পোস্টস

সত্তাশ্রয়ী

নানী - একটি স্মৃতি চারণ

১৯ জুন ২০২৪

জাকির সোহান

আমাকে নবী নূহের গল্প বলতেন নানী। ষাটগম্বুজের আযান ধ্বনির গল্প বলতেন। ইউছুফ নবীর গল্প বলতেন। খরগোশ কচ্ছপের গল্প বলতেন। রাজা উজিরের গল্প বলতেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন গল্প বলতেন। জোলার গল্প,তাঁতির গল্প,  টোনাটুনির গল্প, হাজারো গল্প বলতেন আমাকে। তার গল্প শুনতাম অপার রহস্য নিয়ে। সেই ছোট্টবেলা থেকে নানীর সাথে হেঁটে যেতাম পারুলিয়া থেকে গোপালঝাড়। লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা থানার পারুলিয়া গ্রামে আমার নানার বাড়ি আর নীলফামারীর  জলঢাকা উপজেলার  গোপালঝাড় গ্রাম হচ্ছে নানীর বাবার বাড়ি।

এমনকি নানী আমি আর নানীর মা; তাকে আমি ডাকতাম বড়আম্মার সাথে  একজন দক্ষ গাইডের সাহায্যে হতো এই যাত্রা। সকাল সকাল বের হতাম। হাঁটতে হয় তিস্তার চর, চরের চকচকে বালি, একেক জায়গায় একেক রংয়ের বালি। বালি দেখে ছুটাছুটি করতাম। বালি শার্টের পকেটে রাখতাম। এত রংয়ের বালি দেখে বিস্ময় বাড়তে থাকে। বালি রাখার জন্য জুতো খুলে জুতোর মধ্যে রাখতাম। নানী হাসতেন আমার কাজ দেখে। নদী পার হতাম ছোট -বড় নৌকায়। আবার হাঁটা। মানুষের বাড়ির পাশ ঘেষে পথ করে নিতে হতো।  পথের মাঝে অনেকে নানীকে চিনতেন- জমশের মাস্টারের বউ বলে। আর নানীর সব রাস্তাঘাট মনে থাকত। সে সময় তার বাবার বাড়ি যাতায়াতের সহজ এবং আরাম দায়ক উপায় ছিলো-হাঁটা।

নানীর কাছে আমি টানা তিন বছর ছিলাম। পড়েছিলাম সেখানকার স্কুলে এইট-নাইন-টেন। এছাড়াও আব্বুর পেশাগত কারনে যেখানেই থাকতাম না কেন, বেশিরভাগ ঈদের সময় নানীর কাছে চলে আসতাম আমি কারো না কারো সাথে। আব্বু-আম্মুর সাথে যত ঈদ করেছি তার চেয়ে বেশি ঈদ করেছি নানীর সাথে।

আমরা যখন রংপুরের লালদিঘীরহাট, খোলাহাটি বা অন্য কোনো জায়গা থেকে নানীর কাছে আসতাম ট্রেনে বেশির ভাগ সময় মধ্যরাত হয়ে যেত।  
ট্রেনের শব্দ / হুইসেল শুনে মেজ মামা চলে আসতেন স্টেশনে। নানী হোক সেটা শীত, গীষ্ম, শরত ঘুমাতেন না আমাদের অপেক্ষায় থাকতেন। আর সেই সময়ও  আমার জন্য রেডি থাকত পছন্দের দুধভাত।

নানী অত্যন্ত প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তার তিন ছেলে পাঁচ মেয়ে। নাতী নাতনীর মধ্যে আমি সবচেয়ে বড়। নানীর বাড়িতে নাতী নাতনীর মধ্যে  একমাত্র আমার জন্ম তার বাড়িতে তার ঘরে, এমন কি আমার নাড়ি পোতা তার ঘরে। সবচেয়ে আমি তার সান্নিধ্য পেয়েছি বেশি। কথায় কথায় তিনি বলতেন, তোর নাড়ি পোতা আমার ঘরের কোনায়।

মেজ মামা কভিড পজেটিভ হওয়ায় তীব্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভাগ্যিস নানী তখন রংপুরে ছোট আন্টির বাসায়। ১৪ দিনের মাথায় মেজ মামাকে ডাক্তার দ্বিতীয়বার কোনো টেষ্ট না করেই ফোনে জানায়, আপনি এখন থেকে কভিড নেগেটিভ।  অতএব এখন আপনি স্বাধীন। শারীরিক অসুস্থতা তখনও সাড়ে নি। শুধু 'নেগেটিভ' হওয়ার খবরে তিনি সবখানে যেতেন। ফলে নানীও বাড়িতে চলে আসে। একদিন বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় মামার ফের জ্বর আসে। মেজ মামা আবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদিকে সুস্থ নানী ফজরের নামাজের জন্য ওযু করতে গিয়ে  বাথরুমে পড়ে যায়।  এরপর থেকে নানান জটিলতার শুরু ।  ২ সেপ্টেম্বর রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হসপিটালের  ইমার্জেন্সি ইউনিটে ভর্তি করা হয়, অবস্থার অবনতি হওয়ায় ৩ তারিখে ICU -তে ভর্তি করা হয়। 
ওদিকে মেজ মামার অবস্থা আরো খারাপ। ৪ তারিখে তাকে নিয়ে আমি রংপুরে আসি। একই হসপিটালে দুই রোগী। থেকে থেকে কাঁদছে সবাই।  মামার নানা রকম টেষ্ট করা হয়। ৫ তারিখ রাতে ডাক্তার বলেন, মামা আবারও কভিড পজেটিভ। ফুসফুস বেশ সংক্রমিত। কভিড ভ্যাকসিনের ডাবল ডোজ কমপ্লিট থাকায় কিছুটা রেহাই পাচ্ছেন। মামা বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

আর নানী  এখনো ICU-তে।  

লাগাতার পরিশ্রমে ক্লান্ত কাজিন তারেক, ফারহান, শাহরিয়ারদের ছুটি দিয়ে  আজ  সকাল   থেকে হসপিটালে আছি আমি।

কিছুক্ষন আগে ডাক্তার উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ারএ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা নিয়ে  যাওয়ার কথা বললেন।  

সব সুনশান পরিবেশে সম্মুখে ক'জন ICU তে ভর্তি পেশেন্টের আত্মীয়র বুকচাপা মৃদু ক্রন্দনরোল ভাসছে,  মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে,  ডিউটিরত ডাক্তার-নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের যাতায়াত।

নানী আমাকে উৎসাহ দিতে সবসময় বলতেন, দোয়ার জোরে ডাঙ্গায় ডিঙ্গি চলে। তাঁর জন্য দোয়ার অনুরোধ রইল। কারণ এখন মিরাকল ঘটার অপেক্ষায়...

( বিঃদ্রঃ নানীকে বাড়ি আনার কিছু দিন পর তিনি মারা যান।)