পোস্টস

বিশ্ব সাহিত্য

দ্য মেমরি পুলিশ -ইয়োকো ওগাওয়া

৯ অক্টোবর ২০২৪

হাসিনুল ইসলাম

মূল লেখক ইয়োকো ওগাওয়া

অনুবাদক হাসিনুল ইসলাম

জাপানের বেশিরভাগ প্রধান সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া লেখিকা হচ্ছেন ইয়োকো ওগাওয়া (জন্ম ১৯৬২)। অন্যান্য অনেক পুরস্কারসহ তিনি আকুতাগাওয়া পুরস্কার ও ইয়োমিউরি পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া, আন্তর্জাতিকভাবে তিনি শার্লি জ্যাকসন এওয়ার্ড ও আমেরিকান বুক এওয়ার্ড পেয়েছেন। তাঁর উপন্যাসিকা দ্য মেমরি পুলিশ আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের হ্রস্ব তালিকায় স্থান পেয়েছিল। প্রথমে তিনি শখের বসে লেখালেখি শুরু করলেও পরবর্তীতে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সচিবের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি লেখালেখিতে মন দেন। তিনি তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে স্মৃতিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করেছেন। কিশোরী অবস্থায় তিনি অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়ে বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। দ্য মেমরি পুলিশ উপন্যাসিকাটি অনেকটাই সেই ডায়েরির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ। তবে, উপন্যাসিকাটি অনেক পাঠকের মনে ফ্রান্জ কাফকার ও জর্জ অরওয়েলের উপন্যাসের প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি অন্যান্য জাপানি লেখক যেমন মিয়েকো কানাই, কেনজাবুরো ওয়ে ও হারুকি মুরাকামির দ্বারা প্রভাবিত বলেও মনে করা হয়। তাঁর সাহিত্যকর্মের একাংশ এখনো ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি। দ্য মেমরি পুলিশ উপন্যাসিকাটি ২০১৯ সালে স্টিফেন স্নাইডারের হাতে ইংরেজিতে অনূদিত হয় ও প্যানথিয়ন বুকস ও হার্ভিল সেকার দ্বারা প্রকাশিত হয়। চিত্রনাট্যকার চার্লি কফম্যানের লেখনিতে উপন্যাসিকাটির চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে যেখানে লিলি গ্ল্যাডস্টোন অভিনয় করেছেন ও রিড মোরানো পরিচালকের ভূমিকায় ছিলেন। উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ ২৮টি অংশে বিভক্ত এবং এখানে ১, ১৫ ও ২৮ নম্বর অংশ থেকে উদ্ধৃতাংশ বাংলায় অনুবাদ করা হলো।

 

কাহিনি সারাংশ

গল্পটিতে আমরা ‘মেমোরি পুলিশের’ নিয়ন্ত্রণাধীন একটি দ্বীপে একজন ঔপন্যাসিকাকে পাই। একটি অজানা শক্তি দ্বীপের মানুষদের স্মৃতিকে সম্মিলিতভাবে ‘ভুলিয়ে দেয়’ এবং সেই সাথে বাস্তব বস্তু বা ধারণার প্রতি তাদের আসক্তিকে দূর করে দেয়। তাদের স্মৃতি থেকে সেই সব বস্তু অদৃশ্য হয়ে যায়। এর ফলে টুপি, সুগন্ধি, পাখি এবং ফিতা ইত্যাদির প্রতি তারা আদৌ আকর্ষণ বোধ করে না কারণ সেগুলো তাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। দ্বীপটির বাসিন্দাদের হারিয়ে যাওয়া বস্তুর সংখ্যা বাড়তে থাকলে সেখানকার মেমরি পুলিশ দ্বীপ থেকে অদৃশ্য বস্তুগুলো দ্রুত অপসারণের উদ্যোগ নেয়। যাদের স্মৃতি ঠিক থাকে ও যারা সবকিছু বা অনেক কিছু মনে রাখতে পারে, যেমন লেখিকার মা, তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়া এড়াতে দ্বীপ থেকে পালানোর চেষ্টা করে। কেউ সফল হয়, আবার অনেকেই ধরা পড়ে যায়। অথবা তারা নিরাপদ কোনো বাড়িতে লুকিয়ে সময় কাটানোর চেষ্টা করে। মেমরি পুলিশ কখনো কখনো সেইসব গুপ্ত স্থান থেকেও তাদের ধরে বের করে আনে।

‘আর’’ (R) নামধারী ব্যক্তি অর্থাৎ লেখিকার সম্পাদক নিজেকে এমন একজন বলে দাবি করেন যাঁরা এখনও অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বা হারিয়ে ফেলা বস্তুর কথা মনে করতে পারেন। তাঁরা সবসময় ভয়ে থাকেন যে তাদেরকে মেমরি পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। বৃদ্ধ এক পারিবারিক বন্ধুর সাহায্যে গল্পের নায়ক তাঁর বাড়ির একটি গোপন কক্ষে ‘আর’’-কে লুকিয়ে রাখে। লুকিয়ে থাকার সময় ‘আর’’, লেখিকা ও বৃদ্ধের কাছে বহুদিন আগে অদৃশ্য বা হারিয়ে হয়ে গেছে এমন কিছু জিনিসকে স্মরণ করাতে সাহায্য করে। কিন্তু হা হতোশ্যি! তাঁর সে চেষ্টা বিফল হয়। লেখিকা ও সেই বাড়ির বৃদ্ধ মানুষটি পূর্বের সেই সব জিনিসের কোনো কিছু স্মরণ করতে পারে না।

ক্যালেন্ডারগুলো যখন অদৃশ্য হতে শুরু করল তখন শীত চলতে থাকলেও বসন্ত আর আসে না। দ্বীপে খাবারের অভাব শুরু হলো। লেখিকার বাড়িতে যখন তারা বৃদ্ধের জন্মদিন উদযাপন করছিল, তখন মেমোরি পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। তাদের ভাগ্য ভালো যে পুলিশের চোখে গোপন কক্ষটি অনাবিষ্কৃত থেকে যায়। তখন তারা পুলিশের হাত থেকে মুক্তি পায়। পরবর্তীকালে, এক সময় উপন্যাসও অদৃশ্য হতে শুরু করে এবং কাহিনির নায়ক একজন টাইপিস্ট হিসাবে কাজ শুরু করে। ‘আর’’-এর পীড়াপীড়িতে লেখিকা তাঁর উপন্যাস লেখার কাজ চালিয়ে যান। নিজের সাথে কিছু বইও তিনি রাখেন। 

একদিন ভূমিকম্পের পর, তাঁর মায়ের কিছু ভাস্কর্য ভেঙে পড়লে আরো কিছু হারিয়ে যাওয়া বস্তুর দেখা মেলে। এক পারিবারিক বন্ধু তাকে ভাস্কর্যগুলো ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে পাওয়া গেল একটি ফেরি টিকিট এবং একটি হারমোনিকা। তখন তিনি তাঁর মায়ের কেবিনটি ভালোভাবে খুঁজে দেখার ইচ্ছে পোষণ করলেন। ‘আর’-এর বিশ্বাস সেখানে আরো অনেক হারিয়ে যাওয়া বস্তুর দেখা মিলতে পারে। লেখিকা ও বৃদ্ধটি তাঁর সাথে যোগ দেন। তাঁরা সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি করে বেশ কিছু বস্তুর খোঁজ পান। সেগুলোকে তাঁরা বাড়ির মধ্যে এক গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখেন।

একদিন মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণজনিত কারণে বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। শীঘ্রই, বস্তু ভুলানোর নতুন নিয়ম আসল। দ্বীপের বাসিন্দাদের তাদের শরীরের কিছু অংশ ভুলে যেতে বাধ্য করা হল। এরপরও যারা ভুলিয়ে দেওয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে স্মরণে রাখল, মেমোরি পুলিশ তাদেরকে কয়েদখানায় পুরল। লেখিকা, অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও, তাঁর প্রেমকাহিনিনির্ভর উপন্যাসটি লেখা শেষ করতে পারলেন কিন্তু প্রেমকাহিনিটি একসময় অন্ধকার গলিপথে এগোতে শুরু করল। লেখিকাসহ দ্বীপের বাসিন্দারা ধীরে ধীরে তাদের ভাগ্যকে মেনে নিতে শুরু করল কারণ তারা তো তাদের নিজেদের অস্তিত্বই ভুলে যেতে শুরু করেছে। নিজের অস্তিত্ব ভুলে গেলে ব্যক্তির কী হয়? ব্যক্তি বিলীন হয়ে যায়। যেন অদৃশ্য হয়ে পড়ে। অদৃশ্য হওয়ার আগে, লেখিকা ‘আর’-কে আশ্বস্ত করেন যে তিনি একদিন অন্যদের সাথে নিয়ে লুকানো অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন, তখন তারা সবাই মিলে তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারবেন।

 

দ্য মেমরি পুলিশ [উদ্ধৃতাংশের অনুবাদ]

০১

আমি মাঝে মাঝে আশ্চর্য হয়ে ভাবি যে সবার প্রথমে কোন জিনিসটি অদৃশ্য হয়েছিলÑ দ্বীপ থেকে যত কিছু হারিয়ে গেছে সে সব জিনিসের কথা বলছি।

‘অনেক আগে, তোর জন্মের আগের কথা বলছি, আরও অনেক জিনিস ছিল এখানে,’ আমার শৈশবাবস্থায় মা আমাকে গল্প শোনাতেন। ‘স্বচ্ছ জিনিস, সুগন্ধি জিনিস... ফটফট করে পাখা নাড়ানো জিনিস, উজ্জ্বল জিনিস... এমন বিস্ময়কর সব জিনিস যা কেউ এখন কল্পনাও করতে পারবে না। তুইও না।’

‘এটা লজ্জার বিষয় যে এখানে যারা বাস করে তারা সেই সব বিস্ময়কর জিনিসকে তাদের মস্তিষ্ক বা হৃদয়, কিছুতে সেগুলো ধারণ করতে সক্ষম হয়নি। দ্বীপটা কিন্তু যেমন, ঠিক তেমনই আছে। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো জিনিস এক এক করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। তোর সামনে আর এমন বেশি সময় নেই,’ তিনি যোগ করলেন। ‘যখন নিজেই দেখতে পাবি যে তোর নিজ জীবনেরই কিছু অদৃশ্য হয়ে গেছে।’

‘এটা কি ভয়ংকর, ভীতিকর ব্যাপার?’ হঠাৎ উদ্বিগ্ন হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম।

‘না, চিন্তা করিস না। এতে কোনো কষ্ট হয় না, এটা ব্যথা দেয় না। এমনকি বিষয়টি এমন যে তোর মনে তেমন দুঃখও অনুভূত হবে না। মনে কর, একদিন সকালে তুই জেগে উঠলি, দেখলি যে কিছু একটা আর নেই, সেটি হারিয়ে গেছে। তুই কিছু বুঝে উঠার আগেই বিষয়টি ঘটে যাবে। এমনটাই হয়ে থাকে। হয়ত ভোরে বিছানায় শুয়ে আছিস, চোখ বন্ধ, কান খাড়া, সকালের মৃদুমন্দ বাতাস উপভোগ করছিস, হঠাৎই বোধ করলি যে আগের রাতে যেমনটা ছিল, কিছু একটা আর তেমন নেই, আসলে কিছু একটা হারিয়ে গেছে। তখন বুঝবি যে কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছিস, দ্বীপ থেকে কিছু একটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু সেটি কী, তা কি আর স্মৃতিতে আনতে পারবি? না।’ 

......

১৫

বিরক্তিকর কিছু ঘটেছে। কী সেটি? একদিন সকালে হঠাৎ আমার টাইপরাইটার অকেজো হয়ে গেল। আমি যতই জোরেই কী-গুলো টিপি না কেন, কী-এর সাথে আটকানো বর্ণের লিভারটি আর কাগজে ঘাই দিচ্ছে না। কী-গুলো কেবল ঘুগরে পোকার মতো, কিন্তু মৃদুস্বরে সামান্য কম্পন সৃষ্টি কেেছ। বর্ণমালার শুরু থেকে শেষ, ০ থেকে ৯ পর্যন্ত, কোনো কী-ই আর কাজ করছে না। প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকে শুরু করে, কমা, ফুলস্টপ, কিছুই কাজ করল না। 

আগের রাতে আমি তাকে ‘শুভ রাত্রি’ টাইপ করে লিখেছিলাম। সেটাই ছিল শেষ টাইপিং। এরপর থেকে অচল। টাইপরাইটারটি আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না, অন্য কোনো ভাবেও না। অথচ, আমি এই সময়ের মধ্যে একে কখনো আছড়ে ফেলিনি, বা এর সাথে কোনো কিছুর ধাক্কাও লাগে নি। কিভাবে এমনটা হতে পারে? একটা অক্ষরও টাইপ করতে পারছিলাম না। অবশ্যই, ছোটখাটো মেরামত করার অভিজ্ঞতা আমার ছিল- কোনো বেঁকে যাওয়া কী সোজা করা বা রোলারে তেল দেওয়া ইত্যাদি ছোটখাটো কাজগুলো করতে পারতাম। সত্যি বলতে কি, টাইপরাইটারটি ছিল খুব শক্তিশালী, আমার জন্য খুব নির্ভরযোগ্য এক যন্ত্র।

তাই, আমি তখনও ভাবলাম যে আমি নিজেই এটি ঠিক করতে পারব। এটা ভেবে আমি টাইপরাইটারটিকে আমার কোলে তুলে নিলাম এবং যতটা শক্তি দেওয়া সম্ভব ততটা শক্তি দিয়ে প্রতিটি কী টিপতে শুরু করলাম। আমার সাথে আমার যে শুভাকাক্সক্ষী বসেছিলেন তিনি তখন যেন আমার পাশে হাঁটুগেঁড়ে বসলেন। আমি টিপতে শুরু করলাম A, S, D, F, G, H, J, K; যখনই আমি L এ পৌঁছলাম, আমার শুভাকাক্সক্ষী আমার ঘাড়ের দুই দিক দিয়ে আমাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি বললেন, ‘এভাবে বারবার বাড়ি মেরে তুমি তো এটা আরো নষ্ট করে ফেলবে।’ তিনি আমার কাছ থেকে টাইপরাইটারটি নিয়ে বললেন, ‘আমাকে দেখতে দাও।’ তিনি টাইপরাইটারের কভার খুলে আস্তে করে বিভিন্ন অংশ টেনে টেনে দেখতে শুরু করলেন। ‘এটা কি ভেঙে গেছে?’ আমি জিজ্ঞাসা করতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু কী-গুলোর মতো আমার কণ্ঠও অচল হয়ে থাকল। আমি কেবলমাত্র আমার আঙুলগুলো দিয়ে শূন্যে টোকা দিতে থাকলাম যেন আমি তখনও টাইপিংয়ের ছাত্র।

‘বড় সমস্যাই দেখছি,’ তিনি বললেন। ‘একে মেকানিকের কাছে নিয়ে বড় ধরনের মেরামত করার প্রয়োজন হতে পারে।’

আমার এখন কি করা উচিত? আমার চেহারাই তাঁকে একথা জানিয়ে দিল।

‘আমরা একে গির্জার পাশের টাওয়ারে নিয়ে যাবো। গির্জার লোকেরা আমাকে ঐ জায়গাটি মেরামতির দোকান হিসেবে ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছে। যেমন যন্ত্রপাতি আমাদের দরকার, সেখানে ঠিক তেমন সরঞ্জাম পাওয়া যাবে। আর আমরা যদি এটি ঠিক করতে নাও পারি, তাহলে আমরা তো তোমাকে স্কুল থেকে অন্য একটি টাইপটাইটার এনে দিতে পারব। চিন্তা করো না, ওখানে অতিরিক্ত অনেক টাইপরাইটার আছে।’

......

২৮

আমি পেন্সিল নামিয়ে টেবিলে মাথা ঠেকালাম, একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বিভিন্ন শব্দ খুঁজে পেতে যে শ্রম আমাকে দিতে হচ্ছিল, এরপর সেগুলোকে একত্রিত করে বাক্যে সাজাতে হচ্ছিল, তাও আবার আমার শরীরের অল্প কয়েকটি অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে, এর ফলে আমি বিধ্বস্ত বোধ করছিলাম। 

অক্ষরগুলো দেখতে বিশ্রী, ওগুলো আমার বাম হাত দিয়ে লেখা; রেখাগুলো দুর্বল, এলোমেলো এবং জায়গায় জায়গায় সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, যেন শব্দগুলো নিজেরাই ক্রন্দনরত। তারা অশ্রু হয়ে কাগজ গলিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি কাগজের পাতাগুলো জড়ো করে একটি ক্লিপ দিয়ে আটকে নিলাম। এটা যে সেই গল্প যেটি ‘আর’ (R) চেয়েছিলেন, এমন আস্থা আমি পাচ্ছিলাম না। তবে আমি যে অন্তত শেষ পর্যন্ত শব্দের শেকলের শেষে পৌঁছে গেছি, এটা বুঝতে পারলাম। আমি এমন একটি জিনিস সম্পন্ন করেছি, যা আমার শুভাকাক্সক্ষীর জন্য আমি রেখে যেতে পারছি।

......

......

যে হাতটি গল্পটা লিখেছিল, আমার যে দুই চোখ অশ্রুতে উপচে পড়ছিল, আর যে গাল তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করেছিল- তারা সবাই তাদের নিজ নিজ পালাক্রমে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং শেষ পর্যন্ত কেবল থাকল কণ্ঠ। দ্বীপের নাগরিকদের যা কিছু ছিল সেগুলো সব হারিয়ে গেছে, অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে, কেবল কণ্ঠটি দ্বীপব্যাপী লক্ষ্যহীনভাবে ভেসে বেড়াচ্ছিল। 

নিচে গোপন ঘরটিতে যাওয়ার জন্য আমাকে আর ‘আর’ এর বাহুতে লুটিয়ে থাকার প্রয়োজন ছিল না। ভারী গোপন দরজাটি কষ্ট করে তুলে পথ করারও আর দরকার ছিল না। কারণ আমি তো এখন এর সরু ফাটল দিয়েই পার হয়ে যেতে পারি, আমার যে সব প্রত্যঙ্গ হারিয়ে গেছে। সেই অর্থে আমার দেহের সম্পূর্ণ অন্তর্ধান আসলে আমাকে একরকম মুক্তি দিয়েছে। তারপরও আমি যদি সাবধান না হতাম, তাহলে আমার অবিশ্বস্ত ও কায়াহীন কণ্ঠটিও বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে চলে যেত। 

........

........

শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আমি চারদিকে তাকালাম। আমার শরীর এখন মেঝেতে সাজানো বস্তুর মধ্যে পড়ে আছে। আমি সেখানে মিউজিক বক্স এবং হারমোনিকা, এই দুয়ের মধ্যে শুয়ে; আমার দুই পা অদ্ভুতরকমভাবে কোনাকুনি হয়ে আছে; আমার হাত আমার বুকের ওপর আড়াআড়ি মোড়ানো; আমার দৃষ্টি নিচের দিকে। একই রকমভাবে সেও নিশ্চয় মিউজিক বক্সে নিজেকে জড়িয়েছে বা হারমোনিকার বাতাসে হারিয়ে গেছে। আমি কল্পনা করলাম যে ‘আর’ স্মৃতিকে হাজির করতে হয়ত আমার দেহকে আদর করছে।

‘আপনাকে কি সত্যিই চলে যেতে হবে?’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার হাতে ধরে রাখা বাতাসটাকে বুকের ভেতর পাঠিয়ে কথাটি বললেন।

‘বিদায়...’ আমার কণ্ঠনিঃসৃত শেষ আওয়াজগুলো ছিল প্রচণ্ড দুর্বল এবং হয়ত বা কর্কশও। ‘বিদায়।’

অনেকক্ষণ ধরে তিনি তার হাতের চেটোতে থাকা শূন্যতার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। শেষমেশ যখন তিনি নিজেকে বোঝাতে পারলেন যে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তখন তিনি ক্লান্ত হয়ে তাঁর হাতদুটো পড়ে যেতে দিলেন। তারপর সে একবারে এক ধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন, গোপন দরজাটি উপরের দিকে ঠেলে উঠালেন, এবং জগতের মাঝে হারিয়ে গেলেন। গোপন কুঠুরিতে এক লহমার জন্য সূর্যের আলো এসে পড়ল কিন্তু দরজাটি বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে তা আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি নিচ থেকে উপরের মেঝেতে কার্পেট গড়িয়ে দেওয়ার ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসতে শুনলাম।

গোপন ঘরটি বন্ধ হয়ে গেল, আমি অদৃশ্য হতে হতে, হারিয়ে যেতে থাকলাম।