্যান্ড রেইজ এগেইনস্ট দ্য মেশিন তাদের গানে শক্তিশালী বার্তা ছড়িয়েছে। কর্ন, লিম্প বিজকিট-এর মতো ব্যান্ড হেভি গিটার রিফের সাথে র্যাপ মিশ্রিত করে নিউ-মেটাল নিয়ে হাজির হয়। এ ট্রাইব কল্ড কোয়েস্ট, দ্য রুটস-এর মতো ব্যান্ড জ্যাজের সাথে র্যাপের সংমিশ্রণ করে। পপ শিল্পীরাও বাদ যাচ্ছেন না। র্যাপ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। যুক্তরাজ্যের গ্রাইম, দক্ষিণ কোরিয়ার কে-পপ র্যাপ, আফ্রিকার আফ্রোবিট র্যাপ বৈচিত্র্যের উদাহরণ। র্যাপ অন্যান্য সঙ্গীত ঘরানার সাথে মিশে গিয়ে নিজস্ব রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশে র্যাপ এবং হিপহপের যাত্রা মূলধারার সঙ্গীত থেকে অনেকটা দূরে শুরু হলেও বর্তমানে দেশের তরুণদের কণ্ঠ হয়ে উঠেছে। '৯০ দশকে বিদেশি র্যাপ-হিপহপ গান শোনার মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমিনেম, টুপাক, নটোরিয়াস বিআইজি, বিস্টি বয়েজের গান ক্যাসেট টেপ বা সিডির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম র্যাপের স্বাদ পেতে শুরু করে।
১৯৯৩ সালে পার্থ বড়ুয়া, আশরাফ বাবু ও আব্দুল ওয়াজেদ চারু ‘ত্রিরত্নের ক্ষ্যাপা’ দেশের প্রথম র্যাপ অ্যালবাম রিলিজ করেন। অ্যালবামটি জনপ্রিয়তা শীর্ষে পৌঁছে, একই বছরে ‘বায়ুচড়া’ নামে ২য় অ্যালবাম রিলিজ হয়। এরপর ধীরেধীরে র্যাপ-হিপহপের বিকাশ শুরু হয়, বাংলাদেশে অনেক হিপ-হপ গ্রুপ গঠিত হয়েছিল।
২০০০ পরবর্তী সময়ে- স্টোইক ব্লিস, ফকির লাল মিয়া, আপটাউন লোকোলজ, ঢাকা থাগস, দেশি এমসি, এমসি শাক, ব্ল্যাক জাং এবং জালালী সেট; উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এই সময়ে তরুণরা র্যাপকে শুধু অনুকরণ নয়, নিজেদের কথা বলার একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে।
স্থানীয় র্যাপাররা দেশের সামাজিক সমস্যা, ব্যক্তিগত সংগ্রাম এবং রাজনীতি নিয়ে গান তৈরি করেন। শহুরে জীবন এবং তরুণদের সংগ্রাম র্যাপের মূল বিষয় হয়ে ওঠে। বাংলা হিপহপ ইউটিউবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০২০-এর দশকে এসে বাংলাদেশে র্যাপ এবং হিপ-হপ আরও বিস্তৃত হয়েছে। র্যাপাররা ইউটিউব, স্পটিফাই, এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেদের গান রিলিজ করে যাচ্ছে। বাংলা মেন্টালজ, রানা ও তাবিব মাহমুদ-সহ আরও অনেকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত নাম। বর্তমানে জনপ্রিয় গানে নিয়মিত র্যাপারদের অংশগ্রহণ দেখা যায়। দেশের শিল্পীরা র্যাপের মাধ্যমে সমাজের অবক্ষয়, দুর্নীতি এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন। ব্যক্তিগত সংগ্রাম থেকে শুরু করে সামাজিক অন্যায়, শহরভিত্তিক র্যাপের পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষার র্যাপও তৈরি হচ্ছে। তরুণদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। এসময়ের র্যাপাররা নানা রকম সঙ্গীত ও বিষয় নিয়ে তাদের গানে পরীক্ষা চালাচ্ছেন। এটি শুধু সঙ্গীত নয়, একটি সামাজিক আন্দোলন এবং কণ্ঠস্বর হিসেবেও কাজ করছে। শুধু বিনোদন নয়, র্যাপ হয়ে উঠেছে আন্দোলনের নতুন ভাষা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সংগীত, বিশেষত র্যাপ এবং হিপ-হপ, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে। র্যাপাররা তাদের গানের কথার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস জুগিয়েছে।
র্যাপাররা শুধু সংগীতশিল্পী নন, তারা সমাজের আয়না। সেজান, হান্নান-সহ অসংখ্য র্যাপার সামাজিক অন্যায়, দুর্নীতি এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরেছেন। র্যাপাররা সরাসরি আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে তাদের গান ব্যবহার করেছেন প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে। তাদের গানে শাসক গোষ্ঠীর ব্যর্থতা এবং দুর্নীতি তুলে ধরেন। এসব গানে তরুণদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শত বাধা উপেক্ষা করে এই প্রজন্মের র্যাপাররা হিপহপ চর্চা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। র্যাপাররা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। র্যাপ এখন শুধু সঙ্গীত নয়, এটি একটি বৈশ্বিক আন্দোলন। র্যাপের ছন্দ এবং কাহিনি বলার ক্ষমতা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এর প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখবে।