পোস্টস

বিশ্ব সাহিত্য

মিলেনাকে লেখা কাফকার অষ্টম চিঠি যেখানে দুইজন কথা বলছেন একে অন্যের অসুস্থতা নিয়ে

৫ জুলাই ২০২৪

ওয়ালিদ প্রত্যয়

মূল লেখক ফ্রানস্‌ কাফকা

অনুবাদক ওয়ালিদ প্রত্যয়

[মেরান, মে ১৯২০]

 

প্রিয় মিলেনা (হ্যাঁ, সম্বোধনটা দিন দিন ভারী হয়ে যাচ্ছে, যদিও টলমলে এই দুনিয়ায় এতটুকুই আঁকড়ে ধরে থাকা, পঙ্গুরা যেভাবে ক্রাচে ভর দিয়ে থাকে, কিন্তু যখন ওই ক্রাচটাই দিন দিন ভারী হয়ে ওঠে তখন আর কিছু করার থাকে না), জার্মানদের সাথে আমি কখনো থাকিনি। জার্মান আমার মাতৃভাষা এবং আমার কাছে ওটাই ন্যাচারাল, কিন্তু চেক ভাষাকে আমার অধিক আকর্ষণীয় মনে হয়, এই কারণেই তোমার চিঠি অগণিত অনিশ্চয়তাকে দূর করে দেয়; আমি তোমাকে স্পষ্ট দেখতে পাই, তোমার শরীরের নাচন, তোমার কোমল হাত, কি চঞ্চল, কি স্থির, যেনো সামনাসামনি দেখছি তোমাকে; এমনকি চিঠি পড়তে পড়তে আমি চোখ তুলে তোমার মুখের দিকে তাকাই— কি দূর্দান্ত দস্তান!— চারদিকে আগুন আর আমি আগুন ছাড়া কিছুই দেখি না। 

 

এসব তোমাকে সেই ‘নিয়ম’ এর প্রতি বিশ্বাস করতে প্রলুদ্ধ করবে যে নিয়মগুলোকে তুমি জীবনযাপনে ক্ষেত্রে বেছে নিয়েছো। মেনে নেওয়া এই ‘নিয়মকানুন’ নিয়ে তোমার দুঃখ পাওয়ার প্রয়োজন দেখি না, কেননা ‘নিয়ম মানবো না’ এটা অহংকার এবং আত্মশ্লাঘা বৈ কিছুই নয় (“সমস্ত দায় আমার”); যাই হোক, জীবনের যে যে পরিক্রমায় তুমি এসব ‘নিয়ম’গুলোকে নিরীক্ষা করে দেখেছো সেসব নিয়ে আর আলোচনার অবকাশ নেই, যে কেউ খুব চুপচাপ তোমার হাতে চুমু খেতে পারে। আমি তোমার ‘জীবনের নিয়ম’গুলোর উপর বিশ্বাস রাখি; কিন্তু এটা বিশ্বাস করতে পারি না যে নিয়মগুলো তোমার জীবনের উপর এতো চিরকালীন বর্বর, নির্মমভাবে নিষ্ঠুর হতে পারে, নিঃসন্দেহে পুরো ব্যাপারটাই ‘অন্তর্দৃষ্টি’, একটা নির্দিষ্ট পথের দিক নির্দেশকারী গভীর ইনসাইট, যে পথের কোনো অন্ত নেই। 

 

এর কোনো প্রভাব ছাড়াই, আমরা যে একটা উত্তপ্ত উনুনের মধ্যে বাস করছি এটা আমাদের জাগতিকতায় আবদ্ধ চিন্তা দিয়ে বুঝতে পারা অসম্ভব। আমি শুধু আমাকে নিয়ে বলতে চাই। আমরা যদি পুরো ব্যাপারটাকে একটা স্কুল এসাইনমেন্টের সাথে তুলনা করি, তাহলে তোমার কাছে তিনটা সাম্ভাব্য ওয়ে আছে আমার সাথে ডিল করার জন্য। যেমন ধরো, তুমি তোমার সম্পর্কে বলা বন্ধ করে দিতে পারো, এভাবে তুমি আমাকে ‘তোমাকে’ চেনার সৌভাগ্য আর তারচেয়েও আমার নিজেকে ‘চেনার’ আরো বড় সৌভাগ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত করতে পারো। সুতরাং, তুমি যে নিজেকে ঢেকে রাখবে— এই অনুমতি আমি দিচ্ছি না। তারপর তুমি আমার কাছ থেকে অনেককিছু লুকিয়ে রাখতে পারো কিন্তু অতিরিক্ত চকচকে করে উপস্থাপন করতে পারো অনেককিছুই, কিন্তু আমি যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে আমি সবটাই বুঝে ফেলতে পারি, বুঝেও আমি হয়তো একটা শব্দও করবো না, তবে মনে রেখো দুঃখ পাবো। সুতরাং এমনটা করার অনুমতিও তোমাকে দেওয়া হলো না। তোমার জন্য শুধু একটাই রাস্তা খোলাঃ তুমি নিজের ঠিকঠাক যত্ন নেবে। সত্যি বলতে কি, তোমার চিঠি এই বিষয়ে কিছুটা পসিবিলিটির আভাস দিচ্ছে। চিঠিগুলোতে প্রায়শই স্থিরতা এবং শান্তির কথা শুনি, অন্যান্য বিষয়গুলোর প্রতিও আমার সমান মনোযোগ থাকে (যদিও শুধু এই সময়ের জন্য) এবং ইদানিং চারপাশে ভয়াবহ অন্ধকার। 

 

তোমার স্বাস্থ্য নিয়ে যা বলেছো আমার পছন্দ হয়নি (আমার স্বাস্থ্য বেশ, সমস্যা একটাই— এই পাহাড়ি বাতাস ঘুমটা ঠিকঠাক হচ্ছে না)। ডাক্তারের চিকিৎসা আমার যুতসই মনে হচ্ছে না, হয় চিকিৎসাটা উপকারী কিংবা উপকারী নয়, এটা পুরোপুরিভাবে তোমার মনোভাবে উপর নির্ভরশীল। ডাক্তাররা আর বাকিসব মানুষের মতোই স্টুপিড, তাদের অভিনয় আরো বেশি বিরক্তিকর— তুমি ওদের সায় দিতে শুরু করলে ওরা আরো স্টুপিড হয়ে যায়, আর ডাক্তাররা তোমার রোগ নিয়ে যা বলেছে তা হয় অহেতুক নয় অসম্ভব। আর তুমি ভীষণ অসুস্থ হবে— এটা কোনোকালেই সম্ভব না। আসল প্রশ্নটা হলো— ডাক্তারদের সাথে কথা বলার পর থেকে তোমার স্বাস্থ্যের সত্যিই কোনো উন্নতি হয়েছে কি?

 

আমাকে আরো কিছু প্রশ্ন করার অনুমতি দাও— কেনো এবং ঠিক কবে থেকে তোমার হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই? আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ রাখছো না? (আমি মতে, যোগাযোগ রাখা উচিৎ, কেননা তুমি একবার আমাকে তোমার এক আত্মীয়ের ঠিকানা দিয়েছিলো যেখান থেকে তুমি প্রায়ই এটা ওটা পেতে, বন্ধ হয়ে গেছে নাকি?) চিঠিতে লিখেছো ভিনেয়ায় কত কত মানুষকে চেনো তুমি, তাহলে এখন কেউ পাশে নেই কেনো? 

তোমার লেখা রম্যপ্রবন্ধ আমাকে আর পাঠাতে চাও না, হয়তো তোমার মনে এই সন্দেহ যে, প্রবন্ধগুলো পড়লে তোমার যে ছবিটা আমি আমার মননে এঁকে রেখেছি তাতে দাগ পড়বে। বেশ, তোমার উপর আমি রাগ করলাম, ঘটনাক্রমে এই রাগ থাকাটা খারাপ কিছু না, তোমার প্রতি আমার যা যা অনুভূতি আছে সেসবের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য আমার হৃদয়ে তোমার জন্য না হয় একটু রাগ থাকুক। 

 

ফ্রানৎস কে