সকাল থেকেই রবি শংকরের মন খুবই খারাপ। যদিও সময় এখন তাঁর খুবই ভালো যাচ্ছে। তাঁর সেতারের মূর্ছনা ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে এখান পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে গেছে। উপমহাদেশের সঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করে, সবার মনের কুঠরিতে জায়গা করে নিতে রবি’র খুব বেশি সময় লাগেনি।
আর সে সব গল্প নিয়েই ছবি বানানোর কাজ চলছে, “রাগা” ডকুমেন্টারি। রবি শংকরের জন্ম থেকে শুরু করে, কী করে সঙ্গীত জগতে এলেন, পাশ্চাত্যের সাথে উপমহাদেশের সঙ্গীতের মেলবন্ধনে রবি শংকরের ভূমিকা, এই সবই তুলে দেখানো হবে ফিল্মটিতে।
ক্যালিফোর্নিয়ার বিগশুরের একটা বাংলোতে রবি শংকর অপেক্ষা করছেন, তাঁর বন্ধু জর্জের জন্য। তাঁকে নিয়েই আজ শুটিং হওয়ার কথা। বিটলস ব্যান্ডে থাকা অবস্থাতেই জর্জ হ্যারিসন, রবির কাছে এসেছিল সেতার ও ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিকেল মিউজিকে দীক্ষা নেয়ার জন্য। সে হিসেবে রবি, জর্জের গুরুও বটে! দুজনের পরিচয় আজ অনেক বছরের, তাঁরা এখন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
জর্জকে রবি অভ্যর্থনা জানায়, কুশল বিনিময়ের পর জর্জ প্রশ্ন করে, “রবি তুমি ঠিক আছো তো? তোমায় কেমন বিক্ষিপ্ত লাগছে...”
“ঠিকই ধরেছ বন্ধু,” রবি বলে ওঠেন। “আসলেই আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি।”
“কি নিয়ে এত চিন্তা করছো শুনি?”
“তুমি বুঝতে পারবে কিনা জানি না জর্জ, কখনও বাংলাদেশের নাম শুনেছ তুমি?”
“কোনো দেশের নাম?”
“হ্যাঁ, তবে এখনও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পায়নি। দেশটায় এখনও যুদ্ধ লেগে আছে। জানো আমিও এক বাঙ্গালী ঘরের ছেলে...”
“তাই নাকি? আমি তো জানতাম তুমি ইন্ডিয়ান।”
“তা তো বটেই। এই দেশটিও একসময় ইন্ডিয়ার অংশ ছিল। আচ্ছা, তুমি পাকিস্তানের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই?”
“হ্যাঁ, সম্ভবত ইন্ডিয়ার পাশের দেশ।”
“এক সময় ইন্ডিয়া, পাকিস্তান আর যে দেশে এই মুহূর্তে যুদ্ধ হচ্ছে, এই তিন দেশ মিলেই ছিল পুরো ভারতবর্ষ। ১৯৪৭ সালে, ইংরেজ শাসন আমল শেষে ভারতবর্ষ তিনভাগে বিভক্ত হয়ে তিনটি দেশে ভাগ হয়ে যায়। সঠিক তিনটি না, দুইটি দেশে। ভারত এবং পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান। যদিও পশ্চিম আর পূর্ব পাকিস্তানের মাঝে কিছুতেই তেমন কোনো মিল নেই। তবুও পশ্চিম পাকিস্তান পূর্বকে কঠোর শাসনে রাখে। এমনকি এই দুই দেশের ভাষাও ভিন্ন, আর যখন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্বে তাদের ভাষা কায়েম করতে চেষ্টা করলো, সেটা দেশের মানুষ মেনে নিল না। এরপর ১৯৫২-তে হলো ভাষা আন্দোলন।”
জর্জ রবির কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। অবাক হয়ে বলে উঠল, “ভাষার জন্য আন্দোলন! এরকম তো আগে কখনও শুনিনি...”
রবি একটু থেমে আবার শুরু করলেন, “হ্যাঁ, এটা সত্যিই একটা নজীরবিহীন অধ্যায় ছিল। এই ধরনের আন্দোলন আগে কখনও কোথাও হয়নি।
“পশ্চিম পাকিস্তান কক্ষনো পূর্বের বাঙ্গালীদের ভালো ভাবে নেয় না। পূর্বের প্রতি চলতে লাগলো পশ্চিমা আগ্রাসন আর কঠিন দুঃশাসন। তারই জের ধরে আজকের এই যুদ্ধ। চলছে অরাজকতা। দেশটা দিনে দিনে একটা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে। মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে।”
রবি হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “উফ! আমি আর ভাবতে পারছি না, জর্জ। যদি কিছু করতে পারতাম দেশটার জন্য।”
জর্জ একটু কিছুক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করলো, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, “একটা কনসার্ট আয়োজন করলে কেমন হয়?”
“কনসার্ট? সেটা করে কি লাভ হবে?”
“হ্যাঁ, আমরা কোনো মিউজিশিয়ান কোনো পারিশ্রমিক নিব না, সব টাকা যাবে বাংলাদেশের সাহায্যে। অ্যালবাম বিক্রির টাকাও সবসময় দেশটির পুনর্গঠনের কাজে দেয়া হবে।”
“বাহ! সাহায্যের জন্য কনসার্ট? এ তো দারুণ ব্যাপার।”
“এই বর্বরতার কথা সারা বিশ্বের মানুষকে জানিয়ে দিতে হবে, আর ‘বাংলাদেশ’ একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। সেটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।”
রবি আবার বলে উঠেন, “বব ডিলানকে বলতে পার। উডস্টক কনসার্ট করতে আসার পথে মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে বব তো আর নিয়মিত শো করছেই না।”
“হ্যাঁ, ববকে এবার অ্যাকোস্টিক পারফর্মেন্স করতে বলবো।”
জর্জ আবার বলে, “এরিককেও বলবো ভাবছি...”
“এত কিছুর পরও তুমি এরিককে বলবে?”
“আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য এত বড়ো মাপের একজন মিউজিশিয়ান হারিয়ে যাবে, এটা আমি মেনে নিতে পারছি না, রবি।”
রবি অবাক হয়ে বলেন, “তুমি মহান, জর্জ।”
জর্জ হ্যারিসন আর এরিক ক্ল্যাপ্টন অনেক পুরনো বন্ধু। সেই বিটলস আমল থেকেই তাদের পরিচয়। বিটলসের “ওয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপ্স” গানে এরিককে গিটার বাজানোর জন্য আহ্বান জানায় জর্জ। এইসময়ই এরিকের সাথে পরিচয় হয় জর্জের স্ত্রী প্যাটির। প্যাটির সাথে এরিকের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়। একসময় এই বন্ধুত্ব প্রণয়ে পরিণত হয়। এসবই জর্জের অগোচরে হতে থাকে। একসময় তারা জর্জের কাছে ধরা পড়ে যায়। এরিক মনে কষ্ট নিয়ে দূরে সরে যায়। সেসময় এরিকের এক বন্ধু তাকে একটা গল্প শোনায়। আরব্য রজনীর একটা গল্প, লাইলি–মজনুর প্রেম কাহিনি। গল্পটা এরিককে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। সেই গল্পে উৎসাহী হয়েই এরিক প্যাটিকে নিয়ে একটা গান লেখে “লেয়লা”। একটা অ্যালবাম করে, কিন্তু নিজের নাম ব্যবহার করল না, নাম দিল: ডেরিক অ্যান্ড দ্য ডমিনোস। এরপর সে নিজেকে স্বেচ্ছায় মিউজিক থেকে অনেক দিন বিরত রাখে। পরবর্তীতে জর্জের আহ্বানে প্রথমবারে মতো ফিরে আসে কনসার্ট ফর বাংলাদেশে।
কনসার্টের দিন ঠিক করা হলো, পহেলা আগস্ট। রিহার্সালের জন্য যথারীতি সবাই উপস্থিত হলেও এরিক আর বব আসেনি। জর্জ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।
কনসার্ট শুরু হয়ে যায়, প্রথমেই জর্জ, রবি শংকরকে পরিচয় করিয়ে দেন। রবি প্রথমেই উঠে সিতারে কিছুক্ষণ টুংটাং করলেন। দর্শক তা শুনেই করতালি দিতে লাগল। রবি শংকর বললেন, “যদি টিউনিং করাই আপনাদের কাছে এত ভালো লাগে, তাহলে আশা করছি আমাদের বাজানো আরও ভালো লাগবে।”
এই বলে তিনি শুরু করেন। বাংলা ধুনে সত্যিই সেদিন সবাই বিমোহিত হয়েছিল। এরপরই জর্জের স্টেজে ওঠার কথা।
বব ডিলান শেষ মুহূর্তে চলে আসেন। জর্জকে বলেন, “আমি কিন্তু অনেকদিন শো করি না, সেটা তো তুমি জানো। আবার অ্যাকোস্টিক শো, কেমন নার্ভাস লাগছে।”
জর্জ বলল, “কোনো চিন্তা কর না, বব, আমি থাকবো তোমার সাথে।”
কিন্তু এরিক তখনও পৌঁছায়নি। ঠিক স্টেজে ওঠার আগে মদ্যপ অবস্থায় এরিক হাজির। জর্জ বিচলিত হয়ে পড়ে, “তুমি পারবে তো বাজাতে এরিক?”
এরিক বলে, “জাস্ট গিভ মি আ গিটার, এনি গিটার।”
সবার নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় এভাবেই হয় ঐতিহাসিক সেই কনসার্ট। প্রথম বেনিফিট কনসার্ট। কনসার্টের একদম শেষে জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের সেসময়ের অবস্থার কথা বর্ণনা করে “বাংলাদেশ” গানটি পরিবেশন করেন। গানটিতে তিনি সবাইকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর আহ্বান জানান। যুদ্ধকে প্রতিহত করতে গানের মহলের শক্তিশালী পদক্ষেপ যেন অস্ত্রের ভূমিকা রাখে!
My friend came to me
With sadness in his eyes
He told me that he wanted help
Before his country dies
Although I couldn’t feel the pain
I knew I had to try
Now I'm asking all of you
To help us save some lives
Bangladesh, Bangladesh
Where so many people are dying fast
And it sure looks like a mess
I've never seen such distress
Now won't you lend your hand and understand?
Relieve the people of Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
Such a great disaster, I don't understand
But it sure looks like a mess
I've never known such distress
Now please don’t turn away
I want to hear you say
Relieve the people of Bangladesh
Relieve Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
Now it may seem so far from where we all are
It's something we can’t neglect
It's something I can’t neglect
Now won’t you give some bread to get the starving fed?
We've got to relieve Bangladesh
Relieve the people of Bangladesh
We've got to relieve Bangladesh
Relieve the people of Bangladesh
মানবতার সেবায় রক মিউজিকের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারটা এই প্রথম না ঘটলেও, আমাদের দিয়েই কিন্তু এর শুরু। বিশ্বে কোনো এইড কনসার্ট বাংলাদেশের জন্যই প্রথম আয়োজন করা হয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় আর্থিকভাবে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে আগস্টের ১ তারিখে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয় “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ”। সেদিন সেই কনসার্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাম প্রথমবারের মতো বিশ্বের সামনে আসে।
কনসার্টের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বিটলস ব্যান্ডের জর্জ হ্যারিসন এবং পণ্ডিত রবি শংকর। বাংলাদেশের স্বীকৃতিস্বরূপ এই কনসার্টে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপ্টন, লিওন রাসেল, বিলি প্রেস্টন, রিংগো স্টারসহ আরও অনেকে। ওই কনসার্টটি ছিল সেসময়ের সবচেয়ে বড়ো স্টেজ শো।