অধ্যায়-১ - ভয়ের শুরু
বিছানার ধারে সে বসে আছে, ভয়ে তার পা প্রচন্ড ঝড়ে দুলতে থাকা গাছের মতো থরথর করে কাঁপছে, সে তার হাত পেটের ওপর রাখে, হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে, হাতের আঙুলগুলোর সাহায্যে নিজের ফুলে ওঠা পেটকে শক্তভাবে চেপে ধরে আছে যেন ছেড়ে দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে, মনের মধ্যে তার এখন মনে একটাই আকাঙ্ক্ষা- আমাকে রক্ষা করতে হবে। দূরে থেকে কিছু একটা এই দৃশ্য দেখতে থাকে, যে কিনা তার মায়ের গর্ভের নিজের অস্তিত্বের খোঁজার লক্ষ্যে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকে…
মেইলি তার হাত পেটের ওপর রাখে, গর্ভে থাকা সন্তান যে কিনা এখনো পুরোপুরি ভাবে বিকশিত হতে পারি নি, তার অস্তিত্ব খুঁজতে থাকে, সে শুনতে পায় একটা চাপ পড়া ঘড়ির ঠকঠক শব্দ, অনুভব করতে থাকে একটা আবছা হৃদস্পন্দন। তার কাছে মনে হতে থাকে এই ক্ষীণ শব্দই বুঝি এই বিশৃঙ্খল পৃথিবীর সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে ফেলতে পারে।
দূরের সদর দরজা থেকে ভেসে আসছে ভারী দরজা বারি দেয়ার শব্দ। কাঠ ভাঙার শব্দ, যেন মৃত্যু দরজায় কুঠার চালাচ্ছে। এই শব্দ অবিরাম, বিরতিহীন। যেন কেউ দরজায় মাথা ঠুকছে। প্রতিটা আঘাতে ঘরটা কাঁপছে। কেউ দরজায় বারবার বারি দিয়ে যেন ভাঙতে চায় তাদের সমস্ত আশ্রয়। যেন তাদের লক্ষ্য এই পৃথিবীকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। ঘরের ছাদ থেকে ঝুলন্ত বাতি আজ ম্লান আলোয় দুলছিল। তার আলো দেয়ালে মৃদু ছায়ার নৃত্য তৈরি করছিল। যেন অন্ধকারে যমের দূতেরা মৃত্যুর মশাল হাতে ছুটে আসছে। যা তার পেটের ভেতর জমাট বাঁধা ভয়কে আরও বাড়িয়ে তুলছিল।
সে বলতে থাকে তারা এসেছে, তারা আমার খোঁজে এসেছে। তার শ্বাস ঘন হয়ে আসছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে কর্মকতারা তার খোঁজে এসেছে। মৃদু গরম পানিতে থাকা পা সে ধীরে ধীরে বাটি থেকে উঠাতে থাকে, বিছানার পাশে থাকা চাদর নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে নেয় এই আশায় যেন তারা তার ফুলা পেট না দেখতে পারে আর অপেক্ষায় থাকে কখন তারা দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে তাকে তুলে নিয়ে যাবে।
তখন শীতের বিকেল শেষ হয়ে আসছে। আকাশে থাকা সূর্যের ম্লান আলো ভালোভাবেই ছড়াচ্ছিল, যখন প্রকৃতি কুয়াশার চাদরে আবৃত হয়ে রাতকে আমন্ত্রন জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখনই ঝড়ের মতো পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে আসা চারজন কর্মকতা মৃত্যুর দেবদূতের মতো পাশের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তারা দেখতে পায় ফ্যাং যে কিনা বাড়ির আঙ্গিনায় বসে শান্তিতে তিলের বীজ শুকাতে দিচ্ছিল আর তার বুকে একটা ছোট্ট শিশু যার বয়স সবে তিন সপ্তাহে পৌঁছেছে, মনের আনন্দে ফ্যাং এর বুক থেকে দুধ চুষে পেট ভরচ্ছিল। ফ্যাং এর জীবনের এই সাধারণ দৃশ্য কারো কারো কাছে বিষের মতো মনে হয়েছিল। এক মূহূর্তের জন্যও ফ্যাং বুঝতে পারে নি যে এই সাধারণ দৃশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জীবনকে দুঃস্বপ্নে পরিনত করতে চলছে। এই সাধারণ দৃশ্যটা ভেঙ্গে দিতে চার অফিসারের এক মূহূর্তও সময় লাগল না। তাদের চোখে এই দৃশ্য দেখা ছিল ঘোর পাপের। তারা মূহূর্তের মধ্যেই ফ্যাং এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, টেনে নিয়ে যেতে থাকে বন্ধ্যাকরণের জন্য। ফ্যাং যে কিনা শিকারীরূপী অফিসারদের আঘাতে কোণঠাসা আহত বাঘিনীর মতো চিৎকার করতে থাকে, লাথি মারতে থাকে, তার কান্না দূর থেকে শুনে হচ্ছিল যেন একটা পশুর আর্তনাদ যাকে কিনা বাধ্য করা হচ্ছিল কসাইখানায় যাওয়ার জন্য। আঙ্গিনায় থাকা ভাতের বাটি, যা কিনা ডাম্পলিং তৈরির জন্য পানিতে ভেজানো ছিল, তা ধস্তাধস্তিতে উল্টে যায়। দুটো দেশি হাঁস তখনও নির্বিঘ্নে, মাটিতে পড়ে থাকা বীজ ঠুকরে খাচ্ছিল।
সবশেষে তারা কঠোর সংগ্রামের পর ফ্যাং এর হাত বেঁধে তাদের ট্রাকের খোলা পিছনে জোর করে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ধস্তাধস্তিতে ফ্যাং এর সাদা গেঞ্জি ছিঁড়ে যায়। তার কাঁধে রক্তের দাগ। যা তার কাঁধে লাথি খেয়ে অফিসারের ফাটা নাক পড়ছে। আর সেই অফিসার এখন তার পায়ের কাছে বসে মোটা দড়ি দিয়ে তাকে ট্রাকের ধাতব দন্ডের সাথে শক্তভাবে বেঁধে দিল। আটকা পড়ে অসহায় ফ্যাং তার শরীর ঝাঁকিয়ে উঠল, তার কণ্ঠস্বর যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ল। সে অভিশাপের বন্যা বইয়ে দিল- “আমি তোদের অভিশাপ দিচ্ছি! তোমাদের পরিবারে নয় প্রজন্ম ধরে কোনো পুত্র জন্মাবে না! তোরা কি ভুলে গেছিস যে তোরা তোমদের মায়ের দুধ খেয়ে মানুষ হয়েছিলি? আর এখন তোরা একটা শিশুকে তার মায়ের বুক থেকে টেনে নিচ্ছিস? ...” এই নির্মম দৃশ্য দেখে মেইলি আর সহ্য করতে পারল না। তার মনে হলো তার পা নিজে থেকেই চলে গেল। সে প্রাচীর টপকে ফ্যাং এর আঙ্গিনায় ঢুকে পড়ল। মাটিতে পড়ে থাকা শিশুকে সে কোলে তুলে নিয়ে অফিসারের দিকে তাকাল। তার চোখে অনুনয়, যেন কোনো অন্ধকার পথে ক্ষীণ আলোর রেখা খুঁজছে। “দয়া করুন,” সে ফিসফিসিয়ে বলল, “আর একটু সময়... শুধু একটু সময় দিন।”
মেইলি তার কোলে শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে । “এর থেকে দূরে থাক মেয়ে!” তার কণ্ঠস্বর ছিল শীতল ও নির্মম, যেন তার মধ্যে দয়া-মায়ার কোনো ছিটেফোঁটাই নেই। হাত ঘষতে ঘষতে ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিল, “আপনি কি সরকারি নোটিশ পড়েননি? যদি তল্লাশির সময় অনুমতিপত্র ছাড়া কোনো মহিলাকে গর্ভবতী পাওয়া যায়, তবে তার বাড়ির একশ মিটারের মধ্যে যত বাড়ি আছে প্রত্যেক বাড়ির পরিবারকে শাস্তি দেওয়া হবে। বিশাল অঙ্কের জরিমানা দিতে হবে। নিকটতম প্রতিবেশী হিসাবে, শিশু জন্মের আগেই আপনার উচিত ছিল কর্তৃপক্ষকে জানানো। আপনি শিশুর জন্মের আগে তাকে রিপোর্ট করতে পারেননি। আপনাকে কম করে হলেও হাজার ইয়ুয়ান জরিমানা পরিশোধ করতে হবে।”।
মেইলি এই কর্মকর্তাদের কাউকে চিনতে পারেনি, এরা এই গ্রামের না। যেন অন্য জগত থেকে এসেছে। তারা ছিল অপরিচিত, উচ্চারণেও নেই কোনো আঞ্চলিক টান। সে ধরেই নিয়েছিল অফিসারদেরকে হয়ত পাশের শহর থেকে আনা হয়েছে মানুষকে ‘এক সন্তান নীতি’ কর্মসূচির গুরুত্ব বোঝাতে। সে বারবার চাচ্ছিল ফ্যাং এর দিকে ছুটে গিয়ে নিজের গায়ের চাদর তার গায়ে জড়িয়ে দিতে। কিন্তু হঠাত করে তার নিজের অবস্থার কথা মনে পড়ে গেল, সে যে নিজেও একজন গর্ভবতী। কর্মকর্তারা যদি টের পেয়ে যায়? তারা যাতে তার অবস্থা বুঝতে না পারে, তার জন্য সে একই জায়গাতে শিকড় গাড়া গাছের মতো, নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তার চোখে পড়ল যখন ট্রাকটা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করল, অসহায়ের মতো ফ্যাং এর শরীর ট্রাকের পিছনে দিকে ঝাঁকুনি খেতে থাকে আর তার বুক থেকে ফোঁটা ফোঁটা দুধ ঝরছিল।
দরজার ধাক্কা হঠাৎ থেমে গেল, মাঝখানে কয়েক মুহূর্তের বিরতি তারপর দরজা ধাক্কানো আবার শুরু হল তবে এবার আগের চেয়ে আরো বেশি জোরে শুরু হল। “আমি কংজি! তাড়াতাড়ি দরজা খোলো!” স্বামীর চাপা কণ্ঠস্বর শুনে উদ্ভিগ্ন মন শান্ত হয়ে গেল, স্বস্তিবোধ করতে থাকল। “তাড়াতাড়ি দরজা খোলো!” হঠাত করে তার মনে পড়ল ঘণ্টাখানিক আগে তার দেওয়া দরজায় বেড়ার কথা। দরজার সাথে শক্ত করে একটা কোদাল বেঁধেছিল যাতে দরজা বাইরে থেকে কেউ খুলতে না পারে। সে দৌড়ে দরজার কাছে চলে যায় আর কোদাল সরিয়ে ভিতরে ঢোকার পথ করে দিল।
কংজি কোনোমতে ঘরে ঢুকে পড়ল, তার চেহারায় গভীর চিন্তার ছাপ, তার চুল পোশাক দুটোই এলোমেলো, তার দৃষ্টি অস্থির এবং বিভ্রান্ত, সে যেন ভয়ের গোলকধাঁধাঁয় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে, গোলকধারা থেকে বের হতে পারছে না। সে ছোট ঘরটাতে অস্থিরভাবে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল, যা বাতাসকে ঘন করে তুলছিল, ঘরটাকে দমবন্ধর অবস্থা করে ফেলছিল, যা মেইলির উপর যেন একটা মানসিক চাপ দিচ্ছিল। সে এইমাত্র পার্টি মিটিং থেকে ফিরেছে, মুখে ভয়ের ছাপ। “গতকালকে আসা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে আসা অফিসারদের একটা দল,” সে জানালো, তার কণ্ঠস্বর চিন্তায় চাপা, “হেক্সি শহর থেকে পাঠানো হয়েছে ‘এক সন্তান নীতি’ কর্মসূচি পরিচালনার জন্য। গ্রামের পার্টি অফিস যথেষ্ট বড় না হওয়ায় তারা স্কুলের একটা ক্লাসরুম দখল করেছে এবং সেখানে নারীদের গর্ভপাত ও বন্ধ্যাকরণ করছে। মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার বদলে ক্লাসরুম ব্যবহার করছে মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য। তাদের এই কর্মকান্ড অত্যন্ত জঘন্য রুপ ধারন করবে।”
“আমরা কি করব, কংজি? আমাদের কি হবে?” আতঙ্কে মেইলির কণ্ঠস্বর থেকে ভালোভাবে শোনা যাচ্ছিল না, তার দৃষ্টিতে আতঙ্ক, দমবন্ধর হয়ে আসছে তার।
“আমি জানি না, মেইলি, আমি সত্যিই জানি না,” কংজি মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকল। তার কণ্ঠস্বর ভারী, “তবে অফিসাররা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, যেসব গর্ভবতী মহিলার যার জন্ম দেওয়ার অনুমতিপত্র নেই, তাকে ধরার সাথে সাথে গর্ভপাত করানো হবে আর দশ হাজার ইয়ুয়ান জরিমানা দিতে হবে।”
“দশ হাজার ইয়ুয়ান? আমরা আমাদের বাড়ি এবং ভেতরের সবকিছু বেচে দিলেও এই বিশাল অঙ্কের টাকা জোগাড় করতে পারব না,” মেইলি হতাশায় ভরা কন্ঠে বলে উঠলো, “ভাগ্যিস গত মাসে আমরা একটা নকল জন্ম দেওয়ার অনুমতিপত্র কিনেছি।”
“ওটা দ্বারা মনে হয় না আর ঠকানো সম্ভব হবে”, কংজি বলল, চোখের সামনে কোনো পথ সে দেখতে পাচ্ছে না। সে চশমা খুলে তার ক্লান্ত মুখ ঘষতে থাকল। তার কণ্ঠস্বর নিস্তেজ, “এবার তারা অনুমতিপত্রগুলো খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখছে, মরিয়া হয়ে নকল অনুমতিপত্র খুঁজছে।”
‘আজ তারা কতজন মহিলাকে ধরেছে, এই নৃশংস ভাগ্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য?’ মেইলি জিজ্ঞাসা করল, এক প্রকার বমি বমি ভাব তার গলায় উঠে আসছিল।
“দশজনকে পার্টি অফিসের বাইরে বেঁধে রেখেছে”, কংজি গম্ভীর কণ্ঠে বলল। স্কুলের চৌকিদার যখন তাদের মধ্যে তার নিজের বউকেও দেখল, তার মুখ আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে যায়, তাদের নির্মম থাবা থেকে নিজের বউকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অফিসাররা এক ফোঁটা দয়া না দেখিয়ে তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে এরপর তাকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে তালা দিয়ে আটকে রাখে। লোকাস্ট ট্রি লেনে থাকা বৃদ্ধ দর্জি তার গর্ভবতী মেয়েকে অফিসারদের থেকে লুকানোর চেষ্টা করেছিল তাকে তারা পিটিয়ে হত্যা করে।”
“তারা মানুষটাকে মেরে ফেলল, কংজি? তারা কি সত্যিই... মেরে ফেলেছে?” মেইলির কণ্ঠস্বর ভেঙে গেল। খবরটা শুনে তার শরীর কাঁপতে থাকে, যেন তার শরীরে বজ্রপাত পড়েছে। সে নিজের অজান্তে ফোলা পেটে হাত বুলিয়ে গর্ভে থাকা সন্তানের কাছ থেকে সান্ত্বনা খুঁজছে। সে কংজির কাছ থেকে উত্তরের আশায় তার দিকে তাকাল, যে কিনা ঘরের চারপাশে বিষণ্ণভাবে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে, তার অস্থিরতা বাড়ছে। প্রতিটা পদক্ষেপে, প্রতিটা কার্যকালাপে প্রকাশ পাচ্ছে তার হতাশা, উত্তেজনা আর অস্থিরতা। সে অসহায়, উত্তেজনায় হাত ছুঁড়ে মারছিল, গলা থেকে চাপা আর্তনাদ বের করছিল যা মেইলি আগে কখনও কংজির মধ্যে দেখেনি। কখনও তাকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে নি। একজন মানুষ কোন পর্যায়ে এসে পৌঁছালে এমন করে তা সে ভাবতেও পারছে না। হঠাৎকরে সে ধপ করে তার পাশে বসে পড়ল, দেখে মনে হচ্ছে পরাজয়ের ভারে সে ভেঙে পড়ছে। হঠাত করে বসা পড়ায় তার পায়ের আঘাতে মেইলির পায়ের কাছে রাখা পানির বাটিটা ভোঁতা শব্দ করে উল্টে যায়। ভিতরে থাকা পানি ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে গেল। মেঝেতে পড়ে থাকা ছোট পালকগুলো ছড়িয়ে পড়া জলে ভাসছিল। দেখে মনে হয় যেন অন্ধকার কোনো লেকের উপর ভাসতে থাকা ভাঙা একটা নৌকা। “মেইলি, তুমি এটা সরালে না কেন?” কংজি রেগে উঠল। তার কণ্ঠস্বর ছিল বিরক্তির ছাপ। সে তার ভেজা জুতো দেখিয়ে বিরক্তির সুরে বলল, “দেখ, আমার জুতো ভিজে গেছে।”
"আমি এটা তোমার জন্য রেখেছিলাম। আমি দুঃখিত। এখন দয়া করে, এখানে এসে আমার কাছে বসে পড়।" হঠাত করে রেগে যাওয়ার কারণে মেইলি ভয় পেলেও শান্ত গলায় বলল। সে থার্মোফ্লাক্স থেকে বাটিতে আবারও গরম জল ঢালল, তারপর তার সামনে বাটিটা এগিয়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। যত্নের সাথে কংজির কাদা লেগে থাকা জুতো খুলে তার পা ধীরে ধীরে ধুতে শুরু করল। ধোয়া শেষ করার পর একটা শুকনো কাপড় দিয়ে তার পা মুছে দিল। এরপর মেঝেও পরিষ্কার করে ফেলল।
“ক্লাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে,” কংজি মুখ বিষণ্ণ করে বলল। “আমার মনে হয় না কেউ আর স্কুলে আসবে। হয়ত কিছু সংখ্যক ছাত্র এমনিতেও আসতো যদি না এই কার্যক্রম এত চরাওভাবে শুরু না হতো। হয়ত এতক্ষণে কিছু পরিবার তাদের সন্তানদের অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়েছে, অন্যান্য শহরে থাকা তাদের আত্মীয়দের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে যতক্ষণ না এই অভিযান, এই সন্ত্রাসী কর্যকালাপ শেষ হয়।”
“তাহলে তোমার বেতনের কি হবে? বেতন ঠিকমতো পাবে তো?” মেইলি জিজ্ঞাসা করল, তার কণ্ঠস্বর তীব্র হতাশার ছাপ।
“হ্যাহ। আর বেতন! তুমি বেতনের কথা বলছ?” কংজি কষ্টে বিদ্রুপ করে বলল “তুমি জান না গত তিন মাস ধরে আমি ঠিকমতো বেতন পাচ্ছি না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগে সপ্তাহে একশ ইয়ুয়ান হলেও দিত, এখন তো তাও দিচ্ছে না। গত সপ্তাহে বেতনের পরিবর্তে কি পেয়েছি? একটা ছোট ডিজেলের টিন আর একটা সস্তা লেখার খাতা। যা আমাদের কোনো কাজেই আসবে না। এর উপর কর্তৃপক্ষ আবার সাহস করে বলে বেরাচ্ছে যে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম লঙ্ঘনকারীদের জোরপূর্বক গর্ভপাত এবং বন্ধ্যাকরণের এই মহৎ অভিযান শুরু করা হয়েছে গ্রামের স্কুলগুলোর জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে! তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো, মেইলি যে আমাদের স্কুল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংসের থেকে পাওয়া অর্থের একটা অংশও পাবে না। প্রকৃতঅর্থে কোনো স্কুলই পাবে না।”
মেইলি চোখ ডানদিকে সরে এলো, একটা পরিচিত অবয়ব তার চোখে পড়ল। সে তার মেয়ে নান্নানকে দেখল। যে কিনা ঘরের এক কোণে বসে আছে, মেঝেতে থাকা কাদায় মাখা জুতোর তাকিয়ে আছে। “ওখানে কি করিস তুই, নান্নান?” সে মৃদু কণ্ঠে বলল, যতটা পারে তার গলাকে নরম করার চেষ্টা করল। “বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড় সোনা।”
নান্নান ঘুমন্ত চোখে কংজির দিকে তাকায় আর এবং সে তার ছোট মুখ থেকে নরম গলায় বিড়বিড় করে বলল “আমি শিশি করব, বাবা…”
“যাও, নিজে গিয়ে কর। তোমার দুই বছর বয়স হয়েছে, প্রায় বড় মেয়ে হয়ে গেছ তুমি। তোমার আর এখন অন্ধকারে ভয় পাওয়া উচিত নয়,” কংজি তার দিকে তাকিয়ে আগের মতো উত্তেজিত হয়ে কর্কশভাবে বলার চেষ্টা করলেও তার গলা বের হয় খানিকটা নরম কন্ঠস্বর।
নান্নান, মুখ গোমড়া করে বিরক্ত হয়ে সামনের দরজার দিকে পা টেনে টেনে কোনোমতে এগিয়ে গেল কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও দরজার হাতল ঘোরাতে পারল না। নান্নানের এই চেষ্টা দেখে মেইলি আর বসে থাকতে না পেরে আলতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর দরজার হাতল নিচে নামিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজার বাহির থেকে ঠান্ডা বাতাস যা কিনা ছিল ধারালো কাটার মতো, পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। বাইরের বাতাস যেন ধারালো কাটার মতো চামড়ায় বিধতে থাকল। মেইলি কেঁপে উঠলো, কাটা যেন চামড়া ভেদ করে পেটের ভিতরে প্রবেশ করতে চাইছে। ভেতরের থাকা শিশুও যেন ভয়ে আরও ছোট হয়ে কুঁকড়ে গেল, মেইলির পেটের চামড়া কঠিন বরফের মতো শীতল হয়ে উঠল।
কংজিও শীতে কেঁপে উঠল, ঠান্ডা বাতাস তার কাপড়ের ভিতরে প্রবেশ করল। শীতে একটুখানি উষ্ণতার সন্ধানেই হোক আর মাথা ঠান্ডা করতেই হোক সে একটা সিগারেট ধরাল। তার পিছনের দেয়ালে একটা মোজাইকের তৈরি ম্যুরাল আছে। সবুজ পাহাড় এবং নীল নদীর চমৎকার এই ম্যুরাল পিছনের দেয়ালের একটা বিরাট অংশ দখল করে আছে। যা তার বন্ধু, ওল্ড চাও যে কিনা এলাকার একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্প, তিন বছর আগে কংজির এই বাড়ি তৈরি পর ম্যুরালটা উপহার হিসেবে তৈরি করে দিয়েছিলেন। যদিও ওল্ড চাও এখন আর গ্রামে নেই। সে গত বছর হয়ত উন্নত জীবনযাপনের আশায় হোক কিংবা আসন্ন বিপদের আভাস পেয়েই ছেলে এবং পুত্রবধূর সাথে নিয়ে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে শহরে নিম্ন শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য তৈরি করা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ওঠে। আর কংজির বাম দিকে হলো রান্নাঘর। যার প্রবেশপথের পাশে দেয়ালে ঝুলছিল শিশুদের অল্প বয়স থেকে আর্দশ ও ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য বহুল প্রচলিত কনফুসীয়বাদের ও থ্রি ক্যারেক্টার ক্লাসিকের স্ক্রোল আর একটা বির্বণ হয়ে আসা ফ্রেমে বাধা ছবি। যেখানে কংজি ও মেইলি হানিমুনের সময় হাতে হাত রেখে বেইজিংএর টিয়ানানমেন স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে আছে আগামী দিনগুলোকে সুন্দর করে জীবন যাপনের আশায়। যেই ছবি এখন তাদের কাছে শুধুমাত্র অতীতের একটা দূরবর্তী স্মৃতি বাদে কিছুই না। আর তার ডানদিকে আছে একটা ছোট ঘর। যেটা হলো নান্নানের রুম। রুমের এক কোণে একটা বিছানা আছে। যার নিচে সার এবং শূকরের খাবারের বস্তাগুলো এলোমেলোভাবে স্থুপ করে রাখা আছে। আর এই বস্তাগুলোর নিচে লুকানো আছে একটা গোপন ডাগআউট যা কিনা মাটির নিচে তৈরি করা একটা গোপন কুঠুরি। কংজি নিজের হাতে মাটি খুঁড়ে তৈরি করেছিল এই গোপন কুঠুরি। মেইলির শেষ আশ্রয়। যেদিন তার গর্ভ আর লুকানো যাবে না, সেদিন এই গর্তেই তাকে ঢুকিয়ে রাখবে। অফিসারদের থাবা থেকে বাঁচানোর জন্য।।
“ওল্ড হুয়ান, জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রধান আজ মিটিং এ ছিল,” কংজি বলতে লাগল, তার কণ্ঠে আর আগের মতো উত্তেজনা নেই, গলা থেকে শব্দের বদলে ফিসফিসানি বের হলো। সিগারেটের জ্বলন্ত রক্তিম অঙ্গার যেন ম্লান আলোতে অশুভ ভবিষতের আশা দিচ্ছিল। সিগারেটের একটা গভীর টান দিয়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে দিতে দিতে বলতে থাকল,“এই কার্যক্রম পুরো দেশ জুড়েই চলছে। কোনো গ্রাম, কোনো পরিবার এই কার্যক্রমের বাহিরে থাকবে না। সর্বস্থরের সরকারি কর্মকতা এর সাথে জড়িত। আর অফিসাররা এমনকি তাদের প্রধানও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য চাপে আছে। আর আগামীকাল…” একটু থেমে বলতে থাকল, “গ্রামের প্রতিটি মহিলার জরায়ুতে, যাদের ইতিমধ্যে একটি সন্তান আছে, জোরপূর্বক আইইউডি ঢোকানো হবে।”
“আমি কিছুতেই ঐ আইউডি, নরকীয় তারের কুণ্ডলী, আমার ভেতরে ঢোকাতে দেব না!” মেইলির কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, তার হাত তার অজানন্তেই পেটের উপর চেপে ধরল।“বেচারি ইয়ান, ব্যথার কারণে সে কোমর সোজা করে কাজ করতে পারে না। যদি সে কষ্ট করে মাঠে কোনোভাবে উবু হয়ে কাজ করেও থাকে তবে কাজ শেষে করে কোমর আর সোজা করতে পারে না। প্রায়ই দাঁড়াতে গেলে ব্যথায় চিৎকার করে উঠে।” ব্যথায় কুঁজো হয়ে থাকা ইয়ানের পরিনত যেন চোখের সামনে ভাসতে থাকল, কালকের পর হয়ত তার নিজের অবস্থাও ইয়ানের মতো হতে পারে ভেবেই তার গা শিউরে উঠল।
কংজি মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকল, তার মুখে গভীর চিন্তা আর হতাশার ছাপ। “আর যদি তারা ওটা জোর করে ঢোকায়,” গলা থেকে শব্দের বদলে ফিসফিসানি বের হলো, “তবে… গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মেইলি, তুমি কালকে ঘর থেকে বের হবে না, তোমাকে লুকিয়ে থাকতে হবে। ঘরের ভেতরেই থাকবে, চার দেয়ালের ভেতরে নিজেকে বন্দী রাখবে, সবার অলক্ষ্যে দৃষ্টির সীমার বাইরে থাকবে। যদি কাল পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দরজা ধাক্কায়, তোমাকে অভিনয় করতে হবে, তাদের বিশ্বাস করাতে হবে। যেন তোমার অবস্থা জানার তারা আর জোর না করতে পারে। যদি এরপরও আইউডি লাগানোর জন্য জোর করে তবে তুমি নিজেকে তুমি বন্ধ্যা বলে দাবি কর, তুমি প্রথম সন্তান হওয়ার পর তোমার আর গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অভিনয় কর! অভিনয়! তাদের বুঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা কর। যদি তাতেও কাজ না হয় তাহলে শেষ অস্ত্র হিসেবে, অনুমতিপত্র দেখিয়ে ঘোষণা করবে যে তোমাকে দ্বিতীয় সন্তানের জন্য চেষ্টা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই তোমার আইইউডি লাগানোর দরকার নেই। আমার বাবা…” যোগ করল সে, চিন্তায় কালো হওয়া মুখে খানিকটা হলেও আশার আলো ফুটল, “এখনও পার্টিতে যথেষ্ট ক্ষমতা রাখেন, হয়ত নুওয়া দেবীর কৃপায়, তারা বিশ্বাস করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।”
“কিন্তু,” মেইলি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল, গলার স্বর প্রায় শোনা যায় না, ফিসফিসিয়ে বলল,“আমার ফোলা পেট…,” তার হাত স্বজ্ঞানেই পেটের নিচের দিকে গেল একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলতে থাকল, “তো এখন আর কোনোভাবেই লুকানো যাবে না ভালোভাবে তাকালে ঠিকঠিকই ঢোলা কাপড়ের নিচ দিয়ে ফোলা অংশ বুঝা যাবে। আর এই তো গতকাল সকালে, গ্রামের পথে যখন যাচ্ছিলাম, হঠাত করে শরীর খারাপ লাগায় রাস্তাতেই বমি করে দিলাম আর তখনই কুং দুফার বউ আমাকে দেখে। আমাকে কেমন সন্দেহের চোখে দেখছিল। যেন সে সব জানে।” মেইলি বলার পর তার টর্চের আলো নান্নানের দিকে ঘোরাল। নান্নানের ছোট শরীরটাকে বাহিরে দেয়ালের পাশে বসে থাকতে দেখল।
“তুমি একটা আহাম্মক!” কংজি চিৎকার করে উঠলো, “বোকা মেয়ে” উত্তেজিত হয়ে উঁচু গলায় বলতে থাকল, “সে যদি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়? এখন তো ওরা শুধুমাত্র তথ্য দিয়ে অপরাধীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য একশ ইয়ুয়ান পুরস্কার দেয়।” সে যখন দেখল নান্নান ঘরে ঢুকছে, পা টেনে টেনে তার দিকে এগিয়ে আসছে, তার গলা আর আগের মতো বড় করে রাখতে পারল না। “নান্নান, সোনা, এবার তুমি ঘুমাতে যাও, বেশিক্ষণ বাহিরে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
“আমার অনেক শিশি করছি, বাবা,” নান্নান তার ছোট পা মেঝেতে ছড়ানো তারগুলোর ওপর আলতো চাপ দিচ্ছিল নরম গলায় বিড়বিড় করে বলল, “আমি জল খাব।”
কংজি মুখ ফিরিয়ে নি। কোথাও কোনো আশার আলো সে দেখতে পাচ্ছে না। মেইলির ভয় ভরা চোখের দিকেও তাকাতে পারছে না। সে অসহায়, উত্তেজনায় হাত ছুঁড়ে মারছিল, গলা থেকে চাপা আর্তনাদ বের করছিল। “গর্ভপাত, বন্ধ্যাকরণ, আইইউডি!” তিনি বিড়বিড় করলেন, “এ কেমন দেশ? কোথায় যাচ্ছি আমরা? দেশটা আজ কোথায় যাচ্ছে? স্বয়ং কনফুসিয়াস, যিনি দুর অতীতে প্রাচীন চীনের বিস্তৃত সাম্রাজ্যের নৈতিক মেরুদণ্ড গড়েছিলেন, বলে গেছেন, পুত্র না রেখে যাওয়া হল সবচেয়ে বড় অপরাধ। কিন্তু এখন দেখ ২ হাজার বছর পর, আমি কংজি, তার ৭৬তম বংশধর, সেই অপরাধ করতে যাচ্ছি!”
“আমি কাল সকালে কোনোভাবেই ওই স্কুল নামক নরকের দিকে চোখও মাড়াতে চাই না,” মেইলি ফিসফিসিয়ে বলল, ভয়ে তার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। “আমি বরং মাটির নিচে তৈরি গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে থাকব।”
“তাতে কাজ হবে না। মা গ্রাম তো চেন? ঐ গ্রামের হতভাগা এক খরগোশপালনকারী পাক্কা দুই মাস মাটির নিচে লুকিয়ে থাকতে সম্ভব হয়েছিল,” কংজি বিষণ্ণভাবে বললেন। “কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! গতকাল তারা তাকে খুঁজে বের করেছে। তারা তাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে এনে, জোর করে বন্ধ্যা করেছে, তার ৩০০ খরগোশ বাজেয়াপ্ত করেছে। ভাবতে পারছ ৩০০ খরগোশ! একটা মানুষ কতটা নিচে নামলে এমন করতে পারে ভাবতে পারছ?”
বমি ভাব যেন মেইলির গলা পর্যন্ত উঠে এলো, এক জঘন্য, ধাতব স্বাদ মুখে। মেইলির বিষয়টা কল্পনা করতেই গা গুলিয়ে উঠল, বমি বমি ভাব আসছে। নাকে মুখে এক তীব্র তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ল। ভাবতে লাগল, এই অনুভুতি কি আসছে আসন্ন দিনগুলোর কথা চিন্তা করার থেকে নাকি নিজের ভেতরে থাকা শঙ্কা থেকে?
“দেখো, বাবা, আমার পেটও বড় হতে পারে!” নান্নান তার জামা তুলে নিজের ছোট পেট ফুলিয়ে দেখাল।
“বিছানায় এক্ষুনি যাও!” বাবা চিৎকার করে উঠল।
নান্নান কান্নায় ভেঙে পড়ল এবং মার দিকে ছুটে গেল, মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল, কোলে মুখ লুকাল। “বাবা ভালো না। বাবা পচা,” সে চিৎকার করে কাঁদছিল। “আমার নতুন বাবা চাই! ভালো বাবা চাই, পচা বাবা না!”
মা নান্নানকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, নিজের ভয়ের কথা ভুলে গেল, যেন নান্নানের কষ্টে সে ভয় ঢাকা পড়ে গেছে। কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেল। ভালো করে ছোট শরীরকে কাঁথা দিয়ে জড়িয়ে দিল আর যত্নের সাথে মাথায় হাত বুলাতে থাকল, চুল আঁচড়াতে শুরু করল, নরম, ছন্দময় হাতের ছোঁয়া যেন অন্ধকারে সামান্য সান্ত্বনা।
দূর থেকে সে তার মার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে তার মার গর্ভের দিকে। চেষ্টা করছে গর্ভে নিজের অস্তিত্ব খোঁজার জন্য। অপেক্ষায় আছে কোন দিন সে এই পৃথিবীর মুখ দেখবে। সে ক্রমেই কালের পরিক্রমায় সময়ের চাকার পিছনে গিয়ে, মা বাবার নয় বছরের ফেলে আসা পথ ধরে, স্মৃতির সরু পথ বেয়ে ফিরে আসে নিজ আলয়ে। যা কিনা একটা জীর্ণ কুঁড়েঘর। যা ছিল তার, মা মেইলির দ্বিতীয় সন্তানের ভবিষ্যৎ আবাসস্থল, জন্মস্থান। যেখানে সে জন্ম নিয়ে নয় বছরের ফেলে আসা জীবন পূনরায় উপভোগের জন্য অপেক্ষা করছে।
হঠাত করে সে দেখতে পেল ঘরের মধ্যে কিছু ছায়া যেন অন্ধকারে আলো আঁধারের খেলায় মেতে উঠছে।
তার মনে হতে থাকে ছায়াগুলো যেন কিছু একটা আভাস দিচ্ছে। সে বুঝতে পারে ছায়াগুলো খেলছিল না তা কাঁপছে, আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে। অনুভব করতে থাকে অতীতের কোনো এক হারানো প্রতিধ্বনি, বহুদিনের চাপা অনুভূতি, দুঃখ, কষ্টের ফিসফিসানি সব যেন এই বাড়ির ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছে। দূরে দেওয়ালের গায়ে লেগে থাকা বিবর্ণ মোজাইকের ভাঙা টুকরো যেন বারবার জানান দিচ্ছে অতীত ও ভবিষতের আসন্ন দিনগুলোর কথা। দিগন্তের ওপারে, আঙ্গিনায় যেন শূন্যতা গ্রাস করছে, একটা ঝুঁকে পড়া খেজুর গাছ আর ডালপালা বাদে আর কিছু নেই। যেন জানান দিচ্ছে আগত দিনগুলোতে কথা। ডালপালাগুলো আকাশের দিকে বাড়িয়ে দেয় তার নিঃসঙ্গ হাত যেন আকুল হয়ে প্রার্থনা জানাচ্ছে। যাতে ভবিষতে মুক্ত আকাশের নিচে প্রাণখুলে বাঁচতে পারে। যদিও এসব দৃশ্য মা বাবার চোখ পড়ে নি। অশরীরী আত্মা হওয়ায় শুধু তার চোখেই পড়ল…
যখন জানতে পারে মা দ্বিতীয়বারে মতো সন্তানের মা হতে চলছে, তখন তিনি প্রায়ই বলতেন ছেলে সন্তান হওয়ার আশায় বাড়ির আঙ্গিনায় খেজুর গাছ লাগিয়েছিলেন, আসন্ন সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনায় খেজুর গাছের নরম শিকড়ের নিচেপুঁতেছিলেন রক্ষাকবচ হিসেবে পুঁতেছিলেন একটা দীর্ঘায়ু লকেট। আর মা বলেছিলেন
খেজুর গাছ পোঁতার আগে নুওয়া দেবীর আর্শীবাদ লাভের জন্য গোপনে কুয়াশা-ঢাকা পর্বতের উপরে পবিত্র নুওয়া দেবীর গুহায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গভীর শ্রদ্ধার সাথে খেজুরগাছের পাতাগুলো গুহার ফাটলের উপর স্পর্শ করিয়েছিলেন। প্রার্থনা করেছিলেন যেন আগামী বছরগুলোতে, তার সকল সন্তান, যারা জন্মেছে এবং যারা এখনও জন্মেনি, এই গাছের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠে, নুওয়া দেবী যেন তাদের চিরকাল রক্ষা করে। আবার বাবা নান্নানের বিছানার নিচে গোপন কুঠুরিতে থাকা লাল সিন্দুকের কথা বলেছিলেন, যার মধ্যে আছে কনফুসিয়াসের এনালেক্টের প্রাচীন সংস্করণ যার মধ্যে আছে তার আর্দশ ও শিক্ষার সমাহার। আর আছে কং পরিবারের বংশতালিকা যার মধ্যে কং বংশের সকলের পরিচয় যত্ন সহকারে খোদাই করা আছে। কং পরিবারের ঐতিহ্যের আজ কিছু অবশিষ্ট না থাকলেও তাদের কালের সাক্ষী হয়ে সেই লাল সিন্দুক এখন ভাঙা বিছানা আর কুঠুরির শ্বাসরুদ্ধ করা ওজনের নিচে চাপা পরে আছে।
সে দেখতে পেল তাদের বিধ্বস্ত বাড়ির পেছনের ছায়ায় ঢাকা সরু পথের পাশে ভুট্টা ক্ষেত থেকে এক উইলো গাছ যেন জেগে উঠে। আর দূরে লাল দেয়ালের পিছনে দুটি পাশাপাশি ওসমান্থাস গাছ প্রহরীর মতো পাহাড়া দিচ্ছে আর পাশেই গ্রামের বাইরে যাওয়ার রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাছগুলো ফিসফিস করে কিছু একটা বলছে। আভাস দিচ্ছে কোনো এক অদেখা বিপদবার্তার।
(চলবে…)