বঙ্কিমচন্দ্রের 'দুর্গেশনন্দিনী' এর বিরুদ্ধে প্ল্যাজিয়ারিজমের গুরুতর অভিযোগ উঠেছিলো। সেই সময় বলা হয়েছিলো যে স্যার ওয়াল্টার স্কটের 'আইভ্যানহো' নভেল নকল করে বঙ্কিম তাঁর বিখ্যাত 'দুর্গেশনন্দিনী' লিখেন।
তৎকালিন বিভিন্ন বোদ্ধা ব্যক্তি বঙ্কিমের পক্ষে অবস্থান নেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় 'আইভ্যানহো' বাংলায় অনুবাদ করে ফেলেন বঙ্কিমকে কলঙ্কমুক্ত করার উদ্দেশ্যে।
মূল লেখক ওয়াল্টার স্কট সাহিত্যিক হিসেবে নিজ জীবনকালেই আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিপ্রাপ্ত হন। মজার ব্যাপার হচ্ছে তাঁর লিখা বিখ্যাত অনেক উপন্যাস সম্পর্কে তিনি নিজেই সন্দিহান ছিলেন। তাই রচনা করেছিলেন এসব নভেল বেনামে। ওয়েভার্লি নভেল হিসেবে এ সকল উপন্যাস এখনো পরিচিত।
মিডিয়্যাভাল ইংল্যান্ডের উপন্যাস 'আইভ্যানহো'। সহৃদয়, বীর রাজা রিচার্ডের প্যালেস্টাইন যু*দ্ধে অংশগ্রহনের সুযোগে তাঁর ভাই প্রিন্স জন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ১৬ শতকের ইংল্যান্ডে এরকম তীব্র দ্বন্দ্বে প্যাঁচে পড়ে যান ভূস্বামী স্যাকশস সেড্রিক, তাঁর পালক কন্যা লেডি রাওএনা, তাঁর অনুগত দাস গার্থ এবং আরেকজন দাস ভাঁড় ওয়াম্বা। জীবন-সংহারী বিপদ নেমে আসে একজন ইহুদী আইজাক এবং তাঁর কন্যা রেবেকার উপর।
প্যালেস্টাইনের যুদ্ধে উত্তরাধিকার-বঞ্চিত আইভ্যানহো অফ উইলফ্রেড গিয়েছেন। পিতা স্যাকসন সেড্রিকের সাথে আইভ্যানহোর মূল দ্বন্দ্ব-ই হলো রাওএনাকে নিয়ে। কারণ গোত্রগত রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে সেড্রিক চান রাওএনার সাথে এথেলস্টেনের বিয়ে হোক। কিন্তু আইভ্যানহো এবং লেডি রাওএনার মধ্যে সৃষ্ট অনুরাগ সেড্রিক স্যাকসনকে এতটা নিষ্ঠুর করেছে পুত্রের প্রতি।
উপন্যাসে মধ্যযুগের ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ধর্মীয় গোড়ামি, কুসংস্কার, গোত্রে-গোত্রে সংঘাত, যুদ্ধপারদর্শিতার ক্রিড়া, দাসপ্রথা, তৎকালে প্রতিজ্ঞার সুকঠিন মূল্য পরিশোধের ঘটনা ঘুরেফিরে এসেছে।
বিভূতিভূষণের অনুবাদে উপন্যাসটি আমার ভালো লেগেছে অনেক। সেই একটা হারিয়ে যাওয়া সময়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যুদ্ধ, বিভিন্ন গম্ভীর কথোপকথন, ঘটনার ঘনঘটার অনুপুঙ্খ বিবরণ সব মিলিয়ে পুরো মিডিয়্যাভাল ইংল্যান্ডের আবহ বিভূতির অনুবাদে বেশ উপভোগ্য এবং মানানসইভাবে ফুটিয়ে তুলা হয়েছে।
আইভ্যানহোতে মজার কয়েকটা সারপ্রাইজ আছে। একটি প্রতিযোগিতা এবং সেড্রিক স্যাকশনের ভয়াবহ বিপদে এগিয়ে আসেন ফিকশনের এক কিংবদন্তি ধনুর্ধর। এই তীরন্দাজের উপর বেইস করে ডিসি কমিক্সের গ্রীণ অ্যারোও কিংবা মার্ভেলে হক আইসহ বেশিরভাগ ফিকশনাল তীরন্দাজকে কোন না কোনভাবে প্রভাবিত করা হয়েছে।
আইভ্যানহোর নৈপুণ্য-উদার হৃদয়ের প্রকাশের পাশাপাশি ঐ ফিকশনের কিংবদন্তি তীরন্দাজের উপস্থিতি খুব ভালো লেগেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো পুরো উপন্যাসে আইভ্যানহো নিজেই আছেন অল্প সময়ের জন্য। এটি সম্ভবত রব রয় সিরিজের পঞ্চম বই। অবশ্য আগের কোন বই না পড়েও আইভ্যানহো ইজিলি পাঠ করা যায়।
আমি কোন রিভিউতে প্রোডাকশন কোয়ালিটি নিয়ে তেমন একটা বলিনা। তবে প্রতীকের এই বইটির প্রোডাকশন মান টপ নচ। ওয়াল্টার স্কটের অন্যান্য বইগুলো সময়-সুযোগ হলে পড়ে নিবো। 'আইভ্যানহো' এর অনুবাদকর্ম যেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরই জন্য ঠিক করা ছিলো।
বই রিভিউ
নাম : আইভ্যানহো
লেখক : স্যার ওয়াল্টার স্কট
অনুবাদক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ : আবু তৈয়ব আজাদ রানা
প্রথম প্রতীক প্রকাশ : অক্টোবর ২০২৩
প্রকাশক : প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
পরিবেশক : অবসর প্রকাশনা সংস্থা
জনরা : ঐতিহাসিক ফিকশন
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ