Posts

গল্প

আমি স্বপ্নের ফেরিয়ালা

January 5, 2025

Aditya Shankar

Original Author গ্যাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

Translated by আদিত্য শংকর

28
View

একদিন সকাল নয়টার দিকে হাভানা রিভিরিয়া হোটেলে নাস্তা করার সময় সাগরের বিশাল ঢেউ মেরিন রোডে চলা গাড়ী অথবা পার্ক করা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় আঁছড়ে পড়ে। সেই ঢেউয়ের ধাক্কায় একটা গাড়ী হোটেলের দেওয়ালে গেঁথে যায়। এই গেঁথে যাওয়া শব্দটা ছিলো অনেকটা ডিনামাইটের বিস্ফোরনের মত। সেই শব্দ শুনে হোটেলের সমস্ত টুরিস্ট ভয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে।

ঘটনা ঘটার প্রায় ছয় ঘন্টার মধ্যে কিছু কিউবান স্বেচ্ছাসেবীর দল দমকল কর্মীদের সাহায্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নিলো। সকালে কেউ দেয়ালে গেঁথে থাকা গাড়ীর কথা ভাবেনি। সবাই মনে করেছিলো গাড়ীটা পার্ক করা গাড়ীগুলোর মধ্যে একটি । কিন্তু যখন ক্রেনটা গাড়ীটাকে ওঠালো, তখন স্টিয়ারিং-এর পেছনে থাকা একজন মহিলার লাশ পাওয়া গেলো। ঢেউয়ের ধাক্কা এমনই ছিলো যে মহিলার পায়ের কোনো অংশ বলতে অবশিষ্ট ছিলো না। তার মুখটাও যে চিনবো সেই উপায়ও নেই। তার আঙ্গুলে একটি স্বর্ণের আংটি ছিলো। যেটা কিনা সাপের মত ছিলো আর চোখটাও পান্নার ছিলো। পুলিশ বলেছিলো যে মহিলাটা পুর্তগালের নতুন রাষ্ট্রদূতের গৃহপরিচারিকা ছিলো। খবরটি পড়ার সময় তার পরিচয় নিয়ে আমার তেমন মাথা ব্যাথা ছিলো না। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়টা হচ্ছে সেই পান্না খঁচিত চোখের সাপের আংটিটা। কিন্তু কোন আঙ্গুলে তিনি পড়ে আছেন সেটা খবরে লেখা ছিলো না।

এই ছোট তথ্যখানা আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারণ, আমি এমন আরেকজন মহিলাকে চিনতাম যিনি কিনা একই রকমের আংটি তার ডান হাতের তর্জনীতে পড়ে থাকতেন। চৌত্রিশ বছর আগে ভিয়েনার ল্যাটিন আমেরিকার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় এক পানশালায় তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। তিনি সেখানে আলু সেদ্ধ আর সসেজ খাচ্ছিলেন। আমাকে সকাল বেলায় টাকার প্রয়োজনে রোম থেকে এখানে আসতে হয়েছিলো। তাকে প্রথমে দেখে মনে হয়েছিলো তিনি এই পানশালার একমাত্র অস্ট্রিয়ান। কিন্তু আমার ধারণা ভুলছিলো। তার জন্ম হয়েছিলো কলম্বিয়াতে আর দুই  বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি খুব ছোট থাকতে পরিবারের সাথে গান শিখতে অস্ট্রিয়ায় চলে আসেন।

তিনি তার সঠিক নাম কাউকে বলতেন না। তাই পানশালার শিক্ষার্থীরা তাকে ফ্রাউ ফ্রিদা বলে ডাকতো। আমার সাথে যখন তার দেখা হলো আমি তাকে অভদ্রের মত প্রশ্ন করলাম, এতো দূর থেকে এসে তিনি কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন?

আর তিনি জবাব দিলেন “আমি স্বপ্নের ফেরিয়ালা।”

বাস্তবে এটাই ছিলো তার কাজ। তিনি কালদাস শহরের ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের এগারো সন্তানদের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তিনি যখন থেকে কথা বলা শিখলেন তখন থেকেই তিনি পরিবারের কাছে স্বপ্ন বর্ণনা করতেন। সাত বছর বয়সে তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে তার এক ভাই বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। মেয়ের এই কথা তার মা ছেলেদেরকে পানিতে নামার জন্য নিষিদ্ধ করলো। কিন্তু  ফ্রাউ ফ্রিদা ততোদিনে স্বপ্ন বলার পদ্ধতি শিখে গেছেন। 

তিনি বললেন, “এই স্বপ্নের অর্থ এমন তো নয় যে পানিতেই ডুবে মরবে। হতে পারে, মিষ্টি জাতীয় কোনো কিছু খেয়েও মরবে।“

ফ্রাউ ফ্রিদার এই কথাটা শুনে তার মা পাঁচ বছরের ছেলেকে ক্যান্ডি খেতে নিষেধ করে দেন। কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। মায়ের অন্যমনষ্কতার সু্যোগে ছেলেটা একটা ক্যান্ডি খায়। সেটা গলায় আটকে গেলে সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়।

ভিয়েনার প্রবল শীতে আর্থিক কষ্টে পড়ার আগে ফ্রাউ ফ্রিদা কোনো দিনও ভাবেন নি যে, তিনি তার এই প্রতিভা দিয়ে রোজগার করবেন। তিনি কাজের সন্ধানে নানা জায়গায় ঘুরতে লাগলেন। শেষে তিনি একবাসায় বাড়িতে কাজ পেলেন। যেখানে, স্বপ্ন বলাটাই তার কাজ হলো। সেই বাসার গৃহকর্তা থেকে শুরু করে ছেলে-মেয়ে সবাই তার কথায় ওঠা বসা করতো। বেতন ছিলো তার নিজের চলার মত আর তিন বেলা খাবার পেতেন। তিনি অনেক বছর ধরেই ওখানে কাজ করলেন। এমন কি সেই পরিবারকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করাল গ্রাস থেকে রক্ষাও করলেন। 

আমি যখন ভিয়েনায় ছিলাম তখন সেই বাড়ীর কর্তা মারা যান। মারা যাবার আগে তিনি ফ্রাউ ফ্রিদাকে একটা শর্ত দিয়ে তার সমস্ত সম্পত্তি লিখে রেখে যান। সেই শর্তটা হচ্ছে তিনি তার পরিবারের সদস্যের জন্য আজীবন স্বপ্ন  দেখে যেতে হবে।

তখন ভিয়েনায় অন্যান্যদের মত আমারও ছাত্রজীবনে প্রায় এক মাসের উপর নানারকম সমস্যা চলছিল। যে টাকার আশায় আমি ছিলাম সেই টাকাটাও ঠিক সময়ে আসছে না। সেই সময়ে পানশালায় ফ্রাউ ফ্রিদার আগমনে এবং উদার মনোভাবে একটা উৎসবের আমেজ তৈরি হতো। একরাতে ফ্রাউ ফ্রিদা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমাকে ফিসফিসিয়ে জরুরী নির্দেশ দিলেন,

“আমি এখানে তোমার জন্যই এসেছি। গত রাতে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। তুমি এখনই ভিয়েনা ছেড়ে চলে যাও আর আগামী পাঁচ বছর তুমি এখানে আসবে না।“

তার আত্মবিশ্বাস এতোই প্রবল ছিলো যে সেটা বিশ্বাস না করে পারা যায় না। তাই আমি ঐ রাতের শেষ ট্রেনে করে রোমে চলে গেলাম। সত্যিই তিনি আমাকে এমন সব দূর্ঘটনা থেকে বাঁচালেন যে যা আমি কোন দিনও ভাবতে পারি নি। এরপর আমি আর ভিয়েনায় যায় নি।

হাভানার ঘটনা ঘটার আগে ফ্রাউ ফ্রিদার সাথে বার্সেলোনায় একবার দেখা হয়েছিলো। ওই সময় পাবলো নেরুদা গৃহ যুদ্ধের পর স্পেনে প্রথম আসলেন। তিনি নানা জায়গা ঘুরে দেখলেন, বই কিনলেন। 

আমার কাছে সব থেকে অবাক লেগেছিলো যে, রেনেসাঁ সময়কালের পোপদের সম্পর্কে তার এতো ধারনা ছিলো যে অন্য কারো হয়তো এমনটা ছিলো না। সেই দিন এক রেষ্টুরেন্টে তিনি আর তার স্ত্রী মাটিল্ডা সহ খেতে খেতে কথা বলছিলাম। একসময়ে তিনি খাওয়া বন্ধ করে নিচু স্বরে বললেন,

“পিছন থেকে কেউ আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে।“

আমি তাঁর কাঁধের উপর পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ঘটনাটা সত্য। তিন টেবিল দূরে এক বয়স্ক মহিলা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। মহিলাটার তর্জনীতে থাকা সাপের আংটি দেখে চিনলাম যে, ইনি ফ্রাউ ফ্রিদা ছাড়া আর কেউ হতে পারবেন না।

তিনি নেরুদাদের সাথে একই জাহাজে নেপলস থেকে এসেছেন। কিন্তু তাদের সাথে তার দেখা হয় নি। আমরা তাকে কফি খেতে ডাকলাম আর কবিকে অবাক করার জন্য আমি তাকে তার স্বপ্ন দেখা নিয়ে বলতে বললাম। কিন্তু নেরুদা তেমন কোনো আগ্রহ দেখান নি কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে স্বপ্নের কোনো ক্ষমতা নেই।

তিনি বললেন,”এগুলা সবই ভূয়া কেবল কবিতারই ভবিষ্যত বলার শক্তি আছে।“

দুপুরের খাবার পর বাধ্যতামূলক হাঁটার সময় ফ্রাউ ফ্রিদার সাথে কথা বলার জন্য পিছিয়ে গেলাম। আমরা দুইজন স্মৃতিচারণ করতে লাগলাম। তিনি আমাকে বললেন যে, তার ভিয়েনার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে পুর্তগালের ওপোর্টোতে চলে এসেছেন। তার কথা শুনে স্পষ্ট হলো যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে তিনি ভিয়েনার সেই সম্পদের মালিক হয়েছেন। আমার কাছে মনে হলো স্বপ্ন দেখাটাই তার রোজগারের কৌশল এবং আমি তাকে তাই বললাম।

তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আমাকে বললেন, “তুমি সেই আগের মত ঠোঁট কাটা রয়ে গেলে।“ আমি আর কথা বাড়ালাম না, কারণ সবাই হাঁটা থামিয়ে অপেক্ষা করছে নেরুদার জন্য। তিনি রাম্বালা দে লস পাহারোসের তোতা পাখিদের সাথে চিলের অশ্লালীন ভাষায় কথা বলছে। ফ্রাউ ফ্রিদা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আমার সাথে কথা বলতে লাগলেন।

“ওহ হ্যাঁ, তুমি এখন ভিয়েনায় যেতে পারো।“

তখনই আমার মনে পড়লো যে, আমাদের প্রথম সাক্ষাতের প্রায় তেরো বছর কেটে গেছে।

উত্তরে আমি বললাম, “যদিও আপনার স্বপ্নগুলো মিথ্যা, তবুও আমি সেখানে ফিরব না।“

বেলা তিনটার দিকে ফ্রাউ ফ্রিদার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এটা নেরুদার পবিত্র ঘুমের সময়। তিনি আমার বাসায় ঘুমালেন। দিবা নিদ্রার পর লিভিং রুমে তিনি ফ্রেশ হয়ে আসলেন।

“আমি স্বপ্নে সেই স্বপ্ন দেখা মহিলাটাকে দেখলাম।“ তিনি বললেন।

মাটিল্ডা তাঁর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলেন।

“আমি দেখলাম, সে আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে।“

আমি বললাম, “ এ তো বোর্হেসের গল্পের মত শুনাচ্ছে।“

তিনি খানিকটা মনোক্ষুণ হয়ে আমার দিকে তাকালেন।

তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, “সে কি ওটা লিখে ফেলেছে?”  

আমি বললাম, “যদি তিনি এখনও না লিখে থাকেন তাহলে কোন এক সময়ে তিনি লিখবেন আর সেটা হবে তার আরেকটি গোলকধাঁধাঁ”

সন্ধ্যা ছয়টার দিকে জাহাজে ওঠার পর নেরুদা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফল্গুধারার মত কবিতা লিখতে শুরু করলেন। আমরা ফ্রাউ ফ্রিদাকে খুঁজতে লাগলাম। প্রথমে তাকে পেলাম না। পরে জাহাজ থেকে নামার সময় ট্যুরিস্ট ডেকে তাকে পেলাম। তিনিও দুপুরের ঘুম থেকে সবে মাত্র উঠলেন।

তিনি বললেন, “আমি ওই কবিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি।“

অবাক হয়ে আমি তাকে স্বপ্নটার কথা জানতে চাইলাম।

“আমি দেখলাম যে তিনি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন।“ তিনি বললেন। আমার চোখে মুখে বিস্ময়ের আভাস দেখে ঘাবড়ে গিয়ে তিনি বললেন, “ কি হলো? মাঝে মাঝে আমি এমন স্বপ্ন দেখি যার সাথে বাস্তবের কোনো মিল নাই।“

হাভানা রিভেরার ঘটনার আগে ফ্রাউ ফ্রিদাকে নিয়ে কখনও ভাবি নি। কয়েক মাস পর এক কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে পুর্তগীজ রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা হবার সময় তাকে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। মহিলা তার ব্যাপারে ভালোই বললেন। তাকে নিয়ে একটা গল্প লেখার কথাও তিনি বললেন। কিন্তু একটা কথা না শুনে আমি শেষ করতে পারলাম না।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “উনি কি করেন?”

“স্বপ্ন দেখা ছাড়া তিনি আর কিছুই করতেন না।“

Comments

    Please login to post comment. Login