হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ঘুরতে ঘুরতে সেখানকার এক ছাত্রকে খুনের পরিকল্পনা করছিলাম আমরা। বিষ প্রয়োগে, গলায় তার পেঁচিয়ে, ছুরি দিয়ে, নাকি অন্য কোনোভাবে - কীভাবে তাকে খুন করলে ভালো হবে তার বিভিন্ন অপশন ভেবে দেখছিলাম। আর তখন নিজেকেও একটা প্রশ্ন করছিলাম। আনাকারেনিনা এটা কীভাবে করত?
তার মানে আমি আসলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম আজকের এই বহুসংস্কৃতির যুগে খুনের সর্বসম্মত ও সর্বগ্রহণযোগ্য পদ্ধতিটা কী? ট্রেনের চাকার নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরা? খুব সহজেই অন্যদের নজরে পড়বে সেটা। কোনো স্যান্ডউইচের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দেয়া? বেশ ঝুঁকি আছে তাতে। বন্দুক দিয়ে গুলি ছোঁড়া? না। বাতাস জোরে বইতে পারে, লক্ষ্য ব্যর্থ হতে পারে।
“সব পদ্ধতিরই সীমাবদ্ধতা আছে,” আমি বিড়বিড় করলাম।
মাফিয়া বসের ছেলেকে এই জনবহুল ক্যাম্পাসে সবার সামনে খুন করতে গেলে অবশ্যই সাবধান হতে হবে।
“বাতাসের বেগ প্রবল,” আমি যোগ করলাম। “তবে দ্বিতীয় গুলিটা ঠিকই লাগতে পারে, প্রথমটা হয়ত আশেপাশের কারো গায়ে লাগবে।”
“হ্যাঁ,” মিল্ট বলল। “খুব বেশি দূর থেকে গুলি করা যাবে না।” তার হাতে থাকা দুটো অপশনের কথা খুবই সংক্ষেপে বলল সে। “হাত খানেক দূর থেকে করতে হবে।”
“হাত খানেক দূর।” আমি তার সাথে একমত হলাম।
এগার বছর ধরে মিল্ট আমার কাজের সহযোগী। কাজ মানে খুন-খারাবি আর কি। এখন এই কাজটায় সে সহযোগী হয়েছে যাতে দুজন মিলে দেড় লক্ষ ডলার ভাগ করে নিতে পারি, এক দিনে। আর তাই আমরা দুজন হার্ভার্ডের মাঝখানে এসে দেখে যাচ্ছি কোন জায়গা থেকে আক্রমণটা করা যায়। আমাদের টার্গেটের সমবয়সী লোকদের সমাগম দেখছি।
“আর গোলমাল পাকানো,” আমি যোগ করলাম।
“না, না, না।” মিল্ট বলল। “গোলমাল করে পার পাওয়া যাবে না।”
সে জ্যামিতিক বিশ্লেষণ করছিল: ইটের দেয়াল, ব্যাকপ্যাক, কোণ, আলো-ছায়া - এর কোনো একটা আমাদের কুড়ি বছর বয়সী টার্গেটের জন্য হেল্পলাইন হিসেবে কাজ করতে পারে কি না দেখে নিচ্ছিলাম। আমার কাজ হলো মানবিক দিকগুলো দেখা। আমাদের আশপাশ দিয়ে যেতে থাকা ছাত্রছাত্রীদের আমি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। লালমুখো ছাত্র। কোরিয়ান ছাত্রী। বেঞ্চে বসে থাকা গোমড়ামুখো ছাত্রী। মন্থর গতির জগার। তারা আগামীকালের খুনটাকে কীভাবে দেখবে তা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। এখনও না ঘটা ঘটনায় তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে আমার তা জানা দরকার।
“গোলমাল আমি পছন্দ করি না,” মিল্ট বলল।
আমিও। কিন্তু আমাদের হাতে টার্গেট সম্পর্কে বেশি তথ্য নেই। শুধু এটুকু জানি যে ছেলেটা অর্থনীতির ক্লাসে ভর্তি হয়েছে, ক্লাশ হয় বুধবারে, সকাল এগারোটায়, হার্ভার্ডের ম্যাসাচুসেটস হলে। আমাদের এই বিল্ডিংটার পেছনেই।
“মাঝের মাঠটা পেরুতে হবে আমাদের,” আমি বললাম। “আসো, মাপটা নিয়ে নিই।”
আমরা নীরবে আঘাতের পরিকল্পনা করছিলাম। এমন আঘাত যাতে সংস্পর্শের পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই টার্গেট মারা যায়। তার মানে আঘাতটা করে আমাদের ভেগে যাওয়ার জন্য তাত্ত্বিকভাবে পাঁচ সেকেন্ড সময় হাতে থাকবে। তারপর পুলিশের নজরদারির এলাকা পেরিয়ে বের হয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের হাতে থাকবে ছয় মিনিটের মতো।
ছয় মিনিট।
পুরো সকাল আমরা এই সংখ্যাগুলো নিয়ে তর্ক করেছি, আর এই হিসেবটা পুরোই নির্ভর করছে আমাদের চারপাশের লোকজনের প্রতিক্রিয়ার উপর। আমরা গড়পরতা ছাত্রের খোঁজ করছি, আর তখন আমার নজর পড়ল সামনের সিঁড়িতে বসে প্রুস্তের কাব্য পড়তে থাকা মেয়েটির দিকে। কিংবা তার পেছনে যে ছেলেটা বসে ছবি আঁকছে তাকেও বেছে নেয়া যায়। আমরা আমাদের পরীক্ষাটা চালানোর জন্য একটা গিনিপিগ চাই। সেই গিনিপিগ যেন এখানকার বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
“ওই মেয়েটা,” একটা ফুলেল ড্রেস পরা মেয়ের দিকে তাকিয়ে মিল্ট বলল। “ওইটা তোমার টেস্ট কেস হতে পারে। যাও কথা বলে দেখো।”
“ওই মেয়েটা? না।”
“মেয়েটার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ওই ভালো হবে। মাইকেল ডেিনস রায়ানের চোখে তো ওকে ভালো লাগারই কথা।”
“আমরা এখানে পরীক্ষা করতে এসেছি। আর না, আমার বয়স ওর দ্বিগুণ।”
“হোক না কেন, তোমার বয়সের অর্ধেক, সাথে আরো সাত যোগ করে নাও। যাও হে। এসব মেয়েরা একইরকম। সামাজিকভাবে মৃত। তারা বইয়ের সাথে কাল্পনিক আলাপ চালিয়ে যেতেই পছন্দ করে।”
“আমি তা করব না।”
“হ্যাঁ, তুমি করবে না। নিশ্চয় তুমি এখন ফিসফিসিয়ে মবিডিকের সাথে কথা বলছ, আমার কথায় কান না দিয়ে।”
আমি ফিসফিস করছিলাম না। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা ভাবছিলাম। হয়ত আমাদের জন্য সৌভাগ্য - কিংবা দুর্ভাগ্য, যেভাবে দেখতে চান সেভাবেই বর্ণনা করা যেতে পারে সেটাকে।
“ওই যে আমাদের টার্গেট,” একটা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললাম। আমরা আশা করিনি ওকে এখানে দেখতে পাবো। “আর দেখো, ও একা না।”
আগামীকাল আমাদেরকে খুন করতে বলা হয়েছে গোরান সোভাগোভিক মেসিককে। তার বর্ণনা এরকম: বয়স কুড়ি বছর, লম্বা, এথলেটদের মতো শরীর, গলার স্বর উচ্চ। আর এখন সে আমাদের সামনে মাঠে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
“ওকে তো একাই দেখছি,” মিল্ট বলল।
“পেছনে দ্যাখো।”
“কই? আমি তো… পেয়েছি।” মিল্ট একটু দূরেই দুজন শক্তসবল লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। “হ্যাঁ, ক্রোয়েশিয়ান মাফিয়া। ওরা মজা দেখছে।”
মিল্ট বোঝাতে চাইছে ছেলেটার বডিগার্ডরা একটু দূরেই অবস্থান করছে। তার মানে ছেলেটা কারো সাথে মারামারি করুক এটা ওরা দেখতে চায়। দু:সাহসী কেউ এসে ছেলেটার গায়ে পড়ে ঝগড়া বাঁধালে তারা খুশি হয়। আর এখন আমাদের মনে হচ্ছে, ভালোই হলো, এখন আমরা সহজেই তাকে আঘাত করতে পারব।
সহজেই - যদি সে এখনকার মতোই আগামীকালও থাকে এবং আমাদের কথা শোনে।
গোরান তার ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটছে। তাকে দেখে ইউরোপের কোনো প্লেবয়ের মতোই মনে হচ্ছে।
“ভ্রনস্কি,” আমি বিড়বিড় করলাম।
“কী?”
ভ্রনস্কি, সেই পুরুষ যে আনা কারেনিনাকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে গেছে। লোকটা সুপুরুষ ছিল, শারীরিক গঠন আর চেহারা দেখিয়েই ১৮০০ সালের এক ভদ্রমহিলার সংসার তছনছ করে দিয়েছে। আমি এসব মিল্টকে বললাম না। আমি তার সারসংক্ষেপ বললাম। “এমন এক লোক যে সবসময় তার নিজের স্বার্থের জন্য কাজ করবে।”
“ম্যাসাচুসেটসের প্রত্যেক পুরুষই তাই করবে।”
“ওই ছেলেটা এমনভাবে তা করবে যা আমাদের কাজে লাগবে। তাকে আমি অনুমান করতে পারছি।”
মিল্ট জানাল যে আমি তাকে কখনো দেখিনি, আমি তার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। আরো বলল যে আন্দাজে আমি একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি; তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত না নিয়ে আমি এখন আন্দাজের উপর নির্ভর করছি। সে ঠিকই বলেছে, আমি আগেও এরকম করেছি, এখনও তাই করছি। আমার মন বলছে, কিংবা হতে পারে আমার কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার কারণেই আমি এটা ধারণা করতে পারছি: এই ছেলেটাকে খুন করা সহজ হবে না।