পোস্টস

গল্প

গাড়িটা যখন দার্জিলিং

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মাসুদ হোসেন

মূল লেখক সপ্তর্ষি রায় বর্ধন

অনুবাদক মাসুদ হোসেন

গাড়িটা যখন দার্জিলিং–এর খাড়াই পথে এসে মলের কাছে দাঁড়ালো তখন ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা বেজে গ্যাছে। সারা রাস্তায় মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু যাত্রাশেষের আধঘণ্টায় জাঁকিয়ে বৃষ্টি এল। শিলিগুড়ির ছেলে সুরেশের এসব রাস্তায় চলে অভ্যাস। সে ভরসা দিয়েছিল যতই আবহাওয়া খারাপ হোক, পাঁচটার মধ্যেই সে হোটেলে পৌঁছে দেবে আমাদের। কাদা–মাখা রাস্তার একপাশে গাড়িটা পার্ক করে সে অভয় দিল ‘আপনারা হোটেলের ভিতরে গিয়ে ওদের লোককে এসে মালপত্রগুলো নিয়ে যেতে বলুন স্যার। আমি আছি।‘ আমরা, মানে আমি, রঞ্জনা, পার্থ আর জয়শ্রী, একসঙ্গে ঢাল বেয়ে উঠে এলাম  হোটেল রজার্স স্টে’র রিসেপশনে। কাচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই ভেতরের উষ্ণতায় শরীর জুড়িয়ে গেল।

ম্যানেজার মিস্টার ব্রেগাঞ্জা কলকাতার লোক। মাঝবয়সী। একমুখ হাসি নিয়ে নিজের ঘর থেকে

বেরিয়ে এসে খ্যানখ্যানে গলায়  একটা ‘গুড ইভিনিং’ ছুড়ে দিলেন।পার্থ বলল ‘ইফ ইউ ক্যান প্লিজ টেল ইউর ম্যান টু কলেক্ট আওয়ার লাগেজ ফ্রম দ্য কার?” 

— “ওহ ইয়েস, হি মাস্ট হ্যাব গন বাই দিস টাইম।‘

বলতে বলতেই দেখি দুজন নেপালি ছেলে আমাদের তিনটে সুটকেস আর দুটো হ্যাবার স্যাক নিয়ে উপস্থিত, পিছনে সুরেশ। সে এসেছে গাড়ির ভাড়া বুঝে নিতে। আমি পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে বললাম, ভাই গুনে নাও একবার।

টাকা গুনতে গুনতেই সে আমায় চাপা গলায় বলল, স্যার এখানে কদিন থাকার প্লান আপনাদের? 

আমি একটু বিরক্তই হলাম তার এই প্রশ্নে। বললাম, কেন বল তো? দিন তিনেক আছি আমরা। 

“না স্যার, মানে যদি তার আগেও দরকার হয় জানাবেন। এই আমার ফোননম্বর।” এই বলে ঝটপট আমার হাতে একটা ছোট্ট কার্ড ধরিয়ে সে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল।

 

Rain

যাত্রাশেষের আধঘণ্টায় জাঁকিয়ে বৃষ্টিএল

দার্জিলিং এসে পৌঁছতে পারার আনন্দে ক্রমশ ভুলেই গেলাম সুরেশের কথা। এই রজার্স স্টে হোটেলটা পাহাড়ের গায়ে চারটে ধাপ কেটে বানানো। প্রথম ধাপে বেশ বড় রিসেপশন আর লবি। তার ওপরের দুটো ধাপে সব মিলিয়ে খান দশেক কামরা। একদম ওপরে কী আছে বোঝা গেল না। আমাদের তেতলায় দুটো ঘর। সামনে একফালি কাচে মোড়া বারান্দা। সেখানে চেয়ার টেবিল পাতা— আড্ডা মারার জন্য অনবদ্য।

জয়শ্রীকে অনেকক্ষণ দেখছি না। খোঁজ করতে জানা গেল সে তাদের ঘরে বাথরুমে ঢুকেছে। আমরাও নিজেদের ঘরে এসে জিনিসপত্র বার করে গুছিয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। বাথরুমে ঢুকে দেখি সেটা পেল্লায়, কিন্তু সেই অনুপাতে আলো কম। একটাই জানালা, সেটা বন্ধ। ভারি মিষ্টি একটা গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাবলাম রুম ফ্রেশনার দেওয়া হয়েছে বুঝি।

কিন্তু আমি নিশ্চিত এই গন্ধ কোনও বাজারচলতি রুম ফ্রেশনারের গন্ধ নয়। একধরনের পাহাড়ি লিলি ফুলের গন্ধ এটা। জানালা বন্ধ। অন্য কোনও ফাঁকফোকর চোখে পড়ল না। ঘরে ফিরে এলাম। সামনের বারান্দায় আলো জ্বলে উঠেছে। রঞ্জনা আমাদের জন্য মেনু কার্ড নিয়ে বসে। পার্থ ছবি তুলতে ব্যস্ত।

Mysterious lobby

ওপরের দুটো ধাপেসবমিলিয়েখানদশেককামরা।

খানিক বাদেই গরম গরম চিকেন পকোড়া, মোমো আর ধূমায়িত কফিতে ডুবে গেলাম আমরা। বাইরে বৃষ্টি বেড়েছে। ছাতা নিয়ে লোকজন চলেছে। ডানদিকে একটু চড়াই উঠলেই মল। বাইরের চলমান দৃশ্য দেখে এই হোটেলের ভেতরের নিস্তব্ধতার আন্দাজ মিলবে না। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। রিসেপশনে লাগানো ছবি দেখে জানলাম রজার কেন্ট নামে চা বাগানের এক ম্যানেজার তৈরি করেছিলেন এই বাড়িটা, ১৯০৪ নাগাদ, অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের এক বছর আগে। কেন্টের সঙ্গে কোম্পানির বনিবনা না হওয়াতে তিনি চাকরি ছেড়ে এই হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন। ইংল্যান্ড থেকে আসা মানুষজন এসে উঠত এখানে। সাহেব তাঁর সঞ্চয়ের টাকা লাগাতে কার্পণ্য করেননি। দিনের পর দিন একটু একটু করে সাজিয়ে তুলছিলেন হোটেলটা 

‘বুজলে, সারা বাড়িটা কিন্তু আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে‘, পার্থ বলল।

জয়শ্রীর নেশা হেরিটেজ। বলল, ‘বাড়িটার ওপরে একটা attic আছে, খেয়াল করেছ, মানে বাংলায়যাকেবলেচিলেকোঠা। সাহেবি বাড়িতে এ ধরণের attic থাকে আর তাকে ঘিরে থাকে  নানা কাহিনি।‘

জয়শ্রীর শেষ কথাটা আমার কানে লাগল।

— ‘কাহিনি বলতে?’

— ‘কাহিনি নানারকম, ওই যেমন হয় আর কী!’

 রঞ্জনা কফির কাপ হাতে নিয়ে প্রায় নিঃশব্দে একটা চুমুক দিল।

hot coffee

রঞ্জনা কফির কাপহাতেনিয়েপ্রায়নিঃশব্দে একটাচুমুকদিল

মোবাইল ফোনে চার্জ থাকলেও সিগনালের নামগন্ধ নেই। পার্থ ফোন ছাড়া থাকতে পারে না। এই মুহূর্তে সে হতাশ।

‘যাবে নাকি? একবার বাড়িটা ঘুরে দেখে আসি?’ আমি বললাম পার্থকে। জয়শ্রীর যাবার ইচ্ছে থাকলেও সে রঞ্জনার সঙ্গে আড্ডা দেবে বলল। পার্থ আর আমি বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। ডান দিকে ঘুরলে রিসেপশন। আমরা বাঁদিকে গেলাম।

এটা বাড়ির পিছনের দিক। বেশ খানিক আলো–আঁধারি। আসলে রিসেপসনের ঝকমকে আলোর পাশে বলেই হয়ত অন্ধকারটা চোখে লাগছে। যেখান দিয়ে হেঁটে এগুচ্ছি সেটা একটা একফালি করিডোর। দুপাশের দেওয়ালে দামি কাঠের প্যানেলে বেশ কিছু হাতে আঁকা ছবি টাঙানো।

আগে পার্থ, তার মোবাইলের আলো একটা ছবির ওপর পড়তেই চিনতে অসুবিধে হল না, এটা হল পাহাড়ের গায়ে রজার্স স্টে’র ছবি, ওপরের চিলেকোঠা সহ।

এক ঝলক ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটা জিনিস লক্ষ করলাম। আধো অন্ধকারেও চিলেকোঠাটা যেন বেশ উদ্ভাসিত। আর্টিস্টকে বাহবা না দিয়ে পারলামনাতারএইঅঙ্কনকুশলতার জন্য, কিন্তুমনেরমধ্যেআরেকটাখটকাওলেগেরইল।

curtain

অন্ধকার করিডোর যেখানে শেষ সেখানে ভারী পর্দা টাঙানো। চারদিকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ। 

‘এর পিছনে কী আছে বল তো‘? পার্থ প্রশ্ন ছোঁড়ে আমাকে। 

‘পর্দা সরিয়েই দেখা যাক না!’

দুজনে মিলে হাত লাগিয়ে পর্দা সরাতেই একরাশ ধুলো উড়ে এল। দুটো মোবাইল টর্চের আলোয় মনে হলো ভাঙাচোরা একটা রেস্তোরাঁ। কী বীভৎসভাবে পুড়ে গ্যাছে চারদিক। টেবিল, চেয়ার, বার কাউন্টার, দেওয়াল, কার্পেট ছাড়খার হয়ে গিয়ে তাদের কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। সিলিং থেকে ঝাড়বাতি, ইলেকট্রিক তার, পলেস্তারা খসে ঝুলছে চারদিকে। 

আমি আর পার্থ দুজনেই চুপ মেরে গেছি। একটা ঠান্ডা হাওয়া যেন ঘুরপাক খাচ্ছে ঘরটার মধ্যে আর তার সঙ্গে একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে ঢুকছে। সেই পাহাড়ি ফুলের গন্ধ!

‘চলে এস পার্থ‘, বলেই আমি পিছন ফিরলাম। খানিক এগিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে দেখি পার্থ নেই। দৌড়ে ফেরৎ গেলাম সেই রেস্তোরাঁর দরজায়। দেখলাম পার্থ কেমন অসার একটা দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সম্বিৎহীন অবস্থায়। হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে ওকে নিয়ে আসতে হল সেই মুহূর্তে।

ওপরে উঠে দুজনে কেউইআর ভাঙলাম না সেই ঘটনার কথা।

Mysterious room

দুটো মোবাইল টর্চেরআলোয়মনেহলোভাঙাচোরা একটারেস্তোরাঁ

রাতে খাওয়াদাওয়ার আগেই পার্থর জ্বর এল।

আওয়াজ শুনে বোঝা যাচ্ছে বাইরের বৃষ্টিটা এখন আর ইলশেগুঁড়ি নয়, বরং ঝমঝমিয়ে। পার্থকে বিছানায় শুইয়ে তার গায়ে একটা কম্বল আর একটা লেপ চাপা দেওয়া হয়েছে। রিসেপশন থেকে আমি গিয়ে একটা থার্মোমিটার নিয়ে এসেছি খানিক আগে। প্রায় ১০৩ ডিগ্রির কাছাকাছি জ্বর। জয়শ্রী তার মোবাইলে চেষ্টা করে চলেছে ডঃ রণজিৎ চৌধুরীকে ধরবার। রণজিৎ আমাদের প্রতিবেশী, ডাক্তার হিসাবে বেশ নাম করেছে সে। চিকিৎসার ব্যাপারে সেইই আমাদের ভরসা।

বার পাঁচেক চেষ্টা করেও লাইন পাওয়া গেল না। পালা করে আমরা এবার একে একে সবাই নিজেদের ফোন থেকে চেষ্টা করে চলেছি। একবার আমি বাইরের করিডোরে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজের মনে ফোনটা কানে নিয়ে কখন যেন একদম সিঁড়ির কাছে চলে এসেছিলাম। হঠাৎ নজর গেল নীচের দিকে, যেখানে সিঁড়িটা শেষ হয়েছে। একরাশ জমাটবাঁধা অন্ধকার সেখানে। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। চোখের ওপর ভেসে উঠল রজার্স স্টে’র সেই পুরনো ছবিটা, যেখানে চিলেকোঠার মধ্যে যেন আলো জ্বলে উঠেছে। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এলাম।

ঘরে ঢুকতেই একটা অস্পষ্ট গোঙানি। বুঝলাম পার্থর জ্বর বাড়ছে। জয়শ্রী একটা ছোট টিফিন বাটিতে জল নিয়ে একটা রুমাল ভিজিয়ে চেপে ধরল পার্থর কপালে। ঘরের মধ্যে একটা নিস্তব্ধতা। আচমকা বাতি নিভে গেল। লোডশেডিং! আর ঠিক তখনই বাথরুমের কাচের জানালাটার পাশ দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম একটা মানুষের ছায়া সরে গেল। দৌড়ে বাথরুমের দিকে যাব ভাবছি, কারেন্ট চলে এল, আর সেই মুহূর্তেই ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল জয়শ্রীর ফোন।

man's shadow

বাথরুমের কাচের জানালাটার পাশদিয়েস্পষ্টদেখলামএকটামানুষের ছায়াসরেগেল

— ‘হ্যাঁ রণদা, আমি ফোন করছিলাম। আমি, মানে আমরা দার্জিলিংয়ে। হ্যালো… শুনতে পাচ্ছ? আরে পার্থর ১০৩/৪ জ্বর উঠে গেছে সন্ধ্যা থেকে… কী? কী বলছ…? কী…”

আমার ইশারা দেখে জয়শ্রী দৌড়ে বারান্দায় চলে গেল। বাকি কথাবার্তা আমরা ঘরের ভিতর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম।— “আমরা তো ফিরতে ফিরতে আরও তিনদিন রণদা। ওহ, ওষুধ হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছ! ঠিক আছে। তুমি না আমার সঙ্গে পার্থর ফোনেও করে দিও— এখানে কানেকটিভিটির চ্যালেঞ্জ আছে…”

খানিকক্ষণের মধ্যেই ওষুধের নাম ইত্যাদি পাওয়া যেতে আমি গিয়ে ব্রেগাঞ্জার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলাম। ঘড়িতে দশটা বেজে গ্যাছে। এই বাদলা রাতে ওষুধের দোকান খোলা না পেলে আমার চেয়ে অনেক বেশি কাজেআসবে কোনও স্থানীয় মানুষ।এইজন্যইহোটেলের কোনওকর্মচারীর সাহায্য চাই। 

— “মিস্টার ব্রেগাঞ্জা, ক্যান ইউ প্লিজ ওপেন দ্য ডোর?”

ভিতর থেকে একটা অদ্ভুত খ্যাস খ্যাসে গলায় প্রশ্ন এল “হুইস দ্যাট?”

নিজের পরিচয় দেওয়াতে কাজ হল। কিন্তু খুট করে ছিটকিনি খুলে যে মানুষটা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি যেন এক অন্য মানুষ। গলার স্বর তো পাল্টে গেছেই , সেই সঙ্গে খানিক আগে আলাপ হওয়া হাস্যমুখ মানুষটাও যেন কেমন বদলে গ্যাছেন ।

পার্থর অসুস্থতার কথা বলতেই কীরকম একটা অদ্ভুত চাহনি দিলেন ‘ওহ, সো হোয়াট ক্যান আই ডু? ইউ ওয়ান্ট এ ডক্টর টু বি কলড?’

না তার আর দরকার হবে না। শুধু এত রাতে এই ওষুধগুলো জোগাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে, বুঝিয়ে বললাম আমি।

ক্যান ইউ প্লিজওপেনদ্যডোর?

ব্রেগাঞ্জা তার ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। আমি ভেজানো দরজার বাইরে। অস্পষ্ট একটা কথাবার্তার আভাস পেলাম। ব্রেগাঞ্জা আবার এলেন। “ধনু ইজ কামিং, হি উইল হেল্প ইউ।” আমি একটা ধন্যবাদ আর শুভরাত্রি জানাতেই খানিক আকস্মিকভাবে বললেন “রেস্ট অফ দ্য নাইট ক্লোজ ইউর রুম ডোরস ওয়েল, গুড নাইট!” 

কেন হঠাৎ এই কথাটা বললেন সেটা জিজ্ঞেস করবার আগেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

ধনু বেশ চটপটে আর করিৎকর্মা। আধঘণ্টার মধ্যে ঠিক ঠিক ওষুধপত্র কিনে নিয়ে এল। পাশের একটা দোকান থেকে গরম স্যান্ডউইচও বানিয়ে এনেছে সে। আমাদের অবস্থা দেখে খানিক মায়া হল বুঝি তার। কিচেন থেকে এক ফ্লাস্ক গরম জল করে নিয়ে এল, সঙ্গে কয়েকটা টি ব্যাগ ।

পার্থ চোখ বুজে আছে।কোনওরকমে তাকে ধরে তুলে ওষুধগুলো খাওয়ানো গেল।কারোরই সেরকম খিদে নেই। তাও প্রায় জোর করেই স্যান্ডউইচ আর ঘরে বানানো চা খেলাম আমরা তিনজন। 

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। সারাদিন ধকলের পর সবাই খুব ক্লান্ত। জয়শ্রীকে বললাম যদি রাতে দরকার হয় যেন আমাদের দরজায় টোকা  দেয়। আর সেই মুহূর্তে ব্রেগাঞ্জার কথাটা মনে এল, “ক্লোজ ইওর ডোর্স ওয়েল।” 

— “জয়শ্রী রাতে দরকার হলে ফোন করিস”, এই বলে গুড নাইট করে আমি আর রঞ্জনা প্রায় অন্ধকার বারান্দা দিয়ে হেঁটে এসে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়লাম। দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে একটা বিশ্রী ক্যাঁচ করে আওয়াজ হল।

medicine

ধনু বেশ চটপটেআরকরিৎকর্মা। আধঘণ্টার মধ্যেঠিকঠিকওষুধপত্র কিনেনিয়েএল।

ঘরে ঢুকেই অন্ধকার বাথরুমের দিকে নজর গেল। আমার আগেই রঞ্জনা গেল ফ্রেস হতে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আমি ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই আলো নিভে গেল হঠাৎ। মুহূর্তের মধ্যে নাকে এল সেই মিষ্টি ফুলের গন্ধ। এবার সেটার ঝাঁঝ খুব বেশি। মনে হল যেন আমার আশেপাশেই আছে গন্ধের উৎস।  নিমেষে দৃষ্টি গেল জানালার দিকে। এবার আরও স্পষ্ট দেখলাম সেই ছায়ামূর্তিটাকে। এবার সে স্থির, অপেক্ষমান। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি ঘরের আলো দিব্বি জ্বলছে।

সকালেঘুমভাঙলযখনতখনমেঘকেটেগিয়েনরমরোদউঠেছে।রাতটামোটামুটি নিরুপদ্রব কেটেগ্যাছে। পার্থরজ্বরকমলেওপুরোসুস্থনয়সে।আমরাঠিককরলামব্রেকফাস্ট করবখানিকদূরেকেভেন্টার্স-এরছাদেবসে।পার্থকে জিজ্ঞেস করাতেসেবেশখুশিইহল, কারণকেভেন্টার্সে খাওয়ারকথাসেকলকাতাথেকেইঠিককরেএসেছিল। এসুযোগহাতছাড়া করতেসেরাজিনয়মোটেই!

কেভেন্টার্স–এর ছাদে বসে এদিক ওদিক তাকালে বহু পুরনো বাড়ি চোখে পড়ে। দূরে আমাদের হোটেলের চিলেকোঠাও দৃশ্যমান। সেদিকে তাকিয়ে পার্থ খানিক আনমনা হয়ে যায়। ইংলিশ ব্রেকফাস্টের স্বাদ অসাধারণ। গরম কফিতে চুমুক দিতেই গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে। তাড়াতাড়ি পার্থকে নিয়ে আমরা ভিতরে চলে আসি।

keventers darjeeling

কেভেন্টার্স-এর ছাদে বসেএদিকওদিকতাকালেবহুপুরনোবাড়িচোখেপড়ে

দাম মিটিয়ে বেরুতে বেরুতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তারপরেই আকাশ পরিষ্কার। এই ফাঁকে আমরা একবার টুক করে মলেগিয়ে নাথমলের চা–এর দোকানে ঢুঁ মেরে এলাম। পার্থ চড়াই উৎরাই বেয়ে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়াতে হোটেলের ঠিক নীচে রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চে বসে খানিক দম নিতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পর আমরা উপরে উঠে আসতে মিস্টার ব্রেগানসা একঝলক হাসি দিয়ে একখানা জবরদস্ত ‘গুড মর্নিং‘ ঝাড়লেন!

কালকের রাতের কথা ভোলেননি দেখছি ।

— হাউ আর ইউ নাও মিস্টার পার্থ? শরীর ওকে? 

— “হ্যাঁ, মানে ইটস ওকে–ই বলতে পারেন আর কি।”

আমরাএখনরিসেপশনের লবিতেবসেআছি।জয়শ্রীআররঞ্জনাপালাকরেতাদেরমোবাইলফোনেছবিতুলেচলেছে।পার্থভারীবিমর্ষমুখে Gilian Wright-এরলেখা “The Darjeeling Tea Book”-এর পুরনোযেকপিটাবইয়েরতাকেরাখাছিলসেটানামিয়েপাতাউলটেপাল্টে দেখছে।  আমিসবেআনন্দবাজারের পাতায়উত্তরবঙ্গের বর্ষারগতিপ্রকৃতি নিয়েখবরেরদু’লাইন পড়েছি কিপড়িনি, ব্রেগানসা সাহেবএকটাঅদ্ভুতপ্রশ্নকরেবসলেন। “কালরাতেএমনিতেআরকোনওডিসটারবেন্স হয়নিআশাকরি? ইটওয়াজআপিসফুলনাইটআদারওয়াইস?”

পার্থযেকারণেইহোকপ্রশ্নটা শুনতেপায়নিআরআমিযখনএইপ্রশ্নের খানিকসূত্রবোঝারচেষ্টাকরছি, রঞ্জনাবলল “কালরাতেআপনাদের হোটেলে কি কোনওপার্টিছিল? অনেকরাতেখুবহইহইহচ্ছিল, যেমনপার্টিতে হয়েথাকেআরকি!” 

“হ্যাঁ ঠিক, আমিওশুনেছি। সঙ্গেকাচেরগ্লাস, প্লেট, ছুরিকাঁটাচামচনাড়াচাড়ার শব্দ।কিন্তুজানালার পর্দারফাঁকদিয়েতোকোনওমানুষজন চোখেপড়েনি।রাস্তাঘাটও  শুনশান…” জয়শ্রীবলেওঠে। 

“হোয়াট টাইম ওয়াসইটম্যাডাম?”

আমাদেরঅবাককরেদিয়েদুজনেইসময়টাবলেরাতআড়াইটের আশেপাশে। জয়শ্রীআররঞ্জনাও মুখচাওয়াচাওয়ি করে, কারণএইঘটনারকথাতারাসকালথেকেকেউকাউকেবলেনি! আমাকেবাপার্থকে তোনয়ই। 

ব্রেগানসা খানিকঅন্যমনস্ক হয়েদুবারটোকাদিলেননিজেরকপালে।

Party

কাল রাতেআপনাদের হোটেলেকিকোনওপার্টিছিল?

বিকেলপেরিয়েসন্ধেহতেইপার্থরআবারজ্বরএল। 

খানিকঅন্ধকার নামতেইরজারসস্টেজুড়েপ্রসারিত হলএকঅদ্ভুতনৈশব্দ। নীচেররাস্তাদিয়েচলেছেমানুষজ। একধরণের ব্যস্ততা, জীবনেরআভাস।আরঠিকতারপাশেএযেনএকচলৎশক্তিহীন, জীর্ণশীর্ণইমারত।ওপরেরদিকেতাকাতেবুঝলামবেশকুয়াশাহয়েছেআজ।আরেকটাজিনিসপ্রায় নজর এড়াতেগিয়েওএড়ালনা, দেখলামহোটেলের চিলেকোঠা খানিকআলোক-উদ্ভাসিত। হলদেটে মোমের আলোজানালার সার্সিবেয়েবাইরেআসছে।গতকালের মতোনাহলেওপার্থরজ্বররয়েছে। “এবারেরবেড়ানোটা যেনকীরকমবেরঙিনহয়েগেল…” রঞ্জনাই কথাটাবলল, “আমারনাএইহোটেলটায় আরএকটুওথাকতেভাললাগছেনা!”

“আমারও। দেখ, দিব্বিসুস্থমানুষটা এসেকেমনজ্বরবাঁধিয়ে বসল, অ্যান্ড নটফরএনিগুডরিজন,” জয়শ্রীবলে। 

কালসন্ধেবেলা থেকেআজএখনঅবধিঘটনাক্রম আমাকেওখানিকভাবিয়েতুলেছেবলাবাহুল্য। আমাদেরট্রেনের টিকিটপরশুরাতে।এখনওপ্রায়আটচল্লিশ ঘণ্টারধাক্কা। কীভেবেকলকাতার ট্র্যাভেল এজেন্টকৃষ্ণমৌলিককে ফোনকরলাম।শনিবারের বাজারেকৃষ্ণকে অফিসেপেয়েযাওয়াটাও কাকতালীয়। 

“দাঁড়ান দেখি কালদুপুরের ফ্লাইটের কীঅবস্থা…”

খানিকক্ষণের মধ্যেইআমারমোবাইলফোনেরবিবারদুপুরেবাগডোগরা-কলকাতাবিমানের তত্ত্বতালাশ চলেএল।রাতদশটায়যখনআমরাঘুমুতেগেলামতারআগেট্রেনের টিকেটক্যানসেল করেকালদুপুরের বিমানেআমাদেরকলকাতাফেরবারবন্দোবস্ত করেফেলেছেকৃষ্ণ।ব্রেগানসাকেও আমরাসেইমতোজানিয়েদিয়েছি। হঠাৎমনেপড়লগাড়িরড্রাইভার সুরেশের কথা।সেকীদরকারের

কথাবলেছিলসেদিন? সেকিবুঝেছিল আমাদেরনির্দিষ্ট দিনেরআগেইফিরেযেতেহবে? সাতপাঁচনাভেবেসুরেশকে ফোনকরতেইসেরাজিহয়েগেল।কালসকালেইসেচলেআসবেআমাদেরবাগডোগরা পৌঁছেদেওয়ারজন্য। 

মনেরমধ্যেএকটাভাবনাআরআশঙ্কানিয়েশুতেগেলাম।

কী ভেবে কলকাতার ট্র্যাভেল এজেন্টকৃষ্ণমৌলিককে ফোনকরলাম

তখনকটাবাজেজানিনা, দরজাধাক্কার আওয়াজেঘুমভেঙেগেল।জয়শ্রীর গলা।ঘুমেরমধ্যেপ্রথমেমনেহয়েছিলদূরথেকেডাকটাআসছে, কিন্তুরঞ্জনাধাক্কাদিতেইবুঝলাম, ডাকটাএসেছেআসলেদরজারওপারথেকে।আলোজ্বালিয়ে দরজাখুলতেইজয়শ্রীর ফ্যাকাশে মুখথেকেতিনটেকথাবেরুলযাশুনেআমারগাহাতপাঠান্ডাহয়েগ্যাছে। 

“পার্থ ঘরে নেই!” 

“সে কি!” 

রঞ্জনাআমারহাতচেপেধরেছে।  যেটাবোঝাগেলজয়শ্রীর কথায়, তাহল, খানিকআগেজয়শ্রীবাথরুমে গেছিল।পার্থবিছানায় ঘুমন্ত। কিন্তুবাথরুমথেকেফিরেএসেসেআর পার্থকে দেখতে পায়নি। সামনেরদরজাটাহাটখোলাছিল।একঝলকবারান্দার ওদিকেচোখযেতেদেখলামনিকষকালোঅন্ধকার জমাটবেঁধেআছেসিঁড়িরদিকটায়। মাথারমধ্যেবিদ্যুতের মতোখেলেগেল… তাহলেকী! 

আমিসামনে, পিছনেরঞ্জনাওজয়শ্রীনামতেশুরুকরেছিকাঠেরসিঁড়িবেয়ে।রিসেপশনের উল্টোদিকেসেইকরিডোর। কিছুদেখাযায়না।শুধুআমাদেরতিনটেমোবাইলফোনেরটর্চথেকেবেরনোআলোইতস্ততধাক্কামারছেকাঠেরদেওয়ালগুলোতে। 

“এখানে কী আছে?” জয়শ্রীজিজ্ঞেস করল।এইমুহূর্তে সেইপ্রশ্নের কোনওউত্তরনেইআমারকাছে।

Stairwell

নিকষ কালো অন্ধকার জমাটবেঁধেআছেসিঁড়িরদিকটায়

করিডোরের শেষেপৌঁছেআমারসারাশরীরকেঁপেউঠল।পার্থদাঁড়িয়ে আছেসেইপর্দাঘেরা রেস্তরাঁর সামনে।একহাতেপর্দাসরিয়ে  মন্ত্রমুগ্ধের মতোচেয়েআছেভিতরেরঅন্ধকারের দিকে।আমরাতিনজনেইচিৎকারকরেউঠেছি।বোঝাগেলনাপার্থআমাদেরউপস্থিতি টেরপেয়েছেকিনা।আমিপ্রায়ঝাঁপিয়ে পড়েওরহাতধরে হ্যাঁচকা টান মারলাম। জয়শ্রীআররঞ্জনাও ওকেধরেসরিয়েনিয়েএল।খেয়ালকরলামগোটাজায়গাটা ভরেআছেসেইপাহাড়িফুলেরগন্ধে। 

কোনওরকমে পার্থকে ঘরেএনেশোয়ানোহল।বেশভালোইজ্বর।ঘড়িতেতখনরাতআড়াইটে!  

কালরাতেরঘটনাসম্পর্কে আমরাআরকোনওআলোচনাকরিনি।পার্থকেও কিছুজিজ্ঞাসাবাদ করাটাঅর্থহীন। সুরেশঠিকসকালনটায়গাড়িনিয়েপৌঁছেগিয়েছিল রজারসস্টে’র সামনে। এখনআমরাপ্রায়জলপাইগুড়ির কাছাকাছি। পার্থগাড়িরসামনেবসেতারফোনথেকেগানবাজিয়েচলেছেএকেরপরএক। 

“ আমারকিন্তুবীভৎসখিদেপেয়েছেরে।তোদের?” দুদিনধরেকুঁকড়েপড়েথাকাপার্থবেশফুরফুরে মেজাজেবলেওঠে। 

“হ্যাঁ, আমারও। সময়আছে, একটুথামলেইতোহয়।” আমারনির্দেশে সুরেশএকটাবেশভদ্রস্থ দোকানেগাড়িদাঁড়করিয়েদ্যায়।খাওয়াদাওয়া শেষেদুটোপঁয়ত্রিশের প্লেনধরেআমরাকলকাতায় ফিরেএলাম। 

***

আজ১৪জুলাই, ২০১৭।প্রায়একহপ্তাহতেচললআমাদেরদার্জিলিং থেকেফেরার।অফিসেবসেখবরেরকাগজউলটোতেই ছোট্টখবরটাচোখেপড়ল।

“Mysterious death of  manager at Darjeeling hotel”… মিস্টার ব্রেগানসাকে গতকালসকালেমৃতঅবস্থায় পাওয়াগ্যাছেহোটেলরজার্সস্টে’র চিলেকোঠায়!