পোস্টস

গল্প

জীবনবৃক্ষ

৪ জুলাই ২০২৪

মিলু আমান

(অধ্যায় ১) 

জীবনবৃক্ষ  

কেউ কখনও ভাবতেও পারেনি পৃথিবীর একদিন এমন পরিণতি হবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নে যদিও আজ পৃথিবী অনেক এগিয়ে, কিন্তু তা স্বত্বেও মানবজাতি দুটো দলে বিভক্ত। সাধারণ জনগণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুন্দর জীবন-যাপন করতে চায়। আর অন্যদিকে এক অশুভ চক্র নিজেদের হীন স্বার্থে প্রযুক্তির অপব্যবহার করে। সাধারণ মানুষ আজ নিপীড়িত।

অহংকারী শোষক শ্রেণী ক্রমশঃ মনুষ্যত্ব হারিয়ে অর্থ-সম্পদ-ক্ষমতার নেশায় ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে। জনগণের উপর শোষণের সাথেসাথে তারা স্বাভাবিক প্রকৃতিকে কলুষিত করতেও পিছ পা হয়না। ক্ষমতার নেশায় তারা এতটাই উন্মত্ত এখন যে প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। ফসল-খনিজ সব তাদের দখলে, সমুদ্র-নদী সব তাদের নিয়ন্ত্রণে। খাবার, বিশুদ্ধ পানি মেলে না সাধারণের ভাগ্যে। সমস্ত প্রাণীকূল আজ বিলীন। দুই মেরু যেন বরফগলা নদী। বাতাস বিষাক্ত, বুক ভরে কেউ নিতে পারেনা নিঃশ্বাস, অক্সিজেন মুখোশ ছাড়া বাইরে বেরুনো দায়। গাছপালা বন উজাড় করে জুয়াড়ীদের মত তারা নিজেদের জন্য গড়ে তোলে একের পর এক প্রাসাদ, সাধারণের নেই কোন অধিকার।

সমগ্র বিশ্বের সাধারণ মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করে সর্বশক্তি দিয়ে শেষবারের মত রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের দমাতে লেলিয়ে দেয়া হয় অতি-উচ্চক্ষমতাশালী রোবট। শুরু হয় এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞের অধ্যায়।

এবার জেগে ওঠে সব কম্পিউটার হ্যাকাররা। বেশ দক্ষতার সাথে স্বয়ংক্রিয় প্রায় সব রোবট বিকল করে দিতে সক্ষম হয় তারা। কিন্তু সেই বিজয় ছিল ক্ষণস্থায়ী। বিকট শব্দে রাজপথে একে একে নেমে আসে সব যুদ্ধের বহর। আকাশে ফাইটার আর বম্বিং প্লেন, রাস্তায় ট্যাংক আর কামান। শুরু হয় গোলাবারুদের যুদ্ধ, যার জন্য সাধারণ মানুষ একদমই প্রস্তুত ছিল না। গুলি বোমা ফুটছে যত্রতত্র। নিরীহ মানুষ মরছে প্রতিদিন লাখে লাখে।

না, শেষ রক্ষা বুঝি আর হল না। পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ এখন সম্পূর্ণরূপে শোষকশ্রেণীর হাতে। তারা ঈশ্বরকে ভয় তো পায়ই না, বরং নিজেদেরকে ঈশ্বর দাবী করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। বিশ্বাসীদের ওপর চলে তাদের নির্মম সব অত্যাচার। পৃথিবীর শুভ্র নীল আকাশ আজ ধূসর, পৃথিবী আজ প্রায় সবুজ শূণ্য, সূর্যের আলো আজ বিমর্ষ।

 

(অধ্যায় ২) 

পৃথিবীর গান 

রবিন  তার স্ক্রীনের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে, তার আঙ্গুলগুলো দ্রুত চলতে থাকে। সে এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে কিছু একটা করার। সে একজন দুর্ধর্ষ হ্যাকার, সাইবার-যুদ্ধে রোবটদের থামিয়ে ক্ষণস্থায়ী বিজয়ের সাক্ষী! শুধু তাই না, রবিন  ছিল এই সাইবার-যুদ্ধের মূল স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানের আর্কিটেক্ট। বিশ্বজুড়ে গোপনে ছড়িয়ে থাকা শত হাজার সাইবার- যোদ্ধা এখনও তারই পরবর্তী কমান্ডের অপেক্ষায়, কিন্তু এখন আর যেন কিছুই করতে পারছে না রবিন । নিজেকে বড় অসহায় লাগছে, ল্যাপটপটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও, কি মনে করে আবার বুকে জড়িয়ে ধরে। ক্রমেই বুঝতে পারে,ধীরে ধীরে সব কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিন  রাগে হতাশায় অসহায়ত্বে চীৎকার করে ওঠে।

নিজেকে একটু সামলিয়ে, ল্যাপটপে কি একটা ট্র্যাকিং করে রবিন । আজরার সাথে দেখা করা তার খুব প্রয়োজন। কাছেই একটা জায়গায় আজরার লোকেশন দেখাল। এটা একটা গোপন আস্তানা, যার কথা বিপ্লবী সুপ্রীম কমান্ডের হাতেগোণা কিছু সদস্য ব্যতীত আর কেউ জানেনা। ল্যাপটপটা দ্রুত ব্যাগে ভরে কাঁধে ঝুলিয়ে, অক্সিজেন মাস্কটা পরে নিয়ে সে সাম্প্রতিক এয়ার রেইডে প্রায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত একটা ভবনের বেসমেন্ট থেকে চুপিসারে বেড়িয়ে পরে। চোখকান খোলা রেখে খুব সাবধানে যেতে হবে।

আজরা একজন যোদ্ধা, সে একটা গেরিলা দলের কমান্ডার। আজরা আর রবিন  শৈশব থেকে একসাথে বড় হয়েছে। রবিন  আর আজরার বাবারা ছিল একে অপরের খুব কাছের বন্ধু এবং সহযোদ্ধা।রবিন  আর আজরা কিশোর বয়সেই তাদের বাবাদের হারায়, দুজনই শহীদ হন এক যুদ্ধে! তখন থেকেই তারা দুজন একজন আরেকজনের সুখ দুঃখের সাথী। পরবর্তীতে যা ক্রমশঃ প্রেমে রূপ নেয়, তারা একে অপরকে ভালবাসে।তাদের এখন দেখা হয় কদাচিৎ, যুদ্ধের জন্য এই ত্যাগ মেনে নিতে হয়েছে, কারন জয় যে তাদের ছিনিয়ে আনতেই হবে!

রবিনের  ভেতর একটা বিশ্বাস ক্রমেই বেড়ে উঠছে, তা হলঃ বহির্বিশ্বের কোন শক্তিই একমাত্র পারবে এখন এই পৃথিবীকে রক্ষা করতে। অশুভ শোষকদের সৈন্যবাহিনীর হাতে সাম্প্রতিক পরাজয়ের পর তার সেই বিশ্বাস এখন একমাত্র উপায় বলেই মনে হচ্ছে। শহরের শেষ প্রান্তে, একটা প্রাচীণ পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে একটা উঁচু ইমারত। আর তার উপর বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী স্যাটেলাইট, যা দূর মহাবিশ্বে সিগন্যাল পাঠাতে সক্ষম। একসময় এই রিসার্চ ল্যাব ঘিরে সবচেয়ে সেরা মাথাগুলোর ছিল অনেক প্রাণচাঞ্চল্য, কর্মব্যস্ততা। কিন্তু এখন তা ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতোই পরিত্যক্ত। রবিন  ঠিক করে সেখানেই যাবে। কিন্তু পাহাড়ের গোড়ায় কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী, আর সেটা পার হতেই আজরার গেরিলা দলের সাহায্য তার সবচেয়ে বেশী দরকার।

আজরা রবিনের  সব কথা শুনে বলে, “তাদের চেকপোস্ট আমরা গুঁড়িয়ে দিতে পারব। কিন্তু, তুমি ওই ইমারতের ভেতর ঢুকবে কি করে? অনেক বছর ধরে তা তালাবদ্ধ পরে আছে…”

রবিন  তার ল্যাপটপটি দেখিয়ে বলে,”আমার সাথে এটা থাকলে যে কোন দুর্ভেদ্য লক আমি নিমেষেই হ্যাক করতে পারব। তারপর মৃদু একটা হাসি দেয় বলে, “সে নিয়ে তুমি ভেবো না”। আজরা রবিন কে জড়িয়ে ধরে বলে, “সাবধানে যেও!”

রবিন  বলে, “তুমি যা করছ তা আমার কাজের থেকে হাজারগুণ বিপদজনক! তুমি সাবধানে থাকবে, নিজের দিকে খেয়াল রাখবে।”

প্ল্যানমত দিন তারিখ ক্ষণ দেখে তারা যে যার আস্তানা থেকে বেড়িয়ে পরে। সারা রাস্তায় লুকোচুরি করে তারা পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছায়। পুরোটা পথ আজরার গেরিলা বাহিনী রবিন কে ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরী করে এগোয়। ওরা গন্তব্যে পৌঁছায়। রবিন কে পেছনে রেখে আজরা তার দলকে সিগন্যাল দেয়, সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। চেকপোস্টের সশস্ত্র প্রহরীরা এহেন অতর্কিত গেরিলা আক্রমণে একেবারেই অপ্রস্তুত হয়ে পরে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আজরা ইশারায় রবিন কে আসতে বলে। কাছাকাছি আসতেই আজরা শুধু বলে, “দৌঁড়াও”। রবিন  নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে একবার পেছনে ফিরে দেখে, আজরা বজ্রের মত শক্তি নিয়ে  একের পর এক শত্রু পরাস্ত করছে। গর্বে রবিনের  বুক ভরে ওঠে। সে সামনে এগোয়।

পাহাড়ের চুড়ায় রিসার্চ ল্যাবের সাথেই মহাকাশ কেন্দ্র, এখন অচল, পরিত্যক্ত। মহাবিশ্বের নতুন সব দিক উন্মোচন কিংবা গঠনমূলক যে কোন গবেষণা, কোনকিছুর চাকাই এখন আর সচল নেই। বৃহত্তর মানব-কল্যাণে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে শোষকদলের কোন মাথা ব্যথা নেই। তারা শুধু বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চায় মডার্ণ ওয়ারফেয়ারে তাদের ধ্বংসযজ্ঞে লাভ হবে এমন আবিষ্কারে! মহাকাশ কেন্দ্রের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। বিশাল ইমারতের এ মাথা থেকে ওমাথা আজ জনশূন্য, সদর-দরজা বিশেষ-কোড দ্বারা সীল করা। কিন্তু রবিনের  কাছে তা তো কোন বাঁধাই নয়, সে নিজে একটা সেইফ স্পটে লুকিয়ে, খুব দ্রুত কাঁধের ব্যাগ থেকে তার ল্যাপটপ বের করে। একটু পরেই তার চেহারায় খেলে যায় বিজয়ীর হাসি, মনে মনে বললঃ ৩-২-১…

সদর দরজাটা স্লাইড করে আস্ত্র আস্তে খুলে যেতে থাকে। ইলেকট্রনিক দরজাটা খুলে গেলেই রবিন হামাগুড়ি দিয়ে মূল ভবনের মধ্যে প্রবেশ করে। প্রায় সাথেসাথেই তার পিছে দরজাটা আবার লক হয়ে যায়। একটা নিকষ কালো অন্ধকার মুহুর্তের মধ্যেই গ্রাস করে ওকে। টর্চের আলোয় ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে ও। ল্যাপটপে থাকা এই বিল্ডিং-এর থ্রী-ডি ম্যাপ অসংখ্যবার স্টাডি করার মাধ্যমে সে আগেই জেনেছে কোন ফ্লোরের কোন রুমে কি; ওর টার্গেট - স্যাটেলাইট কন্ট্রোলরুম।অজানা আশংকায় দুলতে থাকা ওর মন বলছে, কন্ট্রোল প্যানেলের যন্ত্রপাতিগুলো এখনও ঠিকঠাক আছে তো?

প্যানেলে কয়েক নজর বুলিয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রবিন । স্যাটেলাইটের এনক্রীপ্টেড কোড সিকোয়েন্সগুলো ডিকোড করে তা হ্যাক করে ফেলে ও খুব দ্রুত। কিন্তু রবিনের  মাথায় কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছেঃ এই মুহুর্তটার জন্য অনেকদিন সে অপেক্ষা করে আছে, সম্ভাবনার সেই দুয়ার এখন তার হাতের মুঠোয়, অথচ, কি বলবে ও, ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করেই বা সাহায্য চাইবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারে না যেন সে। কয়েক মুহুর্ত অপলক স্ক্রীণের দিকে চেয়ে থেকে, একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিশন চালু করে। রবিন  হাঁটু গেড়ে বসে, সাহায্য চাইবার পরিবর্তে অনেকটা প্রার্থনার সুরে বিড়বিড় করে বলে উঠেঃ “অন্ধকারে, এই বদ্ধ ঘরে, পৃথিবী নিয়ে লেখা আমার এই গান; শুনতে কি পাবে কেউ কোনো দিনও, মহাশূন্যের কোথাও কোনো প্রাণ, পৃথিবীর গান।“

 

(অধ্যায় ৩) 

সত্যযোদ্ধা 

রবিনের  সাংকেতিক কোডে লেখা চিঠি ঠিকই পৌঁছে যায় মহাজাগতিক বুদ্ধিমত্তার কাছে। তারা পৃথিবী থেকে আসা সেই বার্তা গ্রহণ করে, ডিকোড করে মুহুর্তেই। রবিনের  প্রবল আকুতি ভরা ডাক আলোর গতি ছাড়িয়ে অবশেষে প্রাচীণ বুদ্ধিমত্তার কাছে পৌঁছে গেছে! 

আকাশ জুড়ে যেন বিদ্যুতের ঝলক খেলে যায়। একটা চোখ ধাঁধানো আলো ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আলোর উৎস থেকে তির্যক একটা রশ্মি পৃথিবীর বুকে এসে আছড়ে পরে। সেই তীব্রতায় রাস্তার সব বিদ্যুতের খুঁটি যেন কড়মড় করে উঠছে, সেই আলোর অপার্থিব মহিমায় ভেঙ্গে পড়া শহর যেনো প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। ধীরে ধীরে ধোঁয়াশা সরে যেন আকাশের সুপ্ত সুনীল আভা আবার বের হয়ে আসছে, সুর্যটাও যেনো জেগে উঠছে, আবার প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। হাজার লক্ষ ছায়াপথ পেরিয়ে আকাশের বুক চিরে অদ্ভুত আকৃতির স্পেইস শীপের বিশাল বহর নিয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে সত্যযোদ্ধারা। পাহাড়-চূড়োয় ল্যাবের বারান্দা থেকে তা দেখে রবিনের  চোখ ভিজে ওঠে।

আলোর তৈরি সত্যযোদ্ধাদের কাছে নেই কোন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। তারা তাদের নিজ নীল বলয়ের ভেতর থেকে আলোক রশ্মি ছুঁড়ে সম্মুখ-শত্রুকে  মুহুর্তেই ঘায়েল করতে সক্ষম। যারা নিজেদেরকে এতদিন ঈশ্বর ভাবত, সেই শোষকদল আজ সত্যযোদ্ধাদের মেধা-শক্তি-প্রযুক্তির কাছে একেবারেই অসহায় হয়ে পরে। তাদের কামান মিসাইল গোলাবারুদ সব নিমিষে হয়ে যায় ছাই। সত্যযোদ্ধারা সব অশুভ শক্তিকে বিলীন করে দেয়, শত চেষ্টা করেও তারা সত্যযোদ্ধাদের সামনে দাঁড়াতেই পারে না। দ্রুত অশুভ শক্তির সব বলয় ভেঙ্গে পড়ে। তারা সত্যযোদ্ধাদের কাছে পরাস্ত হয়। শোষণতন্ত্র থেকে পৃথিবী হ্য় মুক্ত।

 

(অধ্যায় ৪) 

সমাধি 

কিন্তু হায়!এই জয় আসে কঠিন মূল্যের বিনিময়ে। এই তাণ্ডবলীলায় পৃথিবীর সাধারণ (শুভ দলের) মানুষও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ন্যায়ের এই যুদ্ধে ঝরে যায় অসংখ্য সতেজ প্রাণ। অশুভ দলের পরাজয়ের পাশাপাশি গেরিলা যোদ্ধাদের অনেকী শহীদ হয় সত্যযোদ্ধাদের পক্ষে যুদ্ধ করে, কেউ বা হয় কোল্যাটারেল ড্যামেজ, যা যুদ্ধের এক নির্মম বাস্তবতা!

রবিন  নেমে আসে রাস্তায়। পৃথিবী যেন আজ এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় এখানে সেখানে পরে আছে বীভৎস, পোড়া গন্ধ ওঠা, বিকৃত শরীরের সারিসারি লাশ। রবিন  নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারে না। তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। রবিন  বিহ্বল হয়ে ওঠে, যেন সে কোন এক পরাবাস্তব জগতে এসে পড়েছে। রবিন নিজেকে একটু সামলে নিয়ে দ্রুত আবার আজরার খোঁজে বেড়িয়ে পরে। ট্র্যাকার কাজ করছে না। কিন্তু ও জানে কোথায় আজরাকে পাওয়া যাবে। আজরাকে অভিনন্দন জানাবে ও এখন।

পথে আসতে আসতে রবিন দূরে কোথাও একটা বাচ্চার কান্না শুনতে পায়। তীক্ষ্ণ সেই কান্নার শব্দ একটা অন্ধকার গলি থেকে ভেসে আসছে। রবিন সন্তর্পনে সেদিকে এগিয়ে যায়। খন্ডিত,ঝলসানো এক নারীদেহের পাশে ফুটফুটে একটা শিশু তারস্বরে কেঁদে যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে দারুণ ভয় পেয়ে গেছে। রবিন  মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয়। একেরপর এক ভয়াবহ দৃশ্য পাড়ি দিয়ে রবিন শিশুটিকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এসময় কাছেই কে যেন মৃদু স্বরে আকুতি করে উঠলঃ “পানি, পানি!”

রবিন  মেয়েটিকে তার কোল থেকে নামিয়ে, এগিয়ে যায় একটা বিধ্বস্ত ঘরের দিকে। মৃতপ্রায়, রক্তাক্ত একজন পুরুষ কাতরাচ্ছে, বিল্ডিং-এর বীম ভেঙ্গে পড়ে তার শরীরটাকে থেঁতলে দিয়েছে। রবিন  তার কাছে যেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তার হাতে হাত রাখল। মানুষটা রবিনের  দিকে একপলক চাইলো, এরপরেই মাথাটা সামনে ঝুঁকে পড়ল। রবিন  অন্ধকার থেকে ভয়ে কূঁকড়ে থাকা একটা বাচ্চা ছেলেকে টেনে বের করে নিয়ে আসে। ছেলেটি শকে কোন কথা বলতে পারছে না। রবিন  ছেলেটিকে তার সাথে নেয়। তারা তিনজন পরের কয়েক ঘন্টা আরও অনেক পরাবাস্তবতার সাক্ষী হয়ে, হেঁটে সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী পাড়ি দিয়ে, শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় আজরার ডেরায়। রবিনের চোখ আজরাকে খুঁজতে থাকে।

কিন্তু এখানেও একই দৃশ্য, শুধুই লাশের ছড়াছড়ি। রবিনকে আসতে দেখে দূর থেকে একজন ছুটে আসে। রবিন  তাকে চিনতে পারে। সে আজরার দলেরই একজন ডেপুটি। ছেলেটি রবিনের কাছে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পরে, আর বলতে থাকে, “কমান্ডার আর আমাদের মাঝে নেই! চেকপোস্টের মিশন সফলভাবে শেষ করে আমরা ফিরে আসছিলাম। তোমাকে মেইন-গেটের ওপারে ঠিকঠাক ঢুকে যেতে দেখে আর লড়াইয়ে জয়লাভের পর আমরা সবাই এত ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম!কিন্তু তারপরই হঠাৎ ওরা আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে, নিশ্চয়ই হাই-টেক কোন সারভেইল্যান্স ড্রোনে আমাদের ট্র্যাক করছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদের আস্তানা ওরা খুঁজে পেয়ে যায়। শুরু হয় আরেক সম্মুখ যুদ্ধ!

আমরাও পাল্টা আক্রমণ করি, কিন্তু তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সাথে কিছুতেই পেরে উঠছিলাম না আমরা। সৈন্যসংখ্যাও বেশি ছিল তাদের। শেষ অব্দি আর উপায় না দেখে কমান্ডার আমাদের প্রাণ বাঁচাতে কোনরকম কভার ছাড়াই একা ছুটে  যান সামনে, আত্মঘাতী বোমা নিয়ে তাদের ট্যাংকের উপর যেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন! নিমিষেই সব শেষ...

ওরা এই যুদ্ধেও পরাস্ত হয়, আমরা হই বিজয়ী। কিন্তু কমান্ডার!!?” সে চোখের পানি মুছে বলে, “জয়ী আমরা আজ হলাম ঠিকই, কিন্তু হারালাম আমাদের পরম প্রিয়জন, আমাদের প্রাণপ্রিয় কমান্ডারকে!আর সেই সাথে অনেক কমরেডকে!”

রবিন কিছুতেই যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। না, এ কিছুতেই হতে পারেনা! সে মাটিতে বসে পড়ে! ডুকরে কেঁদে ওঠে। বাচ্চাদুটোও যেন কিছু বুঝে উঠতে পারেনা কি করবে। রবিনের গা ঘেঁষে দুজন জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। এরই মধ্যে আজরার গেরিলা দলের আরও অনেকেই ওদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সবার চোখে নোনা জল। ওরা রবিন কে ধরে ওঠায়, নিয়ে যায় আজরার কাছে। কেউ একজন বলে ওঠে, “কমান্ডার শেষ অব্দি লড়ে গেছেন। তিনি প্রকৃত মহাবীর, তিনি শহীদ!” ওরা সবাই আজরার উদ্দেশ্য একটা স্যালুট দেয়।

ওই তো আজরা! রবিনের ছোট্টবেলার খেলার সাথী আজরা!  ওর প্রাণের আজরা! সাদা কাপড়ে ঢাকা আজরার নিষ্প্রাণ দেহের খন্ডিত অংশগুলোর সামনে রবিন হাঁটু গেঁড়ে বসে, মুখ থেকে কাপড়টা সরায়। আজরার সুন্দর মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে, একটা পাশ কেমন ঝলসে গেছে। কিন্তু, তবুও কি পরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে আছে যেন!রবিন আর সহ্য করতে পারেনা। 

আজরার এই মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দোষী করে রবিন । আজরাকে নিয়ে ওরা সারিবেঁধে বেরিয়ে আসে খোলা আকাশের নীচে। ওপরে আকাশ মেঘে মেঘে ঢেকে যায়। শেষবারের মত আজরার কপালে চুমু খেয়ে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দেয় মাটিতে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইতে শুরু করে, কোথা থেকে যেন বুনোফুলের তীব্র সুবাস চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। বৃষ্টির ফোঁটা নেমে আসে ওর গাল বেয়ে নেমে আসা কান্নার জলের সাথে মিশে। রবিন  ভেজা চোখে বৃষ্টিভেজা দু’হাত আকাশের পানে তুলে আজরার জন্য, আজরার নিজের অজান্তে কৃত সব পাপের ক্ষমা প্রার্থনা করে। পৃথিবীকে শান্তি উপহার দিতে সৃষ্টিকর্তার ডাকে যারা আজ চলে গেছে তাদের সবার জন্য প্রার্থনা করে। ঝড়ো বাতাসের সাথে অঝোরে বৃষ্টি পরতে শুরু করে। কিন্তু সেসবের দিকে যেন কোন খেয়ালই নেই রবিনের , আজরার সমাধির পাশে সে ঠায় বসে রয়, একা।

 

(অধ্যায় ৫) 

রক্ষক

প্রলয়ংকরী যুদ্ধে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত পৃথিবীর মানুষের দিকনির্দেশনা দিতে মহাজাগতিক শক্তি একদল রক্ষক প্রেরণ করে, পৃথিবীর প্রকৃতি আর মানুষের পুণর্বাসনের জন্য, পৃথিবীবাসীদের সঠিক পথ দেখানোর জন্য। জীবনবৃক্ষ রক্ষা করার পাশাপাশি এই পৃথিবীকে তার চিরাচরিত শান্তিময় রূপ ফিরিয়ে দেয়াই ছিল তাদের মূল দায়িত্ব।

অপরদিকে,আজরা আকাশের পথে চলে যাবার পর থেকে রবিন  নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেটাকে আর মেয়েটিকে নিয়ে ও ফিরে যায় সেই পরিত্যক্ত মহাকাশ কেন্দ্রে। সেখানেই গড়ে তোলে তার নতুন আবাস। ওদের সাথে যোগ দেয় রবিনের  সাইবার সেনারা আর আজরার গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্বের একটা অংশ। মহাকাশ কেন্দ্রটাকে ওরা আবারো ঝকঝকে করে তোলে। এটাই ওদের নতুন হেডকোয়ার্টার এখন। 

কিন্তু রবিনের মনের গভীরে এখনও আজরা বাস করে, ২৪ ঘন্টাই তার উপস্থিতি রবিন অনুভব করে! আর, অনুভব করে এক অসহ্য, অব্যক্ত টানাপোড়েনের যন্ত্রণা, আর প্রচন্ড অপরাধবোধ। সে স্যাটেলাইট কন্ট্রোল রুমের উপরের চূড়ায় একাকী কাটায় দিনের একটা বড় অংশ। ওর টীমের লীডারেরা সবাই জানে ওর মানসিক টানাপোড়েনের ব্যাপারটা। জরুরী দরকার ছাড়া কেউ ওকে ডাকেও না। সারাদিন ও নিজেকে ব্যস্ত রাখে, স্বয়ংক্রিয় নানান আধুনিক যন্ত্র আবিস্কারে। এভাবেই অনেক ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর একসময় রবিন  তৈরি করে ফেলে বিশেষ ধরনের ড্রোন ক্যামেরা, যা খালি চোখে দেখা তো যাবেই না, বরং পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাডারকেও ফাঁকি দিতে সক্ষম। সেইগুলি রবিন  ছড়িয়ে দেয় সারা বিশ্বময়। রবিন  চাইলেই বিশ্বের যে কোন জায়গা যেকোন সময়েই মুহুর্তের মধ্যেই এসব ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে দেখতে পারে দূর দেশের মানুষ, জীবনযাত্রা, আবহাওয়ার গতিবিধি। এখনও সে সবাইকে জানায় না এই মহা-আবিষ্কারের কথা। 

রবিন ছেলেমেয়ে দুটিকে নিজের সন্তানের মতই মানুষ করার চেষ্টা করে। ছেলেটার নাম ও রাখে  ‘বিজয়’, আর মেয়েটার, ‘আজরা’। তারা দুজন বেশ ভাল ভাবেই সবার সাথে মিলে মিশে বেড়ে উঠছে। ওদের প্রতিদিনের সবচেয়ে প্রিয় সময় কাটে, রবিনের কাছে যখন ওরা খেলাচ্ছ্বলে নতুন নতুন প্রযুক্তির নানান কিছু শেখে।

সারাদিন নিজের গবেষনা নিয়ে অখন্ড ব্যস্ততা, বাচ্চাদের সময় দেয়া, মাঝেমাঝে তার টীমের ডাকে জরুরী ট্রাবলশ্যুটিং-এ সাড়া দেয়া - এতসবের পরও প্রচন্ড অস্বস্তিতে সারারাত ঘুমাতে পারে না রবিন , ছটফট করে বিছানায় এপাশ ওপাশ শুয়ে। এরপর উঠে যায়। রবিন এরপর সারারাত প্রার্থনা করে কাটায়। প্রার্থনা করতে করতেই দিনের শুরু হয়। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, এভাবেই কাটে ওর প্রায় নির্ঘুম জীবন!সবাই এখন রবিনকে তার গভীর দার্শনিক প্রজ্ঞা আর আধ্যাত্মিক চিন্তাচেতনার জন্য আরও অনেক বেশী সম্মান করে। 

এমনি একদিন ভোরের ঠিক আগে, প্রার্থনায় মশগুল রবিনের চোখ হঠাৎ বুজে আসে। আর সে খুব অস্বস্তিকর দুঃস্বপ্ন দেখে, মানসচোখে দেখে আগুনের হলকা ঝড়ানো প্রচন্ড বাতাসের শব্দে পৃথিবীটাই কাঁপছে যেন, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে তাণ্ডব! দেখে এক ভয়ংকর কালো ছায়া প্রবল বেগে থাবা মেলে ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে এগিয়ে আসছে ক্রমশঃ, যাতে পৃথিবীর প্রাণীকূল হবে বিলীণ! বুকটা ওর ধ্বক করে ওঠে, এক ঝটকায় প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে উঠে বসে ও. কপালে দুশ্চিন্তার রেখা, রবিন ভাবতে থাকে, এই অদ্ভুত স্বপ্নের অর্থ কি!

ওদিকে মহাজাগতিক শক্তি রক্ষক মোতায়েন করেছিল পৃথিবী রক্ষার কাজে। কিন্তু এই রক্ষকরাই একটা পর্যায়ের পর ঈশ্বরের আইন ভঙ্গ করে হয়ে ওঠে ব্যভিচারী। তাদের উপরে দেয়া দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে তার হয়ে ওঠে স্বেচ্ছাচারী। কোন নিয়মের বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে তারা মানবকূলের সাথে যৌনমিলন ঘটায়, ধর্ষনেও পিছপা হয়না। এভাবে একসময় জন্ম নিতে শুরু করে নতুন এক দানব প্রজাতির! তারা রক্ষক, মানুষ এমনকি একে অপরকেও হত্যা করে, ভক্ষণ করে মৃতদের শরীর! রবিনের  ড্রোন সারভেইল্যান্সেও এইসব ধরা পরে। রবিন  ভাবে কিছু একটা করা দরকার।

মহাজাগতিক পরম শক্তি যাদের উপর মানবজাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছিল, তারাই আবার মানুষের ধ্বংসের সূচনা করে। এমন অবস্থায়, ঈশ্বর ক্রোধান্বিত হয়ে রক্ষকদের কঠিন শাস্তি প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেন। পৃথিবীর কেন্দ্রে অন্ধকার গহবরে রক্ষকদের নিক্ষেপ করে, সেখানে শিকলবন্দী করে রাখেন। সত্তর প্রজন্ম তারা সেখানে আটক থেকে শাস্তি ভোগ করবে, জ্বলবে পুড়বে নরকের আগুনে।

এরও বেশ কিছুদিন পরের কথা।সময়টা ভোরের আগের, তখনো নিকষ কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ। রবিন সেদিনও প্রার্থনায় বসে, দু’চোখ বন্ধ ধ্যানমগ্ন। হঠাৎ সে এক মুহুর্তের জন্য আবারও দেখতে পায় সেই বিশাল অপার্থিব শক্তিকে, কিন্তু এবার তা অনেক স্পষ্ট। দেখে এক মহাপ্লাবণের রুপ নিয়ে আকাশ-সমান ঢেউ প্রচন্ড বেগে ক্রমেই এগিয়ে আসছে। কালো আকাশ, আগুনের হলকা, ভয়ানক ঝড়-বৃষ্টি আর মহাবন্যায় ক্রমশঃ তলিয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব!

রবিন ধড়মড় করে উঠে। স্যাটেলাইট রুমে গিয়ে এক্সট্রীম-সারভেইল্যান্স মোড অন করতেই দেখতে পায় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা এক অবিশ্বাস্য ঝড়-বৃষ্টিতে ঢাকা পড়েছে। তুষারাচ্ছন্ন পৃথিবীর সব পর্বত থেকে হিমবাহ পানি হয়ে নেমে আসছে সাগরে, ক্রমেই বাড়ছে পানি আর ঢেউ। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে প্রলয়ংকরী বন্যা, কোথাও সুনামীর পূর্বাভাস! সিসমোগ্যাফের রিডিং বলছে সব মহাসাগরের নীচে টেকটোনিক প্লেটে বড় কম্পনের আভাষ! রবিন তার সাথীদের ডেকে বিস্তারিত জানায়, সাবধান করে, বাকীদের জানাতে বলে। সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব প্রস্তুতি নিতে বলে।

অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই অবস্থার আরও অবনতি হল। রবিনের সারভেইল্যান্সে এখন বিশ্বের প্রতিটা কর্নারে বেড়ে যাওয়া পানির রাশি ছাড়া আর প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না! যেকোন মুহুর্তে ওদেরকেও ঘিরে ফেলবে এই আকাশসম জলরাশি, বুঝতে পারছে রবিন! স্ক্রীনটা অফ করে, কি যেন একটা মনে পড়ে যায় তার। ও দৌড়ে যেয়ে ওর বুক শেলফে অবিন্যস্তভাবে কি যেন খুঁজতে থাকে! শেল্ফের এক র‍্যাকের এলোমেলো অনেক বইপত্রের পেছন থেকে পুরনো দিনের ক্যাসেট প্লেয়ারের মত ছোট একটা ডিভাইস নামিয়ে আনে। ডিভাইসটা সে নিজে বানায়নি, বহুদিন আগে, সত্যযোদ্ধারা চলে যাওয়ার সময় এটা তারা তাকে দিয়ে গিয়েছিল।

অবাক কৌতুহলী দৃষ্টিতে বিজয় আর আজরা ছুটে আসেঃ “এটা কি, বাবা?”

রবিন  তাদের বলে, “এটা একটা ট্র্যান্সফর্মেশন ডিভাইস, যা পানিকে কাঁচে রূপান্তর করতে পারে।“

বিজয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “সেটা দিয়ে এখন কি হবে?”

রবিন  ইতস্তত করে উত্তর দেয়, “আমিও ঠিক জানি না। তবে এটা জানি, আমরা পানিতে অবরুদ্ধ হতে যাচ্ছি, পৃথিবী এই ভয়ংকর বন্যায় তলিয়ে যাবে। কিছু একটা করতেই হবে আমাদের। হয়ত এই ডিভাইসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে কোন সংকেত! আমাদের এখনি বেরুতে হবে!”

উত্তেজিত আজরা অনিশ্চয়তা জড়ানো কন্ঠে জানতে চায়ঃ “আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি, বাবা? এই উঁচু পাহাড়ের চূড়াতেই কি বরং আমরা নিরাপদ না?”

রবিন খুব শান্ত স্বরে বলেঃ “আমরা সাগর তীরে যাব মা।“

আজরা আর বিজয় এই উত্তরে বেশ অবাক হয়! এই অঝোর ঝড়বৃষ্টির মাঝে তারা সমুদ্রে যাচ্ছে কেন? কিন্তু রবিনের ওপর তাদের অগাধ বিশ্বাস! তারা আর প্রশ্ন না করে রবিনের সাথে নির্দ্বিধায় রওয়ানা দেয়।

 

(অধ্যায় ৬) 

মহাপ্লাবণ 

রক্ষকদের ভক্ষকে পরিণত হওয়া, আর দানবদের তান্ডবে একটা সময় মহাপ্লাবণ দিয়ে পৃথিবী নিঃশেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় মহাজাগতিক শক্তি। এই মহাবন্যা এমনই ভয়াবহ হবে যে, এতে মানুষ এবং দানব কোনকিছুই রেহাই পাবে না। পুরো দুনিয়াজুড়েই বিরামহীন মরণবৃষ্টি আর সব সাগর-মহাসাগরের পানি কেবল বেড়েই চলেছে।

প্রচন্ড দমকা বাতাস, সব নিয়ে যায় পারলে যেন। এর মধ্যেই রবিন, আজরা আর বিজয়কে নিয়ে  অনেকটা ঊর্দ্ধ্বশ্বাসেই দৌড়ে ছুটে চলছে সাগরের দিকে ।পথে রবিন তার অনুসারী যাকেই পেয়েছে, সবাইকে তার সাথে আসতে বলে। পুরো ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই তখন বাকবিহবল, কেউই ধীরস্থিরভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কি করবে, শুধু ছুটছে এদিক সেদিক, নিরাপদ কোন আশ্রয়ের সন্ধানে। এর মাঝে রবিনের ডাক শুনে অনেকেই সাথে সাথে ওর কথা বিশ্বাস করে ওর পিছে পিছে আসতে থাকে, আর কেউ কেউ কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়েও বাকীদের দেখে রবিনের সাথে যুক্ত হয়, আবার অনেকেই ভেবে নেয়, রবিন  নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে। না হয় এমন তাণ্ডবের সময় কেউ সাগরের কাছে যাওয়ার সাহস করে? তারা রবিনের  কথায় কান না দিয়ে এদিক সেদিক ছুটে। এদিকে ঝড় আর প্রচন্ড গর্জনে বজ্রবৃষ্টি বেড়েই যাচ্ছে, সেইসাথে সাগরের পানিও…

বাতাসের তীব্রতা উপেক্ষা করে বিশ্বাসীদের সাথে নিয়ে রবিন  এগিয়ে যেতে থাকে সাগরের দিকে। ধীরে ধীরে তারা সমুদ্রের কাছাকাছি চলে আসে। সাগর তখন ভয়ানক উত্তালরুপ ধারণ করেছে। বিশাল সব ঢেউ একের পর এক সাগরপাড়ে আছড়ে পড়ছে! তাই দেখে রবিনের  দলের অনেকেই পিছিয়ে গেল, উল্টোদিকে দৌড়ে ছুটে পালাল। কিন্তু রবিন  অটল, এতদূর এসে ফিরে যাবেনা। সে পিছে ফিরে তাকায়। অল্প কিছু বিশ্বাসী অনুসারী সহ সে দুই হাতে বিজয় আর আজরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সাগরের তীরের দিকে এগিয়ে যেতেই থাকে। ভারী ডিভাইসের বাক্সটা রবিনের কাঁধ থেকে চামড়ার বেল্টে ঝুলছে।

ঠিক যখন সমুদ্রের একদম কিনারে গিয়ে তারা পৌঁছাল, দেখে একটা আকাশের সমান উঁচু মহাবিশাল ঢেউ ফনা তোলা সাপের মত তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এই বুঝি তা আছড়ে পড়বে ওদের ওপর, সবাইকে নিয়ে যাবে অতল জলের গভীরে। ঠিক তখনই রবিন  সেই ছোট ডিভাইসটি বের করে সুইচ অন করে। আর ঠিক তখন অদ্ভুত কিছু একটা ঘটল! সময়টা যেন এক মুহুর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল! বাতাসের গর্জন আর কানে আসছে না কারো! আর, সেই প্রলয়ংকরী ঢেউও কাঁচের মত শক্ত হয়ে যায়, ধীরে ধীরে তা একটা কাঁচের রাস্তায় পরিণত হয়! রবিন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে সেদিকে চেয়ে রয়! বাকীরাও সম্মোহিতের মত তা দেখছে!

এবার রবিন পিছে ফিরে হাতটা তুলে ইশারা করে, সবার উদ্দেশ্যে ও বলে, “সবাই চলে এসো। তোমরা ভয় পেওনা। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করবেন।” রবিনের কন্ঠের মধ্যে স্পিরিচুয়াল একটা কিছু ছিল, সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত ওকে অনুসরণ করতে থাকে, শুধুমাত্র ওর প্রতি পুর্ণ বিশ্বাস রেখে। রবিন  সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যায় কাঁচের সেই পথ ধরে … এক অজানার উদ্দেশ্যে।

পৃথিবীর বুকে পানি কেবল বেড়েই চলল; ফলে যেখানে যত বড় পাহাড়-পর্বত থাকুক না কেন, সব একসময় ডুবে গেল। সমস্ত প্রাণীকূল বিলীন হয়ে গেল। এইভাবে পৃথিবীর সকল মানুষ আর দানব বিলীন হয়ে গেল।

এদিকে রবিন  তার অনুসারীদের নিয়ে কাঁচের রাস্তা দিয়ে পার হতে থাকে। দুরে একটা উজ্জ্বল আলোর দিশা দেখা যায়, দেখে মনে হয় একটা গেইটের মত যেন। সেদিকে দ্রুত এগোতে থাকে ওরা, কাছে যেতে যেতে বুঝতে পারে সেটা আসলেই একটা প্রবেশদ্বার। সবাই একে একে সেটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়, আর শেষ মানুষটা, রবিন, সেই গেইটের ওপাশে প্রবেশের পরমুহুর্তেই কাঁচের রাস্তাটা আবার পানি হয়ে যায়, বিশাল এক ঢেউ হয়ে কানফাটানো গর্জনে আছড়ে পড়ে সাগরের বুকে। আর তার ঠিক তার পরপরই সাগরের সমস্ত পানি উঠে আসে পৃথিবীর বুকে।সমস্ত দুনিয়ার স্থলভাগই ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে এই মহাপ্লাবনে। কোথাও কোন সবুজের রেশ নেই আর, পুরো পৃথিবী গ্রহটাই একটা বিশাল বড় ঘন নীল বুদবুদের আকার ধারণ করে।

 

(অধ্যায় ৭)  

আজরাঈল 

রবিন শেষবারের মত ফিরে পৃথিবীর দিকে তাকায়, আর দেখতে পায় সমগ্র আকাশ জুড়ে এক কালো মেঘের চাদর, আকাশ থেকে যেন তা নেমে আসছে কালো এক ভয়াল ছায়া হয়ে!

মৃত্যুদূত আজরাইল নেমে আসে সাত আসমান থেকে। সৃষ্টিকর্তার আদেশে আজরাঈল একে একে কেড়ে নিতে থাকে পৃথিবীর বুকের শেষ প্রাণটিও। তাঁর শীতল মৃত্যুছোবল থেকে মানুষ-দানব কেউই রেহাই পায় না। এভাবেই মহাজাগতিক শক্তির আদেশে আজরাঈল তার কাজ করে যায় সৃষ্টির শুরু থেকে…অনন্তকাল…

 

পুনশ্চঃ

রবিনের প্রতি অবিচল বিশ্বাস রেখে তার অনুসারীরা কি কাঁচের পথ পেরিয়ে শান্তিময় কোন ঠিকানা খুঁজে পেল? তারা কি এই অজানা সফরে অন্য কোন পৃথিবীর সন্ধান পেল? অন্য কোন ডাইমেনশানে, বা অন্য কোন সময়ে পৌঁছে গেল? নাকি, অতল নীলে তাদেরও সলিল সমাধিই ঘটতে যাচ্ছে!?

 

(অসমাপ্ত)

 

 

গ্রাউন্ডফোর্স ব্যান্ডের “জীবনবৃক্ষ” অ্যালবামের ৭টি গান নিয়ে এই গল্পটি লেখা হয়। 

অ্যালবামটির গানগুলো লিংকে শুনতে পারেন  

youtube.com/playlist?list=PLNzwLJlANrfAlJLw11dqhlaOorUTHs1rn&si=uhnsATA_tUhozU2Z