পোস্টস

ভ্রমণ

তৃষিত তৃপ্তির সন্ধানে (পর্ব-১)

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মাসুদ হোসেন

মূল লেখক Shoranshi Raghuvanshi

অনুবাদক মাসুদ হোসেন

(১৯১৮-১৯২০৷ আসাম : লখিমপুর : জৈন্তিয়া পাহাড়) এ বছর আমাদের আপিসের মিস্টার মি- দূরবিনের কাজ করবার জন্য জৈন্তিয়া পাহাড়ে গিয়েছিলেন৷ সেখানে কতকটা জায়গা একেবারে দুর্গম আর মানুষখেকো বাঘেরও ভয়৷ তার অত্যাচারে কয়েকটা গ্রাম একেবারে উজাড় হয়ে গিয়েছিল, সেই অঞ্চলের জৈন্তিয়া কুলিরা সহজে জঙ্গলে কাজ করতে যেতে সম্মত হত না৷ মিস্টার মি-কে অনেক জোগাড়যন্ত্রকরে তাঁর খালাসিদের সঙ্গে কুলি পাঠাতে হত৷

দুবার তাঁর লোকদের সঙ্গে ওই বাঘের সাক্ষাৎ হয়েছিল৷

একবার তাঁর তিন-চারজন খালাসি একটা গ্রামে যাচ্ছিল, গ্রাম থেকে কুলি নিয়ে তারা পাহাড়ে যাবে৷ সূর্যাস্তের আগেই গ্রামে পৌঁছতে হবে, সেইজন্য তারা লম্বা-লম্বা পা ফেলে চলেছে৷ হতভাগা বাঘ কিন্তু তাদের পিছু ধরেছে৷ এক-আধবার ছায়ার মতো চোখে পড়ে আবার চোখের পলক না ফেলতে জঙ্গলের আড়াল হয়ে যায়৷ কখনো বা পিছনে দেখা দেয় আবার কখনো বা কুড়ি-ত্রিশ ফুট সামনে৷ লোকরা একেবারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল, কেমন ভয় পেয়েছিল সে তো বোঝাই যায়৷ তারা হাত ধরাধরি করে অতি সাবধানে চলেছে, এবার গ্রামে পৌঁছবে, তখন বাঘটা ক্রমাগত তাদের সামনে রাস্তার উপর দেখা দিতে লাগল৷

বেচারা খালাসিরা ভয়ে আর এগোয় না৷ শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে এক জায়গায় একটা শুকনো গাছ দেখতে পেয়ে সেখানে দাঁড়াল৷ তাদের সঙ্গে লম্বা দড়ি ছিল, চার-পাঁচটা গাছের চারদিকে ওই দড়ি দিয়ে চার-পাঁচবার ঘিরে নিল৷ ঠিক যেন ফাঁদ পেতেছে৷ তারপর ওই শুকনো গাছে আগুন জ্বেলে দিয়ে ঘেরা জায়গাটুকুর মধ্যে আশ্রয় নিল৷

কত চিৎকার করে কত ডাকাকাকি করল, কিন্তু গ্রামের লোকেরা কোনো সাড়াই দিল না, যদিও গ্রামের লোকের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল তারা৷ সমস্ত রাত তারা ওই জায়গাতে কাটাল৷ বাঘটা কতবার দেখা দিল, কিন্তু আগুনের ভয়েই হোক, কি দড়ি-ঘেরা জায়গাটাকে ফাঁদ মনে করেই হোক, তাদের ধরবার চেষ্টা করেনি৷

সকালে যখন তারা গ্রামে গিয়ে পৌঁছল, তখন গ্রামের লোকেরা বড়োই আশ্চর্য হয়ে গেল যে তাদের বাঘে খায়নি৷ পরে সাহেব গিয়ে গ্রামের প্রধানকে বিশেষ তিরস্কার করেছিলেন৷ তাদের ওই এক উত্তর: ‘আমরা ওদের চিৎকার শুনতে পাইনি৷’

আর একবার ওই সাহেবের কয়েকজন লোক একটা পাহাড়ে কাজ করতে গিয়েছিল, তাদের সঙ্গে ওই গ্রামের কয়েকজন কুলি ছিল৷

পাহাড়ের চুড়োর সমস্ত জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে, বড়ো-বড়ো গাছ সব চারদিকে এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে, চুড়োটুকু পরিষ্কার৷ খালাসিরা ওই চুড়োর উপর ক্যাম্প করবার বন্দোবস্ত করতে লাগল, কিন্তু সঙ্গের জৈন্তিয়া কুলিদের ওই খোলা জায়গাতে থাকা পছন্দ হল না, কিংবা নিরাপদ মনে করল না৷ তারা একটু নীচে নেমে জঙ্গলের আড়ালে লতাপাতার কুঁড়ে খাড়া করে নিল৷

জরিপের কাজ সকালে সাতটা, সাড়ে-সাতটা থেকে আরম্ভ হয়৷ লোকজন অন্ধকার থাকতে উঠে, হাত-মুখ ধুয়ে, রান্নার জোগাড় করে৷ এ পাহাড়ে বাঘের ভয়, সেইজন্য কেউই ভোরে ওঠেনি৷ চারদিক পরিষ্কার হলে, উঠে, হাত-মুখ ধুতে ব্যস্ত আছে৷ একজন জৈন্তিয়া কুলি তাদের কুঁড়ে ঘরের কাছেই ঝোপের আড়ালে পায়খানায় গেছে, আর তাকে বাঘে ধরে নিয়ে গেল, বাঘটা যেন সুযোগের অপেক্ষায় বসে ছিল৷ অন্য সব কুলিরা হাউমাউ করে চিৎকার জুড়ে দিল, আর পাহাড় ছেড়ে একেবারে গ্রামে চলে গেল৷

বেচারা খালাসিরা কজন পাহাড়ের চুড়োতেই থেকে গেল৷ বাঘ কিন্তু তাদের উপর হামলা করেনি৷ সে বোধহয় ওই কাটা গাছগুলোকে ডিঙিয়ে যাওয়া নিরাপদ মনে করেনি৷ কিংবা সেগুলো দেখে ফাঁদ মনে করেছিল৷ সেইজন্য তাদের কাছেও যায়নি৷

সাহেব খবর পেয়ে স্বয়ং ওই পাহাড়ে গিয়ে খালাসিদের উদ্ধার করে এনেছিলেন৷

.

হাবিলদার সিংবীর থাপা জৈন্তিয়া পাহাড়ের যেখানে মানুষখেকো বাঘ আছে সেখানে কাজ করতে গিয়েছিল৷ তার সঙ্গে বেশি করে লোকজন আর হাতিয়ার দেওয়া হয়েছিল৷ রান্না করবার জন্য নিজের একজন গুর্খা সঙ্গে গিয়েছিল৷ তার কাজের জায়গায় মানুষখেকো বাঘের ভয় আছে, তাকে বিশেষ সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল যেন খুব হুঁশিয়ার হয়ে কাজকর্ম করে, তাঁবু ফেলে৷

হাবিলদার ছিল পল্টনওয়ালা আর খুব বাহাদুর লোক, সেইজন্য বেছে-বেছে তাকেই ওই কাজে পাঠানো হয়েছিল৷

আড়াই-মাস তিন-মাস বেশ কেটে গেল, বাঘের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হল না৷ চারদিকের কাজ শেষ হয়ে গেছে, মাঝখানে একটু বাকি আছে, অল্প কয়েকদিনের কাজ৷ গ্রামে তাঁবু রেখে আর এ-কাজটুকু হতে পারে না, অনেক দূর পড়ে যায়, যাতায়াতেই প্রায় সারাটা দিন চলে যায়৷ সেখানে একটা পরিত্যক্ত গ্রাম ছিল, বাঘের অত্যাচারে লোকরা সব পালিয়ে গেছে৷ হাবিলদার মনে-মনে স্থির করল ডেরা তুলে ওই শূন্য গ্রামে নিয়ে যাবে, মাত্র কদিনের কাজ বাকি, সেটুকু ওই গ্রামে থেকেই শেষ করবে৷ গ্রামের ঘর-দোর সবই মজুত ছিল৷ যে গ্রামে এতদিন তাঁবু ছিল, সে গ্রামের লোকরা ওদের সঙ্গে গিয়ে ওই শূন্য গ্রামে কয়েকদিন বাস করতে রাজি হল না৷ অনেক তর্কাতর্কির পর শুধু ওই গ্রামে পৌঁছে দিয়ে আসতে রাজি হল৷

হাবিলদার কত বোঝাল যে তিনমাসের মধ্যে আমাদের সঙ্গে বাঘটার দেখা হয়নি, ওটা নিশ্চয়ই অন্য কোথাও চলে গেছে, আর তো মাত্র কদিনের কাজ বাকি, ইত্যাদি, কিন্তু কোনো ফল হল না৷ তারা বলল সেই গ্রামে পৌঁছে দিয়েই চলে আসবে৷

সমস্তদিন হেঁটে বিকেলবেলা তারা সেখানে পৌঁছল৷ গ্রাম থেকে মাইল দুই দূরে এক টুকরো খেত ছিল, সেখানে মেলা তরকারি হয়েছে— কুমড়ো, শিম, কচু ইত্যাদি৷ খালাসিরা বলল, ‘এখানে একটু সবুর করো, আমরা তরকারি নেব৷ তিন মাস খালি ডাল ভাত আর নুন ভাত খাচ্ছি৷’

কুলিরা বিশেষ আপত্তি জানাল, তারা কিছুতেই দাঁড়াবে না, সন্ধ্যা হয়ে যাবে৷ হাবিলদার তখন খালাসিদের বলল, ‘আজ চলো, কাল সকালে আমি কাজে যাব না৷ তোমরা তখন এসে তরকারি নিয়ে যেয়ো৷’

তারা রাজি হয়ে চলতে লাগল আর সন্ধ্যার আগেই গ্রামে পৌঁছে গেল৷

পরদিন ভোরে উঠে কুলিরা চলে গেল, তিনজন খালাসি তাদের সঙ্গে ডাক আনতে গেল, চারজন খালাসি গেল তরকারি আনতে৷ এরা তরকারি নিয়ে ফিরলে তবে রান্না করে খাবে, নুন ভাত আর তারা খাবে না৷

হাবিলদার তাঁবুতে বসে নিজের কাজে ব্যস্ত৷ ক্রমে বেলা হল, যে সব লোকরা তাঁবুতে ছিল তারা উদবিগ্ন হয়ে উঠল, ওরা এখনও আসে না কেন? দু-মাইল তো রাস্তা, দু-ঘণ্টা আড়াই-ঘণ্টার মধ্যে ফিরবার কথা৷

বারোটা বেজে গেল, ক্রমে বিকেল হল, কিন্তু ওই চারজন লোকের দেখা নেই৷ চিৎকার করে কত ডাকাডাকি করা হল, কোনো উত্তর নেই৷ একবার ভাবল ওরা বোধহয় ওই খেতেই রান্না করে খেতে বসেছে, কিন্তু তাও তো সম্ভবপর নয়, কেননা সঙ্গে চাল নেই, বাসন-কোসন নেই, রাঁধবে কীসে?

বড়োই আতঙ্ক উপস্থিত হল৷ তারা বড়ো-বড়ো ধুনি জ্বেলে সমস্ত রাত জেগে কাটাল৷ সকালে উঠেই হাবিলদার রাইফেল ঘাড়ে চলল তার লোকজনের খোঁজে, তার সঙ্গে চলল তার রোটিওয়ালা অর্থাৎ তার রাঁধুনি৷ তখন একজন খালাসি তাঁবুতে ছিল, সেও সঙ্গে চলল, একলাটি তাঁবুতে থাকবে না৷ আগে-আগে বন্দুক ঘাড়ে হাবিলদার, মাঝখানে রাঁধুনী, পিছনে খালাসিটি৷ প্রায় দেড় মাইল পাহাড় চড়ে, এক জায়গায় দেখতে পেল পথের উপর একটা কাটা গাছের ডাল পড়ে রয়েছে, তার পাতা শুকোতে আরম্ভ করেছে, পাশে গাছের গায়ে দা দিয়ে ছাল ছাড়ানো৷ বুঝল আগের দিন কুলিরা রাস্তা ছেড়ে এইখানে বনে ঢুকেছিল৷ রাস্তার উপর ডাল কেটে ফেলে রখেছে পিছনের লোককে সাবধান করার জন্য যেন ওই পথে কেউ না যায়৷

দু-চার পা জঙ্গলে গিয়ে দেখল জায়গায়-জায়গায় গাছের গায়ে দা দিয়ে দাগ দেওয়া আছে, ওইখান দিয়ে তারা গেছে৷ কিন্তু কেন? হাবিলদার দাঁড়িয়ে একটু ভাবল, তারপর বন্দুক ভরে নিয়ে রাস্তা ধরে চলতে লাগল৷ যারা তরকারি আনতে গিয়েছিল, রাস্তায় তাদের পায়ের দাগ দেখল৷ আরও সিকি মাইল আন্দাজ গিয়ে দেখল রাস্তার পাশেই খানিকটা জায়গার মাটিতে নখের আঁচড়ের দাগ, আর কী যেন পড়ে আছে৷ এক পা এগিয়ে দেখল— রক্তের দাগ৷

চকিতে একবার চারদিকে দেখে নিয়ে তারা আবার চলতে লাগল৷ হঠাৎ পিছনে ক্যাঁক করে একটা আওয়াজ হল, মুখ ফিরিয়ে দেখল পিছনের খালাসিটি আর নেই আর পাশেই ঘাসবন নড়ছে৷ বুঝতে বাকি রইল না তাকে বাঘে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ কাছেই পাহাড়ের ঢালুর কিনারায় গাছ ছিল, দুজনে প্রাণপণে সেদিকে ছুটল৷ হাবিলদার ছুটে গিয়ে লাফিয়ে একটা ডাল ধরে অতিকষ্টে কয়েক ফুট চড়ে গেল, তার ঘাড়ে বন্দুক, পায়ে বুট জুতো৷

তার চাকরটা সবেমাত্র গাছের গোড়াতে পৌঁছেছে আর ঝড়ের মতো বাঘটা এসে তার ঘাড়ে পড়ল৷ তার চিৎকার শুনে হাবিলদার নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল কী ব্যাপার, আর তাড়াতাড়ি রাইফেলটা ঘুরিয়ে এক হাতেই গুলি ছুড়ল৷ বন্দুকের আওয়াজ শুনেই বাঘটা রোটিওয়ালাকে ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল৷ হাবিলদার ততক্ষণে আরো দু-পা উঠে ডালের উপর ভালো করে বসে বন্দুকে আবার কার্তুজ ভরে নিল৷ বাঘ আর চোখে পড়ছে না, সে গা ঢাকা দিয়েছে৷ রোটিওয়ালা পড়ে আছে, ঢালুর উপর দিকে তার পা, নীচের দিকে মাথা৷

হাবিলদারের গাছ থেকে নীচে নামবার সাহস হচ্ছে না, যদি নামবার সময় বাঘ লাফিয়ে এসে ঘাড়ে পড়ে৷ গাছের উপর বসে সে বাঘের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল৷

রোটিওয়ালা কিন্তু তখনও জীবিত৷ সে কোঁকাতে-কোঁকাতে বলতে লাগল হাবিলদার যেন তাকে ফেলে না যায়, সে তার আপনার লোক৷

হাবিলদার বলল যে সে কখনো তাকে ফেলে যাবে না৷ কেন যে নামতে পারছে না তাও বলল, গাছের উপর তবু কিছু দূর দেখা যায় বাঘ আসছে কিনা, মাটিতে নামলে কিছুই দেখতে পাবে না, হয়তো নামবার সময়ই বাঘ এসে ধরে ফেলবে৷ হাবিলদার আরও বলল পট্টি আর পাগড়ি জড়িয়ে দড়ি তৈরি করে উপর থেকে রুটিওয়ালার কাছে নামিয়ে দেবে! সে যেন সেটাকে বুকে পিঠে জড়িয়ে বাঁধে, তাহলে হাবিলদার দড়ির অন্যদিক ধরে টেনে তাকে গাছে তুলে নেবে৷ তারপর ভগবান যেমন ব্যবস্থা করেন৷

এর মধ্যে দু-একবার একপাশের জঙ্গল একটু নড়েছে আর হাবিলদার সেইদিক লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে৷ তার মনে হচ্ছিল বাঘটা আবার রোটিওয়ালার কাছে আসছিল কিন্তু বন্দুকের আওয়াজ শুনে পালিয়ে গেল৷

রোটিওয়ালা বেচারা কত চেষ্টা করল কিন্তু কিছুতেই দড়িটা বুকে জড়িয়ে নিতে পারল না৷ তার ঘাড়ে বিষম চোট লেগেছিল, অতি কষ্টে কোঁকাতে-কোঁকাতে কথা বলছিল৷ যখন কিছুতেই দড়িটা জড়াতে পারল না তখন সব চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে কোঁকাতে লাগল৷ সমস্ত দিন ওই অবস্থায় পড়ে রইল, সন্ধ্যার সময় কোঁকানো বন্ধ হল৷

এর মধ্যে আরও দু-চারবার ঝোপ নড়া দেখে বন্দুক চালাতে হয়েছে, পাছে বাঘটা বেচারার দেহটা নিয়ে যায়৷ রাতটাও ঠিক ওইভাবে কাটাতে হল৷ একবার পলকের জন্য হাবিলদার বাঘটাকে দেখতে পেয়েছিল, গুলিও করেছিল৷ কিন্তু অন্ধকারে গুলি লাগল কিনা বোঝা গেল না৷ সকালে দেখা গেল রোটিওয়ালার দেহটা সেখানেই পড়ে আছে৷

এখন কী কর্তব্য হাবিলদার তাই চিন্তা করতে লাগল৷ চবিবশ ঘণ্টা চলে গেছে, এক ফোঁটা জলও পেটে পড়েনি, তার উপর এই ভীষণ কাণ্ড! অবস্থা তো বোঝাই যাচ্ছে৷ এমন করে কতক্ষণ চলবে? সেই মরতেই হবে, কিন্তু এখনও শরীরে শক্তি আছে, চেষ্টা করলে হয়তো বা এই ভীষণ জায়গা থেকে বের হয়ে যেতেও পারা যায়৷

এই রকম মনে-মনে আলোচনা করে, তিন-চারবার উপরি-উপরি বন্দুকের আওয়াজ করল৷ এইবার গাছ থেকে নামবে৷ তখন তার মনে হল কেউ যেন চিৎকার করে ডাকছে৷ হাবিলদারও চেঁচিয়ে জিগগেস করল, ‘কে তুমি?’

একজন খালাসি তার নাম বলল৷ সেই প্রথম দিন যে ক-জন তরকারি আনতে গিয়েছিল, তাদের একজন৷

‘কোথায় তুমি?’

‘গাছে৷ বাঘ মরেছে?’

‘না, গুলি করেছি, কিন্তু পালিয়ে গেছে৷ তুমি গাছ থেকে নেমে আমার দিকে এসো, আমিও গুলি করতে-করতে এগোচ্ছি, বাঘ ভয়ে আসবে না৷’

হাবিলদার গাছ থেকে নেমে ওইদিকে চলল৷ চার-পাঁচ কদম যায় আর বন্দুকের আওয়াজ করে৷ খালাসিও এসে হাজির হল৷ তখন দু-জনে সেই উজাড় গ্রামের দিকে দৌড়ল৷ খালাসিকে সামনে রেখে, হাবিলদার পিছন-পিছন ভরা বন্দুক হাতে নিয়ে৷ গ্রামে এসে খালাসি বলল সে জল খাবে, আটচল্লিশ ঘণ্টা জল খায়নি৷ হাবিলদার সামান্য জল দিয়ে বলল, ‘বেশি খেলে অসুখ করবে৷ চলতে পারবে না৷’

তারপর কিছু চাল সঙ্গে নিয়ে তারা সেই সর্বনেশে জায়গা ছেড়ে গেল৷ নীচে নালায় গিয়ে ওই চাল দু-মুঠো ভিজিয়ে চিবিয়ে খেল, তবে জল খেল৷

তারপর, বারো-তেরো মাইল দূরে অন্য পাহাড়ে গ্রাম ও খেত দেখা যাচ্ছিল, সেইদিকে চলল৷ সমস্ত জিনিসপত্র ফেলে এসেছে, শুধু বন্দুকটি, দুখানা কম্বল আর দু-মুঠো চাল সঙ্গে এনেছে৷ সন্ধ্যার পর সেই খেতে গিয়ে পৌঁছল৷ পা আর চলে না৷ খেত পাহারা দেবার জন্য আট-দশ ফুট উঁচু মাচার উপর ছোটো একটি কুঁড়েঘর ছিল৷ কিছু ভিজে চাল আর জল খেয়ে, ওই মাচার উপরে উঠে তারা শুয়ে রইল৷ ভয়ে, আতঙ্কে, ঘুমোতে পারল না৷ সঙ্গে দেশলাই ছিল, ওই ঘরে কাঠ ছিল, আগুন জ্বেলে সারা রাত জেগে কাটাল৷

পরদিন সকালে যখন গ্রামে পৌঁছল, তখন তাদের আধ-মরা অবস্থা৷ দেখতে-দেখতে এই সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল৷ আমাদের আপিসের সাহেবরা হাতি নিয়ে বাঘ মারতে গেলেন, কিন্তু বাঘের কোনো সন্ধানই পেলেন না৷

আগেই বলেছি হাবিলদার বাহাদুর লোক৷ আবার সে ওই জায়গায় ফিরে গিয়ে তার আত্মীয়ের সৎকার করেছিল, আর বাকি কাজটুকুও শেষ করেছিল৷

খালাসিটার কাছে আগের দিনের সব ঘটনা শোনা গেল৷ ওরা চারজন অন্য কুলিদের ছেড়ে একজনের পিছনে একজন লাইন বেঁধে রাস্তা ধরে তরকারি আনতে যাচ্ছিল৷ যেখানে হাবিলদার প্রথম রক্ত দেখেছিল, সকলের পিছনের লোকটিকে ওইখানে বাঘে ধরে৷ বাকি তিনজন ওই রাস্তায়-রাস্তায় ছুটতে আরম্ভ করে আর বাঘটাও পিছনে-পিছনে তাড়া করে, একজনের পর একজন করে আরও দুজনকে মেরে ফেলে৷ ততক্ষণে সকলের আগের লোকটি ছুটে গিয়ে একটা গাছে উঠে প্রাণ বাঁচায়৷

এর পরের বছর আমি কলকাতায় বদলি হয়ে গেলাম আর জঙ্গলের কাজের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ সম্পর্ক ঘুচে গেল৷ সুতরাং আমার বক্তব্যও এখানে শেষ হয়ে গেল৷

সমাপ্ত